ফরিদ আহমেদ : বিপ্লবী নেতাদের কর্মকাণ্ড সাধারণত বৈপ্লবিক হয়ে থাকে। এটাই স্বাভাবিক। বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড করতে না পারলে লোকে তাদের বিপ্লবী বলবেই বা কেনো? যে যতো বড় বড় বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড করে, সে ততো বড় বিপ্লবী হিসাবে তাঁর ভক্ত এবং সমর্থকদের কাছ থেকে স্বীকৃতি পায়। চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুং ছিলেন এমনই একজন বিরাট বিপ্লবী। আমাদের দেশে একসময় তাঁর অসংখ্য ভক্ত ছিলো। এখনো হয়তো আছে। চেয়ারম্যান মাও এর প্রতি ভক্তির কারণে তারা নিজেরাও হয়ে উঠেছিলো একেকজন পাতি বিপ্লবী।
চেয়ারম্যান মাও বিশ্বাস করতেন যে বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উত্স। বন্দুকেই বিপ্লব থাকে। এই বন্দুক যার কাছে থাকবে, সেই-ই বিপ্লব ঘটাতে পারবে। এর জন্য জনগণকে প্রস্তুত করার কোনো প্রয়োজন নেই। বিপ্লব কী, সমাজতন্ত্র কী, সে সব বিষয়ে তাদের জ্ঞান বাড়ানোর দরকার নেই। ও দিয়ে কী হয়, কেনো তা প্রয়োজন, সেগুলো তাদের জানার কোনো প্রয়োজন নেই। অযথাই সময় এবং সম্পদ নষ্ট তাতে। তার চেয়ে কিছু বন্দুক জোগাড় করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নিলে, জনগণ এমনিতেই বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে যাবে। বিপ্লবের সব সুফলও ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে। জনতা হচ্ছে গিনিপিগ। গিনিপিগ জনতার এতো কিছু জানার প্রয়োজন নেই। বিপ্লবীরা বিপ্লব করে তাদের মুখে অন্ন তুলে দেবে, শরীরে বস্ত্র দেবে, মাথার উপরে ছাদ দেবে। সব দায়িত্ব তাদের। গিনিপিগদের দায়িত্ব হচ্ছে একটাই। বিপ্লবীদের নামে জয়ধ্বনি করা।
তাঁর এই সহজ সরল চিন্তার বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শুধু চীনেই কাজ করেনি, বাংলাদেশেও প্রায় তা সফল হতে যাচ্ছিলো। সত্তরের দশকে তাঁর অনুসারীরা সেনানিবাস থেকে ট্যাংক, কামান, বন্দুক নিয়ে বের হয়ে এসে একাধিকবার বিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা চালিয়েছিলো। ট্যাংকে বসে থাকা জলপাইওয়ালারা হতো সিপাহী আর ট্যাংকের পাশ ঘেঁষে দাড়িয়ে থাকা কৌতূহলী জনগণ হতো জনতা। এই দুই অংশের মিলনে গড়ে উঠতো সিপাহী-জনতার বিপ্লব! কেউ কেউ আবার চোরাই পথে বন্দুক জোগাড় করে খুব-খারাবি, ডাকাতি, রাহাজানিও করেছে। তাদের অনুসারীরা সেগুলোকে অসমাপ্ত বিপ্লব বলে মহিমান্বিত করেছে। সেই সব খুনি ডাকাতদের কাউকে কাউকে বিশাল বিপ্লবী আসনও দেওয়া হয়েছে। তাদের নিয়ে অনেক ব্যালাডও তৈরি করা হয়েছে।
১৯৪৯ সালের শেষের দিকে বন্দুকের জোরে চীনের ক্ষমতা দখল করেছিলেন চেয়ারম্যান মাও। তাঁর এবং তাঁর অনুসারীদের ভাষায় সেটা ছিলো কৃষক শ্রমিকের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। বিপ্লব করে শ্রেণীশত্রু সব ধ্বংস ক্ষমতার সিংহাসনে বসে দেখেন যে সেখানেও শান্তি নেই। বিপ্লব তখনো শেষ হয়নি সব সেক্টরে। এর মধ্যে একটা হচ্ছে হেলথ সেক্টর।
হেলথ সেক্টরে চরম দুরবস্থা চলছে তখন। কলেরা, প্লেগ, ম্যালেরিয়াতে জনজীবন বিপর্যস্ত। মাওয়ের যে স্বপ্ন, একটা কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে চীনকে শিল্প-ভিত্তিক শক্তিশালী সমাজে দ্রæত রূপান্তর করা, সেটাতে বড় এক বাধা এটা। এই বাধা অতিক্রম করার জন্য দ্রæত কিছু করা দরকার। এর জন্য প্রয়োজন ছিলো গণ ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রাম বা স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নত করার মতো প্রোগ্রাম হাতে নেওয়া। কিন্তু, চেয়ারম্যান মাও একজন বিপ্লবী নেতা। এই সব গতানুগতিক রাস্তায় তিনি হাঁটেন না। তাঁর চিন্তাভাবনাও বৈপ্লবিক।
