শামীম আহসান মহাবুল্লাহ : গল্পের নাম ‘হোং ফেন’, আমি যার ভাবার্থ করেছি ‘লাল প্রসাধনী’! এই গল্পটাকে ছোট গল্পই বলা যায়, তবে গল্পটা আকারে বেশ বড়। গল্পের লেখক সু থোং, এই নামটি লেখকের ছদ্মনাম। ‘লাল প্রসাধনী’ গল্পের প্রেক্ষাপটের সময়কাল হচ্ছে গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশক। গল্পটার শুরু করছি, পাঠকদের অনুরোধ করছি গল্পটা পড়ার জন্য!

(পূর্ব প্রকাশের পর)

মাহযোং খেলায় রতো সবাই দৌড়ে এলো ছিউ ই-র কাছে, এদের মধ্যে একজন টান দিয়ে ধরলো ছিউ ই-র হাত, সে বললো, তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? কথার জবাবে ছিউ ই বললো, হাঁ আমি পাগল হয়ে গেছি, আমি তো পাগল হয়েছি সেই ষোল বছর বয়স থেকে, যখন থেকে ঢুকেছি এই ব্যাশ্যালয়ে! নীচের তলার সব কিছুই যেন ওটল পাটল হয়ে গেছে, মাসী সিড়ির উপর দাঁড়িয়ে ছুঁড়ে মারলো একটা ছোট থলে। রাগে মাসীর দম বন্ধ হয়ে আসছিলো, চিৎকার করে অভিশাপ দিয়ে মাসী বললো, সব আছে থলের ভিতরে, নিয়ে যাও, ভাগো এখান থেকে, বিদায় হও, ভাগো!

একটু পরেই ছিউ ই থলেটা বগলদাবা করে পান্নার মেঘ মহল্লা ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। রাত এরই মধ্যে গভীর হয়ে গেছে। রাস্তা নিঃস্তব্ধ, মানুষজন নাই। ছিউ ই রাস্তার মাথায় পৌঁছালো, হঠাৎ করেই ওর মন খারাপ হয়ে গেলো, দুঃখ যেন হঠাৎ করেই আক্রমণ করলো ওর হৃদয়টাকে, এমন মন খারাপ করার অনুভ‚তি ছিউ ই-র কাছে একেবারেই অচেনা! সে ঘাড় ফিরিয়ে লাল রঙ্গ দলানটার দিকে তাকালো, সিয়াও অ-র অন্তবাসটা এখনও ঝুলে আছে, দোল খাচ্ছে বাতাসে। সে সিয়াও অ-র অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা করে উদ্বিগ্ন হচ্ছিলো। কিন্তু খুব বেশি উৎকন্ঠার ভার সে বইতে পারছিলো না। এই অল্প ক’টা দিনের মধ্যে সব জিনিসগুলো আগের মতোই আছে, তবে মানুষগুলো সব বদলে গেছে। মেয়েগুলো বহিষ্কৃত হয়েছে লাল রঙ্গ দলান থেকে একেবারে চির তরে! ফ্যাকাশে হলুদ রঙের রাস্তার বাতির আলোয় সে পথ চিনে নিতে পারলো। ছিউ ই সিদ্ধান্ত নিলো যে, শহরের উত্তর অংশের দিকে যাবে সে, লাও ফু-র খোঁজে। যা-ই হোক না কেনো, আশ্রয় নেয়ার স্থল হিসেবে ছিউ ই-র প্রথম পছন্দের ব্যক্তিটি অবশ্যই হবে লাও ফু! (ক্রমশ)

আজ থাকছে গল্পটির পঞ্চম পর্বের প্রথম অংশ।
৫ (ক)
লা ফু বিদ্যুৎ কোম্পানির অবিবাহিত পুরুষদের জন্য বরাদ্দ আবাসিক ভবনে থাকে। ছিউ ই যখন ওখানে পৌঁছালো, তখন সদর দরজার নিরাপত্তা রক্ষী সবে মাত্র লোহার তৈরী কলাপসিবল গেইটটা খুলেছে। নিরাপত্তা রক্ষীটি ছিউ ই-কে বললো, লাও ফু তো ওর বাসায় নাই, সে তো প্রায়ই রাতে বাসয় ফিরে না। ছিউ ই বললো, অসুবিধা নাই, আমি উপরে যাই, উপরে গিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করি। ছিউ ই ভাবলো, আর যাই হোক, এই দারোয়ানের চেয়ে, সে নিজে লাও ফু-কে অনেক বেশি চিনে!

