শামীম আহসান মহাবুল্লাহ : এখন পর্যন্ত নোংরা কথা বলার অভ্যাস ছাড়তে পারো নাই! বিলাস কেন্দ্র প্রাসাদের দরবারে তুমি কিভাবে তোমার চেহারাটা দেখাবে?”
মং ফুরেন হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করেছেন, তিনি তাঁর মুখের উপর গোলাপ কাঠের লাঠিটা চেপে রাখতে দিচ্ছেন, বাধা দিচ্ছেন না মোটেই!
“আমি আর গালি দিবো না।”, কাঁদতে কাঁদতে বললেন মং ফুরেন, “আমি যেন আপনাদেরকে এক সাথে মিলে মিশে তুয়ান পাই-এর বিরুদ্ধে গুপ্ত ষড়যন্ত্র করতে দিবো, আমি মরে গেলেই তো আপনারা নিশ্চিতে নির্বিঘ্নে সব কিছু করতে পারবেন!”
“তুয়ান পাই তোমার ছেলে নয়, তুয়ান পাই হচ্ছে সিয়ে দেশের রাজা!”, প্রচণ্ড রাগত স্বরে হুয়াং ফু ফুরেন বললেন,
“তুমি যদি আবারও কান্নাকাটি চিত্কার চ্যাঁচামেচি শুরু করো, তবে তোমাকে তোমার মায়ের কাছে খেঁসারির ডাল বাটার দোকানে পাঠিয়ে দেবো। তোমার কাজ হলো ডাল বাটা দিয়ে ত ফু বানানো; রাজ দরবারে সিয়ে দেশের রাজার মা হিসাবে তোমাকে মানায় না!”
দুই মহিলার মধ্যাকার বিতর্ক আর বাগ বিতণ্ডা আমার কাছে এক ঘেয়ে আর বিরক্তিকর হয়ে উঠলো, তাঁদের ঝগড়ার সুযোগ নিয়ে আমি নীরবে বিলাস কেন্দ্র প্রাসাদের দরবার কক্ষ থেকে সরে পরলাম!
সবে মাত্র বড় বকুল গাছটার নীচে এসে দাঁড়িয়েছি, ঠিক তখনই ছুটতে ছুটতে আসা কেতাদুরস্ত সামরিক পোশাক পরা এক হাবিলদারের মুখোমুখি হলাম। লোকটি আমাকে দেখেই নত হয়ে কুর্নিশ করলো।
“সীমান্তে আমাদের শত্রু সৈন্যরা সীমানা রেখা অতিক্রম করে আমাদের ভূমিতে ঢুকেছে, পশ্চিম সীমান্তের দায়িত্বে থাকা সেনাপতি সেনাধ্যক্ষ যোঔ জাঁহাপনার কাছে খুব জরুরি একটা চিঠি পাঠিয়েছেন।”, আমি ক্ষণিকের জন্য লোকটির হাতে থাকা চিঠির দিকে তাকালাম, জরুরি বার্তার নির্দেশক হিসেবে চিঠিটার সাথে তিনটা মোরগের পালক গেঁথে দেয়া আছে। আমি বললাম, “আমি এ ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাতে চাচ্ছি না, তুমি আমার দাদী হুয়াং ফু ফুরেনের কাছে চিঠিটা পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করো।”
আমি পিঠটাকে সোজা করে লাফ দিয়ে সরে আসলাম। আমি বকুল গাছটা থেকে একটা ডাল ভেঙ্গে নিলাম যেটাতে ফুটে থাকা অনেকগুলো বকুল ফুল থেকে চমত্কার মিষ্টি সুবাস পাওয়া যাচ্ছিলো। আমি গাছের ডালটা দিয়ে আমার সামনে কুর্নিশ করে নত হয়ে থাকা লোকটার পশ্চাদত্দেশে একটা হালকা বাড়ি দিলাম।
আমি এগিয়ে যেতে যেতে বললাম, “তোমাদের কোন ব্যাপারে আমার একে বারেই কোন আগ্রহ নেই, সারা দিন ধরেই তোমরা আমার কাছে এটা সেটা নানা সমস্যা নিয়ে আসছো! এগুলো শুনতে শুনতে আমার মাথা ধরে যায়! বিদেশী সৈন্যরা আমাদের দেশের ভেতরে ঢুকে জমি দখলে নিচ্ছে!
ওদেরকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দাও, ওদের বের করে দিলেই তো সব ঠিক হয়ে যাবে, তাই না?”
আমি ভিতরে বাইরে উদ্দেশ্য বিহীনভাবে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করলাম, সব শেষে এসে দাঁড়ালাম প্রয়াত সম্রাটের যাদুকরী ঔষধ তৈরীর চুল্লীটার সামনে, গোধূলী বেলার সূর্য কিরণ বড় কাঁসার পাত্রটার গায়ে প্রতিফলিত হয়ে বিকিরণ করছে কড়া বেগুনী রশ্মি। আমি যেন দেখতে পাচ্ছি, বাদামি রঙের একটা অমরত্বের বড়ি, যেটা আবদ্ধ আছে পোড়া মাটির একটা গোলক আকৃতির ভাণ্ডের ভেতর। আর ঐ ছোট গোলকটা ঔষধের বড়িটাকে নিয়ে বিশাল কাঁসার পাত্রের ফুটন্ত গরম পানির ভেতর ছুটাছুটি করছে! আমার মনে হচ্ছে যদিও অনেক দিন আগেই চুল্লীর আগুন নিভে গেছে, কিন্তু তামার ধাতু শঙ্করের বড় পাত্রটা থেকে এখনও নির্গত হচ্ছে অদ্ভুত গন্ধ, সেই সাথে বেরিয়ে আসছে তীব্র উষ্ণ বাতাস যা কি না মানুষের ত্বক পুড়িয়ে দেয়ার মতো গরম! লাল কাপড়ের অজগরের ছবি সম্বলিত আমার আলখেল্লাটা খুব দ্রুত ঘামে ভিজে গিয়েছে।
প্রয়াত সম্রাটের অমরত্বের ঔষধ বনানোর চুল্লীর কাছে গেলে আমার সব সময়ই এমন হয়, আমার শরীর থেকে ঘাম বের হওয়া থামে না!
একটা ঝুলন্ত তামার বাসন দেখতে পাচ্ছি, যেটা বাতাসের ধাক্কায় পাক খেয়ে ঘুরছিলো। আমি হাতে থাকা বকুল গাছের ডালটা দিয়ে বাসনটার গায়ে একটা বাড়ি দিলাম। ঢং করে একটা আওয়াজ হলো। আওয়াজ শুনে চুল্লীর পিছন থেকে হঠাত করে উদয় হলো পুরনো প্রাসাদ ভৃত্য সুন সিন। ওকে হঠাত করে দেখে আমি ভূত দেখার মতোই চমকে উঠলাম!
সুন সিনের চেহারা আগের মতোই দুঃখ ভারাক্রান্ত। অবয়বে ফুটে উঠেছে পাগলামীর ছাপ। ওর হাতে আছে একটা ভেঙ্গে যাওয়া তীরের খণ্ড!
সুন সিন সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো!
“তুমি এই ভাঙ্গা তীরটা কোথায় পেয়েছো?”, আমি আশ্চর্য হয়ে সুন সিনকে জিজ্ঞেস করলাম!
“তাম্র কাঠি পাহাড়ের রাজকীয় শিকারের মাঠে!”, সে আঙ্গুল দিয়ে উত্তর দিক নির্দেশ করলো। ওর মুখ-অবয়ব হয়ে গেছে একটা শুকিয়ে যাওয়া গাছের পাতার মতো জীর্ণ শীর্ণ, সে কাঁপতে কাঁপতে বললো, “এটা একটা বিষ মাখা তীর!”
রাজকীয় শিকার ক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া ঐ ঘটনাটা আমার আবার মনে পড়ছে, আমার মনটা হঠাত করেই আবার খারাপ হয়ে গেলো।
আমার দাদী গুপ্ত তীর নিক্ষেপকারীকে আগলে রাখছেন। আর অপ্রত্যাশিতভাবে ঐ বিষ মাখা তীরটা এসেছে পাগলা সুন সিনের হাতে! আমি জানি না, সুন সিন কিভাবে ওটা খুঁজে পেয়েছে, আমি এটাও জানি না কেনোই বা সুন সিন আমাকে ওটা দেখাচ্ছে!
“তীরটা ফেলে দাও।”, আমি সুন সিনকে বললাম, “আমার ওটার দরকার নেই! আমি জানি কে এই গুপ্ত তীর ছুঁড়েছে!”
