সোনা কান্তি বড়ুয়া : নাগরিক প্রতিনিধি দলের মতে, “পটুয়াখালীর রাখাইনরা সংখ্যালঘু থেকে সংখ্যাশূন্য হতে চলেছে! দঙকুপাড়াকে করা হয় ইসলামপুর, হুইসেনপাড়াকে করা হয় হোসেনপাড়া, দোকাশি পাড়াকে করা হয় দোভাষীপাড়া, থঞ্জুপাড়াকে করা অঞ্চুপাড়া, ফ্যাথিপাড়াকে করা হয় ফাঁসিপাড়া, নাচনাপাড়াকে করা হয় ওলামানগর, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার কয়েকটি গ্রামে পৌঁছে স্থানীয় রাখাইন পরিবারগুলোর সদস্যসহ অন্যদের সঙ্গে কথা বলি। এর মধ্যে ছিল টিয়াখালী ইউনিয়নের ছয়আনিপাড়া ও চৈয়াপাড়া; মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নের তুলাতলীপাড়া ও মধুপাড়া; কুয়াকাটা পৌর এলাকার কেরানীপাড়া ও লতাচাপলী ইউনিয়নের মিশ্রিপাড়া।” রাখাইনরা প্রথম “পটুয়াখালীর এ এলাকায় কুয়া খনন করেছিল। তাই নাম হয়েছে কুয়াকাটা। কিন্তু অধিকাংশ রাখাইন আদিবাসী আজ দেশান্তরী, বিপন্ন। পটুয়াখালী জেলায় বসবাসরত রাখাইন জনগোষ্ঠীর বঞ্চনা ও সংকটের ধরন পর্যবেক্ষণে নাগরিক প্রতিনিধি দল স¤প্রতি কয়েকটি রাখাইন জনপদ সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। বাংলাদেশে সবচেয়ে বিপন্ন জনগোষ্ঠীর নাম রাখাইন আদিবাসী! দশকের পর দশক ধরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে একের পর এক রাখাইন জনপদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। জবরদখল-উচ্ছেদের শিকার হয়ে তাদের অধিকাংশই মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে গেছে! DAINIK SAMAKAL ১২ ডিসেম্বর ২০২১)!
চিটিংবাজ জবরদখলকারীরা তাদের ভিটামাটি, পুকুর আর কৃষিজমি দখল করেই ক্ষান্ত হয়নি; বেদখল হয়ে গেছে তাদের উপাসনালয় বৌদ্ধ মন্দির। ভূমিগ্রাসের কবলে চলে গেছে একের পর এক শ্মশানভূমি। আমরা নাগরিক প্রতিনিধি দল রোবায়েত ফেরদৌস, নূর খান লিটন, জাকির হোসেন, মির্জা আজিম হায়দার, দীপায়ন খীসা, মং ম্যা রাখাইন, আজিজ আখতার, মাসুদ আলম লেখকবৃন্দ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, সাংবাদিক, ভূমি অধিকার ও আদিবাসী অধিকারকর্মী। (DAINIK SAMAKAL ১২ ডিসেম্বর ২০২১)! চিটিংবাজ জবরদখলকারীরা রাখাইন জনগোষ্ঠীর ভিটামাটি, কৃষিজমি দখল করেছে!
বিশ্বকবির রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, “মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে, / সন্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান! …
দীর্ঘ জীবনপথ, কত দুঃখতাপ, কত শোকদহন–
গেয়ে চলি তবু তাঁর করুণার গান \
খুলে রেখেছেন তাঁর অমৃতভবনদ্বার–
শ্রান্তি ঘুচিবে, অশ্রু মুছিবে, এ পথের হবে অবসান\
অনন্তের পানে চাহি আনন্দের গান গাহি–
ক্ষুদ্র শোকতাপ নাহি নাহি রে।
অনন্ত আলয় যার কিসের ভাবনা তার–
নিমেষের তুচ্ছ ভারে হব না রে ম্রিয়মাণ!”
