শামীম আহসান মহাবুল্লাহ : একটা খড়ের মাদুরকে গুটিয়ে বালিশের মতো করে কবরের মাথার কাছে রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম। অনেক দিন আগে আমি একবার বলেছিলাম যে, আমি কখনোই ভাড়া করা গাধার লাগাম টানা লোক কিংবা ভিক্ষুকদের মতো যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে পড়তে পারিনা, কিন্তু ঐ দিন আমি ছিলাম ভীষণ ক্লান্ত-অবসন্ন, ঊষার আবির্ভাবের সময় এমন মধুর আর গভীর ঘুম আমি আগে কখনও-ই ঘুমাই নাই! আমার মনে হচ্ছিলো, আকাশটাকে যেন চাপ দিয়ে আমার কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়েছে, আমাকে যেন প্রলুব্ধ করা হয়েছে অসংখ্য পাখী বিষয়ক স্বপ্ন দেখতে। আমার স্বপ্নে দেখা সব গুলো পাখীই ধবধবে সাদা, তুষারের মতো, আমার স্বপ্নে দেখা পুরো আকাশটাই স্বচ্ছ আর সীমাহীন। আমি স্বপ্নে দেখেছি সব গুলো পাখীই উড়ছে আকাশে!

আমি স্বপ্নে দেখেছি, একটা নতুন জগৎ!
পিঠের ভ্রমণ সামানের থলেটা এখন আবারও একে বারে খালি, যেন ধুয়ে ফেলা হয়েছে ওটাকে। ওখানে শুধু রয়ে গেছে একটা জীর্ণ শীর্ণ গ্রন্থ ‘ভাষা তত্ত¡’ এবং গোল করে পেঁচানো দড়াবাজী খেলার কাজে ব্যবহৃত খানিকটা নারিকেলের ছোবড়ার রশি! আমার মনে হচ্ছে এ দু’টো জিনিস যাদের একটার সাথে আরেকটার কোনই সম্পর্ক নাই, কিন্তু এরাই এখন এমন কিছু যা আমার সাথে সবচাইতে বেশী খাপ খায় —— আমার জীবনের সারাংশ!

বহু বছর কেটে গেছে, তবুও ‘ভাষা তত্ত¡’ বইটা শান্তি মতো পড়ার ইচ্ছা আমার হয় নাই! কিন্তু তা সত্বেও বই এবং নারকেলের ছোবড়ার রশি এক সাথে নিয়েই আমি রাখলাম, সংরক্ষণ করলাম। সামগ্রীকভাবে বলতে গেলে জীবনের কোন না কোন কালে অবসর সময় আসবেই, আমি ‘ভাষা তত্ত¡’ বইটা পড়ে শেষ করতে পারবোই! আমার মনে পড়ছে, বহু বছর আগে আমার কাছ থেকে চলে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হওয়া সন্ন্যাসী চুয়ে খোং-কে, তাঁর প্রশান্ত চিত্ত, তাঁর অনন্য সাধারণ সর্কতা মূলক উপদেশ, তাঁর জ্ঞান গর্ভ দূরদর্শীতা পূর্ণ ক্ষমা সুলভ সার্বক্ষণিক অভিব্যক্তি, যা কিনা সরাসরি স্বর্গীয় জ্যোতির দীপ্তিতে উজ্জ্বল করেছে আমাকে!

হুই ছোট রানী-র সাথে হঠাৎ করে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ভাবে দেখা হয়েছিলো ছাং চৌ-এর পুরনো বাজার-এ।ওর অবিন্যস্ত চুল আর ময়লা লেগে থাকা অবয়ব দেখে ওকে আমি চিনতে পারি নাই! এক টানা ডাকতে থাকা নীল কণ্ঠ চিত্র দোয়েল-এর মতো সে অনর্গল কথা বলেই যাচ্ছিলো, যা কিনা পাগল হওয়ার ল²ণ বলে বিবেচিত হতে পারে! সে বসেছিলো, পথে আসা-যাওয়া করা মানুষের ভীড়ের মধ্যে, পুরনো বাজার-এর রাস্তায় ব্যস্তবাগীশ মানুষ জনের শশ-ব্যস্ততার মাঝে! প্রকৃতপক্ষে সে বসেছিলো তার উদ্দেশ্য পূরণের একটা সঠিক আর উপযূক্ত স্থানে! আমি দেখলাম, সে পথিকদের মধ্যে ফেরি করে বিক্রি করছে নানা রঙের কেঁচি দিয়ে কাটা কিছু কবিতা সম্বলিত কাগজ। “দেখেন, দেখে যান, এটা একটা উত্তম জিনিস!”, সে যেন একটা মৌণ-বোবা অভিব্যক্তির শব্দ দিয়ে বারে বারে পথ চলা মানুষদের উপর চাপ সৃষ্টি করে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছিলো। “পঞ্চম সিয়ে সম্রাট-এর নিজের হাতে লেখা প্রেমের কবিতার কাগজ —- একেবারে আসল, নকল নয়! যদি কিনে নেন, তবে কোন ভাবেই ঠকবেন না!”

