সোনা কান্তি বড়ুয়া : হিংসা উন্মত্ত সমাজে গৌতমবুদ্ধের মানবতাবাদ! সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি তত্তে¡র মর্মভেদী করুনাণাঘণ গৌতমবুদ্ধ মানুষের মঙ্গলের জন্যে সা¤প্রদায়িক সম্প্রীতির সমৃদ্ধ সাধনে “অহিংসা পরম ধর্ম” প্রচার করে সমগ্র মানব জাতির সর্বাঙ্গীন মঙ্গল সাধন করেছিলেন! বৌদ্ধ কাহিনী অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা নাটক (১) নটীর পূজা (২) শ্যামা (৩) চন্ডালিকা (৪) মালিনী (৫) রাজা (৬) অচলায়তন ও (৭) গুরু।
বুদ্ধপূর্ণিমা উপলক্ষে গৌতমবুদ্ধকে সশ্রদ্ধ বন্দনা নিবেদনের নৈবেদ্য সাঁজিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী” গানটি (বুদ্ধ জন্মোৎসব ২১শে ফাল্গুন, ১৩১৩ বঙ্গাব্দ) মহামানব বুদ্ধের নামে উৎসর্গ করেছিলেন,
“হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বি নিত্য নিঠুর দ্ব›দ্ব
ঘোর কুটিল পন্থ তার লোভ জটিল বন্ধ।
নতুন তব জন্ম লাগি কাতর যত প্রাণী
কর ত্রান মহাপ্রাণ আন অমৃত বাণী
বিকশিত করো প্রেম প্রদ্ম চিরমধু নিষ্যন্দ
শান্ত হে মুক্ত হে, হে অনন্ত পুণ্য
করুণাঘন ধরণীতল করহ কলংক শূন্য
এস দানবীর দাও ত্যাগ কঠিন দীক্ষা
মহাভিক্ষু লও সবার অহংকার ভিক্ষা।
দেশ দেশ পরিল তিলক রক্ত কলুষ গ্লানি;
তব মঙ্গল শঙ্খ আন, তব দক্ষিণ পাণি
তব শুভ সঙ্গীতরাগ, তব সুন্দর ছন্দ।
শান্ত হে মুক্ত হে, হে অনন্ত পুণ্য
করুনা ঘন ধরনীতল করহ’ কলঙ্ক শূন্য।”
রাজপুত্র সিদ্ধার্থ মনের লোভ দ্বেষ মোহ অহঙ্কারসহ মারসমূহ জয় করে বুদ্ধত্ব লাভ করলেন পরম পূজনীয় গৌতমবুদ্ধ সমগ্র মানবজাতির কল্যাণমিত্র এবং আজ ২৬০০তম পবিত্র বুদ্ধ পূর্ণিমায় বৌদ্ধ জগত জুড়ে বুদ্ধ বন্দনায় জন গণমনে “বুদ্ধং সরনং গচ্ছামি” বিরাজমান। রাজপুত্র সিদ্ধার্থ তাঁর পিতা মহারাজা শুদ্ধোধনের রাজসিংহাসন ত্যাগ করে ছয় বৎসর কঠিন সাধনার (আর্য্য অষ্ঠাঙ্গিক মার্গ ও ৩৭ প্রকার বোধিপাক্ষীয় (বুদ্ধত্বের সাধনা) ধর্মের অনুসরন); পর মহাকরুনা এবং মহাপ্রজ্ঞার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে ‘বুদ্ধ বা মহাজ্ঞানী মহাজন’ হয়েছিলেন।
ভগবানবুদ্ধের ধ্যানে ও বন্দনার আলোকে মানবাধিকার প্রসঙ্গ নিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা চন্ডালিকা নৃত্যনাট্যে চন্ডাল কন্যা চন্ডালিকার অশ্রæ প্রবাহ বিরাজমান। বাংলা ভাষার প্রথম গ্রন্থ ও আদিমতম নিদর্শন চর্যাপদ ও বৌদ্ধ দর্শনে সমৃদ্ধ। বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘মহামানব বুদ্ধ’ শীর্ষক প্রবন্ধে ১৮ মে, ১৯৩৫ সালে কোলকাতায় মহাবোধি সোসাইটির ধর্মরাজিকা বৌদ্ধ বিহার প্রাঙ্গনে মহাবোধি সোসাইটি হলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বলেন,
