মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

সাতষট্টি.
আমার বাবা কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর রাজনীতির এই কঠিন নেতিবাচক দিকগুলো বিবেচনা না করেই কথাটা বলেছিলেন। আমার ব্যক্তিগত রুচি কখনও কিন্তু আমাকে রাজনীতির কাদা ছোঁড়াছুড়ির দিকে নিয়ে যায়নি। আমি সব সময় যে কোন গঠনমূলক তর্ক বিতর্কে অংশ নিতে প্রস্তত থাকি, আর আমি মনে করি, আমার চামড়াটা পাতলা নয়। সাধারণ মানুষের বাস্তবতা অনুধাবন করতে করতে আমি বড় হয়েছি। কিন্তু সোফি ঠিক আমার মত নয় এবং তার বেড়ে ওঠাটা ঠিক আমার মতও ছিল না। কিন্তু তারপরও ভাবছিলাম, আমাদের যে কোন সিদ্ধান্ত আমাদেরকে যে পরিমাণ প্রভাবিত করবে, তার চেয়ে বেশি প্রভাবিত করবে আমাদের সন্তানদের।

এমন সব বিষয় যখন আমার চিন্তায় বার বার আসছিল, তখন কেটি এবং গ্যারী ঠিক করল, আমরা তিন দিনের জন্য একটা আলোচনা ও তর্ক বিতর্কের একটা ব্যবস্থা করবো এবং সেখান থেকেই আমরা এই সিদ্ধান্তের চুড়ান্ত জায়গায় পৌছব। আমি সবাইকে এই বিষয়টা পরিষ্কার করে দিয়েছিলাম, আমি যদি নেতৃত্বের দৌড়ে অংশ নিই, তবে আমার প্রচারণাটা হবে সম্পূর্ণ আলাদা। আমার সেই প্রচারণায় যেভাবেই হোক অনেক অনেক বেশী কানাডার মানুষ অংশ নিবে। তখন আমাদের প্রয়োজন ছিল লিবারেল পার্টির দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া। যদি আমাদের দলের কখনও সেই সুদিন আসে, তাহলে আমরা অবশ্যই খুঁজে বের করব, কিভাবে আমাদের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের সঠিক সম্মান জানানো যায় এবং মানুষের প্রাপ্যতা তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া যায়।

জুলাইয়ের শেষে আমরা মন্ট ট্রেম্বলান্ট এ এক হয়েছিলাম। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা একটা দলের সাথে আমার পরিবারের সদস্যরা বসেছিল এবং এই দলে যারা এসেছিল, তাদের মেধা, অভিজ্ঞতা ও জীবন শক্তি ছিল সমীহ করার মত। আমাদের লক্ষ্য ছিল, এই দলের সাথে আলোচিত বিষয়গুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব।

আমরা নবীন আর প্রবীণদের সংমিশ্রণে চমৎকার একটা দলকে সেখানে উপস্থিত করতে পেরেছিলাম। ওদের অনেকেরই রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ছিল আর অনেকেই ব্যবসা জগত ও সেবামূলক জায়গা থেকে এসেছিল। আমাদের দলে সংখ্যার দিক দিয়ে নারী ও পুরুষের একটা সামঞ্জস্যতা ছিল, সেই সাথে ছিল বয়স্ক সেনা সদস্য ও মেধাবী নতুন অভিবাসী। আরো ছিল বিভিন্ন ক্ষেত্রের চাকুরীজীবী ও আমার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব। আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল একটা বিষয়, তা হচ্ছে, আমরা প্রায় সবাই আমাদের পরিবারকে আমাদের সাথে আনতে পেরেছিলাম। অবশ্যই সোফি সেখানে ছিল, সেই সাথে ছিল আমার ভাই শাসা। আমি সবাইকে তাদের সঙ্গী আর ছেলেমেয়েদেরকে সাথে আনার জন্য বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলাম। আমি জানতাম, আমরা যদি সত্যিই আমাদের সিদ্ধান্ত আর সামনে এগুনোর পথকে ইতিবাচক দিকে নিয়ে যেতে পারি তাহলে আমাদের পরিবারের সবারই সমর্থন আমাদের লাগবে। দীর্ঘ পথ চলার পর রাতে ঘুমানোর আগে আমাদের যে ‘ষ্ট্র্যাটেজিক সেশন’ থাকত, সেটাতে আমি সবার উদ্দেশ্যে কোন বিষয়ে কথা বলার জন্য আমার বক্তব্য এমনভাবে তৈরী করতাম যে, মনে হত আমার পাশে যারা আছে, তাদেরকে বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজে তাঁদের পরিবার থেকে অনেক ঘণ্টা বা বেশ কিছু দিনের জন্য দূরে থাকতে হতে পারে। সেই সময় আমি উপলব্ধি করেছিলাম, শুরু থেকেই সকলের জানা উচিৎ সত্যিকারের রাজনৈতিক জীবনটা আসলেই কেমন। আবার সেই সাথে আমাদের এই মিলনমেলা আমাদেরকে এটাও মনে করিয়ে দিয়েছিল, রাজনৈতিক জীবন এমন হওয়া উচিৎ যা কর্মজীবী পিতা মাতা উভয়কেই পরিবারের প্রতি আরও বেশি দায়িত্ববান করে তুলে।

