শামীম আহসান মহাবুল্লাহ : পুরোহিত, তাঁর কন্ঠস্বরকে উঁচু করে একাধিক বার পড়লেন, “পঞ্চম পুত্র তুয়ান পাই, লাভ করেছে রাজ-উপাধীর উত্তরাধিকার।”
পূণ্য অর্ঘ দালানের সামনে সাথে সাথেই শোনা গেলো একটা গুঞ্জনের শব্দ। আমি ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, আমার আপন জননী মং ফুরেনের পরিতৃপ্তির বিস্তৃত হাসি ভরা মুখমণ্ডল।

অবশ্য ওনার আশেপাশে দাঁড়ানো প্রয়াত সম্রাটের অন্যান্য পত্নীদের মনে ভাব সম্পূর্ণ ভিন্ন, যা প্রকাশিত হচ্ছে তাঁদের মুখমন্ডলের অভিব্যক্তিতে।
ওঁদের কারো কারো অবয়ব একেবারেই ভাবলেশহীন, কারো কারো চেহারায় ফুটে উঠেছে স্বতঃস্ফূর্ত ঈর্ষা।
নৈরাশ্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে তাঁদের সবার চোখের দৃষ্টিতে।
আমার চারজন বৈমাত্রীয় ভাইদের মুখমণ্ডল সাদা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
তুয়ান সুয়েনকে দেখতে পাচ্ছি, সে দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁট কামড়াচ্ছে।
তুয়ান মিং বিড়বিড় করে ঠোঁট নেড়ে কি যেন বলছে।
তুয়ান উ তাকিয়ে আছে বিভ্রান্তি আর ঘৃণা ভরা দৃষ্টি নিয়ে।
শুধুমাত্র তুয়ান ওয়েনকে দেখাচ্ছে ধীর-স্থির, প্রশান্ত অবয়বে।
যদিও, আমার কাছে মনে হচ্ছে, এটা ওর একটা ভণিতা।
কারণ, আমি জানি, ওর মনকষ্ট সব চাইতে বেশি।
তুয়ান ওয়েন মনেপ্রাণে আকাঙ্খা করেছিলো, রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকার।
সে হয়তো একেবারেই ভাবে নাই, আমাদের পিতা, প্রয়াত সম্রাট, তাঁর রেখে যাওয়া সিংহাসনের উত্তরাধিকার দিয়ে যাবেন আমাকে।

আমি ভাবি নাই, কক্ষনো চিন্তাও করি নাই, আমি হঠাত করেই, ঠিক এই ভাবে হয়ে যাবো, সিয়ে দেশের সম্রাট।
অমরত্বের ঔষধ তৈরী করার কাজে নিয়োজিত সেই পুরনো প্রাসাদ ভৃত্য সুন সিন, আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো, “হেমন্ত শেষ হয়ে আসছে, ঘনিয়ে আসছে, সিয়ে দেশের বিপর্যয় কাল।”
আমারও কিন্তু জানতে ইচ্ছা করছে আসলে আমাদের পিতা পরলোকগত সম্রাট, তাঁর উত্তরাধিকার ফরমানে কি লিখিয়ে রেখে গেছেন?
এই মানুষগুলো আমাকে স্বর্ণ খোচিত রাজ শকট, আর রাজ সিংহাসনে বসাতে যাচ্ছে! এর ভাবার্থ কি? কি এর পরিণাম, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমার বয়স এখন মাত্র চৌদ্দ বছর, আমি জানি না, কেনো আমাকেই রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসাবে বেছে নেয়া হয়েছে।