“আমি যাঁকে আমার অন্তরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে উপলব্ধি করেছি আজ তাঁর জন্মোৎসবে তাঁকে আমার প্রণাম নিবেদন করতে এসেছি, এ কোন বিশেষ অনুষ্ঠানে অর্ঘ নিবেদন নয়, যাঁকে নির্জনে বারংবার অর্ঘ নিবেদন করেছি, সেই আজ নিবেদন করতে উপস্থিত হয়েছি। একদিন বুদ্ধগয়াতে বুদ্ধমন্দির দর্শনে গিয়েছিলুম। সেইদিন এ কথা মনে জেগেছিল – যে সময়ে ভগবানবুদ্ধেও চরণস্পর্শে সমস্ত বসুন্ধরা জেগে ওঠেছিল, গয়াতে যেদিন তিনি স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন, সেদিন কেন আমি জন্মাইনি, কেন সেদিন অনুভব করিনি তাঁকে একান্তভাবে শরীর মন দিয়ে। বর্তমানের পরিধি অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ। এই ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে তাঁকে উপলব্ধি করতে পারা যায় না। কিছুদিন পুর্বে তাঁর জীবন কথায় পড়েছিলুম – সে যুগের কথা। সেদিন ছিল কথায় বিরোধ, চিন্তার বিরোধ। সেদিন তাঁকে খর্ব্ব করতে, তাঁর চরিত্রে কলঙ্ক আরোপ করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু যাঁরা মহাপুরুষ তাঁরা কোন ক্ষুদ্র কালে আসেন না। বর্তমানকে উপলক্ষ করে তাঁরা জন্মান না, মহাযুগের মধ্যে তাঁদের আবির্ভাব, ক্ষুদ্র বর্তমানের মধ্যে তাঁদের আবির্ভাব সম্ভব নয়। সুদূর জাপানের এক মৎস্যজীবি সেদিন এই বোধিদ্রæমমূলে কাতরভাবে তার পাপ বিমোচনের জন্য প্রার্থনা করেছিল, বুদ্ধদেবের চরনতলে লুটিয়ে পড়েছিল, সেদিনও বুঝেছিলুম তাঁর জন্ম ক্ষুদ্র কালের মধ্যে নয়।
যাঁরা প্রতাপবান, বীর্য্যবান তাঁদের সংখ্যা পৃথিবীতে বেশি নয়। অনেক মানব, রাজা, ধনী মানী ও রাষ্ট্রনেতা এ পৃথিবীতে জন্মেছে। কিন্তু সম্পূর্ণ মনুষ্যত্ব নিয়ে কতজন এসেছেন? যিনি সম্পূর্ণ মনুষ্যত্ব নিয়ে এসেছিলেন আবার তাঁকে আহ্বান করছি আজকে এই ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ভারতে, যেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিসম্বাদ, যেখানে ভেদ বিবাদে মানুষ জর্জরিত, সেই ভারতে তিনি আবার আসুন।
কেমন করে কোন ভাষায় বলব, তিনি এই পৃথিবীতে এসেছিলেন, কেমন করে মানুষকে তাঁর বাণী বলেছেন, সেই স্মৃতিটুকু রাখবার জন্য মানুষ অজন্তা গুহা হতে শুরু করে কত না অসাধ্য সাধন করেছে। কিন্তু এর চেয়ে দুঃসাধ্য কাজ হয়েছে সেদিন, যেদিন সম্রাট অশোক তাঁর শিলালিপিতে লিখলেন বুদ্ধের বাণী। অশোক তাঁর বীরত্বের অভিমান, রাজত্বের অভিমান দিয়েছিলেন ধূলায় লুটিয়ে। এতবড় রাজা কখনও পৃথিবীতে এসেছেন কি? কিন্তু সেই রাজাকে রাজাধিরাজ করল কে? সেই গুরু জাতিতে জাতিতে ভেদ, বিসম্বাদ পূর্ণ, হিংসায় ভরপুর ও পঙ্কিল এই জাতিকে কি শুধু রাষ্ট্রনীতি দ্বারা রক্ষা করা যাবে? যিনি এসেছিলেন, তিনি আবার আসুন, উপনিষদের সেই বাণী নিয়ে। উপনিষদ বলছে, “কো ধর্ম্মভূতে দয়া, সমস্ত জীবের প্রতি দয়া, শ্রদ্ধা ও দয়া। শ্রদ্ধয়া দেয়ম, ধিয়া দেয়ম। অশ্রদ্ধা করলে দান করলে সে দান কলুষিত হয়। যেখানে মানুষ মানুষকে অপমান করে, সেখানে কি মানুষ রাষ্ঠ্রনীতিতে সিদ্ধিলাভ করতে পারে?