অতএব, কানাডার অনেক দুঃসাহসিক অভিযানের মত আমার নেতৃত্বের প্রচারণাটা শুরু হয়েছিল ‘ক্যাম্প ফায়ার’ ঘিরে।
আমরা যারা সেখানে গিয়েছিলাম তাদের সকলেই নিজেদের গাড়ী বা ‘স্লীপিং ব্যাগ’ আর সেই সপ্তাহের শেষ দিন দুটির জন্য আমরা যে কটেজগুলো ভাড়া নিয়েছিলাম, সেখানে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছিলাম। আমাদের এই ক্যাম্পেইন এ সবাইকে দেশ ও রাজনীতির পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করার জন্য যে কৌশলগত তথ্য ও উপাত্ত টম পিটফিল্ড তৈরি করেছিল, সেই’ই মন্ট্রিয়ল থেকে আগুনে ঝলসানো মাংসও নিয়ে এসেছিল। আর সবাই যখন বলাবলি করতে লাগল যে সূর্য ডুবতে শুরু করেছে, তখনই আমরা পেছনের দিকে একটা খোলা জায়গায় আগুন জ্বালানোর পরিবেশ তৈরি করে ফেললাম। আমরা যখন সবাই সেই আগুনের চারপাশে জড় হলাম, তখন আমি সবার উদ্দেশ্যে আমাদের এই জমায়েতের মূল লক্ষ্য নিয়ে কিছু কথা বলেছিলাম। আমি বারবার সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছিলাম, একটা বিশেষ লক্ষ্যকে সামনে রেখে এবং আমাদের একটা উদ্দেশ্য সফল করার জন্য আমরা যে ঘর ছেড়ে বের হয়ে এই দূরের নির্জন জায়গায় এক হয়েছি, সেটা আমাদের চলার পথকে অনেক বেশি সহজ করে দিয়েছে। আমি কিছুটা কৌতুকের ভংগিতে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলাম, যদি আমরা সত্যিই জিততে পারি, তবে এই জায়গা এবং আমাদের এই মিলনমেলা সার্থক হবে এবং এই সময়টা একটা ইতিহাস হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা যদি আমাদের এই উদ্দেশ্য পূরণের দিকে পা বাড়াতে না পারি, তাহলে সোফি আর আমাকে নিস্প্রাণভাবে এই সপ্তাহের শেষ দিন দুটি কাটাতে হবে।

আমার কথা শেষ করার সময় আমি সবার উদ্দেশ্যে খুবই সহজ কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন করেছিলাম। আমি সবাইকে এক এক করে বলতে বলেছিলাম, ‘তুমি কেন এখানে এসেছ?’

এক এক করে সবাই তাদের নিজেদের কথা বলতে শুরু করেছিল এবং তাদের সবার কথাগুলোই ছিল কানাডার জনগণের কথা। কেউ কেউ আবার নিজের জীবনের কথা বলেছিল। মিসিসাগার সম্ভাবনাময়ী এমপি যে ২০১১ সালের নির্বাচনে খুবই অল্পের জন্য হেরে গিয়েছিল, সেই নাভদ্বীপ বেইনস বলেছিল, কানাডা কিভাবে তার পরিবারকে সুন্দরভাবে বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছে। সেই সাথে সে কিছুটা আংশকা নিয়ে আরও বলেছিল, দেশের রাজনীতি যে দিকে মোড় নিচ্ছে তাতে তার পরবর্তী প্রজন্ম সেই সব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। অন্যরা বিশেষ কিছু নীতির ব্যাপারে নিজেদের মতামত জানিয়েছিল। সেখানে উপস্থিত সবার মধ্যে কেউ অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা, শিক্ষা, প্রাকৃতিক সম্পদ, পরিবেশ পরিবর্তন এবং অভিবাসন ও বৈচিত্রতার মত বিষয় নিয়ে কথা বলেছিল। এগুলো ছাড়াও অনেকে এখানে আসার ব্যাপারে নিজেদের প্রত্যাশার কথা জানিয়েছিল। আমার পাপিনিউ সংসদীয় এলাকার প্রেসিডেন্ট ল্যাক কুজিনিউ, যে আমার নেতৃত্বের প্রচারণায় আর্থিক বিষয়াদি দেখভাল করছিল, সে বলেছিল, সে মনে করে কনজারভেটিভদের নেতৃত্বে কানাডা দিন দিন একটা খারাপ রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে পড়ছে। কানাডার জাতীয় আলোচনার ক্ষেত্রে কুইবেকের কেউ অংশ নিতে পারছে না, অর্থাৎ আমাদের পার্টি থেকে পার্লামেন্টে কেউ অংশ নিতে না পারায় সে দুঃখ প্রকাশ করেছিল। সেই সময়ের ব্রিটিশ কলম্বিয়ার অর্থ মন্ত্রীর চীফ অব স্টাফ রিচার্ড ম্যাক্সিমার্টজ আমাদের দলে পশ্চিম থেকে যারা এসেছিল, তাদের চিন্তা চেতনার কথা বলেছিল। সে বলেছিল, আমাদের এই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলনের সময় কানাডার ঐ দিকে কেউই পার্টি নিয়ে এমন কথা বলার ব্যবস্থা করেনি।
সত্যি বলতে কি, সেগুলো ছিল চমৎকারভাবে জেগে ওঠার সব কথাবার্তা।