আমি বেশ দূর থেকে হুই রানীর দিকে নজর রাখছিলাম, আমি ওর ব্যতিক্রম ধাঁচের ব্যবসার কাজে বিঘœ ঘটাই নাই! আশা করেছিলাম মানুষ জন এসে থামবে, আর হুই ছোট রানীর সাথে দরকষাকষি করবে, কিন্তু পুরনো বাজারে আসা মানুষ জনের সবাই আগ্রহী ডেকচি, বাটি, কাঠের হাতা কিংবা তাওয়া, এমন ধরনের জিনিসের প্রতি, কেউ-ই যেন চোখ তুলেও তাকাচ্ছে না হুই ছোট রানীর হাতে থাকা কবিতার কাগজ গুলোর দিকে! এমনও হতে পারে, মানুষ জনের চোখে কিংবা হৃদয়ে রঙিন কাগজের উপর রচনা করা ঐ কবিতা গুলোর মূল্য হয়তো এক পয়সাও না, ওদের চোখে এগুলো আবর্জনা বৈ অন্য কিছু নয়!

ওটা ছিলো বসন্ত কালের একটা উষ্ণ মধ্যাহ্ন, আমি পুরনো বাজারের রাস্তায় বেশ দূর থেকেই হুই ছোট রানীকে লক্ষ্য করছিলাম। একটা মৃদু গন্ধ পাচ্ছিলাম যা ছিলো দোয়াতের কালি, বেগুনি রাস্না ফুল আর পুদিনা পাতা-র সংমিশ্রণের ঘ্রাণ! যা কিনা পুরনো বাজারের রাস্তায় ভেসে ভেসে আসছিলো, তবে গন্ধটা ছিলো খুবই ক্ষীণ —- প্রায় অনুভব করা যায় না বললেই চলে! আমি জানি ঐ ঘ্রাণ ওর হাতে ধরে থাকা বিক্রি করতে আনা কবিতার কাগজের পাতা থেকে আসছে না! আসছে না —- জীবনের নানান ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত, দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া, ভ্রমণ ক্লান্ত ঐ মেয়েটার দেহের ত্বক থেকেও! আসলে ওটা হচ্ছে, আমার অতীত জীবনের সর্বশেষ স্মৃতি থেকে ভেসে আসা একটা সৌরভ!

ওটা ছিলো আমার ভ্রমণ পথে, নিজ মাতৃভূমি আর জন্মস্থানে অবস্থান করার শেষ দিবস! পরবর্তী দিন ফং কুয়ো দেশের কতৃপক্ষ, অনেক দিন অবরুদ্ধ থাকা শহরের যাতায়াতের উপর আরোপিত অবরোধ তুলে নেয়। আমি নিজের পরিচয় গোপন করে এক দল লবণ সংগ্রাহক ব্যবসায়ীদের মধ্যে ঢুকে পড়ে চুপিচুপি লুকিয়ে লুকিয়ে ত্যাগ করলাম এই ভগ্ন-হৃদয় শহরটাকে!

ষাট বছরের চক্রাকার চীনা বর্ষ পঞ্জিকা-র হিসাব অনুযায়ী সেই দিনটা ছিলো চন্দ্র বর্ষের তৃতীয় মাসের ঊনিশ তারিখ!


আমার বাকী জীবনটা অতিবাহিত হয়েছে তিক্ত বাঁশ পাহাড়-এর তিক্ত বাঁশ মন্দিরে। ওটা তো ফং কুয়ো দেশ থেকে অনেক দূরে, একই সাথে আমার মাতৃভূমি সিয়ে দেশ-এর জমি থেকেও বহু দূরে! ঐ বন-জঙ্গলে ঢাকা উঁচু পার্বত্য এলাকাটা বহু কাল আগে থেকেই এক টানা কয়েক শতাব্দী যাবৎ কোন সম্রাট, কোন সামন্ত রাজা কিংবা গোত্রপতির নিয়ন্ত্রণের অধীন নয়! শুনা যায়, আমার কিশোর বয়সের গুরু সন্ন্যাসী চুয়ে খোং খুঁজে বের করে ছিলেন মনোরম পীচ ফলের উদ্যানের মতো, যেন বাস্তব দুনিয়ার বাইরে থাকা এই জায়গাটি! তিনি সর্বপ্রথম এখানে এসেছিলেন আমার আট বছরের সম্রাট জীবনের একে বারে প্রথম দিকে। এই জঙ্গলাকীর্ণ জায়গায় জঙ্গল পরিষ্কার করে সব্জীর বাগান আর খাদ্য শস্যের আবাদ করা শুরু করেছিলেন তিনি। যে তিক্ত বাঁশ মন্দির-এর কথা বলছি, সেটিরও নির্মাণ কাজ তিনি নিজের অর্থ ব্যয়ে ও শ্রম দিয়ে, তিন বছর ধরে ধীরে ধীরে পুরপুরি শেষ করেছিলেন।