আমার দাদী হুয়াং ফু ফুরেন একটু তাড়াহুড়া করেই আমাকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করলেন। আমি সামনের দিকে কয়েক কদম এগিয়ে গেলাম। অশিতীপর বৃদ্ধ পুরোহিত দুই হাতে উঁচু করে ধরে রেখেছেন কালো চিতার অবয়ব খোচিত আমার পিতার রাজ মুকুট। বয়সের ভারে তিনি ঠিক মতো হাঁটতে পারছেন না, তাঁর শরীর কাঁপছে, তিনি এগিয়ে আসছেন খুব ধীরে ধীরে। তাঁর ঠোঁট ঝুলে পরেছে, মুখ থেকে বেড়িয়ে আসছে লালা।
আমি ভাবছি শুধু আমারই জন্য এই বয়সে তাঁকে এত কষ্ট করতে হচ্ছে! আমি খুব ধীরে খানিকটা খুড়িয়ে খুড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমি নত শিরে থাকা ভঙ্গি বদলালাম, মাথা উঁচু করলাম।

কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা, আমার মাথার ঠিক মাঝখানে বসানো হচ্ছে কালো বর্ণের চিতা বাঘের মুখাবয়ব খোচিত রাজ মুকুট।
আমার খানিকটা লজ্জা লাগছে, খানিকটা বিব্রত বোধ করছি। তাই আমি আমার চোখের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলাম। আমি এখন তাকিয়ে আছি, প্রাসাদ দেয়ালের পাশে থাকা অমরত্বের ঔষধ তৈরীর কাজে ব্যবহৃত চুল্লীটার দিকে। চুল্লীর তদারককারী পুরনো প্রাসাদ ভৃত্য সুন সিন মাটিতে বসে ঝিমাচ্ছে।
প্রয়াত সম্রাট আমার পিতার এই অমরত্বের দাওয়াই খাওয়ার আর কোন প্রয়োজন নাই। যদিও চুল্লীর আগুন এখনও জ্বলছে।
কেনো জ্বলছে এখনও আগুন?
আমি মনে মনে প্রশ্ন করি। কেউই আমার কথা শুনতে পায় না।
কালো রঙের চিতা বাঘের মুখ খোচিত মুকুটের নীচে ঝুলে থাকা ফিতার উপর বসানো টিপ বুতাম আমার পোশাকের সাথে এঁটে দেয়া হয়েছে। মুকুটটা আমার কাছে খুব ভারী মনে হচ্ছে। আমি মাথায় একটা শীতল স্পর্শ অনুভব করছি।
ঠিক এর পরপরই শুনতে পেলাম পূণ্য অর্ঘ দালানের সামনে হওয়া মানুষের ভীড়ের মধ্য থেকে আসা একটা তীক্ষ্ণ চিত্কারের শব্দ।
“সে নয়, সিয়ে দেশের নতুন সম্রাট সে হতে পারে না।”

আমি দেখতে পাচ্ছি, মানুষ জনকে যেন ঘোরের মধ্যে ফেলে দিয়ে, প্রয়াত সম্রাটের সমবেত পত্নীদের মধ্য থেকে একজন মহিলা সামনের দিকে ছুটে আসছেন।
তিনি হচ্ছেন তুয়ান ওয়েন এবং তুয়ান উ-র আপন মা ইয়াং ফুরেন।
তিনি সোজা, খুব দ্রুত এগিয়ে এলেন আমার দিকে। তিনি পাগলের মতো আমার মাথায় থাকা রাজ মুকুটটা টান দিয়ে ছুটিয়ে নিয়ে নিজের বুকের সাথে চেপে জড়িয়ে ধরলেন।
“তুমি মন দিয়ে শুনো; পঞ্চম পুত্র তুয়ান পাই নয়, সিয়ে দেশের নতুন সম্রাট হচ্ছে জেষ্ঠ্য রাজ কুমার তুয়ান ওয়েন।”
ইয়াং ফুরেন কথাগুলো বললেন চিত্কার করে।

তিনি তাঁর জামার ভিতর থেকে টেনে বের করলেন একটা কাগজের পাতা। তিনি বললেন, “প্রয়াত সম্রাটের উত্তরাধিকারের দলিল আমার কাছে আছে। মহামান্য সম্রাট তুয়ান ওয়েন-কে তাঁর উত্তরসূরী হিসেবে মনোনীত করে গেছেন। রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী তুয়ান পাই নয়।

