বনানী বাবলি : আমরা পঞ্চাশ বছরের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি। মার্চ ২০২১ এলো আবার চলেও গেলো। আমরা প্রাণোচ্ছল উদ্দীপনায় দেশের গান শুনলাম, দেশের চারিদিকে আলোক সজ্জায় চোখ ধেঁধে গেলো আমাদের। আমরা ফেসবুকে ছবি পোস্ট দিলাম, প্রচুর আনন্দ করলাম।
আবার আমরা জেগে উঠবো ডিসেম্বরের বিজয় দিবসে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে জেগে উঠছি কি? গত পঞ্চাশ বছরে কী পেয়েছি? বা কী দিয়েছি দেশ কে? দেশকে আমরা ডিজিটাল বানিয়েছি, পদ্মা সেতু করেছি, এক কথায় বলতে পারি আমরা কাঠামোগত উন্নয়ন করেছি দেশের। কিন্তু মানুষের মূল্যবোধ? সেটার কি উন্নতি করতে পেরেছি? এই যে এখন প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষের যুদ্ধ ধর্ম ব্যবসায়ীদের সাথে বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের। যখন সিলেটের শাল্লায় আগুন দিলো নিরপরাধ মানুষদের ঘরে এবং হেফাজত এখানেই থেমে নেই। তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে, এখানকার ভূমি অফিস, গণগ্রন্থাগার, কালী বাড়ি, আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতভবনে আগুন, পুলিশ ক্যাম্পে, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে হামলা করেছে। হেফাজত রাস্তায় এবং প্রতিবাদের ঝড় তুলছে। তখন মিডিয়া এটা নিয়ে কয়দিন কথা বলবে, আলোচনার তুফান ছুটবে। টক শোতে কয়দিন গরম গরম বক্তব্য হবে। তারপর দিন চলে গেলো, দিন চলে যাবে। আমরাও ভুলে গেলাম। কারণ আগুন তো আর আমার বা আমাদের ঘরে লাগেনি, লেগেছে সংখ্যালঘুদের। জাতীয় সম্পদের ক্ষতি হয়েছে তো আমার কী? লুটপাট হয়েছে তো আমার কী? আমরা সাধারণ বাঙালিরা চোখ খুলে ঘুমিয়ে থাকতে ভালোবাসি।
সুধী পাঠক, এই বার চলুন যাই রাষ্ট্রের তুলনামূলক ব্যাখ্যায়। উন্নত বিশ্বে কী হয় এই ক্ষেত্রে? প্রথমত, উন্নত বিশ্বে যে কোনো ধর্মের মানুষের উপর আঘাত যদি আসে তবে প্রথম অপরাধীকে খুঁজে নেয়। দ্বিতীয়ত, অপরাধী এই অন্যায় কাজটি কেন করলো তার মূল উৎস কী তা জানার চেষ্টা করা হয়, তাকে সংশোধনের জন্য ব্যবস্থা করা হয়। তৃতীয়ত, অপরাধীর সাথে কোনো সংগঠন যদি জড়িত থাকে তবে সেই সংগঠনকেও আইনের আওতায় এনে বিচার করা হয়। চতুর্থত, তারপর দেশের রাষ্ট্র প্রধান, সিটির মেয়র নির্যাতিত মানুষটির পাশে এসে সহমর্মিতা প্রকাশ করে গণমাধ্যমে। তারা এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সতর্ক করে দেয় যাতে ভবিষ্যতে আর কখনো এই ধরণের ঘটনা সংগঠিত না হয়। পঞ্চমত, নির্যাতিত ব্যাক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেয় শুধু সরকার নয়, সমাজের নানারকম কল্যানমুলক প্রতিষ্ঠানগুলি এগিয়ে আসে।
বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে উন্নয়নের দিক থেকে কিন্তু মানুষের মধ্যে মানবিক গুণাবলীগুলির পতন ঘটেছে অবিশ্বাস্যভাবে। এটা কি একদিনে হয়েছে? না একদিনে হয়নি। গত পঞ্চাশ বছর যাবৎ অপসংস্কৃতির চর্চা হয়েছে, গত পঞ্চাশ বছর যাবৎ দুর্নীতির চর্চা হয়েছে, গত পঞ্চাশ বছর যাবৎ অপরাধের বিচার হয় নাই (মুষ্টিমেয় কিছু উদাহরণ ছাড়া)। মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয় ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করছে দশকের পর দশক।
সংবাদপত্রগুলিতে অপরাধের খবরে পূর্ণ। আমরা প্রতিদিন বাংলাদেশের পত্রিকাগুলি দেখি এবং পড়ি। এই বিষয়ে মনে হলো গোলাম সরওয়ারের একটি উক্তি, “If there are unfair activities all around, if a man sees all around only inhumanity, then what will be the consequences? „„So far the principal of psychology is concerned, he doesn’t hesitate to start committing offences. Little by little, he advances towards greater offence(Humanity On Trial by Ghulam Sarwar).”