সত্যের দ্বারা মানবের পূর্ণ প্রকাশ। যিনি আপনার মধ্যে সকল জীবকে দেখেন। তিনি স্বয়ং প্রকাশ। তিনি প্রকাশিত হবেন তাঁর মহিমার মধ্যে। এই জগতের অধিকাংশ মানুষ আজ আচ্ছন্ন, তারা প্রকাশিত হয়নি। সূর্যের আলো প্রবেশের পূর্বেই এই সুন্দরী পৃথিবীর সবকিছু যেমন আচ্ছন্ন ছিল, তেমনিতর আজকের দিনে মানুষ সমস্ত মানুষ আচ্ছন্ন, আপনার ক্ষুদ্র স্বার্থের দ্বারা। যাঁরা সত্যকে পেয়েছেন, তাঁরা প্রকাশ পেয়েছেন। যেমন সূর্য নিজেকে প্রকাশ করে সঙ্গে সঙ্গে এই পৃথিবীকে ও প্রকাশিত করেন, তেমনিতর মহাপুরুষগণ ও ভগবান তথাগত যখন প্রকাশিত হলেন তখন এই ভারতবর্ষ ও প্রকাশিত হ’ল পৃথিবীর কাছে। ভারত তখন আপনার সত্যবাণী প্রকাশ করলে। সকল বর্ণের, সকল ধর্মের ছোট ছোট গন্ডী এড়িয়ে তিনি ছড়িয়ে পড়লন এই মহাবিশ্বে। সমস্ত মরুক্ষেত্রের মধ্যে, দুর্লঙ্ঘ্য পর্বতের উপরে প্রস্তর মূর্তিতে ও স্তপে স্তপে তাঁর বাণী রচিত হ’ল। তিনি মানুষকে বলেছিলেন সত্যকে উপলব্ধি করার জন্যে। কিন্তু সে সত্যকে কি সহজে পাওয়া যায়? তাই মানুষকত দুঃখ দিয়ে এবং কত কৃচ্ছ সাধন করে পর্বত শিখরে, মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠায় তাদের ভক্তিকে চরিতার্থ করেছে। এশিয়া খন্ডে মানবের সে কীর্তি দেখলে বিস্মিত হতে হয়।
কেমন করে কোন ভাষায় বলব, তিনি এই পৃথিবীতে এসেছিলেন, কেমন করে মানুষকে তাঁর বাণী বলেছেন, সেই স্মৃতিটুকু রাখবার জন্য মানুষ অজন্তার গুহা হতে শুরু করে কত না অসাধ্য সাধন করেছে। কিন্তু এর চেয়ে দুঃসাধ্য কাজ হয়েছে সেদিন, যেদিন সম্রাট অশোক তাঁর শিলালিপিতে লিখলেন বুদ্ধের বাণী। অশোক তাঁর বীরত্বের অভিমান, রাজত্বের অভিমান দিয়েছিলেন ধূলায় লুটিয়ে। এতবড় রাজা কখনও পৃথিবীতে এসেছেন কি? কিন্তু সেই রাজাকে রাজাধিরাজ করল কে? সেই গুরু। জাতিতে জাতিতে ভেদ, বিসম্বাদ পূর্ণ, হিংসায় ভরপুর ও পঙ্কিল এই জাতিকে কি শুধু রাষ্ট্রনীতি দ্বারা রক্ষা করা যাবে? যিনি এসেছিলেন, তিনি আবার আসুন, উপনিষদের সেই বাণী নিয়ে। উপনিষদ বলছে, “কো ধর্ম্মভূতে দয়া, সমস্ত জীবের প্রতি দয়া, শ্রদ্ধা ও দয়া। শ্রদ্ধয়া দেয়ম, ধিয়া দেয়ম। অশ্রদ্ধা করে দান করলে সে দান কলুষিত হয়। যেখানে মানুষ মানুষকে অপমান করে, সেখানে কি মানুষ রাষ্ট্রনীতিতে সিদ্ধিলাভ করতে পারে?
