কবি চৈতন্য নাজমুল-এর প্রকাশিত একমাত্র কবিতার বই হচ্ছে ‘নন্দন অসার’। কাব্যগ্রন্থটি লেখার পেছনের কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ‘জগত ও জীবন পর্যবেক্ষণ এবং নিজস্ব অভিজ্ঞার সংমিশ্রণ-প্রসূত তাড়না ‘নন্দন অসার’ বইটি লিখতে স্পন্দন ও চালিকা শক্তি হিসেবে অনুঘটকের কাজ করেছে। জীবনের আদি ঊষালগ্ন হতেই শক্তি যার বেশি (দৈহিক বা বুদ্ধিবৃত্তি), সে-ই প্রভু হয়ে উঠেছে, আর অহেতুক প্রভুত্বকে টিকিয়ে রাখতে শাসকের আসনে জনগোষ্ঠীকে ঠকানোর এবং অবদমিত করবার যাবতীয় জটিল, কুটিল, হীন স্বার্থবাজ ও আগ্রাসী কৌশল উদ্ভাবন আর তার প্রয়োগ করে এসেছে। ব্যক্তিগত সম্পর্কেও একই চাল মানুষেরা প্রয়োগ করে চলে। যুগের প্রহসনে মিথ্যা, সত্যের মহিমায় কর্তৃত্ব করছে, দুর্নীতিই যেন সু-নীতি আজ! মিথ্যাচারী, বেঈমান, পতিত স্বভাবেরা আজ পরাক্রমশালী, বেপরোয়া! তবুও বলতে হয়, মানুষ বা মানুষরূপী দুরাচারী দুই’ই অমরা, অমৃতের সন্তান। দুই’ই মহাজাগতিক আলো অন্ধকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ। কেউ এগিয়ে নিচ্ছেন, কেউ তাতে কালিমা লেপন করছেন জন্মের সংস্কার অনুযায়ী। ‘ঊর্ধ্ব:’ আর ‘অধ:’ বিবর্তন, শক্তির ‘রুপ’ ও ‘প্রতিরুপ’ হ’য়ে ‘সৃষ্টি’ ও ‘প্রলয়’ ছন্দের ভূমিকায় যেন। মাঝে ‘স্থিতি’ কোন রকম যেন টিকে যাচ্ছে।
অন্ধকার দিয়ে আলোক সরানোর কাজ তেমন সফলতা দেখাতে পারে না। কবি জীবনান্দ দাশ, কবি আবুল হাসান, কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে সরালেও তাঁরা এখনো প্রয়াত ও জীবিত কবি। আত্মঘাতি বাঙালির শুভ বুদ্ধির উদয় হউক। শর্তহীন প্রেম ভক্তি সম্ভূত আলোকিত জীবন পথ মানুষ হিসেবে জন্ম নেবার কেবলই সার্থক কারণ হ’তে পারে।
মনিস রফিক
চৈতন্য নাজমুল তাঁর পেননেম বা সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে নাম। জন্ম সত্তরের দশকে বাংলাদেশের শিল্প সংস্কৃতির শহর খুলনায়। বাবা বিভাগীয় জাজ কোর্টের সরকারি কৌসুলি হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। নাজমুলের সরকারি জেলা স্কুলে মাধ্যমিক শিক্ষালাভ এবং তাঁর সে শহরই জীবনের চেতনাগত মূল কাঠামোর ভিত্তিভূমি। ক্ল্যাসিক্যাল সঙ্গীত ও সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক, পরবর্তীতে ঢাকাতে উচ্চমাধ্যমিক লেখাপড়া শেষ হলে ভারতের বরদা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চাঙ্গ সংগীতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ পাবার দিকে টেনে নিয়ে যায় তাঁকে। একটিমাত্র কবিতার বই ‘নন্দন অসার’ কোলকাতা আন্তর্জাতিক বই মেলাতে ‘চতুরংঙ্গ প্রকাশনা সংস্থা’ থেকে বের হয়। তাঁর মাতুল বংশে স্বয়ং মা, মেজ ভাই কবিতা লেখেন; খালাত ভাই, ‘যে তুমি হরণ করো’, ‘পৃথক পালংক’ এর ক্ষণজন্মা কবি আবুল হাসানের জন্ম।
চৈতন্য নাজমুল টরন্টোতে বসবাস করেন।
এক…
আলো আঁধারের অবিরাম সংঘর্ষণে
ক্লান্ত নয় বিশ্ব চরাচর ব’লেই
জীবন মৃত্যুর কুহক সম্ভব হয়
দৃষ্ট দৃশ্যে, শ্রæতির সীমায়;
আঁধারের মৃত্যুশেল আলোর আগম,
তবু গোধূলি ভোরের বেলা, অস্তে উদয়ে
কোন এক অভেদ্য উন্মেষ
স্নিগ্ধতার অমূল্য আবেশ,
যেমন পৃথ্বীর বিরল সুরভী,—
তোমার একদা বর্ণিল জীবনে… সেই আলো হ’য়ে
প্রবেশনমাত্র দেখি, আপাত মাধুরী ঘ্রাণে অন্ধকার;
জগতের এই মোহ, এই শ্লেষ থেকে
অনাগ্রহে ফিরে যাই,
পুনর্বার পরিমল জন্মান্তরে
ফিরবার তরে।
বাতাসের কান্না
ঝড়ের স্বভাবে ঝড় ওঠে
উঠবে উঠুক,
তবু কিছু শুরু হ’ল, মন্দ কি!
