কামাল কাদের : কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে এক পাহাড়ী উপত্যকায় বেশ কিছু জায়গা জুড়ে “মাউন্ট ভিউ হসপিটাল এন্ড নার্সিং হোম”। এই হাসপাতালের যৌথ মালিকানায় আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর ডাক্তার আহসানুল্লাহ, মেয়ে ডাক্তার ফাহমিদা শরীফ এবং জামাতা ডাক্তার মোহাম্মদ শরীফ। ডাক্তার শরীফ একজন নামকরা শল্য চিকিৎসক। ঢাকা মেডিকেল কলেজের এম,বি,বি,এস এবং বিলেতের “ফেলো অফ রয়েল কলেজ অফ সার্জন” এর ডিগ্রিধারী। তার স্ত্রী ডাক্তার মিসেস শরীফ “গাইনিতে” বিশেষজ্ঞ। মিস্টার এবং মিসেস শরীফের পরিচয় হয়েছিল মেডিকেল কলেজে ছাত্র থাকার সময়। হাসপাতালটির পাশেই স্টাফ কোয়ার্টার। সেখানেই প্রায় বছর দুই বয়সের এক ছেলে সন্তানকে নিয়ে তাদের সংসার।
আজ ডাক্তার শরীফের অনেক ব্যস্ত সময় কেটেছে। তাই ভীষণ ক্লান্তিবোধ করছেন। রাত্রি অনেক হয়েছে, কিন্তু চোখে ঘুম নাই। শোবার ঘরে ছোট্ট সাজুকে (শাহজাহান) বুকে ধরে স্ত্রী ফাহমিদা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ব্যালকনিতে রাখা একটা চেয়ার নিয়ে বসে পড়লেন। উপরে আকাশের দিকে তাকালেন, আকাশে কোনো মেঘ নেই। অতবড় আকাশটায় তারায় তারায় ঝলমল করছে। তারাগুলি যেন এক একটা হীরের টুকরো। মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীটা হাসির বন্যায় প্লাবিত হয়ে গেছে। আজ সে রীতিমতো ধনী লোক, টাকা-পয়সার কোনো অভাব নেই, সমাজে একজন গুণী ব্যক্তি। অবশ্য তার এই বর্তমান অবস্থায় পৌঁছাতে তাকে অনেক কাট খড় পোড়াতে হয়েছিল। কেন জানি আজ স্মৃতির মণিকোঠায় তার পিছনের জীবনের জমানো নানা ঘটনা আবির্ভূত হতে শুরু করলো। এক কাপ কফি বানিয়ে ব্যালকনিতে থাকা চেয়ারটাতে বসলো।
বেশি দিনের কথা নয়। প্রায় এক যুগ, হয়তোবা তার চেয়ে কিছু বেশি। ছাত্র জীবনে কতই না কষ্ট করতে হয়েছিল। যে সময়ে তারই সময় বয়সী ছেলে-মেয়েরা আমুদ-ফুর্তি করে ছাত্র জীবন কাটিয়েছে, সেই সময় থেকে তাকে দারিদ্রের সাথে আলিঙ্গন করে বাস্তবতাকে মেনে নিতে হয়েছিল। অনেক সময় সাধনায় ক্লান্তি এসেছে ,তবু সে হাল ছাড়েনি। নারায়ণগঞ্জে খানপুরে শরীফদের বাসা ছিল। তার বাবা শীতলক্ষ্যা নদীর ওপারে এক জুটমিলের “একাউন্টস ক্লার্ক”। বাবার একার আয়ে কোনোমতে সংসার চলে যায়। মাস শেষে হাতে কোনো সঞ্চয় থাকে না। শরীফ পরিবারের বড় সন্তান, ছোট দুই বোন। পরিবারের বড় সন্তান হওয়াতে তার দায়িত্বও অনেক বেশি ছিল।