নানা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে, নানা জায়গায় ঘুরে আমি যখন তিক্ত বাঁশ পর্বতে পৌঁছালাম তখন, ইতিমধ্যেই সন্ন্যাসী চুয়ে খোং পরপারে চলে গেছেন। তিনি আমার জন্য রেখে গেছেন গিরি মালার মাঝ খানে একটা শূন্য হয়ে পড়ে থাকা মন্দির, মন্দিরের বাইরে থাকা খানিকটা বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা নানা জাতের ঘাসে ভরা একটা প্রাণবন্ত সব্জীর বাগান।নানা ধরনের তরিতরকারির বাগানটার মাঝ খানে খাড়া ভাবে দাঁড় করানো আছে একটা ফলক, যেটা কিনা স্থাপন করেছিলো সাধারণ মানুষ! তাঁরই সম্মানে ঐ ফলকে লেখা আছে তিনটা চীনা অক্ষর : ‘ই ছি ওয়াং’! যার ভাবার্থ হতে পারে : ‘একটু খানি আবাদ যোগ্য জমির সম্রাট’! নানা জাতের আগাছা ঘাসের মাঝে আমি খুঁজে পেয়েছি আমার কিশোর বয়সে সিয়ে প্রাসাদে থাকাকালীন সময়ে হাতের লেখা অক্ষর অনুশীলনের কাজে ব্যবহার করা একটা নেকড়ে বাঘের লোম-এর তৈরী তুলি। যা দেখে আমার মধ্যে একটা উপলব্ধির সঞ্চার হয়েছে, আমি অনুভব করলাম সন্ন্যাসী চুয়ে খোং-এর উপস্থিতি! তিনি যেন ইতিমধ্যে আমার জন্যই আট বছর ধরে অপেক্ষায় ছিলেন!

পরবর্তী কালে ফং কুয়ো দেশের সাথে ছ্যান কুয়ো দেশ আর তি কুয়ো দেশের যুদ্ধ বাঁধে। আক্রমনকারী সামরিক বাহিনীর হাত থেকে বাঁচার জন্য নারী, শিশু সহ অসংখ্য মানুষ তিক্ত বাঁশ পাহাড়-এর দিকে চলে আসতে শুরু করে। তিক্ত বাঁশ পাহাড় ধীরে ধীরে লোক বসতিতে পূর্ণ হয়ে উঠে। পরে যারা পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপন করেছিলো —– পরিষ্কার আকাশের রোদ উঠা ভোর বেলায়, তারা স্পষ্ট দেখতে পেতো পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত মন্দিরটি, ওদের নজরে আসতো অদ্ভুত সেই সন্ন্যাসী মানুষটিকে, যিনি দাঁড়াতেন দু’টি পাইন গাছ-এর মাঝখানে, দন্ডায়মান থাকতেন এক খন্ড অনেক উঁচুতে বাঁধা নারকেলের ছোবড়া দিয়ে পাকানো রশির উপর; কখনও কখনও যিনি হাঁটতেন ঐ রশির উপর দিয়ে দ্রুত পদক্ষেপে অথবা হয়ে যেতেন সুস্থির শান্ত দাঁড়ানো সাদা বক-এর মতো নিশ্চল!

আর ঐ মানুষটিই হচ্ছি আমি! দিনের বেলা আমি দড়ির উপর দিয়ে হাঁটার অনুশীলন করি, রাতের বেলা বই পড়ি। আমি বহু রাত জেগে জেগে ধীরে সুস্থে পড়েছি ‘ভাষা তত্ত¡’ নামের গ্রন্থটি। কখনও কখনও আমার মনে হয়েছে আধ্যাত্মিক চেতনায় সমৃদ্ধ এই গ্রন্থটি ধারণ করে আছে জীবন ও জগতের অন্তঃসংযোগ সম্পর্কিত সব কিছু, আবার কখনও কখনও আমি ভাবি এটা কিছুই ধারণ করেনি, শুধু কোন কাজে আসে না, এমন কিছু আগাছা ছাড়া! (সমাপ্ত)

সু থোং-এর লেখা উপন্যাস ‘অ তা তি ওয়াং শাং ইয়া’, যার ভাবার্থ আমি করেছি ‘আমার রাজকীয় কর্ম জীবন’, এখানেই শেষ হলো।
চীনা ভাষার চর্চা আমার একটা যড়ননু বা সখের খেয়াল!
যে সব পাঠক বন্ধু, দীর্ঘ দিন ধৈর্য ধরে বইটার বাংলা অনুবাদ পড়েছেন, তাঁদেরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
কেমন লেগেছে আমার এই ‘অনুবাদ প্রয়াস’[, আপনারা জানাবেন, আপনাদের সমালোচনা ও মতামত আমার জন্য খুবই প্রয়োজনীয় নিঃসন্দেহে!