কিছু কিছু মানুষ সম্রাটের উত্তরাধিকার দলিলে লেখা, কিছু শব্দের ভুল ব্যাখা দিচ্ছে। অর্থ বিকৃত করছে।”
পূণ্য অর্ঘ্য দালানের সামনে আবার দেখা দিলো একটা বিভ্রান্তকর অবস্থা।
আমি দেখতে পাচ্ছি, ইয়াং ফুরেন, চিতার মুখ খোচিত কালো মুকুটটা খুব জোড় দিয়ে বুকের সাথে চেপে রেখেছেন।
আমি বললাম, “আপনি ওটা নিতে চাইলে, নিয়ে যান। ক্ষমতা আর রাজত্ব, আমার কাছে কখনওই ভালো লাগে না।”

আমি সুযোগ বুঝে পালিয়ে যেতে চাইলাম।
কিন্তু বাধ সাধলেন আমার দাদী হুয়াং ফু ফুরেন; উনি আমার পথ রোধ করে দাঁড়ালেন।
ইতিমধ্যেই কয়েকজন নিরাপত্তা রক্ষী সৈন্য মঞ্চে উঠে ক্রোধে উন্মত্ত ইয়াং ফুরেনের কাছ থেকে রাজ মুকুটটি ছিনিয়ে নিয়েছে। ওদের মধ্যে একজন নিজের কপালে বাঁধা শোক নির্দেশক রুমালটা খুলে নিয়ে চিত্কাররত ইয়াং ফুরেনের মুখটা শক্ত করে বেঁধে দিলো। এরপর কয়েক জন সৈনিক তাঁকে জাপটে ধরে উঠিয়ে নিয়ে খুব দ্রুত পূণ্য অর্ঘ্য দালানের বিশৃঙ্খল জটলা থেকে বাইরে নিয়ে চলে গেলো।

আমি বিস্মিত হচ্ছি, আমি সত্যিই জানি না, এত সব কিছু কেনো ঘটছে।
আমার অভিষেকের ছয় দিন পর আমার পিতা প্রয়াত সম্রাটের শবাধার প্রাসাদের বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো। চৌকশ সুসজ্জিত সৈন্যদের একটা বড় দল তাম্র কাঠি পাহাড়ের দক্ষিণ ঢালের পাদ দেশে শবাধারটাকে ধীরে ধীরে বয়ে নিয়ে যেতে লাগলো।
ঐ খানেই আছে সিয়ে রাজ পরিবারের পারিবারিক সমাধী ক্ষেত্র। আছে সম্রাটদের সমাধী, আরও আছে খুব অল্প বয়সে প্রয়াত আমার আপন বড় ভাই তুয়ান সিয়েনের কবর।
আমি শব যাত্রার পথে নেমে শেষ বারের মতো আমার পিতা প্রয়াত সম্রাটের প্রতিকৃতির প্রতি মাথা নীচু করে সম্মান প্রদর্শন করলাম।

এক সময় আমার পিতা ছিলেন দুর্দণ্ড প্রতাপের দাম্ভিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী, সিয়ে দেশের সকল নারী-পুরুষ, যুবা-বৃদ্ধ; আকাশ-বাতাস-মাটি সব কিছুর অধীশ্বর হওয়ার দাবীদার মহারাজাধিরাজ।
আর আজ তাঁর দেহটি শায়িত আছে দুই স্তরের নান মু কাঠে তৈরী শবাধারের মধ্যে!
আমার মনে হয়, মৃত্যুটা হচ্ছে একটা ভয়াবহ ব্যপার। আগে আমার মনে হতো, সম্রাটের মৃত্যু নাই।
কিন্তু তিনি যে মারা গেছেন এটা ধ্রুব সত্য। একটা জীর্ণ শীর্ণ পঁচা কাঠ খণ্ডের মতো, তাঁর দেহটা শায়িত আছে নান মু কাঠের পুরু শবাধারের মধ্যে।