ছিউ ই আসলো লাও ফু-র অ্যাপার্টমেন্টের দরজায়, ধৈর্য্য ধরে দাঁড়িয়ে রইলো দরজার সামনে। এই বিল্ডিং-এ ব্যাচেলার পুরুষরা থাকে। এক জনের পর এক জন পুরুষ মানুষ গামছা আর মগ ও টুথপেষ্ট-টুথব্রাস হাতে নিয়ে দাঁত মাজা ও হাতমুখ ধোয়ার জন্য বাথরুমে ঢুকছিলো। কোন এক ব্যক্তি পানির চৌবাচ্চার সামনে দাঁড়িয়ে ঘাড় ফিরিয়ে বেশ মনোযোগ দিয়েই ছিউ ই-র মুখটা দেখছিলো। একটু পরে সে বললো, খুব সম্ভব পান্নার মেঘ মহল্লা থেকে এসেছে এই মেয়েটা। ছিউ ই শুনেও না শুনার ভান করলো ঐ লোকের মন্তব্য, একটা সিগারেট ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে বের করে, সেটা ধরিয়ে ধীরে ধীরে সিগারেট টানতে লাগলো ছিউ ই। লাও ফু কোথায় বা কোন দিকে গেছে, সেটা নিয়ে সে মনে মনে ভাবতে লাগলো। এমন হতে পারে লাও ফু চায়ের দোকানে গেছে, সকাল বেলার চা খেতে, আবার এমনও হতে পারে সে অন্য পাড়ায় অন্য মেয়েদের সাথে মৌজ করতে গেছে; সে হচ্ছে খাও দাও ফুর্তি করো —– এমনই একটা ফুর্তি বাজ মানুষ!

তুমি কি ভাবে এখানে আসলে? উৎকণ্ঠিত ছিউ ই অপেক্ষা রতো অবস্থায় লাও ফু ফিরে আসলো, পকেট থেকে চাবি বের করে লাও ফু দরজা খুললো, এক হাত দিয়ে ছিউ ই-কে টেনে ভিতরে নিয়ে আসলো সে!

কোথাও তো যাওয়ার জায়গা নাই। ছিউ ই সোফায় গিয়ে বসলো। সে বললো, পিপলস্ লিবারেশন আর্মি পুরো পান্নার মেঘ মহল্লাটাকে সীল গলা করে দিয়েছে, পুরো এক ট্রাক ভর্তি করে সবগুলো মানুষকে টেনে পার্বত্য উপত্যকায় নিয়ে গেছে, আমি ট্রাক থেকে লাফ দিয়ে পড়ে পালিয়েছি।
ঘটনাটা আমি শুনেছি। লাও ফু কপালের ভ্রু কুঁচকে বললো। সে ছিউ ই-র চোখে চোখ রেখে বললো, তাহলে এখন থেকে তুমি কি কাজ করবে? কোথায় থাকবে? কোন কিছুর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছো?

উপরওয়ালা জানেন, কি ভাবে চলবে, আমার কি হবে! গুজব শুনেছি, এখন চলছে খুবই কড়াকড়ি, ওরা এখনও ধরপাকর করছে, মেয়েগুলোকে ধরে নিয়ে কষ্টকর কাজ করাচ্ছে, আমি ঐ গতর খাটানো কাজ করতে পারবো না! আমি ঐ লেবার ক্যাম্পে ফিরে যেতে চাচ্ছি না। অল্প কয়েকটা দিন আমি তোমার এখানে লুকিয়ে থাকবো। লাও ফু, তোমার সাথে তো আমার খানিকটা হলেও প্রেমের সম্পর্ক বরাবরই সব সময় ধরেই আছে, তাই না?

এই টুকু সাহায্য আমি অবশ্যই তোমাকে করবো, লাও ফু ছিউ ই-কে জড়িয়ে ধরে উরুর উপর বসালো, তারপর বললো, কিন্তু এটা তো শুধু পুরুষ মানুষদের থাকার জায়গা, মানুষ বেশি চোখও বেশি, দৃষ্টি ভঙ্গিও বেশি। ভালো হয়, আমি তোমাকে আমার দেশের বাড়ীতে নিয়ে যাই, ওখানে গিয়ে বাইরে থেকে আসা মানুষ জনের কাছে তুমি নিজের পরিচয় দিবে যে, তুমি বাড়ির নতুন বুয়া, বাসায় কাজ করতে এসেছো!

