শামীম আহসান মহাবুল্লাহ : গল্পের নাম ‘হোং ফেন’, আমি যার ভাবার্থ করেছি ‘লাল প্রসাধনী’! এই গল্পটাকে ছোট গল্পই বলা যায়, তবে গল্পটা আকারে বেশ বড়। গল্পের লেখক সু থোং, এই নামটি লেখকের ছদ্মনাম। ‘লাল প্রসাধনী’ গল্পের প্রেক্ষাপটের সময়কাল হচ্ছে গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশক। গল্পটার শুরু করছি, পাঠকদের অনুরোধ করছি গল্পটা পড়ার জন্য!
(পূর্ব প্রকাশের পর)
তোমার পরিমার্জিত ব্যক্তিত্বের প্রশংসা করেছে সে সব সময়ই। তুমিই বলো, তুমি কতো বড় নির্বোধ, তুমি এমন একটা মানুষ সম্পর্কে কি করে খারাপ কথা বলছো!
ছিউ ই ইচ্ছে মতো যখন তখন দরজার বাইরে আসতে সাহস করে না। এখানে ওর করার মতো কোন কাজ নাই, এমন কর্মহীন জীবনে মূল কাজই যেন ঘুমানো! দিনের বেলা একা আর রাতের বেলা লাও ফু-কে সঙ্গ দিয়ে ঘুমায় সে। লাল রঙ্গ দালান-এ ওর জীবনের বছরের পর বছর চোখের নিমিষেই যেন সময়ের স্রোতের সাথে চলে গেছে। এখন ছিউ ই-র পরিচয় অনিশ্চিত, সে ভাবছে ভবিষ্যতেও কি তাকে পুরুষ মানুষের উপরই নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে, আবার এমনও কি হতে পারে, তাকে নির্ভর করতে হবে বিগত বছরগুলোতে তার সঞ্চয় করে জমানো সোনা-দানার মূল্যবান জিনিস গুলোর উপরই! ছিউ ই বিছানার উপর বসলো। আংটি চুড়ি এবং অন্যান্য জিনিস বিছানার উপর বিছিয়ে রাখলো, পুরো বিছানাটাই ভরে গেছে! সে যাথাক্রমে আলাদা আলাদা ভাবে প্রত্যেকটা জিনিসের মূল্য অনুমান করলো। এই সোনা-রূপার মূল্যবান জিনিসগুলো বিক্রি করে অনায়াসে সে পাঁচ-ছয় বছর চলতে পারবে। এই ব্যাপারটা ছিউ ই-র মনকে সন্তুষ্ট করছে। বিছানার উপর রাখা একটা বালার গায়ে খোদাই করে আঁকা আছে অগ্নি-ময়ূর দানবের প্রতিকৃতি, যা কিনা ছিউ ই-র খুব পছন্দের। সে এই বালাটা হাতের কব্জিতে পরলো। এই সময় হঠাৎ করেই ওর সিয়াও অ-র কথা মনে পড়লো। সিয়াও অ-রও তো এ রকম-ই একটা বালা আছে। কিন্তু সিয়াও অ যাওয়ার সময় তো কোন কিছু-ই নিয়ে যায় নাই। ছিউ ই ভাবতে পারছে না ভবিষ্যতে সিয়াও অ-র জীবনটা কেমন হবে! নারীদের যদি টাকাপয়সার সম্পদ না থাকে তবে ওদেরকে নির্ভর করতেই হবে পুরুষ মানুষদের উপর, কিন্তু পুরুষরা তো নির্ভরযোগ্য নয়!
দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেছে। ছিউ ই উপলব্ধি করছে যে, ফু বেগম সাহেবার ব্যবহার আচার দিন দিন অসহ্য হয়ে উঠছে। কোন এক দিন খাওয়ার টেবিলে খাবার খাওয়ার সময় বেগম সাহেবা দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ছিউ ই-কে জিজ্ঞেস করলেন, কবে তুমি আমাদের বাড়ী ছেড়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছো? ছিউ ই বললো, অতিথিকে কি বের করে দিচ্ছেন? ফু বেগম সাহেবা একটা শীতল হাসি হেসে বললেন, তুমি তো আসলে আমার মেহমান নও! আমি তোমাকে এখানে মাসখানেক থাকতে দিয়েছি, এটাই তো মুখ রক্ষার জন্য যথেষ্ট! ছিউ ই একেবারেই তাড়াহুড়ো না করে ধীরে সুস্থে বললো, আপনি এমন গোমড়া মুখ আমাকে দেখাবেন না! বেগম সাহেবা, আপনি ভয় পাবেন না, যা কিছু বলার আপনি আপনার ছেলেকে গিয়ে বলেন, সে যদি আমাকে চলে যেতে বলে তা হলেই আমি চলে যাবো। ফু বেগম সাহেবার হাতে ধরা ছিলো ভাত খাওয়ার কাঠি, তিনি রাগের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ তা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, তারপর বললেন, তোমার মতো সস্তা মেয়ে মানুষ আমি আগে কখনও দেখি নাই, তুমি কি ভাবছো, আমার ছেলেকে এ কথা বলার সাহস আমার নাই?