রাখাইনদের দেখে দেখে আঁখি না ফিরে! রাখাইন’ বাংলাদেশে বসবাসরত একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী যারা আঠারো শতকের শেষে আরাকান থেকে বাংলাদেশে এসে উপক‚লীয় জেলা কক্সবাজার ও পটুয়াখালীতে বসতি স্থাপন করে। রাখাইনদের হাজার বছরের পুরানো এক সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। আদি ব্রাহ্মীলিপিতে প্রথম লিখিত আকারে পালি ভাষায় ‘আরাখা’ অর্থাত রক্ষ বা রক্ষিতা অথবা রক্ষক শব্দ থেকে রাখাইন শব্দটির উত্পত্তি। আর্য বংশোদ্ভূত প্রকৃতি উপাসক রাখাইনরা প্রাচীনযুগে মগধ (Bihar in India) রাজ্যে বসবাস করত। উল্লেখিত সময়ে মগধ থেকে রখঙ্গ, রখাইঙ্গপি, আরখঙ্গ, রোসাঙ্গ, রাখাইনপ্রে বা আরাকানে এসে বসবাস শুরু করলে মগধী বা মগ রূপে ইতিহাসে পরিচিতি লাভ করে। ‘রাখাইন’ একটি আদি স¤প্রদায়। যাদের অস্থিত রয়েছে ৬০০০ বছর আগে থেকে। (সংরক্ষিতঃ (তথ্যকোষ)!
নাগরিক প্রতিনিধি দলের মতে, বিকৃত করে দেওয়া হচ্ছে রাখাইন পাড়া কিংবা রাখাইন গ্রামের নাম। ১৯৭২ সালের ৪ই নভেম্বর বাংলাদেশ গণপরিষদ গৃহীত এবং ১৯৭২ সালের ১৪ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রথম খন্ডে প্রকাশিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ (২) অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, “রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।” জাতির আত্মপরিচয়ের বাংলাদেশের বিশ্ববিজয়! “যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে, / পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে। “শুধু বাংলাদেশ নয়; সভ্যতার ইতিহাসে নিকৃষ্ট এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের পরিশিষ্ট। দানবরূপী হিংস্র ঘাতক সৃষ্ট বর্বরতা ও নৃশংসতায় অভিশপ্ত আচ্ছাদনে নিষ্ঠুর-নির্মমতায় রাখাইনরা সংখ্যালঘু থেকে সংখ্যাশূন্য হতে চলেছে!
পরিদর্শনকালে আমাদের (রোবায়েত ফেরদৌস, নূর খান লিটন, জাকির হোসেন, মির্জা আজিম হায়দার, দীপায়ন খীসা, মং ম্যা রাখাইন, আজিজ আখতার, মাসুদ আলম লেখকবৃন্দ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, সাংবাদিক, ভূমি অধিকার ও আদিবাসী অধিকারকর্মী) মনে হয়েছে, পটুয়াখালী অঞ্চলের রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়।
রাখাইনরা প্রথম এ এলাকায় কুয়া খনন করেছিল। তাই নাম হয়েছে কুয়াকাটা। কিন্তু অধিকাংশ রাখাইন আদিবাসী আজ দেশান্তরী, বিপন্ন। তারা শুধু সংখ্যালঘুই নয় বরং সংখ্যাশূন্য হতে চলেছে। ১৭ শতকের শুরুতে এ অঞ্চলে প্রথম বসতি গড়ে তারা বনজঙ্গল কেটে আবাদি জমি তৈরি করে অঞ্চলকে বসবাসযোগ্য করেছিল। যেখানে কয়েক দশক আগেও লক্ষাধিক রাখাইনের পদচারণায় মুখরিত ছিল, সেখানে তাদের সংখ্যা বর্তমানে মাত্র আড়াই হাজারে নেমে এসেছে। ১৯৪৮ সালে পটুয়াখালীতে ১৪৪টি ও বরগুনায় ৯৩টি রাখাইনপাড়া ছিল। বর্তমানে সেখানে যথাক্রমে ২৬টি ও ১৩টি পাড়া টিকে আছে। এর মধ্যে সর্বশেষ যে রাখাইনপাড়াটি এ বছর নিশ্চিহ্ন হয়েছে সেটি ছয়আনিপাড়া। রাখাইনরা সংখ্যালঘু থেকে সংখ্যাশূন্য হতে চলেছে!