ঠিক আছে, তুমি যে ভাবে চাও, তা-ই ভালো, তা-ই ঠিক। লাও ফু খুব হালকা নরমভাবে ছিউ ই-র ছি ফাও [চীনা নারীদের এক ধরনের পোশাক] টান দিয়ে উঠিয়ে ওর ভিতরের দিকে তাকিয়ে দেখলো, লাও ফু-র মুখ দিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস বেড়িয়ে এলো, সে বললো, ছিউ ই, আমি দেখতে পাচ্ছি, তোমার জান শেষ হয়ে যাবে, তুমি তো আমার আত্মাটাকে চুরি করে নিয়ে গেছো!

ছিউ ই মেঝে লক্ষ্য করে থু করে খানিকটা থুতু ফেললো, সে বললো, মধুর চেয়েও মিষ্টি কথা! আমার সত্যিই খুব ইচ্ছে করছে একটা ছুরি এনে তোমার! এই পুরুষ মানুষটার, বুকটা চিরে হৃদপিণ্ডটা বের করে এনে দেখতে, কেমন ওটার রঙ! এমনও তো হতে পারে, ওটা খুঁচিয়ে বের করলে, বেরিয়ে আসবে কাদা মিশানো কিছু ময়লা, যা দেখে আমি হয়তো মরেই যাবো!

ওরা দু’জনে ‘উসি হুন থুন কোয়ান’ নামের খাবারের দোকান থেকে তাজা অনতন (wontons) এবং বাষ্পায়ীত ধূয়া বের হওয়া চীনা ডাম্পলিং খেলো। খাওয়ার পর রাস্তায় বেরিয়ে একটা রিক্সা ডাকলো। লাও ফু বললো, এখন আমি তোমাকে নিয়ে বাড়ী যাবো। ছিউ ই একটা রেশমের স্কার্ফ দিয়ে তার মুখের অর্ধেকটা ঢেকে নিলো। সে শক্ত করে ধরে রাখলো লাও ফু-র হাতটা —– বিশৃঙ্খল আর বিমর্ষ শহরের রাস্তা অতিক্রম করার সময়। সিনেমা হলে বরাবরের মতোই হলিউড মুভির প্রদর্শনী চলছে। বিজ্ঞাপনের বিল বোর্ডে আঁকা আছে নায়ক-নায়িকাদের চিরন্তন প্রেমের দৃশ্য, যা সব সময়ই সিনেমা হলগুলোতে থাকে। সিনেমার বিজ্ঞাপনের দিকে আঙুল ইশারা করে ছিউ ই বললো, আসলে আমার প্রতি তোমার প্রেমটা খাঁটি নয়, তোমাকে খুশী করার জন্য আমি যে কথা বলছি সেটাও মিথ্যা, ওরা পান্নার মেঘ মহল্লাটা সীল গলা করে দিয়েছে, এটাও পুরোপুরি সত্য নয়!

আমি বিশ্বাস করি না যে, পুরুষ মানুষ ব্যাশ্যালয়ে যাওয়া পছন্দ করবে না! পুরুষ মানুষ ব্যাশ্যালয়ে যাবে-ই! আমাদের মতো মেয়েদের ধরপাকর করে নির্বাসিত করলেই কি পৃথিবীটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে? (ক্রমশ)

