মণিজিঞ্জির সান্যাল : মনে পড়ছে ছোটবেলার সেই দিনগুলোর কথা। নবমীর শেষ সন্ধ্যা। মনটা কেঁদে উঠত সব আনন্দ শেষ হয়ে গেল বলে। এখনো করে, এখনো নবমী মানেই বিষাদের করুণ সুর। যেন শেষ বিদায়। ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী কাটিয়ে নবমীর ঘন্টা বাজতেই দেবীর পায়ে প্রণাম করার পালা। বই ছোঁওয়ানো, বিবাহিত মহিলাদের পরস্পরের সিদুঁর পরা, মিষ্টি মুখ। তারপর ঠাকুর ভাসান।

এরপরের দিনই বিজয়া দশমীকে ঘিরে খাওয়া দাওয়ার পর্ব। বেশ কিছু নিয়ম নীতি পালন। পুরুষদের মধ্যে কোলাকুলি। বড়দের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম, ছোটদের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ। তারপরেই তোড়জোড় বাড়িতে নানান স্বাদের মিষ্টি তৈরির প্রস্তুতি। বিশেষ করে মাংসের কিমা দিয়ে তৈরি ঘুগনি। আহা কি অপূর্ব স্বাদ!

কার কার বাড়িতে ঘুগনি হয়েছে চলল ছুটে তার বাড়িতে পাড়ার ছোট বড় ছেলে মেয়েরা। বিশেষ করে ছেলেরা এপাড়া ওপাড়া কোনো পাড়াই বাদ দিত না।
আমার মা’ তো নিজেই দয়ার সাগর। মা কতো যে ঘুগনি বানাতেন। এই পাড়া, ঐ পাড়ার সব ছেলেরা, ‘কাকিমা …’ বলেই ঘরে ঢুকে টুক করে প্রণাম করে হাসি হাসি মুখে বসে পড়ত। মা সেই সাদা সাদা বড় বড় নারকেলের নাড়ু, অসাধারণ গজা আর ঝাল ঝাল মটরের ঘুগনি পরিবেশন করতেন। পাড়ার দাদারা যেই বলত, আহ্ কাকিমা দারুণ, অমনি মা বলতেন, আরো একটু নে, আরো একটু নে।

মা আরো বলতেন, যারা সুন্দর করে প্লেট পরিস্কার করে খায়, তাদের মনে হয় প্রাণ ভরে খাওয়াই। মায়ের প্রতিটি কাজের মধ্যে কতো আর্ট ছিল। কি সুন্দর করে কাচের প্লেটে মা পরিবেশন করতেন। চামচগুলো রাখার মধ্যেও একটা অসম্ভব সৌন্দর্য ছিল।
তখন খাওয়ার কতো ঝামেলাই ছিল আমার। এটা খাব না, ওটা খাব না।এখন কিন্তু ক্ষিধে পেলে নিজে হাতেই সবকিছু খাই। মায়ের মতো করে এখনো একটাও ভাল কিছু রাঁধতে পারলাম কোথায়। ইস আজ মা -বাবা থাকলে চমকে যেতেন নিশ্চয়ই যে আমিও একটু একটু রান্না শিখেছি!

এই দুটো বছর করোনা পরিস্থিতিতে সবকিছু কেমন যেন হয়ে গেল। কতো মানুষকে হারালাম এই দুটো বছরে। উৎসব তো আনন্দের, মনকে ভাল করে দেয়, কিন্তু এই দুটো বছরে আমাদের মনে আতঙ্কের ছোঁয়া। যদিও এই উৎসবকে কেন্দ্র করেই কতো মানুষের জীবিকার আয়োজন। যেমন ঢাকিদের কথাই ভাবা যাক। তারা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে কবে আসবে উৎসবের দিনগুলো। কিন্তু এবারে তাদের অবস্থাও সঙ্কটজনক।
কতো মানুষের কাজ চলে গেছে, কতো প্রিয়জন চলে গেছে এই পৃথিবী থেকে। কতো মানুষ এই উৎসবের দিনগুলোতে জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে অবস্থান করছেন।