শরীফ নারায়ণগঞ্জের তুলারাম কলেজ থেকে অসামান্য ভালো রেজাল্ট করে ঢাক মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারী পড়ার সুযোগ পেলো। কিন্তু তাদের আর্থিক অবস্থা এত শোচনীয় যে, ঢাকা শহরে থেকে ডাক্তারী পড়ার যে খরচ হবে সেটা শরীফের বাবার একেবারেই সাধ্যের বাইরে ছিল। অন্যদিকে, নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রতিদিন মেডিকেল কলেজে যাওয়া-আসা, ট্রান্সপোর্ট খরচ এবং শারীরিকভাবে যে ধকল যাবে, সে কথা ভাবলে শরীফের কাছে বিষয়টা অবাস্তব বলেই মনে হয়েছিল। এটাও সে অনুধাবন করতে পেরেছিলো যে, বাংলাদেশের নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারদের মধ্যে এ রকম আর্থিক অনটনের ঘটনা নুতন কিছুই নয়। শরীফ ভেবে চলছে তাহলে মেডিকেল কলেজের ভর্তির সুযোগটা তো হাতছাড়া হতে চলছে। তার বাবার চোখে ঘুম নেই। শরীফের মানসিক অবস্থাটা যে কতটা প্রকট তা না বলাই ভালো।
ভাগ্য একই বলে। শরীফ যখন এরকম একটা চরম হতাশায় ভুগছে, ঠিক তখনই সে আশার আলো দেখতে পেলো, ঢাকার এক দৈনিক খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে। পুরানো ঢাকার বক্সীবাজার রোডে জনাব ইসহাক সাহেব, তার প্রাইমারি স্কুলের পড়ুয়া দুই ছেলের জন্য জায়গীর শিক্ষক খুঁজছেন। সকাল, সন্ধ্যায় যতটুকু সময় পাওয়া যায় তাদের পড়াতে হবে, বিনিময়ে খাওয়া-থাকা ফ্রি। শরীফ ভাবলো এ আর এমন কি কঠিন কাজ। সে স্থির করলো আজই ইসহাক সাহেবের সাথে দেখা করবে, পাছে সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যায়।
ইসহাক সাহেব ঢাকাইয়া ব্যবসায়ী লোক, উনার ঢাকার সদরঘাট এবং বাংলাবাজার চৌরাস্তার মোড়ে ছোট বাচ্চাদের জন্য একটা খেলনার দোকান আছে, যেখানে দেশী-বিদেশী সব ধরণের খেলনা পাওয়া যায়। তাছাড়া ইসলামপুর রোডে একটা রেডিমেড জুতার দোকানও আছে। নিজে বিশেষ কিছু লেখাপড়া জানেন না, তবে শিক্ষিত লোকদের অনেক কদর করেন। কালবিলম্ব না করে শরীফ ইসহাক সাহেবের বাসায় এসে উনার সাথে দেখা করলো। শরীফের কথা-বার্তায়, আর ব্যবহারে ইসহাক সাহেব শরীফকে পছন্দ করলেন এবং তাকে গৃহ শিক্ষকের কাজটা দিতে আগ্রহ দেখালেন। শরীফ সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাবটা গ্রহণ করে নিল।
বক্সীবাজার ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে খুব একটা দূরে না। একটু কষ্ট হলেও কলেজে হেঁটে যাওয়া যাবে, ফলে বাস ভাড়াটা বেঁচে যাবে। কলেজের বেতনটা বড় মামার কাছ থেকে পাওয়ার বেশ সম্ভবনা আছে। কারণ প্রায় সময়, তিনি শরীফকে জানিয়েছেন যে তার উচ্চ শিক্ষার জন্য যথাযোগ্যভাবে আর্থিক সাহায্য করবেন। এখন রইলো শুধু হাত খরচটা কিভাবে জোগাড় করা যায়। কয়েক সপ্তাহের পর শরীফ তার আর্থিক টানাটানির কথাটা ইসহাক সাহেবের কাছে জানালো। ইসহাক সাহেব কথাটা শুনে বললেন “শরীফ মিয়া, তুমি মনোযোগ দিয়া লেখাপড়া কইরা যাও। দেখি আমি তোমার লেগা কোনো পার্ট-টাইম কাম জোগাড় কইরা দিতে পারি কিনা, তুমি কোনো চিন্তা করবা না। একটা ব্যবস্তা হইয়া যাইবো।”