এই দিন লাও ফু বাড়ী ফেরার পর ফুল বাগানেই বেগম সাহেবা তার ছেলেকে আটকালেন। ছিউ ই শুনতে পেলো, ফু বেগম সাহেবা কাঁদতে কাঁদতে হট্টগোল করছেন। তিনি লাও ফু-কে নিগ্রিহিত করলেন দীর্ঘ সময় ধরে। ছিউ ই-র কাছে ব্যাপারটা বেশ,হাস্যকর মনে হলো। ছিউ ই কাছে মনে হচ্ছে ফু বেগম সাহেবা একজন অসহায় দুর্ভাগ্যবতী মানুষ, তা না হলে এমন একটা ছোট বিষয় নিয়ে এতো মাতামাতি করার কি আছে, এটা এমন কি কোন তিক্ত ব্যাপর? এমনিতেও ছিউ ই-র ইচ্ছা ছিলো না ফু’দের পরিবারের উপর নির্ভর করে এখানে থেকে যাওয়া? ওর শুধু অপছন্দের বিষয় হচ্ছে ‘বহিষ্কার’! আর চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে সেই বহিষ্কারই আসছে, ওকে যে খুব বেশী অপমান করা হচ্ছে!
লাও ফু উপরের তলায় উঠার পর, ওর চেহারা দেখেই মনে হচ্ছে যে, সে খুবই বিব্রত। ছিউ ই হাসিমুখে ওর চোখের দিকে তাকালো। হাসিমুখেই ওর সাথে কথা বললো। ছিউ ই ভাবছে, দেখতে হবে শেষ পর্যন্ত লাও ফু-র কি হয়! লাও ফু দৌড়ে স্নান ঘরে ঢুকলো গোসল করার জন্য। ছিউ ই বললো, আমি কি তোমার পিঠটা ডলে দিবো? লাও ফু বললো, লাগবে না, আমি নিজেই করছি। ছিউ ই শুনতে পেলো, ভিতর থেকে পানি ছিটকানোর ছলৎ ছলৎ শব্দ আসছে। এর মধ্যেই শোনা গেলো লাও ফু-র অস্পষ্ট গলার আওয়াজ, সে বললো, ছিউ ই, আগামীকাল আমি তোমার জন্য আরেকটা থাকার জায়গা খুঁজে দিবো। ছিউ ই খানিকটা সময়ের জন্য হতবাক হয়ে গেলো। সে খুব দ্রুততার সাথে গোসল খানার দরজা লাথি দিয়ে খুলে ফেললো। ছিউ ই লাও ফু-র দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বললো, নিশ্চিত ভাবেই তুমি একজন অকর্মণ্য পুরুষ, আমি তোমাকে ভুল মূল্যায়ন করেছিলাম। লাও ফু-র মুখটা ছিলো পানির কলের নীচে, সে খানিকটা কুলি করে বললো, আমার কোন উপায় নাই। আর জায়গা বদলালে তো ভালোই হবে, আমাদের মেলামেশাটা হবে আরেকটু সহজ, তাই না? ছিউ ই আর কোন কথা বললো না, সে খুব দ্রæত নিজের জিনিসপত্র গুলো গোছগাছ করে নিলো। সবকিছু নতুন কেনা চামড়ার সুটকেসের মধ্যে ঠেসে ঢুকালো। তারপর সে গিয়ে দাঁড়ালো ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে। চিরুনি দিয়ে মাথার চুল আঁচড়ালো। হালকা প্রসাধনী মাখলো মুখে। লাও ফু গা মুছার তোয়ালে নেয়ার জন্য