এই দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতেই বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে। আর তখুনি মনকে ভাল করতে একটু সাজগোজ করে মুহূর্তগুলোকে আনন্দে ভরিয়ে তুলতে চান অনেকে। পুজোর এই দিনগুলোতে সবাই ছবি তোলেন, আনন্দ করেন, একটু ভাল মন্দ খাবার সবাই ভাগ করে নেন। কিছু সময়ের জন্যে সব বিষাদকে ভুলে যেতে চান।
কেউ কেউ ঘরের মধ্যেই গান, নাচ, রান্না করেন। কেউ বই পড়েন, অনেকে আবার ছেলে মেয়ে স্বামীর সঙ্গে আড্ডা মারেন। মনকে ভাল রাখতে এটুকু তো করতেই হয়। কারণ এই দুর্গোপুজোকে ঘিরেই তো সারা বছরের অপেক্ষা।

আমি কোনো দিনই খুব একটা ভিড়ের মধ্যে পুজো দেখতে যাইনি, ভিড় কোনোদিনই আমার ভাল লাগে না কিন্তু ঘরে বসে চারপাশের উৎসবের যে মেজাজ সেটা আমার ভীষণ প্রিয়। পরিবেশটা এতো সাজো সাজো রবে মুখরিত থাকে যে মনটা আনন্দে ভরে থাকে। চারপাশে ঢাকের আওয়াজ, কাছাকাছি পুজোমন্ডপ থেকে ভেসে আসা গানের সুর, ধূপধূনোর গন্ধে ভরে থাকা আকাশ বাতাস, শিউলির মিষ্টি গন্ধ, আহা মনটা কি যে ভাল লাগে।
মনকে ভাল রাখাটাই তো আমাদের আসল কাজ। নিজের মনকে ভাল রাখা, কাছের বিষন্ন মানুষের মনকে আনন্দে ভরিয়ে রাখতে পারলে নিজেকে খুব আত্মবিশ্বাসী লাগে। আর আমরা মেয়েরাই তো উমা, মানে মা দুর্গা হয়ে পরিবারের হাল ধরে আছি যুগ যুগ ধরে।
নিজেকে উমা ভাবতেই চোখে জল চলে এলো। না এই কথাগুলো সত্যিই আর বলতে ইচ্ছে করছে না। কোন কথা?

ঐ যে মা মেনকা যখন ভাবছেন কালকেই মেয়ে উমা চলে যাবে ছেলে মেয়ে নিয়ে। কারণ সারা বছরে মাত্র তিন দিনের জন্যে উমার বাপের বাড়িতে আসা। সারা বছর উমার মা মেনকা অপেক্ষা করে থাকেন।
মা মেনকা নবমীর এই রাতকে প্রতিবছর কাতর অনুনয় বিনয় করে বলেন,
‘যেও না নবমী নিশি, আজি লয়ে তারাদলে।’
এটাই আপামর বাঙালির মনের কথা। নবমীর দিন এলেই বাঙালি মন কেঁদে ওঠে। আনন্দের মাঝেও বিষাদের বার্তা দিয়ে যায় নবমী নিশি। সারা বছর ধরে যে উৎসবের টানে সবাই অপেক্ষা করে থাকে, তার বিদায় ঘণ্টা বেজে যায় এই নবমী তিথিতেই। তারপরই বিজয়া দশমী। মায়ের আবার মর্ত্যধাম ছেড়ে ফিরে যাওয়া কৈলাসে।
কিন্তু এবছরটা আমার নবমী নিশির জন্যে একটু অন্যরকম কষ্ট হচ্ছে কেন জানি।
তাই বলি …
‘আসছে বছর আবার হবে
আসছে বছর সব ভাল ভাবে হবে ….’
সবাই খুব সাবধানে থাকবেন, যার যেটুকু আছে তাই নিয়েই ভাল থাকবেন এবং আনন্দে থাকবেন।