তিনি বিভিন্ন প্রাণীদের দায়ী করলেন জনজীবনের এই বিপর্যয়ের জন্য। যেমন মশা ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়, ইঁদুর ছড়ায় প্লেগ। এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এইসব রোগ থামানো সম্ভব। তিনি অবশ্য এর সাথে মাছিকেও যুক্ত করলেন। ভনভন করে মানুষজনকে বিরক্ত করে এরা। এবং আশ্চর্যজনককে চতুর্থ প্রাণী হিসাবে চড়ুই পাখিকেও যুক্ত করে দিলেন।
চড়ুই পাখিকে জনজীবনের বিপর্যয়ের কারণ হিসাবে যে যুক্তি দেখানো হলো, সেটা হচ্ছে, একটা চড়ুই পাখি বছরের সাড়ে চার কিলোগ্রাম শস্যদানা খেয়ে ফেলে। অথচ এই শস্য মানুষের খাবারের জন্য ব্যবহার করা যেতো চড়ুই পাখি চীনে না থাকলে। হিসাব করে দেখা গেলো যে যে লক্ষ লক্ষ চড়ুই পাখি চীনে আছে, সেগুলোকে মেরে ফেলতে পারলে অতিরিক্ত ষাট হাজার মানুষকে খাওয়ানো সম্ভব।
এটা ছিলো চেয়ারম্যান মাও এর ফোর পেস্ট ক্যাম্পেইন। চার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণীর বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘোষণা করলেন তিনি। যুদ্ধ শুরু হলো ১৯৫৮ সালে। সারা দেশে পোস্টার দিয়ে ছেয়ে ফেলা হলো। সেই সব পোস্টারে ছোট থেকে বড় সকল নাগরিকদের কাছে দাবি করা হলো ওই চার ধরনের প্রাণীদের হত্যা করার জন্য। চড়ুই পাখিকে পুঁজিবাদের সরকারী পাখি হিসাবে ঘোষণা করা হলো। স্কুলের ছেলেমেয়েদের অস্ত্র চালনা শেখানো হলো চড়ুই পাখিদের গুলি করে হত্যা করার জন্য। বাকিদের বলা হলো যার যা কিছু আছে তাই নিয়েই চড়ুই পাখির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে।
জনগণকে যে কোনো কাজে জড়িয়ে ফেলাতে চেয়ারম্যান মাও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। হর্ষোত্ফুল্ল জনতা যার যা আছে, তাই নিয়ে রাস্তায় নেমে এলো। পতাকা উড়িয়ে যুদ্ধে নেমে পড়লো তারা। চড়ুই পাখির বাসা ধ্বংস করা হলো, ডিম ভেঙে দেওয়া হলো। বাসায় বাচ্চা পাখি থাকলে সেগুলোকে হত্যা করা হলো। অনেকেই হাড়িপাতিল নিয়ে বের হয়ে এলো বাইরে। সেগুলোতে বাড়ি দিয়ে দিয়ে বিকট শব্দ তৈরি করতে লাগলো যাতে করে ভয়ার্ত চড়ুই পাখিগুলো আকাশেই থাকে, কোথাও নামার সাহস না পায়। কেউ কেউ বাজাতে লাগলো ড্রাম। উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয়ে অনেক পাখিই ধপাস করে পড়ে মরে যেতে থাকলো। আকাশে উড়া অবস্থাতেও রেহাই ছিলো না। যাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিলো, তারা পাখিদের গুলি করে মারতে থাকলো। শহরের লোকজন বাড়ির ছাদ্গুলোতে অবস্থান নিলো। সেখানে যাতে চড়ুই আশ্রয় নিতে না পারে। গ্রামে কৃষকরা পাহাড়ের পাদদেশে জড়ো হলো, বনভূমির প্রতিটা গাছে উঠে চড়ুইকে তাড়া করতে লাগলো। এর সব যে তারা নিজেদের উত্সাহে করেছিলো এমন নয়। জুন জৌ তাঁর বই ফরগোটেন ভয়েসেস অব মাও’স গ্রেট ফেমিন, ১৯৫৮-১৯৬২ঃ এ্যান ওরাল হিস্ট্রি বইতে বইতে বলেছেন, উত্তর সিচুয়ানের একটা পাহাড়ি গ্রামের কৃষ ওয়েই ডেংগু তাঁকে বলেছে কীভাবে কৃষকদেরকে দিনের পর দিন বাধ্য করা হয়েছিলো চড়ুই ধাওয়া করার জন্য।