রজনীর বিনম্র শরীরে, তুমি আমি শুয়ে
রাতের দেহের স্বাদ খুঁজে পাই,
রাতের চলার গতি, মৃদু শব্দ
আমাদের আয়ত অর্জন,
রাতের ঝড়ের ক্ষোভ, আর্তনাদ
ঝড়ের বিক্ষুব্ধ আশ্চর্য নিনাদ
জেগে জেগে দেখে যাই তুমি আমি;
তবু এক অক্লান্ত বিরোধ তোমাতে আমাতে,
অনি:শেষ জেগে জেগে
আমাদের প্রণয় সুরভী
বিষিয়েই চলে!……
অসুরীয় দু:সাহস
আমারই পায়ের অতল তলের
অন্ধকারে
অশুভ হায়েনা মূর্খ গর্জনে
আমাকেই, চেতনার সঞ্চয়ন ধনসহ
ছুঁড়ে ফেলে দিতে চায় আস্তাকুঁড়ে
হায় ডাইনী আঁধার, কি অন্যায্য অপকর্মে
শক্তির তমসা বুনে চলো!
অভিনব ক্ষমতা
পতনের বিষবাষ্পে নিমজ্জন হ’লেও
সুনিপুণ যাদু বা দৈবের দানে
তুমি ফের দু’পায়ে দাঁড়াও দৃঢ়;
অন্তর্গত শৃঙ্খলা নিজস্ব ঔষধে
পরম্পরা রক্ষার প্রত্যয়ে
বীজ বুনে চলো অক্লান্ত নিয়মে,–
তবু যার নাম সুখ অথবা দাসত্ব হতে পারে;
নিমেষে পতিত তুমি, তবু
আপন সত্ত্বার শক্তি তেজে দাঁড়াও দু’পায়ে
নিরন্তর, প্রতিবার আশ্চর্য বিস্ময়ে!
সরল রেখায় গড়া বৃত্ত
তোমার আচার রুচি বিশ্বাস উচ্ছ¡াস
বাস্তবিক নারকীয় উৎসের পরিচয়,
তোমার ক্ষণিক মাদক স্পর্শণে
লৌকিক ক্লেদের ঘ্রাণবাহী বিবমিশা
আমাকে পীড়িত করে—
জন্ম দিলো বোধি
লোকোত্তর কাল্পনিক সুষম অমৃত সুরা
কাল থেকে কালান্তরে শ্রæতির বিষয়,—
তোমাকে হাঁতড়ে দেখে, সৃষ্টির অশুচি
সরল বাস্তব ঘেন্না বৃত্তে বৃত্তে একই প্রদাহ
শাশ্বত কাহিনী হ’য়ে ধরা দিলো।
মানবতা ফসিল হলে
মৃত্তিকার স্তরে স্তরে পাললিত যাপিত জীবন
সন্ধানের দ্বিধাহীন প্রজ্ঞার প্রচাপে
রমণীয় মদিরায় ব্যামো জাগে;
একদা ফুলেল পরিতোষে, নারী ছিল
যে সুরভী, অন্তিম মন্থনক্রিয়া
একে একে ভুল হ’লো সব,—
তবুও প্রদীপ্ত যৌবনার ওষ্ঠাধার
ছলনার মাধুরী ক্রীড়ায়
কোন এক অলীক আহ্বান,
চতুরের বোধ বুদ্ধি, শিথিলনে
দৃঢ়বদ্ধ
প্রজন্মের স্তরে স্তরে চাপা পড়ে;
চেতন শরীর-মন ফসিলের মাতা
অজ্ঞাত অখ্যাত ইতিতলে বিস্মৃতির ফল।
অদেখা ও পরিণতি
আমার চেতনালোক নাইবা ফুঁটলো
তোমার অন্ধ গহন নিশীথ আঁধারে;
তোমার দেখার প্রহর সহসা উধাও—
রবে চিরায়ত, আমিও নিশ্চিত জানি
অদেখাই তোমার সাফল্য;
বিচ্ছিন্ন মেরুর অচেনা বাসিন্দা তুমি আমি,
তোমাকে দেখালে আলো
তুমি তাকে অন্ধকার ভাবো!