দীনতম দীনের দুঃখ বিমোচনের জন্য তিনি সর্বত্যাগ করেছিলেন। সমস্ত মানুষকে একান্তভাবে জেনেছিলেন বলেই তিনি সত্য। তাঁর তপস্যা কি শুধু ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে? ভারতের মাটিতে আজ তাঁর তপস্যা বিলুপ্ত হয়েছে। আমাদের অমূল্য ভান্ডারে দ্বার ভেঙ্গে গেছে। মানুষকে আমরা শ্রদ্ধা করিনে। আমাদের সেই প্রেম, মৈত্রী, করুণা, যা তাঁর দান, সব আমাদের গিয়েছে। তাঁর দানকে রুদ্ধ করেছি মন্দির দ্বার পর্যন্ত।
এ জাতের কখনও মঙ্গল হতে পারে? তাঁকে বলা হয় শূন্যবাদী। তিনি কি শূন্যবাদী? তিনি বললেন, “জীবে দয়া কর। সমস্ত বিশ্বের মূলে কোন অতীন্দ্রীয় শক্তি আছে কি না তা আমি বলব না, তোমরা স্বার্থ থেকে, বন্ধন থেকে মুক্ত হও।” এর চেয়ে বড় আধ্যাত্মতত্ত¡ কি আছে জানি নে। তাঁর মূলকথা, মানুষকে শ্রদ্ধা কর, মানুষকে ক্ষমা কর, অসাধুতা জয় করতে হবে সাধুতা দ্বারা, ক্রোধকে জয় করতে হবে, অক্রোধ দ্বারা। বাসনা, তৃষ্ণা মানবের চরম ধর্ম নয়, এ গুলিতে মানুষ সত্যভ্রষ্ঠ হয়।
ক্ষমা আমরা করতে পারি নে কেন? কারণ ক্ষমা করতে চাইলেই আমাদের অন্তরে অহং উত্তেজিত হয়ে ওঠে। আজকের দিনে সমস্ত সমস্যার মূলে এই বাণীর অভাব, অক্রোধের দ্বারা ক্রোধকে জয় কর। সমস্ত বশ্বে আজ এ বাণী পৌঁছেছে, ইউরোপেও। ইউরোপ আজ বড় দুঃখে পীড়িত, হিংসায় শতধা বিভক্ত। কোন রাষ্ট্রনৈতিক কলে (পন্থায়) শান্তি তৈরী করা যেতে পারে না, ইউরোপ তা বোঝে না। শান্তি ম্যাঞ্চেষ্টারের কল এ তৈরী করা কাপড়ের মত কিছু হতে পারে না, এই যে মানুষের মন নিয়ে খেলা। ইউরোপকে একবার প্রাচ্যেও দিকে তাকাতে হবে, যেখানে সত্য রয়েছে, সেখানে কবে মানুষের দৃষ্ঠি পড়বে? বড় দুঃখে আমরা অনেক দিনের পাপ বহন করে এসেছি, এই মানুষকে অপমান করে। তিনি আমাদের এই ভেদ বুদ্ধি থেকে রক্ষা করুন। পার্লামেন্টারী বিধি নিয়মে, অথবা ভোট নেবার কোন এক কৌশলে অন্তরের মধ্যে বিষ পোষণ করে, কলের (যন্ত্র) সৃষ্ঠ শান্তি আমাদের ধর্ম নয়। ধর্ম হইতেছে জীবে দয়া, মানুষে শ্রদ্ধা। (সৌজন্য, দেশ, কলকাতা, ২ মে, ২০০৫, পৃষ্ঠা নং ৪১;)।”