“গুপ্ত তীর ইতিমধ্যেই ছোঁড়া হয়েছে, খুব শীঘ্রই ঘনিয়ে আসছে সিয়ে দেশের বিপর্যয় কাল!”, বিড়বিড় করে এই কথাগুলো বলতে বলতে সুন সিন, ওর হাতে থাকা ঐ ভাঙ্গা তীরটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো। ওর চোখ ভরা পানি, অশ্রু ধারায় নেমে আসছে আরেক বার।
সুন সিনকে আমার খুব মজার মানুষ মনে হয়। যে কোন ঘটনার ব্যাপারে, ওর দুঃখ ঘেঁষা মন্তব্য আমার জন্য একটা অভিনব বিষয়! প্রাসাদের সকল ভৃত্য এবং দাসীদের মধ্যে আমি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি এই বুড়ো পাগলা মানুষটাকে!
যদিও আমার দাদী হুয়াং ফু ফুরেন এবং আমার মাতা মং ফুরেন, দু’জনেই এই ব্যাপারটা নিয়ে আমার উপর বেশ বিরক্ত, কিন্তু সেই শিশু কাল থেকেই আমার সাথে সুন সিনের আছে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা। প্রায়ই আমি ওর হাত ধরে টান দিয়ে ওকে মাঠে নিয়ে যাই, মাটিতে দাগ কেটে দাগের উপর দিয়ে লাফালাফি করার খেলায় মেতে উঠি।
“কেঁদো না তুমি!”, আমি জামার ভিতর থেকে রুমাল বের করে ওর গাল মুছে দিলাম। ওর হাতটা টেনে ধরে বললাম, “চলো, আমরা মাটিতে দাগ কেটে দাগের উপর দিয়ে লাফ দেয়ার খেলাটা খেলি। কতদিন হলো তোমার সাথে মাঠে খেলতে যাই না!”
“দাগের উপর লাফ দিয়ে যাও, আর দেখো ধেয়ে আসছে সিয়ে রাজ্যের বিপর্যয়!”, সুন সিন বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে হাঁটু ভাজ করে পা বাড়ালো সামনের দিকে। একটা ইটের টুকরা দিয়ে মাটিতে কয়েকটা দাগ কেটে লাফ দিয়ে পার হতে হতে বললো, “এক, দুই, তিন! ধেয়ে আসছে সিয়ে দেশের বিপর্যয়ের দিন!”
তুয়ান ওয়েন এবং তুয়ান উ, এই দুই সহোদর ভাইকে শাস্তি দেয়ার আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ দণ্ড বিধায়কদের মধ্যে কেউ ই এই দুই ভাই এর বিরুদ্ধে দণ্ডের আজ্ঞা কার্যকর করার ফরমান লিখতে সাহস করেন নাই।
কয়েক দিন পর, আমার নজরে আসলো, তুয়ান ওয়েন এবং তুয়ান উ দুই ভাই হাতে হাত ধরে বিলাস কেন্দ্র প্রাসাদের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই ওদের দেখে আমার মনটা খুবই দমে গেলো। আমি জানি, ওরা কেমন করে এমন ফ‚র্তির সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এর কারণ আমার দাদী হুয়াং ফু ফুরেনের আশকারা! উনি এই দুই অপরাধীকে রক্ষা করছেন। এখন আমার মনটা দাদীর প্রতি অসন্তোষে পূর্ণ হয়ে আছে। আমার মনে হচ্ছে দেশের সব কিছুই যদি ওনার নির্দেশে চলে, তবে আমার থাকার দরকারটাই বা কি? উনিই তো সিয়ে রাজ্যের সিংহাসনে বসতে পারতেন!
আমার দাদী হুয়াং ফু ফুরেন, আমার নীরব অভিমান আর মনঃক্ষুণœ হওয়ার ব্যাপারটা আঁচ করতে পারলেন। গুলজার কক্ষ নামের প্রাসাদের আরাম কেদারায় দাদী হেলান দিয়ে শুয়েছিলেন, আমাকে দেখে কাছে ডাকলেন। বসতে বললেন তাঁর পাশে। আমি গিয়ে তাঁর পাশে বসলাম। বেশ কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তিনি আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন নীরবে! তাঁর মুখে মাখা প্রসাধনী ধুয়ে মুছে গেছে। তাঁর মুখটা ফ্যাকাশে আর মলিন। চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ পরেছে স্পষ্ট। খুব কাছ থেকে ওনার মুখটা দেখে আমার মনে হচ্ছে, তাম্র কাঠি পাহাড়ের রাজকীয় সমাধী ক্ষেত্রে তাঁর প্রবেশ করার সময় ঘনিয়ে এসেছে!