এভাবে হয় না শোনো চিত্তের প্রসার;
দেহে প্রাণে লেগে থাকা অশুচি প্রাকারে
মেলে না প্রশান্তি সুধা, স্বর্গের সুরভী,
আমার আলোর তৃষ্ণা, আঁধারের… বিপরীত মেধা
কখনো হারায় যদি,
তোমার ভ্রান্তির নিশা ভেঙে যাবে
তখন আমিও নেই, অন্য এক
অশান্ত প্রতীতি
তোমার অঙ্গন।
হৃদয় আকাশ
পৃথ্বীনাথ আজ দু:খী অনাথের মত,
ব্যথাতুর জীবে পরিমল ছায়া মেঘ
শোক বৃষ্টি হ’য়ে অশ্রুর পথে মেলে…!
হৃদয়, চোখ আজ আকাশ আর বৃষ্টি
সঘন আলোড়ন শেষে ঝরণার প্রাণ…!
শ্রদ্ধেয় জননী বনাম রতিসিক্ত রমণী
নীলাম্বরে সেঁটে থাকা চাঁদ, জোছনা ব্যাকুল দেখে
উচ্ছ্বাসে জোয়ারে মেতে
শূণ্যতার ব্যাবধান ভুলে থাকা পাপ;
যেমন জননী জাহ্নবী মাতার সাথে
রতিমদে মুহ্যমান রমণী বা ভার্যা
একায়ত মূর্তি নয়;
একই নিয়ত নারী বিভিন্ন আঙ্গিকে
জোয়ার ভাটার নানবিধ স্রোতে
উদ্ভিন্ন বিচ্ছিন্ন বহু পরিচয়ে;
প্রকৃতি জননীর মত উদার সিথান
মানবিক স্বার্থের উঠানে, দ্বিপীত অঙ্গনে
বরাবর সুস্বাদু প্রসাদ নয়,
আবেগে আবেশে নারী কখনো স্নেহান্ধ
কখনো বা হন্তারক, রক্তে তৃষা তার;
তবুও সৃষ্টির খেলা, বিবর্তন গহীন বিবরে
কখনো ফুলেল তিনি, দানে ধ্যানে ন্যায্য,
কখনো জিঘাংসা রীতি, প্রতারক নটী,
একই সত্তায় নারী,
মীমাংসায় সমাধানে প্রকৃতির মতো
কতনা সহজ, কতনা দ্বিচারী!
ঘাঁটাঘাঁটি
সৃজিত জগত মাঝে কীর্তির পশরা
সবারই আছে,
কখনো তা যাচনার বিপরীত
কখনো পয়মন্ত কাম্য অভিলাষ;
কীর্তির প্রবাহ ধারা শ্রান্তি বা বিষাদে
বিরতি চেনে না ব’লে,—
নরনারী বিলক্ষণ কর্মসূত্রে, কামসূত্রে
আত্মজায় বাঁধা;
অপয়া তবুও ব্যস্ত ধ্বংসের নিশিতে, তাই
শিষ্টাচারে ঘাঁটাঘাঁটি, অধরার খোঁজে
নিজেকে ব্যাপৃত রাখা, মরণ অবধি।
জ্ঞানপাপী
শোন হে সমাজ অধিপতি
তোমার দুষ্কৃতি, কুট বিপরীত রীতি
একদা আমার কাছে অজ্ঞান মনে হতো,
যেন তুমি অজ্ঞতার হেতুবশে
সুকৃতির বহুদূরে থাকো;
বন্ধুর সারল্য নিয়ে তোমার নিলয়ে
বারবার প্রত্যাশার আরাধ্য চেয়েছি,
সুবচন আচার পিরিতি মেলেনি কখনো,
অসহ্য অশুচি ছিলো তোমার নিক্ষেপ;
চৌদিকে ছড়াও তুমি নিন্দার নৈবেদ্য
এবং তোমার অন্ধ, কলংক বিদ্বেষ
প্রেরণার বহুধা উৎস হ’য়ে
আমার চিত্তের বিভা নষ্ট করে
দ্বিধাহীন অবিবেক শক্তি দম্ভে।
এই সব কর্ম কৃতি প্রহেলিকা ব্যথা
তোমার শেয়ানা ফন্দি, দলগত ক্কাথ
আজ আমি বুঝি,
তাই আমি তোমার সরল হাসি থেকে
মেঘের হাসিকে অধিক ভালোবাসি,—
যেহেতু বিদ্যালয় জ্ঞানপীঠ তীর্থধাম থেকে
আয়ত তোমার বিদ্যা, বিদ্যা নয়
জ্ঞানের সঞ্চয়ী পাপে জ্ঞানপাপী তুমি।
সিক্রেট
ঘুম সে তো জীবন ঔষধি
সকলের মতন আমিও তাকে পান ক’রে
চেতনাকে প্রশমিত রাখি,
অগ্রাহ্য আবর্তে নয়,
সুশোভন বিবর্তন দিশা আরাধ্য আমার;
বেঁচে মরে পচনের অনাদৃত সিঁড়ি
যদিবা ভাঙতে হয়,—
আমাকে পাবে না তুমি ভিড়ের প্রান্তরে,
তোমার দেহের পাশে আছি আমি
তবু নেই তোমার অধিত চরাচরে।