পায়রা বন্দরের জন্য অধিগ্রহণের কবলে পড়ে পাড়াটি বিলুপ্ত হয়েছে। এ বসতি এলাকায় একটি তাদের পবিত্র বৃক্ষ ছিল, যার নাম করনজা। গাছটি ছিল ২০০ থেকে ২৫০ বছরের পুরোনো। মূলত এ গাছকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে তাদের ধর্মীয় ও সমাজব্যবস্থা। অধিগ্রহণের পর এ পাড়ার ছয়টি পরিবারকে তাদের বসতবাড়ি, গাছ এবং স্থাপনার জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের ভোগদখলকৃত জমির ক্ষতিপূরণ পায়নি। বিলুপ্ত হওয়া ছয়আনিপাড়ার কাছেই কুয়াকাটা-বরিশাল হাইওয়ের পার্শ্ববর্তী এবং আন্ধারমানিকের শাখা নদী আড়পাঙ্গাশিয়ার তীরবর্তী চৈয়াপাড়া। এ পাড়ায় রাখাইনদের সব জমি দখল হয়ে গেছে। শ্মশানের অধিকাংশই দখল। টিকে আছে মাত্র ১০-১২ শতাংশ। রাখাইন রীতি অনুযায়ী প্রতিটি পাড়ায় দুটি শ্মশান থাকে। এর একটি হচ্ছে স্থানীয় শ্মশান, অন্যটি অতিথি শ্মশান। যেভাবে শ্মশান দখল হয়ে যাচ্ছে, তাতে আগামীতে হয়তো শবদেহ সত্কারের কোনো জায়গাই থাকবে না।
চৈয়াপাড়া শ্মশানে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, লাশ বা শবদেহ নিয়ে যাওয়ার রাস্তাটিও এখন নেই। বাজারের দোকানের সব ময়লা ফেলা হচ্ছে শ্মশানে। প্রাকৃতিক কাজও সেখানে সারছে বাজারের লোকজন। সরেজমিন দেখা যায়, শ্মশানে ঢোকার পথে গেট পর্যন্ত লাগিয়েছে স্থানীয় এক দোকান মালিক। একইভাবে কুয়াকাটার থনজুপাড়া, মিশ্রিপাড়া, দিয়ার আমখোলা, কালাচানপাড়া, তুলাতলী, নয়াপাড়া, সোনাপাড়া, হাঁড়িপাড়াসহ অধিকাংশ পাড়ার শ্মশান দখল হচ্ছে।
আদিবাসী রাখাইনদের সব উত্সব ছিল ভূমিকে কেন্দ্র করে। ফসল ফলানোর জন্য জমি তৈরি করা, বীজ বোনা, ফসল তোলা, ফসলের ব্যবহার, বিয়ে, জন্ম-মৃত্যু-আনন্দ এসব উত্সব ঋতু ও ভূমিকে নিয়ে। অথচ সেই ভূমিই নেই। আদিবাসী রাখাইনদের দাবি, তাদের কাছ থেকে ভূমি কেড়ে নেওয়ার অর্থ হচ্ছে, একটি বাগান থেকে ফুল ছিঁড়ে নেওয়া। ভূমি নেই তো আনন্দ-উত্সব কিছুই নেই। সংস্কৃতিচর্চার জায়গা কোথায়? গান-নৃত্য দূরের কথা; মনের কথা বলার জায়গাই তো নেই! প্রতিটি পাড়ার রিজার্ভ পুকুর দখল হচ্ছে। পাড়ার মূর্তি চুরি হয়ে যাচ্ছে। কুয়াকাটায় ফ্রুচাইপাড়ায় ১৯২৫ সালে নির্মিত গৌতম বুদ্ধের শয়নরত বৌদ্ধবিহার এলাকার চারপাশ দখল করা হয়েছে। মিশ্রিপাড়ায় বৌদ্ধবিহারের জমি দখল করে একের পর এক দোকানঘর নির্মাণ করা হয়েছে। বৌদ্ধমন্দিরের মাঠ দখল করে বাজার বসানো হয়েছে। দেবালয় উল্লেখকৃত রেকর্ডের জমিও রক্ষা পায়নি। প্রাচীন এই বৌদ্ধবিহারটি প্রত্নসম্পদ বিবেচনা করে হলেও সরকারের উচিত দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করা।