“মানবের দুঃখ দূর করার জন্য তিনি জন্ম নিয়েছেন। রাজাধিরাজ অথবা রাজপ্রতিভূরুপে তিনি হয়ত প্রভূত সন্মান পেতেন। কিন্তু সে সন্মান কালের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হ’ত। বর্তমানের আদর্শ মানুষকে খর্ব্ব করে। রাষ্ট্র নেতাকে ক্ষুদ্র বর্তমানের মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু মহা পুরুষদেরকে দেখতে গেলে মহাযুগের মধ্য দিয়ে দেখতে হয়, গভীর অতীতের মধ্য দিয়ে যাঁর পাশে বর্তমান সংলগ্ন রয়েছে। তিনি সমস্ত মানবের চিত্তের মধ্যে জন্ম নিয়েছেন, বর্তমানে তাঁর আসন রচনা হচ্ছে, ভাবী কালেও তাঁর আসন রচিত থাকবে।”
প্রাচীন বাংলা বা ভারতের শাসক শ্রেনীর বিরুদ্ধে লেখা রবীন্দ্রনাথের আলোচ্যমান নৃত্যনাট্য আমাদেরকে শোষিত, নিপীড়িত, লাঞ্চিত ও অপমানিতের সমাজ স্মরণ করিয়ে দেয়। সমাজের মুষ্ঠিমেয় শাসক (ব্রাহ্মণ) উচ্চশিখরে বসে সমস্ত ভোগ বিলাস ভোগ করেছে। আর সর্বহারা চন্ডাল জাত সহ ব্রাহ্মণেতর শ্রেণীতে চলছে নিদারুণ অভাব, দারিদ্র, ক্ষুধা, পীড়ন, শোষন, বর্জন, যন্ত্রনা ও মৃত্যু।
সৌরজগত জুড়ে প্রকৃতির অহিংসা পরম ধর্মের মহাবিস্ময়। তবে মানব মনে অতল সাগর বিরাজমান। বুদ্ধ নামক গ্রহে কি মানব জাতির জন্ম? আজ বুদ্ধ পূর্ণিমার আলোকে পৃথিবী উদ্ভাসিত। ১৩৩৮ বঙ্গাব্দে “বৈশাখী পূর্ণিমা” শীর্ষক কবিতায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৌদ্ধকবি হয়ে লিখেছিলেন,
“সকল কলুষ তামস হর’ জয় হোক তব জয়!
‘অমৃক বারি সিঞ্চন কর’ নিখিল ভুবন ময়।
জয় হোক তব জয়!
মহাশান্তি মহাক্ষেম,
মহা পুণ্য, মহা প্রেম!”