 

উপস্থিত দর্শকদের সামনে কথা বলছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো

তারপর যখন আমার পালা আসল সবার প্রশ্নের উত্তর দেবার, আমি শুধু শেষ কথা বলেছিলাম এইভাবে, বর্তমান সরকার দেশকে যে পর্যায়ে এনেছে দেশটা কিন্তু তার চেয়ে বেশী সুন্দর আর এ দেশের প্রচুর এক সম্ভাবনা আছে। কানাডার মানুষ যেমন উদার, তেমনি তাদের মনও অনেক বড়। সেই সাথে এই মানুষগুলো হচ্ছে সৎ, কর্মঠ, আশাবাদী আর দয়ালু। আমি আরও বলেছিলাম, আমাদের সামনে অনেক কঠিন সব বিষয় আছে যেগুলোতে আমাদেরকে জয়ী হতে হবে। তবে আমি সবাইকে এও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম, পূর্বে আমরা যে সব কঠিনতর সব সমস্যায় উত্তীর্ণ হয়েছি, সেগুলোর তুলনায় আমাদের সামনের এই সমস্যাগুলো তেমন কিছু নয়। আমি আমার সামনের সব লোকজনকে বলেছিলাম, আমাদের দেশের অনেক ভালো কিছুর মধ্যে সব চেয়ে সুন্দরতম হচ্ছে আমাদের দেশের বৈচিত্রতা, এবং এর ফলে স্মরণ রাখতে হবে যারা কানাডাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য কাজ করবে, তাদেরকে সবার প্রতি অনেক বেশী উদার আর দরদী হতে হবে। তবে আমি সবাইকে এটাও স্মরণ করে দিয়েছিলাম, এই উদারতা কিন্তু শুধু যারা আমাদেরকে সমর্থন করছে তাদের প্রতি নয়, বরং দেশের সব জাতির ও বর্ণের সব মানুষদের প্রতি। মি. হার্পারের পেছনে যেমন অনেক মানুষ আছে, ঠিক তেমনি তার থেকে দূরেও অনেক মানুষ আছে। আমি এও বলেছিলাম, কনজারভেটিভ সরকারের প্রধান ত্রæটি হচ্ছে, তাদের হীনমনস্কতা ও চিন্তার ক্ষুদ্রতা, আর যারা তাদের মত সমর্থন করে না তাদের সাথে কোন রকম সম্পর্ক না রাখা। আমি আবার বলেছিলাম, মি. হার্পারের অনমনীয়তা, বিশ্বাস আর মতানৈক্যতা প্রমাণ করে যে কোন সময় তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। আমি আরও বলেছিলাম, এই বিষয়গুলো কানাডার মানুষের জনজীবনে ইতিমধ্যে যে প্রভাব ফেলেছে, তাতে জনগণ অবশ্যই নতুন মুক্তির দিকে ঝুঁকবে।
সব শেষে আমি সবার উদ্দেশ্যে বলেছিলাম, আমি সবার সামনে হাজির হয়েছি একটিই কারণে, আর তা হচ্ছে, এই সরকারের পরিবর্তন ছাড়া আমাদের আর কোন পথ নেই। আমি শুধু তখন চেয়েছিলাম, হয় আমাদেরকে অথবা আমাদের পার্টিকে এই কাজটা করার জন্য কঠিনভাবে দাঁড়াতে হবে। (চলবে)