অবশেষে, ইসহাক সাহেব শরীফকে একটা পার্ট-টাইম কাজ জোগাড় করে দিলেন তারই এক বন্ধুর হোটেলে। কাজটা “উইকেন্ডে”। প্রতি সপ্তাহে শুক্র এবং শনিবার, সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত। কাজটা হোটেলের রিসেপশনিস্টের, প্রয়োজনে হোটেলের রেস্তোরাঁয় ভিড় হলে ওয়েটারের কাজও করতে হতে পারে। সে মনে মনে আওড়ালো, “কাজ তো কাজই, গরীবের আবার পছন্দ অপছন্দ”। শরীফ কোনো দ্বিধা না করে কাজটি নিতে রাজী হয়ে গেলো।
কলেজে ক্লাস শেষ করে, ছাত্র পড়িয়ে, হোটেলে কাজ করে দিন চলে যায়। শরীরের উপর অনেক ধকলও চলছে। বয়েসে তরুণ। এখনই খাটার সময়। শরীফ আশাবাদী, সে একদিন এই কষ্টের উপকার পাবেই। হোটেলে কাজ করার সুবাদে ঢাকা শহরের অন্যান্য নামকরা হোটেলের কর্মচারীদের সাথে পরিচয় হবার সুযোগ হয়। ফলে কোনো হোটেলে বড় ধরণের পার্টি হলে কখনও সখনো “ওয়েটিং” করার ডাক পরে।
ভালো পারিশ্রমিক পায়, যা তার বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতে অনেক উপকারে আসে। একদিনের ঘটনা সে আজও ভুলতে পারিনি। জীবনে কখনো ভুলতেও পারবে না।
একদিন ঢাকার “রেডিসন হোটেলে” তার ডাক পড়লো “ওয়েটিং” করার জন্য। বিরাট সুযোগ। কয়েক বার গুলশান, বনানী যাবার সময় বাইরে থেকে দেখেছে, কখনও ভাবেনি এই হোটেলের ভিতরে ঢুকার সুযোগ হবে। পড়ায় ভীষণ ব্যস্ত থাকার পরও সে কাজটা করার জন্য আগ্রহ দেখায়।
নির্ধারীত সময়ে শরীফ হোটেলে ঢুকে দেখে, সে এক এলাহী ব্যাপার! বিচিত্র আয়োজন। ঢাকা শহরের এক প্রতাপশালী, শিল্পপতি নাতনির প্রথম জন্মবার্ষিকী। আয়োজনে কি নেই। সমস্ত পরিবেশটা মনে হচ্ছে এক স্বপ্নপুরী। দেশের বিত্তবানদের কি পরিমাণ অর্থ-সম্পদ থাকলে এ রকম একটা বিশাল পার্টি দেয়া যায়, সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যেতোনা। বিরাট হল ঘরটির ভিতর নানারকম দামী পোশাকে সজ্জিত অতিথিদের সমাগম। বাদ্যের তালে তালে, সুরের মূর্ছনায় চারিদিক একাকার। ভিডিও লিংক দিয়ে বিরাট স্ক্রিনের ম্যাধমে কানাডা, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশ থেকে জন্মবার্ষিকীর শুভেচ্ছা বিনিময় হচ্ছে। তারি সাথে দেশের নামী-দামী শিল্পীদের নাচ গান পুরোদমে চলছে। রয়েছে মুখরোচক খাবার। প্রয়োজনে যে সমস্ত অতিথির সূরা পানে অভ্যস্ত তাদের কথাও ভুলেননি অতিথি সেবক। শিল্পপতির ছেলে ওয়াসিম যার মেয়ের আজ জন্মদিন, মনে হয় তার সূরা পানটা অনেকটা বেশি হয়ে গিয়েছিলো, তার চলনে বলনে সেটারই আভাস সবার চোখে পড়ছিলো। শরীফ যথারীতি অতিথীদেরকে সার্ভ করে চলছে। হঠাৎ করে দুর্ঘটনাটা ঘটে গেলো। কোথা থেকে ছোট্ট এক মেয়ে লাফাতে লাফাতে শরীফের গায়ের উপর এসে পড়লো। শরীফ ধাক্কার তাল সামলাতে না পেরে ডিনার টেবিলে বসা এক নিমন্ত্রিত অথিতির গায়ে “টি পটের” গরম চা ফেলে দিলো। ভদ্রলোকের কাছে ক্ষমা চাওয়ার আগেই ঝড়ের বেগে ওয়াসিম, শরীফের কাছে এসে তার গালে দিলো এক চড়, আর সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলো “গেট আউট ফ্রম দিস হল ইমেডিয়েটলি।” শরীফ এই অযাচিত ব্যবহারে হতবাক। বিষয়টি আরো জটিল হওয়ার আগেই হেড ওয়েটার জেমস বড়ুয়া হন্ত দন্ত হয়ে শরীফকে সেখান থেকে তার কামরায় নিয়ে আসলো। ঘরের ভিতরে ঢুকেই শরীফ বড়ুয়াকে জিজ্ঞাসা করলো, “দাদা, এটা কি হলো?” বড়ুয়া সহানুভূতি সুরে বললো, “আমি ঘটনাটা সব শুনেছি। তোমার দোষ ছিলো না, ওটা শুধুমাত্র এক্সিডেন্ট ছিল। তুমি মনে কিছু নিও না, আমি ওদের হয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি”।
“আপনি কেন ক্ষমা চাইবেন ওদের হয়ে?” শরীফ জিজ্ঞাসা করলো।
“ওরা অসম্ভব প্রভাবশালী লোক। ওদের সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পরা মানে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনা। তাই আমাকে বন্ধু ভেবে বুদ্ধিমান ছেলের মতো আমার কথা মেনে নাও”।
ডাক্তার শরীফ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে “অতিত” থেকে “বর্তমানে” ফিরে এলো। ব্যালকনির জানালার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলো, দূরের পাহাড়ের চূড়া ঘেসে ভোরের সূর্যের আলো অতি ধীরে ধীরে পরিস্কার আকাশ ভেদ করে উপরের দিকে উঠছে। এখনও সম্পূর্ণ ভোর হয়নি। সূর্যের আলোর ছটায় পাহাড়ে পাদদেশে শিশির ভেজা ঘাস গুলি রুপালি কণার মতো চিক চিক করছে। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য তাকে মোহিত করে তুললো। বেডরুমের দিকে তাকিয়ে দেখলো তাদের একমাত্র সন্তান সাজুকে নিয়ে ফাহমিদা পরম শান্তিতে
এখনো ঘুমাচ্ছে। রান্না ঘরে গিয়ে আরেক কাপ কফি বানিয়ে নিলো। ব্যালকনির চেয়ারয়ে বসে অতি তৃপ্তির সাথে সে কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে চলছে। কফি একেবারে শেষ পর্যায়ে, ঠিক এমন সময়ে ঘরের টেলিফোনটা বেজে উঠলো। জুনিয়র ডাক্তার রায়হান ফোন করেছে। সে জানাল “স্যার, একটা সিরিয়াস কেস এসেছে, হেড ইনজুরি, আপনার সাহায্য ছাড়া আমরা অপারেশন করতে সাহস পাচ্ছি না”। “তুমি অপারেশন থিয়েটারে রোগীকে নিয়ে সব ব্যবস্থা করো, আমি এক্ষনি তৈরী হয়ে আসছি”, শরীফ ডাক্তার রায়হানকে জানালো।
রোগী ছোট্ট এক শিশু। তার বাবা অফুরন্ত সম্পদের মালিক। সমগ্র বাংলাদেশে তার বাড়ি ঘর, জমি জমা, কল কারখানা চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। তিনি নিজেই জানেন না তার ব্যাঙ্ক ব্যালান্স কত। কারণ তিনি জানার প্রয়জন মনে করেন না। ও দিকটা সামাল দেয় তার বিশ্বস্ত একাউন্টেন্ট ডিপার্টমেন্ট। পর পর পাঁচটি মেয়ে হওয়ার পর এই ছেলে সন্তানটি হয়েছে। অনেক মানত করে তাকে পেয়েছেন। বংশের একমাত্র প্রদীপ। এই বিরাট সাম্রাজ্য এক দিন বড় হয়ে তাকেই দেখতে হবে। আজ কোথা থেকে কি হয়ে গেলো, পরিবারটি কোনো অভিশাপে পড়ে গেলো কিনা!