জ্ঞানসূর্য উদয় ভাতি
ধ্বংস করুক তিমির রাতি,
‘দুঃসহ দুঃস্বপ্ন ঘাতি’ অপগত কর ভয়।
জয় হোক তব জয়।
মোহ মলিন অতি দুর্দ্দিন, শঙ্কিত চিত্ত পান্থ,
জটিল গহন পথ সঙ্কট সংশয় উদভ্রান্ত।
করুনাময়, মাগি শরন,
দুর্গতিভয় করহ হরণ;
দাও দুঃখ বন্ধ তরণ মুক্তির পরিচয়।
জয় হোক তব জয়।
মহাশান্তি মহাক্ষেম
মহাপুণ্য, মহাপ্রেম।
কেমন করে কোন ভাষায় বলব, তিনি (গৌতমবুদ্ধ) এই পৃথিবীতে এসেছিলেন, কেমন করে মানুষকে তাঁর বাণী বলেছেন, সেই স্মৃতিটুকু রাখবার জন্য মানুষ অজন্তার গুহা হতে শুরু করে কত না অসাধ্য সাধন করেছে। কিন্তু এর চেয়ে দুঃসাধ্য কাজ হয়েছে সেদিন, যেদিন সম্রাট অশোক তাঁর শিলালিপিতে লিখলেন বুদ্ধের বাণী। অশোক তাঁর বীরত্বের অভিমান, রাজত্বের অভিমান দিয়েছিলেন ধূলায় লুটিয়ে। এতবড় রাজা কখনও পৃথিবীতে এসেছেন কি? কিন্তু সেই রাজাকে রাজাধিরাজ করল কে? সেই গুরু। জাতিতে জাতিতে ভেদ, বিসম্বাদ পূর্ণ, হিংসায় ভরপুর ও পঙ্কিল এই জাতিকে কি শুধু রাষ্ঠ্রনীতি দ্বারা রক্ষা করা যাবে? যিনি এসেছিলেন, তিনি আবার আসুন, উপনিষদের সেই বাণী নিয়ে। উপনিষদ বলছে, “কো ধর্ম্মভূতে দয়া, সমস্ত জীবের প্রতি দয়া, শ্রদ্ধা ও দয়া। শ্রদ্ধয়া দেয়ম, ধিয়া দেয়ম। অশ্রদ্ধা করে দান করলে সে দান কলুষিত হয়। যেখানে মানুষ মানুষকে অপমান করে, সেখানে কি মানুষ রাষ্ঠ্রনীতিতে সিদ্ধিলাভ করতে পারে?”
প্রসঙ্গত: মানব জাতির তৃষ্ণা মেটানোর জন্যে জল নিতান্ত প্রয়োজন। মানব জাতির ধর্মীয় তৃষ্ণা মেটাতে বিভিন্ন ধর্ম বিরাজমান। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লেখা ‘চন্ডালিকা’ শীর্ষক নৃত্যনাট্যে বলেছেন, “আমি যে মানব, তুমি ও সেই মানব। যেই দেবতা বা ব্রাহ্মণ জাতিভেদ প্রথার মাধ্যমে মেহনতি মানব সমাজকে অন্ধকারে রাখেন আমি তাঁর পূজা করি না।” মানবতা এবং হিন্দুধর্মকে অপব্যবহার করে মানুষ মানুষকে চন্ডাল বানায় কেন? মানুষ মানুষের আত্মীয় স্বজন। মানুষ মানুষের রক্ষার জন্যে। মানুষ হয়ে মানুষকে হিংসা করা অপরাধ। বাঙালি আজ দেশে বিদেশে রবীন্দ্রনাথের ‘চন্ডালিকা’ পড়ে মানবতার সাধনা আলোচনায় বুদ্ধের অহিংসা পরম ধর্ম সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন।
লেখক সোনা কান্তি বড়ুয়া সাবেক সভাপতি, বাংলা সাহিত্য পরিষদ, টরন্টো, কানাডা, খ্যাতিমান ঐতিহাসিক, কথাশিল্পী, বিবিধগ্রন্থ প্রনেতা, প্রবাসী কলামিষ্ঠ, লাইব্রেরীয়ান, থাইল্যান্ডের ব্যঙ্কস্থ বিশ্ববৌদ্ধ সৌভ্রতৃত্ব সঙ্ঘ পত্রিকারসহ সম্পাদক, এবং জাতিসংঘে সাবেক বিশ্ববৌদ্ধ প্রতিনিধি!