“তুয়ান পাই, তোমার মুখটা এতো শুকনা দেখাচ্ছে কেনো?”, হুয়াং ফু ফুরেন আমার একটা হাত ধরে বললেন,
“তোমার ঝিঁঝি পোকাগুলো মরে গেছে না কি?”
“সব কিছুই যদি তোমার কথায় চলে, তবে আমাকে সিয়ে দেশের রাজা বানিয়েছ কেন?”, আমি চেঁচিয়ে এই কথাটা বলে, আর কোন কথা খুঁজে পেলাম না বলার মতো!
আরাম কেদারায় হেলান দেয়া অবস্থা থেকে দাদী ধড়ফড় করে উঠে বসলেন। তাঁর চেহারায় ফুটে উঠলো হত বিহ্বলতার ছাপ! ব্যাপারটা উপলব্ধি করে আমি বিব্রত ও সংকুচিত হয়ে একটু সরে বসলাম।
“কে তোমাকে এ সব কথা শিখিয়েছে? তোমার মা মং ফুরেন, না কি তোমার গুরু চুয়ে খোং?”, খানিকটা বকা দেয়ার সুরে হুয়াং ফু ফুরেন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন। আরাম কেদারার পাশে রাখা গোলাপ কাঠের লাঠিটা টান দিয়ে হাতে নিলেন। আমিও আরেকটু সরে বসলাম। আমার ভয় হচ্ছে, উনি লাঠিটা দিয়ে আমার মাথায় খোঁচা দিবেন!
হুয়াং ফু ফুরেন লাঠিটা আমার মাথায় ঠুকলেন না। তিনি হাতের লাঠিটা শূন্যে উঠালেন, ওটা নেমে এসে বাড়ি দিলো এক প্রাসাদ দাসীর মাথায়!
“তুই এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস? এক্ষুনি এখান থেকে দূর হ!”
প্রাসাদ দাসীকে লাঠির বাড়ি মারাটা প্রতীকী ব্যপার! আসলে উনি বাড়িটা মেরেছেন আমাকে! কিন্তু, আমি তো দেশের রাজা! আমার গায়ে কেউ হাত তুলতে পারে না! এমন কি আমার দাদীও নয়! এটাই দেশের শত বছরের রীতি।
দাদীর এই কাজে আমি খুব অপমানিত বোধ করছি।
আমি দেখতে পেলাম প্রাসাদ দাসীটির চোখ লাল হয়ে গিয়েছে, সে দৌড়ে আরাম কেদারার পেছনে ঝুলানো ঝালর দেওয়া পর্দার বাইরে চলে গেলো।
আমি হঠাত করেই আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। চিতকার করে কেঁদে উঠলাম! আমি বললাম, “তুয়ান ওয়েন শিকারের মাঠে আমাকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়েছে। অথচ তুমি ওদের শাস্তি দিতে চাচ্ছ না! যদি চুয়ে খোং হঠাত করেই আমাকে সতর্ক না করতো, তা হলে গুপ্ত তীর আমার শরীর ভেদ করে চলে যেত!”
“আমি তো এরই মধ্যে ওদের শাস্তি দিয়ে ফেলেছি! তোমার চার ভাই, প্রত্যেককেই তিনটা করে গোলাপ কাঠের ছড়ি দিয়ে বাড়ি মেরেছি। এটা কি যথেষ্ট নয়?”
“কোন ভাবেই যথেষ্ট নয়!”, আমি আগের মতোই চিত্কার করে বললাম, “আমি তুয়ান ওয়েন এবং তুয়ান উ-র হাতের আঙ্গুল কেটে ফেলবো। এর পরে ওরা আর কোন দিনই গুপ্ত তীর ছুঁড়তে পারবে না!”
“একে বারেই বাচ্চা ছেলে রে তুই!”, দাদী আমাকে টেনে নিয়ে আরাম কেদারার উপর বসালেন, তিনি হালকাভাবে আমার কানের উপর হাত বুলিয়ে দিলেন। (চলবে)