তবে ছোট থেকেই কষ্ট পেতাম বিসর্জনের দিনটি চলে এলে। সারা বছরের সব আনন্দ কোথায় যেন এক নিমেষে হারিয়ে যায় এই দিনটিতে। চারপাশে কেমন একটা নীরবতা গ্রাস করে সেই নবমীর দিন থেকে। দশমীর সন্ধ্যায় ফাঁকা মন্ডপের সামনে গেলে চারপাশটা অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা। গত তিনদিনের সবটুকু আনন্দ, হাসি, উচ্ছ্বাস কেমন যেন এক লহমায় হারিয়ে যায়, ফিকে হয়ে আসে শরতের সবটুকু ছন্দ, গন্ধ, আনন্দ।

আসলে দশমী’ কথাটির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে বাঙালির আবেগ ও মনখারাপ মিশ্রিত একটি অনুভূতি। দশমী এলেই বাঙালির মনে আসে মায়ের ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা। অপেক্ষায় থাকতে হবে আরও একটা বছর। সাধারনত দুর্গাপুজোর অন্ত হয় দশমীর মাধ্যমেই। এই দিনেই মা দুর্গার প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। তবে এই দিনটিকে বিজয়া দশমী বলার সঠিক অর্থ আজও জানেন না অনেকেই।

তবে ‘আসছে বছর আবার হবে’, এই শব্দগুলো উচ্চারণের সাথে সাথে বুকের ভেতরটা দলা পাকিয়ে আসে কি এক যন্ত্রণায়। ছোট থেকেই অল্পতেই দুচোখ জলে ভরে যেত। কতো কি প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেত। ছোটবেলায় কিছুতেই বোধগম্য হতো না ঠাকুরকে জলে ভাসিয়ে দেবার সাথে সাথে এতো আনন্দ মানুষের মনে কিভাবে আসে? সবাই সবাইকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে।

সবাই যখন ঢাকের তালে তালে নাচতে নাচতে ঠাকুরকে বিসর্জন দিতে নিয়ে যায়,তখন চোখ ফেটে জল আসত আমার, চারদিকে আলোতে আলোতে ঝলমল করে, সবাই বাজি ফাটাতে থাকে আনন্দে, তখন আমার খুব কষ্ট হয়।

আরো অবাক হতাম সিঁদুর খেলা দেখে। সিঁদুর আর লাল আবিরের মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পেতাম না আমি। রং খেলার সময় রং খেলা দেখেছি, দুগালে আবির মাখানো দেখেছি বসন্তকালে। দুটো বিষয়কে মেলাতে গিয়ে কোথাও যেন বিরাট একটা ধাক্কা খেতাম। মেলাতে কষ্ট হতো; আর বিজয়ার যে ছবিটি আমরা প্রত্যক্ষ করি, তা তো দেবীর চলে যাবার দিন, তাহলে কিসের এতো আনন্দ? এর মধ্যে কোথায় বিজয়?
বিষাদের বদলে কেন ‘শুভ বিজয়া’ বলা হয়?
প্রচলিত প্রথানুযায়ী ‘বিজয়া’ শ্রীরামচন্দ্রের বিজয়ের দিন।
শরৎকালে সীতাকে উদ্ধারের জন্য শ্রীরামচন্দ্র অকালবোধন করে দেবীর পুজো করেছিলেন। দেবীর আর্শীবাদে রাবণকে নিহত করে সীতাকে উদ্ধার করেছিলেন। তাই প্রচলিত প্রথানুযায়ী “বিজয়া” শ্রীরামচন্দ্রের বিজয়ের দিন। বিজয় উৎসব থেকে ‘বিজয়া’ কথাটি এসেছে। অশুভের পরাজয়ে শুভের উদ্ভব এদিন থেকেই। সেকারণে বিজয়া আনন্দের দিন, উৎসবের দিন প্রীতি ও স¤প্রীতির দিন।
আমিও জানাই আমার বন্ধুদের বিজয়ার আন্তরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও শুভ কামনা।

মণিজিঞ্জির সান্যাল : শিলিগুড়ি, দার্জিলিং
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