রাখাইনদের জমি, পুকুর, শ্মশানসহ সবকিছু দখল হয়ে যাচ্ছে বলেই নিজ ভূমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে তারা। জালিয়াতির মাধ্যমে জমি জবরদখল, রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও স্বার্থান্বেষী দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য এবং সেই সঙ্গে রাষ্ট্রের নীরবতায় তারা তাদের ভূমি হারাচ্ছে প্রতিনিয়ত। যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাখাইনদের সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, এ ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে এ অঞ্চলে রাখাইনদের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আমরা চাই, আর যেন একটি রাখাইনপাড়াও নিশ্চিহ্ন না হয়। একই সঙ্গে চাই, উচ্ছেদ হওয়া রাখাইন পরিবারগুলোকে যথাযথভাবে তাদের জীবনধারা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ স্থানে পুনর্বাসন নিশ্চিত করা হোক। সেই সঙ্গে আমাদের দাবিগুলো পূরণে সরকারের কাছে আহ্বান জানাই-
১. অবিলম্বে কলাপাড়া উপজেলার ছয়আনি রাখাইনপাড়ার ছয়টি আদিবাসী পরিবারকে তাদের সংস্কৃতি জীবনধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এমন জায়গায় পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সেখানে মৃতদেহ সত্কারে জায়গা ও বৌদ্ধবিহারের জন্য বরাদ্দ দিতে হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পায়রা বন্দরে তাদের চাকরিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
২. অবিলম্বে কুয়াকাটার প্রাচীন বৌদ্ধবিহারটি দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করে অন্যায়ভাবে চলা নির্মাণকাজ বন্ধ করতে হবে।
৩. অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পায়রা বন্দরে তাদের চাকরিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৪. দখলকৃত বৌদ্ধবিহারের জমি ও রিজার্ভ পুকুর দখলমুক্ত করতে হবে। রাখাইনদের শ্মশান ভূমি দখলমুক্ত করে তাদের কাছে ফেরত এবং অবৈধ দখলদারদের আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
৫. রাখাইন ভাষা রক্ষার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে অবিলম্বে রাখাইন ভাষায় শিশুশিক্ষা কার্যক্রম শুরু এবং বিদ্যালয়গুলোয় রাখাইন শিক্ষার্থীদের নিজস্ব ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগ দিতে হবে।
৬. রাখাইন সংস্কৃতি রক্ষা, বিকাশ ও চর্চার লক্ষ্যে রাখাইন কালচারাল একাডেমিকে সক্রিয় করতে হবে।
৭. বিকৃত করা রাখাইনপাড়ার নাম স্ব স্ব ঐতিহ্যগত নামে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
৮. যেসব রাখাইন অধ্যুষিত গ্রামে শ্মশান ভূমি নেই, সেখানে মৃতদেহ সত্কারে দ্রুত রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে জায়গা বরাদ্দ দিতে হবে (কলাপাড়া সদর, কালাচানপাড়া, কুয়াকাটাপাড়া, নয়াপাড়া, নায়রীপাড়ার জন্য)।
৯. ভূমিদস্যু, স্থানীয় প্রভাবশালী ও সাবেক ভূমি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সিন্ডিকেট ভেঙে অবৈধ হাউজিং ব্যবসা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
১০. রাখাইন তাঁতশিল্প টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ, প্রশিক্ষণ ও বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