কোমর বাঁকা করে শরীরটাকে বের করে আনলো গোসলখানার বাইরে, সে বললো, তুমি কি এখন-ই যাবে? তুমি কোথায় যাওয়ার কথা ভাবছো? ছিউ ই বললো, আমি কোথায় যাবো সেটা তোমাকে ভাবতে হবে না। টাকা বের করো! লাও ফু হতবিহ্বল হয়ে বললো, কিসের টাকা? ছিউ ই খটাস করে কাঠের চিরুনিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললো, তুমিই বলো কোন্ টাকা? এতগুলো দিন আমি তোমাকে সঙ্গ দিয়েছি, তুমি কি ভাবছো, এমনি এমনিই মজা করেছো? কাঠের চিরুনিটা মেঝে থেকে তুলে লাও ফু ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখলো। এটা তো কোন ব্যাপারই না, শুধু থাকার জায়গা বদল, তুমি এতো রাগ করছো কেনো? ছিউ ই-র কুঁচকানো ভ্রæ জোড়া উঠানামা করছে, কাঁপছে! সে আবারও লাথি মারলো, এবারের লাথি পড়লো লাও ফু-র পায়ের উপর। তুমি টাকা দাও, আমার সবশেষ খদ্দের হিসেবে, শুধু মাত্র তোমার মতো একটা কুকুরকে সঙ্গ দেয়ার সঙ্গী হিসেবে! লাও ফু বিড়বিড় করে ওর মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করলো। সে বললো, তুমি কতো টাকা চাও, তুমি যা চাও আমি তা-ই তোমাকে দিবো। ছিউ ই হু হু করে কেঁদে উঠলো, সে টাকা গুলো মুট করে ধরে দুমড়ে-মুচড়ে লাও ফু-র মুখের উপর ছুঁড়ে মারলো। ছিউ ই বললো, কে তোমার টাকা নিবে! লাও ফু, আমি কি তোমার কাছ থেকে কখনও টাকা নিয়েছি? তুমি হচ্ছো একটা হৃদয়হীন বস্তু! লাও ফু মুখ সরিয়ে নিয়ে ছিউ ই-র আক্রমণের হাত থেকে বাঁচলো, সে সোফায় বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, তা’হলে তুমি কি চাইছো? যেহেতু এখন এখান থেকে তুমি যেতে চাচ্ছো না, তা’হলে আরও ক’টা দিন থেকে যাও। এরই মধ্যে ছিউ ই চামড়ার সুটকেস হাতে তুলে নিয়েছে, সে তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, আমি পিছপা হচ্ছি না, পিছিয়েও আসছি না! এরপর তাড়াহুড়া করেই সে নীচে নেমে গেলো। বাগানে অকস্মাৎ সে মুখোমুখি হলো ফু বেগম সাহেবার, ফু বেগম সাহেবা এক ধরনের উল্লসিত দৃষ্টিতে ছিউ ই-র চামড়ার সুটকেসের দিকে তাকালেন। ছিউ ই অত্যন্ত অবজ্ঞা আর ঘৃণা ভরে মাটিতে এক দলা থুতু ফেললো, সে বললো আপনি হচ্ছেন ‘অতি-শালীন’ মেয়ে মানুষ, আমি অভিশাপ দিচ্ছি খুব শীঘ্রই মরণ আসবে আপনার! (ক্রমশ)
৯ক.