সোভিয়েত বিশেষজ্ঞ মিখাইল ক্লচকো চড়ুই পাখির বিরুদ্ধে এই অভিযান শুরু থেকেই দেখেছিলেন। ওই সময় বেইজিং এর একটা হোটেলে ছিলেন তিনি। তিনি খুব ভোরে এক মহিলার ভয়াবহ চিত্কারে জেগে ওঠেন। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখেন হোটেলের পাশে এক বাড়ির ছাদে এক নারী এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। হাতে তার বাঁশের লাঠি। লাঠির মাথায় বড় একটা কাপড় লাগানো। ড্রামের আওয়াজ ভেসে আসছে। ওই নারী উন্মত্তের মতো চিত্কার করছে আর লাঠির মাথায় লাগানো কাপড়কে দোলাচ্ছে। হোটেলের লোকজনও এই ক্যাম্পেইনে যুক্ত হয়ে গেলো। বেলবয় থেকে শুরু করে, মেইড, অফিসার, ইন্টারপ্রিটার সবার এখন এক কাজ, চড়ুই হত্যা করা। বাচ্চারা গুলতি নিয়ে বের হয়ে এলো রাস্তায়। পাখা আছে এমন যে কোনো কিছুই তাদের তখন শত্রু। এতে করে দুর্ঘটনাও যে ঘটেনি এমন না। লোকজন ছাদ থেকে পড়ে গেছে, মই থেকে আছাড় খেয়ে পড়েছে। নানজিং এ এক লোকতো স্কুল বিল্ডিং এর তিন তলা থেকেই পড়ে গিয়েছিলো। অনেকেই আগ্নেয়াস্ত্র নিয়েও নেমেছিলো চড়ুই এর বিরুদ্ধে। সেটাতেও দুর্ঘটনা ঘটে কেউ কেউ আহত হয়েছে।
শুধুমাত্র সাংহাই শহরেই বিপ্লবের প্রথম দিনে দুই লাখ শ্রেণী শত্রুকে হত্যা করেছিলো বিপ্লবী জনতা। বিপ্লবী জনতাকে উত্সাহ দিতে ‘দ্য পিপলস ডেইলি’ লিখেছিলো, ‘যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো যোদ্ধাই ঘরে ফিরবে না।”
সাঁড়াশি আক্রমণে দিশেহারা হয়ে বিদেশি দূতাবাসগুলোতে কিছু চড়ুই পাখি আশ্রয় নিয়েছিলো। সেখানে আশ্রয় নিয়েও রেহাই মেলেনি তাদের। চীন সরকার ওই সবার রিফিউজিদের চীনের হাতে তুলে দেবার জন্য অনুরোধ জানায়। পোলিশ দূতাবাস এই অনুরোধকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো। ফলাফল হয়েছিলো মর্মান্তিক। অসংখ্য লোক ঘিরে ফেলেছিলো পোলিশ দূতাবাস। তাদের হাতে ছিলো বড় বড় ড্রাম। সেই সব ড্রামকে তারা অনবরত বাজিয়ে গিয়েছে পোলিশ দূতাবাসে আশ্রয় নেওয়া চড়ুইগুলো সব মারা না যাওয়া পর্যন্ত।
চার পতঙ্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধে দুঃসাহসী চীনার জয়ী হয়। তাদের কেউ হতাহত না হলেও বিপক্ষের ব্যাপক ক্ষতি করতে সক্ষম হয়েছিলো তারা। ওই যুদ্ধে ইঁদুর নিহত হয়েছিলো একশো পঞ্চাশ কোটি, এক কোটি দশ কিলোগ্রাম মশা মরেছিলো, দশ কোটি কিলোগ্রামের মাছি ধ্বংস হয়েছিলো আর চড়ুই পাখি মারা গিয়েছিলো একশো কোটি। চড়ুই এর বিরুদ্ধে লাল বিপ্লব কিংবা লাল সন্ত্রাস যে সর্বতোভাবে সফল ছিলো সেটা বলাই বাহুল্য।
এই একশো কোটি চড়ুই হত্যা করাতে বিপ্লবী জনতা না যতোটা খুশি হয়েছিলো, তার চেয়ে অনেক বেশি খুশি হয়েছিলো ঘাসফড়িঙেরা। চড়ুই পাখির প্রধান খাদ্য ছিলো ঘাসফড়িঙ। তাদের খাওয়ার আর কেউ নেই, এই খুশিতে ঈদের আনন্দ নেমে আসে তাদের জীবনে। অকাতরে বংশ বৃদ্ধি করতে থাকে তারা। বিশাল চীনের শস্য ক্ষেত্র থেকে এক মুঠো, দ’মুঠো দানা তুলে নিতো চড়ুই পাখিরা, তাদের অনুপস্থিতিতে ঘাসফড়িঙেরা পুরো শস্য ক্ষেত্রটাকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়।
১৯৫৯ সালে পক্ষীবিদ সাও-শিন বোঝাতে সক্ষম হন যে পাখি হত্যা করাটা কতোখানি বোকামিপূর্ণ এবং সর্বনাশা একটা ভাবনা। চার পেস্টের তালিকা থেকে চড়ুই পাখির নাম সরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু, ক্ষতি যা হবার তা তখন হয়েই গিয়েছে। ভয়াবহ এক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় চীনে। শুধু যে চড়ুই হত্যার কারণে সেই দুর্ভিক্ষ হয়েছিলো, তা নয়। তবে, চড়ুই হত্যা একটা প্রধান কারণ ছিলো সেটাতে।
চীনের ওই দুর্ভিক্ষে আনুমানিক দেড় থেকে তিন কোটি মানুষ মারা গিয়েছিলো।
টরন্টো, কানাডা