১১. পটুয়াখালী ও বরগুনার সর্বশেষ যে ২৫৬১ জন রাখাইন বাস করছে, তাদের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং এ অঞ্চল থেকে যেন রাখাইনরা চিরতরে হারিয়ে না যায় তার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।
১২. ) ১৯৫০ সালে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৭ ধারা পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
১৩. সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। ভূমি কমিশনের মাধ্যমেই স্থানীয় ভূমিবিষয়ক মামলা, তথ্য-নথি, দলিলপত্র সংরক্ষণ ও কর্মপ্রক্রিয়া সম্পাদন করতে হবে।
১৪. রাখাইনদের সংরক্ষিত পবিত্র-প্রথাগত ভূমি-বনভূমি, জলাভূমি, বৃক্ষ, দেবস্থান, মন্দির, বিহার, উত্সব ও মেলা এলাকা, প্রার্থনা এলাকা, সামাজিক রীতি ও আইনের মাধ্যমে পরিচালনা, রক্ষা-বিকাশের জন্য আইনগতভাবে স্বীকৃতি, মর্যাদা ও দখলমুক্ত করে রাখাইনদের হাতে তুলে দিতে হবে।
১৫. রাখাইনদের ঐতিহাসিক স্থানগুলোসহ নিজস্ব সংরক্ষিত এলাকা কোনোভাবেই অধিগ্রহণ করা চলবে না।
১৬. বেদখলকৃত, অর্পিত বা শত্রুসম্পত্তির নামে দখলকৃত জমি রাখাইনদের কাছে ফেরত দিতে হবে।
১৭. রাখাইন এলাকা বা জমিতে কোনো প্রকল্প গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তাদের পূর্বানুমতিসহ রাখাইনবান্ধব প্রকল্প হাতে নিতে হবে। এটা সবাই স্বীকার করে- বৃহত্তর পটুয়াখালী অঞ্চলের বিস্তীর্ণ ভূমিকে রাখাইন জনগোষ্ঠীই তাদের ঘাম ও রক্ত দিয়ে বাস ও আবাদযোগ্য জমিতে পরিণত করেছিল। তাদের অন্যতম প্রধান নেতা উ সু য়ে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন। আজ সেই রাখাইন জনগোষ্ঠী উন্নয়নের নামে উচ্ছেদের সম্মুখীন। জালিয়াতি ও জবরদখলের মাধ্যমে তাদের জমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এই মুহূর্তে রাখাইন জনগোষ্ঠীর ভূমি, জীবন-জীবিকা রক্ষার্থে প্রয়োজন সাহায্য-সহযোগিতা ও নৈতিক সমর্থন।
প্রায় তিন হাজার বছর আগে আরাকানে ‘আস্সাং নাগিদ্ধা’ নামক ঋষি আদি শিলালিপিতে লিখেছিলেন ‘আম্মিও সিলা নেথা নাহ্-গো, প্রে-ওয়া মেন-দাই, চাঙ থিং নাই-মা রাখাইন না-মা বো-য়ে মি-হ্লা-গো আন্নোথা ছাই নিয়া খ-এ রা-দে’। যার অর্থ জাতি ও শীল এই দুইটিকে স্মৃতিসৌধের মত যিনি সার্বক্ষণিক রক্ষা করতে সক্ষম হবেন তিনিই রাখাইন। এটি যিনি যতদিন বজায় রাখতে পারবেন তিনি ততদিন এই বিশেষণে বিশেষিত হবেন।
রাখাইনদের মধ্যে বিশ্বাস যে, সুদূর অতীতে ২৬ জন ব্রাহ্মণ রাজা আরাকান শাসন করেন। রাখাইন রাজা মারিও থেকে মহা সামাদা, ১৭৮৪ সালে পর্যন্ত মোট ২৩৪ জন আরাকান শাসন করেন। এই শাসনকাল ইতিহাসে ধন্যাবতী, বৈশালী, লেম্রু ও ম্রাউ যুগ হিসাবে চিহ্নিত।
আরাকানের ইতিহাস ‘রাজোওয়াং’ সূত্র মতে, ১৪৬৪ সালে রাজা চন্দ্র-সূর্য চট্টগ্রাম-আরাকান রাজ্য প্রতিষ্ঠাকালে তাঁর সঙ্গী মগধাগত বৌদ্ধ সৈন্যরা চট্টগ্রাম তথা কক্সবাজার আসেন। আরাকানী রাজা সুল-তৈংগ-চন্দয়স ‘সুরতন’ রাজ্য জয়ে বের হলে ৯৫০ সালে একবার চট্টগ্রামের কুমিরা পর্যন্ত অধিকার করে আরাকানী শব্দ ‘চাই মাতাই কং’ বা ‘চেত্তগৌং’ (আর যুদ্ধ নয়) খোদিত বিজয় স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন। মুগলরা মার্মাদের বসবাস পছন্দ করত না বলে ১৬৬৬ সালে শায়েস্তা খানের সময়ে বাংলাদেশের কক্সবাজার-চট্টগ্রামে ‘মগজমা’ নামে কর বসান।