শুরুতেই ছিউ ই ভেবে ছিলো, সে ওদের নিজেদের বাড়ীতে ফিরে যাবে। যে রিক্সাটায় সে চড়েছে সেটা ইতিমধ্যেই ফং হু এলাকায় পৌঁছিয়েছে। এই এলাকাটাতে কেটেছে তার ছেলে বেলা, সে এখানে ছোট থেকে বড় হয়েছে। বেশ ক’টি শিশু কিশোর মেই যা লু নামের রাস্তাটার উপর খেলা করছে, ওরা সবাই আনন্দ উল্লাসে মেতে আছে। বাসাবাড়ীর বারান্দা থেকে রাস্তার উপরে প্রসারিত লোহার ফ্রেমে ঝুলানো আছে ভেজা কাপড় ও শিশুদের পেশাবের কাঁথা, যেগুলো থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। অনেক দিন পর ওর নাকে আসছে একটা অতিপরিচিত কটু গন্ধ! গরীব এলাকার ময়লা আবর্জনা থেকে এমন গন্ধই পাওয়া যায়। ছিউ ই দেখতে পেলো, ওর অন্ধ বাবা বাড়ীর দরজায় বসে মটরশুঁটির খোসা ছাড়াচ্ছে! ওর ফুফু আম্মা জামার আস্তিন গুটিয়ে লবণ ও ভিনেগারে ডুবানো সব্জী একটা চীনা মাটির গামলায় বিছিয়ে রাখছে। ওদের মাথার উপর আছে প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া এসফল্টের ছাওনির ছাদ। একটা বিড়াল চোখ বুঁজে বসে আরাম করছে ঐ ছাদের উপর। রিক্সাওয়ালা বললো, আপা আপনি কি এখানে নামবেন? ছিউ ই না সূচক মাথা নেড়ে বললো, সামনের দিকে যাও, সোজা সামনের দিকে যাও! নিজের বাবার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ছিউ ই ওর অঙ্গুল থেকে আংটি খুলে ছুঁড়ে মারলো বাবার সামনে থাকা মটরশুঁটির বাটিটাতে। ওর অন্ধ বাবা ঘটনাটা দেখতে পেলো না, বুঝতেও পারলো না! উনি আগের মতোই মটরশুঁটির খোসা ছাড়াতে লাগলেন। এ ব্যাপারটা ছিউ ই-র মনটাকে উদ্বিগ্ন আর ব্যথিত করলো। সে রুমাল দিয়ে নিজের মুখ ঢাকলো, রিক্সাওয়ালাকে বললো, চলো, সামনের দিকে চলো। রিক্সাওয়ালা বললো, আপনি আসলে কোথায় যাবেন? ছিউ ই বললো, তোমাকে যেতে বলেছি, তুমি যাও , তুমি কি ভয় পাচ্ছো, তুমি কি মনে করেছো যে আমি তোমাকে টাকা দিবো না?
রাস্তার পাশে দেখা দিয়েছে সোনালী হলুদ রঙের ফুলে ঢাকা সরিষার ক্ষেত। ইতিমধ্যেই ছিউ ই-র রিক্সাটা পৌঁছিয়েছে শহরতলীর গ্রাম এলাকায়। এখানে চারিদিকে দেখা যাচ্ছে বসন্তকালীন গ্রামীণ বুনো পরিবেশের দৃশ্য! একটা ঘন বাঁশ বনের ভিতরে, ছিউ ই-র নজরে আসলো ‘চাঁদের খেলা কুটির’-এর কালো টালির ছাদ আর সাদা রঙের দেয়াল। ছিউ ই রিক্সার সিটে, বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। সে চাঁদের খেলা কুটিরের দিকে আঙ্গুল তুলে রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলো, ওটা কি কোন মন্দির? রিক্সাওয়ালা উত্তর দিলো যে, ওটা হচ্ছে একটা সন্ন্যাসীনিদের আশ্রম। হঠাৎ করেই ছিউ ই নিজে নিজেই হেসে উঠলো, সে বললো, ওখানেই যাবো, সোজাসাপ্টা ব্যাপার, মাথার চুল কামিয়ে সন্ন্যাসীনি হয়ে যাবো!
ছিউ ই চামড়ার সুটকেসটা তুলে নিয়ে বাঁশ বনের ভিতর দিয়ে চললো। দু’জন গ্রামের মহিলা আগর বাতি জ্বালানোর জন্য চাঁদের খেলা কুটির নামের বৌদ্ধ আশ্রম থেকে বেরিয়ে আসছিলো। ওরা বেশ সন্দেহের দৃষ্টিতে ছিউ ই-র দিকে তাকালো। ওদের মধ্যে এক জন বললো, মনে হচ্ছে আগর বাতি জ্বালাতে আসা এই অতিথিটি খুব ধনী মানুষ! ছিউ ই ঐ দুই কিষাণী মহিলার দিকে তাকিয়ে হাসলো, সে চাঁদের খেলা কুটির আশ্রমের গাঢ় লাল রঙের প্রলেপ মাখা বড় দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। ঘাড় ঘুরিয়ে সে দেখলো কাদামাটির উপরে পড়া নিজের ছায়া। গোধূলির রঙে সন্ধ্যার অল্প আলোয়, ঐ ছায়াটাকে ক্ষীণ আর নরম মনে হচ্ছে। ছিউ ই নিজেই নিজেকে বললো, এখানে, ঠিক এখানেই, মাথার চুল কামিয়ে সন্ন্যাসীনি হয়ে যাবো আমি!