তবে প্রশ্ন আসতে পারে তবে কি দেশে আইন নেই? কিন্তু আইনের চোখে ধুলা এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েইতো এসব অন্যায় হচ্ছে। তাহলে বলতে হবে আইন নিষ্কৃয় অথবা আইন ও বিচার বিভাগেও দুর্নীতির পোকা বসবাস করছে। এটার কারণ খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হবে বায়াত্তরের সংবিধানে। বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমায় যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের বংশধররা বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমা করে নাই। তারই জ্বলন্ত উদাহরণ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে শাল্লায় আক্রমণ এবং ২৫ তারিখে ব্রাহ্মণ বাড়িয়াতে আক্রমণ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে আগেও এসেছিলেন। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী মোদী হেফাজতের কাছে একটি অজুহাত মাত্র। বাংলাদেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখন তাদের এই পরিকল্পিত আক্রমণ। কথা আসতে পারে যে পুলিশের ইন্টেলিজেন্স কোথায় ছিল? আমাদের পুলিশ বাহিনী হেফাজতের অনুসারী মন্ত্রীদের কথা ছাড়া তো একসানে যেতে পারে না। এটা ওপেন সিক্রেট ব্যাপার। সবাই জানে সরিষার মধ্যেই ভুত।
অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে সাথে হতে হবে সামাজিক নিরাপত্তা। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা রাষ্ট্রকে নিতে হবে। দুর্নীতিবাজদেরকে চিহ্নিত করতে হবে সে যে রাজনৈতিক ছত্র ছায়ায় থাকুক না কেন। দেশের সমৃদ্ধির সাথে সাথে দেশ কোন পথে ছুটছে?
আমাদের সময় এসেছে একাত্তরের অসমাপ্ত যুদ্ধ সমাপ্ত করার। দেশের সুধীজন, বুদ্ধিজীবী, প্রগতিশীল মানুষ এবং দেশের সমস্ত জাগ্রত জনতাকে এক হতে হবে। সময় এসেছে জাতীয় ঐক্যের। হেফাজত এসেছে জামায়াত-শিবির ও অন্যান্য ইসলামী সংগঠনের উত্তরসূরি হয়ে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বলেন, “শাসক রাজনৈতিক দল যত দুর্বল ও জনবিচ্ছিন হয়, ততই রাজনৈতিক চক্রান্ত বাড়ে। বাংলাদেশেও এখন তাই ঘটেছে (বাংলা কাগজ, টরন্টো, ৯ মার্চ, ২০২১)।”
ক্যাডারভিত্তিক এই সংগঠনগুলিকে বন্ধ করে দেওয়া উচিত অতি সত্তর। আর ফিরে যেতে হবে বায়াত্তরের সংবিধানে। সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের কথাই ধরা যাক। এক সময় এই দেশটি ছিল অনুন্নত, জনসংখ্যাবহুল দরিদ্র দেশ হিসাবে চিহ্নিত ছিল। পরবর্তীকালে তারা দেশের শিল্প স¤প্রসারণের সাথে সাথে, মূল্যবোধের ব্যাপ্তি, জীবন যাত্রার মানও বিস্ময়করভাবে উন্নত করেছে। কারণ জাপানি জনগণের এই অগ্রগতির প্রাতঃলগ্নে জাপানি জনগণের গভীর জাতীয় ঐক্যবোধ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। জাতীয় ঐক্য বোধ ছাড়া কোনো সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়।
বনানী বাবলি