আজ থাকছে গল্পটার পঞ্চম পর্বের দ্বিতীয় অংশ :
৫ (খ)
রিক্সাটা হেলে দুলে এসে পৌঁছালো একটা নির্জন রাস্তায়, লাও ফু হলুদ রঙের একটা ছোট বাড়ির দিকে ইশারা করে বললো, ওটাই হচ্ছে আমাদের বাড়ি, আমার আব্বা মৃত্যুর অল্প কিছু দিন আগে এই সম্পত্তিটা কিনেছিলেন। এখন আমার আম্মা একা থাকেন, একজন কাজের লোকও আছে। বাড়িতে অনেকগুলো খালি কামরা আছে। ছিউ ই লাফ দিয়ে রিক্সা থেকে নামলো। সে লাও ফু-কে প্রশ্ন করলো, তোমার আম্মাকে আমি কি বলে ডাকবো? লাও ফু বললো, তাঁকে ফু বেগম সাহেবা বলে সম্বোধন করলেই চলবে। ছিউ ই বললো, হায়! আমি তো মহিলাদের সাথে কাজ-কারবার চলা-ফেরা করে অভ্যস্ত নই। উনি কি আমার পরিচয় জানেন? সবচেয়ে ভালো হতো, তিনিও যদি আমার মতো পেশায় কাজ করে থাকতেন, তা হলে ওনার সাথে থাকতে আমার কোনই সমস্যা হতো না। লাও ফু মুখটা খানিকটা কালো হয়ে গেলো, সে বললো, তুমি উল্টা পাল্টা কথা বলো না। আমার আম্মা একজন সম্ভ্রান্ত মানুষ, তাঁর সাথে দেখা হওয়ার পর কথা বলার সময় অবশ্যই তোমাকে সতর্ক থাকতে হবে। তুমি বলবে, তুমি হচ্ছো আমার সহকর্মী! খবরদার, তোমার আসল পরিচয় জানাইও না। ছিউ ই হাসলো! হেসে হেসে বললো, এটা কঠিন কাজ, আমি —– মানুষটা ধাপ্পাবাজি করতে পারি না।

ফু বেগম সাহেবা ইজি চেয়ারে বসে সোয়েটার বুনছিলেন, ছিউ ই ওনার বড় বড় আর উজ্জ্বল অক্ষি যুগল দেখামাত্র অল্প হলেও আতঙ্কিত হলো! ঘোড়ার মতো টানা লম্বা চোখ বিশিষ্ট এমন মেয়ে মানুষরা সাধারণভাবে বললে, সবা-ই হয় ভয়ঙ্কর মানুষ! সরু চোখের দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আর কিছু কথা বলে বেগম সাহেবা শেষ করলেন ছিউ ই-র সাথে প্রথম সাক্ষাতের আনুষ্ঠানিকতা। ছিউ ই অন্যমনস্ক হয়ে এ দিক সে দিক, ডাইনে বাঁয়ে তাকালো। পরিচয় পর্বের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিউ ই অনুভব করছে যে, ঐ বৃদ্ধা মহিলার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর উস্কানীমূলক বাক্যবান ছিউ ই-কে পরিপূর্ণভাবেই জর্জরিত করতে পেরেছে। মহিলার কথার মধ্যে আছে আঞ্চলিকতার প্রবল টান, যা ছিউ ই-র কানে কাঁটার মতোই খোঁচা দিচ্ছিলো।

নারী গৃহকর্মীটি ছিউ ই-কে উপরের তলার একটা ঘরে নিয়ে গেলো, স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে যে, ঘরটা দীর্ঘ দিন ধরে খালি, কেউ ব্যবহার করছে না, ঘরের আনাচে কানাচে সব জায়গায় আছে ধূলার আস্তরণ। কাজের বুয়াটি বললো, ম্যাম? আপনি প্রথমে ড্রইং রুমে গিয়ে একটু বসেন, আমি একটু পরেই আসছি, ঘর ঝাড়ু দিতে। ছিউ ই না সূচক হাত নেড়ে বললো, তুমি নীচে যাও, একটু পরে আমি নিজেই ঘরটা ঝাড়ু দিয়ে নিবো। ছিউ ই ঘরের জানালাটা টান দিয়ে খুললো, খোলা জানালা দিয়ে নীচের ফুল বাগানের দিকে তাকালো। লাও ফু এবং ফু বেগম সাহেবা তখনও বাগানে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, ছিউ ই শুনতে পেলো, হঠাৎ করেই ফু বেগম সাহেবা গলার স্বর উঁচু করে বললেন, তুমি মিথ্যা কথা বলো না, আমি চোখের দেখায়ই বুঝতে পারছি, ঐ মেয়েটি কি জিনিস! ওটা তো একটা আবর্জনা, তুমি এমন-ই একটা মেয়ে লোককে বাড়ীতে এনে তুলেছো! লোকে কি বলবে? মানুষ যে হাসাহাসি করবে, তোমার কি ভয় হচ্ছে না বিব্রত হওয়ার? ছিউ ই জানে, ইচ্ছা করে তাকে শুনানোর জন্যই কথাগুলো বলা হচ্ছে। কিন্তু সে কোন কিছু গ্রাহ্য করলো না, সে তো ছোট বেলা থেকেই এ রকম স্বভাবের; গ্রাহ্য করে না অন্য লোকে তার সম্পর্কে কি না কি বলে; লোকের বলা কথায় কি আসে যায়! (ক্রমশ)