এ.পি ফিরের (অ.চ চযুত্ব) বর্ণনাতে লেম্রু যুগের শেষে বার্মার রাজা বো-দ-মাও ওয়ে আরাকান দখল করলে, রাজা মেঙ সোয়ামাউ (জি.ই হার্ভের হিস্টরি অব বার্মা’য় যার নাম নরমিখিলা) বাংলার (গৌড়) স্বাধীন সুলতানের কাছে ১৪০৬ সালে আশ্রয় নেয়। পরে সুলতান জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ শাহ দুই দফায় লক্ষাধিক সৈন্য দিলে মেঙ সোয়ে মাউ ১৪৩০ সালে আরাকান পুনরুদ্ধার করেন। তত্সময়ের কিছু রৌপ্য মুদ্রা এ.পি ফিরে আবিষ্কার করেন। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে এইরূপ আরও কয়েকটি মুদ্রা সংরক্ষিত রয়েছে। ইতিপূর্বে আরাকানে সাংকেতিক মুদ্রার প্রচলন ছিল। সেই থেকে আরাকানী রাজারা রাখাইন ও মুসলমানী (ফার্সি) নাম এবং কলেমা মুদ্রায় উত্কীর্ণ করতে থাকে। মেঙ সোয়ে মাউ (মাং চ মোয়ে) ম্রাউক নগরীতে রাজধানী স্থাপন করে ম্রাউ যুগের সূচনা করেন।
মধ্য-আঠারো শতকে আমত্য হারি’র আমন্ত্রণে ১৭৮৪ সালে বর্মী রাজ আরাকান দখল করেন। ১৭৯১ সালে ওয়েমোর নেতৃত্বে কক্সবাজার থেকে আরাকান গিয়ে পূর্বের গণহত্যার প্রতিশোধ নিয়ে ফিরে আসে। ১৭৯৬ সালে আরাকানে দেশব্যাপী বিদ্রোহ হয়। এর ফলে অনেক আরাকানী কক্সবাজারে এসে আশ্রয় নেয়। ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স (যার নামানুসারে কক্সবাজার) ১৭৯৯ সালে কক্সবাজারের সুপারিনটেনডেন্ট নিযুক্ত হন। তিনি উদ্বাস্ত্তদের পুনর্বাসনের নীতিমালা প্রণয়ন, স্থান নির্ধারণ ও জমি পত্তনি দেয়ার সময় শের মোস্তফা খান, কালিচরণ, সাদ উদ্দীন প্রভৃতি ভূস্বামীগণ দ্ব›দ্ব শুরু করেন। ১৮১৭ সালে পিচেলের চেষ্টায় কক্সবাজারের সরকারি সম্পত্তি প্রকৃত ব্যবসায়ীদের জন্য করমুক্ত ঘোষণা করেন।
জুলাই ১৭৯৯ হিরাম কক্স এক রিপোর্টে আগত রাখাইনদের বসতি স্থাপনের সংখ্যা জানিয়েছিলেন ৪০-৫০ হাজারের মত। ১৮০০ থেকে ১৮১৩ সালের ২৯ জানুয়ারি তারিখের রিপোর্ট মতে, ১৪,৪৫১ জনকে পূনর্বাসন করা হয়। কোম্পানি ১৮০০ সালের মে মাসে রাখাইনদের অধিকতর অভিবাসন বন্ধের আদেশনামা জারি করে। ১৭৮৫ সালের তামাদা পালিয়ে গেলে ব্রাহ্মরাজ বোধ পায়া আরাকানকে ব্রহ্মদেশের সাথে অর্ন্তভুক্ত করে প্রায় দুই লক্ষ আরাকানী নারী-পুরুষ হত্যা করে এবং সমসংখ্যক দাস হিসেবে বার্মায় প্রেরণ করে। স্যার ওয়ান্টার হেমিল্টন রামুতে প্রায় লক্ষাধিক আরাকানী শরণার্থী দেখেছিলেন। ইংরেজরা তাদেরকে দ্বিতীয় দফায় কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পটুয়াখালীতে পুর্ণবাসন করেন। এটি ছিল রাখাইনদের বড় ধরণের অভিবাসন। বর্তমানে বাংলাদেশে কক্সবাজারের পৌর এলাকা, খুরুশকুল, চৌফলদন্ডী, রামু, পানের ছড়া, আশকর কাটা, টেকনাফ, খারাংখালী, হ্নীলা, চকরিয়ার হারবাং, মহেশখালীর গোরকঘাটা এবং পটুয়খালীর খেপুপাড়া ও কুয়াকাটায় রাখাইনরা বসবাস করছে।