আমি লক্ষ্য করেছি, কফিনের ভিতরে ও বাইরে অর্ঘ্য হিসাবে ভরে দেয়া হয়েছে নানা রকম জিনিস। যেমন : সোনার তৈরী, রূপার তৈরী তৈজসপত্র এবং মুক্তা ও নানা রকম রতœ। এর মধ্যে অনেকগুলোই আমার খুবই পছন্দের, যেমন: মনিমুক্তা খোচিত হাতল বিশিষ্ট ক্ষুদ্রাকৃতির একটা তামার তরবারী।
আমার খুব ইচ্ছা করছে, মাটিতে নুয়ে পরে টান দিয়ে ঐ তলোয়ারটা বের করে নিয়ে আসতে।
কিন্তু আমি জানি, আমার ইচ্ছা মতো আমি আমার পিতার শবাধারের ভেতরে দেয়া অর্ঘ্য দ্রব্য নিয়ে যেতে পারি না, এ কাজটা আমার জন্য মোটেও শোভনীয় নয়।

ঘোড়ায় টানা সবগুলো গাড়ি রাজকীয় সমাধী ক্ষেত্রের সামনের নীচু জায়গাটায় থেমে দাঁড়িয়েছে। অপেক্ষা করছে প্রাসাদ ভৃত্যদের জন্য, যারা বয়ে নিয়ে আসছে পরলোকে সম্রাটের সহযাত্রী হিসেবে মনোনীত পত্নী আর উপপত্নীদের লাল রঙের শবাধারগুলো। ওরা আসছে আমাদের অনুসরণ করে, আমাদের পিছনে পিছনে। আমি তাত্ক্ষণিক গুনতে শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলাম, মোট আছে সাতটা লাল কফিন। আমি শুনেছি গতকাল মধ্য রাতে প্রয়াত সম্রাটের পরলোকের সহযাত্রী পত্নী-উপপত্নীদের রেশমের উত্তরীয় গলায় জড়িয়ে শ্বাস রুদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে। রাজ-সমাধীর ভেতর মহামূল্যবান অর্ঘ্যরাশির মধ্যেই এক সাথে রাজ-শবাধারের চার দিকে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে ওঁদের লাল রঙের শবাধারগুলো! ওঁদের সাত জনকে তুলনা করা হচ্ছে সপ্তর্ষী মণ্ডলের সাত ঋষির সাথে, যাঁরা ছিলেন সৌভাগ্যবান। রাজ-শবাধারকে তুলনা করা হচ্ছে চাঁদের সাথে; চাঁদ তো সৌভাগ্যের প্রতীক।

আমি আরও শুনেছি, ইয়াং ফুরেন-কেও করা হয়েছে সমাধীর অর্ঘ্য।
তিনি মরতে চান নাই, তিনি খালি পায়ে প্রাসাদ থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিন জন প্রাসাদ ভৃত্য তাঁকে ধরে নিয়ে আসে, তারপর শক্তি প্রয়োগ করে তাঁর গলায় প্যাঁচানো হয় সাদা রঙের রেশমী উত্তরীয় বস্ত্রের ফাঁস।
সাতটা লাল রঙের শবাধার টেনে রাজ-সমাধীর মধ্যে ঢুকাবার সময়, একটা কফিনের ভিতর থেকে শুনা গেলো, কফিনের ডালায় বাড়ি দেয়ার বিদঘুটে আওয়াজ।
উপস্থিত জনতা ভয় পেয়ে গেছে! ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তাদের অনেকেরই মুখমণ্ডল।
আমি নিজের চোখেই দেখলাম ঐ কফিনের ঢাকনাটা ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে। (চলবে)