আজ থাকছে গল্পটার ষষ্ঠ পর্ব :
৬।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সিয়াও অ দিনে ত্রিশটা পাটের বস্তা সেলাই করে। অন্যান্য মেয়েদের অবস্থাও একই, এটা হচ্ছে নিয়ম মাফিক নির্ধারিত কাজ। যে কাজ শেষ না করতে পারলে অনুমতি ছাড়া ছুটি হয় না। প্রতিদিনই এই অল্প বয়সের মেয়েগুলো জমায়েত হয় পুরনো আমলের একটা অস্ত্রাগারের ভিতরে পাটের বস্তা সেলাই করার কাজে। দিনগুলো ওদের কাছে মনে হয় দীর্ঘ আর পীড়াদায়ক। ঐ পাটের বস্তাগুলো সামরিক সরঞ্জাম ভরে নিয়ে যাওয়ার কাজে ব্যবহৃত, প্রতিদিন ট্রাক বোঝাই করে বস্তাগুলো লেবার ক্যাম্প থাকে নিয়ে যাওয়া হয়।

সিয়াও অ-র হাতের ছোট আর চিকন দশটা আঙ্গুল রক্তের ফোসকা পড়ে ভরে গেছে। এক সময় সে সেলাই করার সুই সুতাও ধরে রাখতে পারছিলো না। সে তার সামনে জমে থাকা পাটের বস্তার স্তুপের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মুখ কালো করে চোখের পানি ফেলে বললো, আমি বস্তার মুখ সেলাই এর কাজ শেষ করতে পারবো না। আমার হাতের আঙ্গুলগুলো যেন ছিড়ে পড়ে যাচ্ছে। ওর পাশে দাঁড়ানো মানুষটি ওকে সান্তনা দিয়ে বললো, আরও কয়েকটা দিন গরমের মধ্যে থাকলে, ফোসকাগুলো ফেটে যাবে, ঐ জায়গায় নতুন পুরু চামড়া তৈরী হবে। ঘন পুরু ত্বক তৈরী হয়ে গেলে আর কোন চিন্তা থাকবে না! সবশেষে সবাই-ই চলে গেছে, গুদাম ঘরটা হয়ে গেছে খালি। শুধু বাকী আছে সিয়াও অ একা, সে যেন আটকিয়ে আছে এক গাদা পাটের বস্তার মধ্যে! গোধূলির আলো কমে আঁধার ঘনিয়ে আসছে। সিয়াও অ শুনতে পেলো দরজার বাইরে একজন সৈনিকের পায়ের আওয়াজ, সে হেঁটে আসছিলো ধীর পদক্ষেপে। খুব অধৈয্য আর উদ্বিগ্নতা ভরা কন্ঠঃস্বরে সে চেঁচিয়ে বললো, আট নম্বর, তুমি এখনও বস্তা গুলোর মুখ সেলাই করার কাজ শেষ করোনি! প্রতিদিনই তো তুমি পিছিয়ে পড়ো! সিয়াও অ শক্ত হয়ে নড়াচড়া হীন ভঙ্গিতে একটা পাটের বস্তার উপর বসে রইলো, সে ভাবলো, যাই হোক না কেন, আমি আর সেলাই করতে পারবো না, ওরা আমাকে নিয়ে যা ইচ্ছা তা করুক! পুরনো দিনের অস্ত্রাগারের বাতাস ছেয়ে আছে পচা পাটের কটু তীক্ষ্ণ গন্ধে। আঁধার আস্তে আস্তে গাঢ় হচ্ছে। কর্তব্যরত সৈনিকটি খটাস্ শব্দ করে পুরনো আমলের সুইচ টেনে নামিয়ে বাতি জ্বালালো। সে সিয়াও অ-কে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বললো, আট নম্বর, তুমি নিশ্চল হয়ে বসে আছো কেনো? তুমি সাবধান হও, নচেৎ তোমাকে জেল খাটতে হবে! সিয়াও অ ধীরে ধীরে হাত তুলে ওর হাতের আঙ্গুলগুলো সৈনিকটিকে দেখালো। সে যা বুঝাতে চাচ্ছে, মুখ দিয়ে সেটা বলতে ইচ্ছে করছে না! চলবে