আরাখা (রাখাইন)রা অরাল ফর্মে কয়েক হাজার বছর পূর্ব মগধে এই ভাষার উদ্ভব ঘটায় বলে ধারণা করা হয়। প্রায় ৬ হাজার বছর আগে নানান্দা পাথরে খোদাই করা শিলালিপিতে প্রথম রাখাইন বর্ণমালার উত্পত্তির দলিল পাওয়া যায়। এই শিলালিপিটি পূর্ব আরাকানে ‘সাঁই থং পাট্টু দগ্রিতে’ সংরক্ষিত রয়েছে। উত্তর ভারতের আদি ব্রাহ্মী লিপি থেকে রাখাইন বর্ণমালার উত্পত্তি। ভাষা তাত্তি¡কগণের মতে এটি ইন্দু-মঙ্গোলিয়েট ভাষা। মগধিরা আরাকানে এই ভাষা-বর্ণমালা নিয়ে আসলে বর্মীরা এই ভাষা-বর্ণমালার অধিকারী হয়। আরাকানে প্রথম ও দ্বিতীয় ধন্যবতী যুগে, বৈশালী যুগের শুরু এবং শেষের দিকে, লেম্রæ যুগে ও ম্রাউ যুগে বর্ণলেখনে সামান্য পরিবর্তন আসে।
হাজার বছর ধরে প্রা-ঝে (ঐতিহাসিক নাটক), ওয়াচ্ছার নাচ (শুকুরের নৃত্য) জে-চাববাং (যাত্রাপালা), ও-থো (গল্প), পুংবাং (উপন্যাস), ছড়া, কাব্যিয়া (কবিতা) ও পেং ওয়ে টেং, যার অর্থ ‘ফুল লুকোচুরি খেলা’ (লোক ধাঁধা)র প্রচলন রয়েছে। কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণ ও রাখাইনরা একটি নতুন লোক ভাষার উদ্ভব ঘটায়, যা দুই তিনশত বত্সর থেকে চলে আসছে। যেমন ‘তুমি মানু বে খায়েনি?’, ‘মগিমানু মরিয়ে জাং গুলা খাইয়ে’, মুসুমমান মানু মরিয়ে কেলা পাতা দি বেরাইয়ে’, ইত্যাদি প্রায় দেড়শত মুখাশ্রিত লোক কাব্যিয়া (কবিতা) বাংলা বর্ণমালায় মুর্তায়ন, সনাক্তকরণ ও কাব্যানুবাদ হয়েছে। এতে লোক সংগীতও রয়েছে। ১৫৩৮ থেকে ১৭০৩ সালে পর্যন্ত আরাকান রাজসভায় মহাকবি আলাওলসহ প্রভৃতি কবিগণ বাংলা সাহিত্য চর্চা করেন।
পূর্বে রাখাইনরা বলপাতা, তালপাতায় কালি ব্যবহার না করে কাঁটা অথবা লোহার শলাকা দিয়ে লোক কাহিনী, নীতিকথা, যাদুবিদ্যা, চিকিত্সা, ত্রিপিটক, জ্যোতিষবিদ্যা ইত্যাদি লিখে যান। ঐ পাতায় পান্ডুলিপির নাম পিজং। যা বিভিন্ন কিয়াং-এ সংরক্ষিত রয়েছে।
রাখাইন আন্নু-লামুং পাইঞা বা চারু ও কারুকলাকে বারো প্রকারে বিভক্ত করেন। রাখাইনদের মধ্যে শিল্পকলা ও নান্দনিক সংস্কৃতির সুপ্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে। বিশেষত স্থাপত্যকলা, চারু ও কারুকলা, চিত্রকলা, ভাস্কর্য শিল্প, সংগীত, নাট্য ও নৃত্যকলায়। রাখাইনরা বাংলাদেশ, আরাকান, মায়ানমার ও মালেশিয়ায় ধার্ম্মার, উদ্দেশ্য, দাটু ও পেরিবগা জাদিসমূহ নির্মাণ করে। বাংলাদেশে প্রায় আড়াইশত বছরের পুরানো ৩২টি জাদি রয়েছে। এগুলির চূড়ায় একখন্ড পাথর থাকে। যা সমুদ্র পথ নির্দেশ করে। এসব জাদিতে আর্য্য চিহ্ন রয়েছে।
বিশ্ববৌদ্ধ পুরস্কার প্রাপ্ত প্রখ্যাত মানবতাবাদী লেখক সোনা কান্তি বড়ুয়া (Bachelor of Arts, University of Toronto), সাবেক সভাপতি, বাংলা সাহিত্য পরিষদ, টরন্টো, খ্যাতিমান ঐতিহাসিক, কথাশিল্পী, বিবিধগ্রন্থ প্রনেতা প্রবাসী কলামিষ্ঠ, লাইব্রেরীয়ান, বিশ্ববৌদ্ধ সৌভ্রতৃত্ব পত্রিকার সহ সম্পাদক এবং জাতিসংঘে বিশ্ববৌদ্ধ প্রতিনিধি!