সন্ন্যাসীনি আশ্রমের ভেতরে আগর বাতির ধূয়া কুন্ডলী পাকিয়ে উপরে উঠছে, নিবেদন বেদীর উপরে তার্পিন তেলের প্রদীপ গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে একটু একটু করে উজ্জ্বল আলো দিচ্ছে। ছিউ ই দেখতে পেলো, কুলঙ্গির পিছনে দাঁড়ানো দু’জন সন্নাসীনির নীলাভ সাদা মুখ, তাদের মধ্যে একজন অল্প বয়সের, আরেক জন বয়স্ক মানুষ। তারা উদাসীন নির্বিকার দৃষ্টিতে ছিউ ই-র মুখের দিকে তাকালো। ওদের একজন খুব আনুষ্ঠানিক কায়দায় ছিউ ই-কে উদ্দেশ্য করে বললো, এই হিতৈষী জন কি আগর বাতি জ্বালাতে এসেছেন? ছিউ ই যেন ডুবে যাচ্ছিলো সীমাহীন গহীন অন্ধকারের মধ্যে, অনেক দিন যাবৎ ক্লান্তি আর স্নায়ুবিক চাপে থাকা ওর শরীরটা এই সন্ন্যাসীনি আশ্রমে এসে হঠাৎ করেই শিথিল হয়ে আসলো। সে মেঝেতে থাকা ফরাশের উপর হাঁটু গেড়ে নতজানু হয়ে ঐ দুই জন সন্ন্যাসীনিকে উদ্দেশ্য করে সম্মান দেখিয়ে মাটিতে মাথা ঠুকে বললো, আমাকে আপনারা অনুগ্রহ করে গ্রহণ করুন, আমার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই। দুই সন্নাসীনির কেউ-ই কোন কথা বললো না, ছিউ ই আবার কথা বললো, আমাকে এখানে থাকতে দিন। আমার অনেক টাকা আছে। আমি আপনাদের জীবন যাত্রার খরচ চালাতে পারবো। বয়স্ক সন্ন্যাসীনিটি এই সময়ে হাতে থাকা জপমালাটা চক্রাকারে পুরো একবার গুণে গুণে জপলেন বুদ্ধের নাম! তিনি ধর্ম গ্রন্থ থেকে নেয়া কয়েকটি শ্লোক খুবই দ্রæত আবৃত্তি করলেন। এবার অল্প বয়সী মেয়েটি মুখ ঢেকে লুকিয়ে লুকিয়ে হাসলো। ছিউ ই-র প্রচন্ড রাগ হলো, খানিকটা উগ্রতা নিয়ে ঝাঁকি দিয়ে সে নীচু করে রাখা মাথাটা তুলে তাকালো, ওর চোখের দৃষ্টি আর চেহারায় ফুটে উঠেছে অধৈর্য্য আর নৈরাশ্যের ছাপ। হাত দু’টো দিয়ে সে হাঁটুর নীচে থাকা ফরাশের উপর বাড়ি মারলো কয়েকবার। সে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বললো, তোমরা কি বধির হয়ে গেছো? আমি যে তোমাদের কাছে কাতর অনুনয় করছি, এটা কি তোমারা শুনতে পাচ্ছো না? আমাকে সন্ন্যাসীনি হতে দাও, আমাকে এখানে থাকতে দাও, তোমরা যদি এতো কিছু বলার পরও কোন কথা না বলো তবে, আমি আগুন ধরাবো, পুড়িয়ে দেবো এই সন্ন্যাসীনি আশ্রম, আমরা কেউ-ই রক্ষা পাবো না! (ক্রমশ)
৯খ.
ছিউ ই কখনও ভুলতে পারে নাই চাঁদের খেলা সন্ন্যাসীনি আশ্রম-এ কাটানো প্রথম রাতটাকে। সে একটা চিলে কোঠা ঘরে এক গাদা জ্বালানি কাঠ আর কৃষি কাজের যন্ত্রপাতির মধ্যে একা শুয়েছিলো। ঐ ঘরে জানালার বেদীতে জ্বলছিল একটা মোমবাতি। রাতের বাতাস বাঁশ বনের ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় শন শন শব্দ হচ্ছিলো। (চলবে)