আজ বাচ্চা ছেলেটির প্রথম জন্ম বার্ষিকী ছিল। বার্ষিকী উদযাপন করার জন্য ঢাকা থেকে সমস্ত আত্মীয়স্বজন নিয়ে তারা কক্সবাজার এসেছিলো। কক্সবাজার নামকরা “সিগাল হোটেলে” বেশ কয়েকটি এপার্টমেন্ট নিয়ে বুক করা হয়েছিল অতিথিদের থাকার জন্য। স্মরণ করার মতো জন্মদিন পালন করা হবে। কিন্তু বিধীর বিধান, গুরুতর অঘটন ঘটে গেলো। ছেলেটিকে সুন্দর করে সাজ সজ্জা করিয়ে ছেলের বাবা দোতালা থেকে নিচের তলায় নামছিলো। পা ফসকে ছেলের বাবা ছেলেটিকে নিয়ে ভয়ঙ্কর শব্দ করে একেবারে ভূ-পাতিত। ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে চুপ হয়ে গেলো, তারপর আর কোনো সারা শব্দ নেই। এই অবস্থায় জরুরী চিকিৎসার প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ালো। হোটেল রিসেপশনিস্টের পরামর্শে রোগীকে “মাউন্ট ভিউ হসপিটাল এন্ড নার্সিং হোমে” আনা হলো।
ডাক্তার শরীফ হাসপাতালের লাউঞ্জে পৌঁছাতেই বাচ্চার বাবা শরীফকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো, “ডাক্তার আমার ছেলেকে বাঁচান, আমার বংশের একমাত্র প্রদীপ, ও না বাঁচলে আমার জীবন বৃথা”।
ডাক্তার শরীফ বাচ্চার বাবার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে বললো “প্লিজ, আমাকে ছাড়ুন, আমাকে অপারেশন থিয়েটারে যেতে হবে।”
পরক্ষনেই বাচ্চার বাবার মুখ খানি দেখে চমকে উঠলো। না তার চিনতে কোনো ভুল হয়নি। সে কি ভোলা যায়। এই তো সেই লোক যিনি একদিন তাকে চড় মেরে হোটেল থেকে বের করে দিয়েছিলো। নিয়তির কি পরিহাস!
শরীফ অপারেশন থিয়েটারের দিকে চললো। পথের মাঝে তার মাথায় এলোমেলো ভাবনা ভাসতে শুরু করলো। এটাই তো মোক্ষম সময় সেই অপমানের শোধ নেয়ার । তার একটু ছুরির আঁচড়ে বাচ্চাটির জীবন একনিমেষে শেষ করে দিতে পারে। কেউ জানবে না, কেউ ভাবতেও পারবে না কেন বাচ্চাটি মারা গেলো। সে ধ্বংস করে দিতে পারে বাচ্চার বাবা ওয়াসিমের সেই মিথ্যে অহংকার। অন্য দিকে তার বিবেক জানাল দিলো, সে একজন চিকিৎসক, উপর্যপুরি সে নিজেও একজন বাবা। বাবার ভালোবাসা সন্তানের প্রতি কত অঢেল এবং অফুরন্ত, তার কাছে সে তো অজানা নয়। বাচ্চাটি তো নির্দোষ, সে তো কারোর ক্ষতি করে নাই। তার তো এ পৃথিবীতে বাঁচার অধিকার আছে। শরীফ তার নিপুন হাতে অপারেশন করে রোগীর মস্তিস্ক থেকে রক্ত ক্ষরণ বন্ধ করতে সক্ষম হলো। অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে শরীফ দেখলো দূরে একটা সোফায় বসে এক উৎকণ্ঠিত বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। সে বুঝতে পারলো এ অবস্থা তো তারও হতে পারতো, সঙ্গে সঙ্গে তার নিজের ছেলে সাজুর মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। শরীফকে দেখে ওয়াসিম কাছে আসলো। শরীফ তাকে জানালো অপারেশন সাক্সেসফুল, রোগী বিপদ মুক্ত। এখন শুধু সময়ের প্রয়োজন। ওয়াসিম শরীফের দিকে হাতজোড় করে বললো, “ডাক্তার, তুমি কি আমার ছেলের নুতন জীবন দিয়ে সেদিনের অপমানের প্রতিশোধ নিয়ে আমাকে ঋণী করে রাখলে?”
“নুতন জীবন দেবার আমি কে? আর প্রতিশোধ নেবারই বা আমি কে? আমি তো শুধু একজন সাধারণ পিতার যা কর্তব্য তাই করেছি!” শরীফ নরম সুরে উত্তর দিলো। শেষ
লেখক : নিউবারি পার্ক, ইলফোর্ড, ইংল্যান্ড