শামীম আহসান মহাবুল্লাহ : কিন্তু এরই মধ্যে যথেষ্ট দেরী হয়ে গেছে, পাঁচজন মুখ ঢাকা ডাকাত ঘেরাও করে ফেলেছে ওকে চারপাশ থেকে! চোখের পলকেই ঘটলো ডাকাতির ঘটনাটা! আমি দেখতে পেলাম এক জন মুখোশধারী ধারালো ছুরি দিয়ে গাধার পিঠের সাথে ফিতা দিয়ে বাঁধা সামানটার ফিতা কেটে দিলো, তারপর টান দিয়ে তুলে ছুড়ে দিলো থলেটা ওর আরেকজন সহযোগীর হাতে যে ছিলো একটা জিনবিহীন ঘোড়ার পিঠে আসীন। যেহেতু ওরা এসেছিলো, দ্রæত পথ চলা ক্লান্ত-শ্রান্ত বলহীন দু’জন পথিকের মোকাবেলায়, তাই আপাতদৃষ্টিতে ওরা পুরো ঘটনাটাই ঘটালো খুব সহজে নির্বিঘœ সাবলীলতায়! এর পরপরই, এক জন মুখোশধারী ব্যক্তি ইয়েন লাঙ-কে চেপে ধরলো। অল্প কথায় সুস্পষ্টভাবে কিছু প্রশ্ন করলো, তারপর টেনে ছিঁড়ে ফেললো ইয়েন লাঙ-এর জামাটা। আমি শুনতে পেলাম ইয়েন লাঙ-এর উচ্চ স্বরে করা বিলাপের ধ্বনি। সে হয়েছে চরমভাবে আশাহত, সে অনুনয় করছে ওদের কাছে। কিন্তু মুখোশধারীরা ওকে কোন কিছু ব্যাখ্যা করার সুযোগ না দিয়েই ওর কোমর বন্ধের ভিতরে থাকা টাকার থলেটা কেটে বের করে নিলো। এই সময় আমি হয়ে গেছি বুদ্ধি শূন্য হতবিহ্বল, কিংকর্তব্যবিমূঢ়! আমি যেন একটুও নড়াচড়া করতে পারছিলাম না, আগের মতোই বসে রইলাম পাথর খন্ডটার উপরে! যেন, শুধুমাত্র একটা বাস্তবতাই আমি অবগত আছি, আর সেটা হলো, ওরা আমাদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করছে, এখন আমরা দু’জন হয়ে গেছি পুরোপুরি কপর্দকহীন নিঃস্ব দরিদ্র!

পাঁচ ডাকাত ঘোড়ার গায়ে থাবড় দিয়ে ঘোড়াকে দ্রæত চলার সঙ্কেত দিলো, ঘোড়াগুলো ছুটতে শুরু করলো, প্রবেশ করলো ওক গাছের বন-এর মধ্যে। গোধূলির আধো অন্ধকারে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ওরা হারিয়ে গেলো চোখের দৃষ্টি সীমা থেকে! ইয়েন লাঙ একটা পানির ডোবার ধারে গড়িয়ে পড়লো মাটিতে, নিশ্চল হয়ে পড়ে রইলো অনেকক্ষণ! কিছুক্ষণ পর আমি লক্ষ্য করলাম, ওর দেহটা প্রবলভাবে কাঁপছে! ঝাঁকুনি দিয়ে কাঁপছে! সে কাঁদছে! আমাদের গাধাটা দৌড়ে রাস্তার এক পাশে গিয়ে ভয় পেয়ে ত্যাগ করছে এক গাদা পাতলা মল, শুনতে পাচ্ছি ওর আতঙ্কিত হ্রেষা! আমি কাদার মধ্য থেকে ইয়েন লাঙ-কে টেনে তুললাম। ওর চোখ ভর্তি অশ্রæ জল, সারা শরীর কাদায় মাখা। দেখেই বুঝা যাচ্ছে, সে হয়ে পড়েছে চরম আশাহত, দুঃখে ভারাক্রান্ত!

“কোন টাকা পয়সা নাই, আমি বাড়িতে গিয়ে মুখ দেখাবো কি ভাবে?”, ইয়েন লাঙ হঠাৎ করেই হাত উঁচু করে হাতের তালু দিয়ে ডান বামে নিজেই নিজের গালে চড় দেয়া শুরু করলো। সে বললো, “মরণ হয় না কেন আমার! আমি ছিলাম ঘোরের মধ্যে, আমার মন ভাবছিলো, জাঁহাপনা যেন আগের মতোই আছেন, আমার মন ভাবছিলো, আমি যেন এখনও রয়েছি প্রাসাদের খোজা দাসদের সর্দার! আমি কেন যে পুরো টাকা পয়সা এক সাথে নিয়ে এসেছি, রাখতে গিয়েছি আমার নিজের সাথেই!”
“ নিজের সাথে না রেখে, অন্য কোন উপায় কি ছিলো? একটা মাত্র গাধা, আছে শুধুমাত্র একটা ভ্রমণ সামান, পরার কাপড় জামা মাত্র কয়েকটা! আমি ঘাড় ঘুরিয়ে চার পাশে তাকিয়েছি, নজর রেখেছি। আগে তো জানতাম পাহাড়ি রাস্তা আর নদী পথে থাকে ডাকাত, দুর্বৃত্ত, দস্যুর দল। কখনো তো শুনি নাই, সমতলের রাজপথে কেউ মানুষ খুন করতে আসার দুঃসাহস দেখিয়ে মানুষের জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে!”

“আমি জানি, সিয়ে দেশে আছে গরীব অনাহারী মানুষ। দরিদ্র মানুষ অভাবের তাড়নায় পাগল হয়ে মানুষ খুন করতে পারে, মালামাল ছিনিয়ে নেয়ার মতো সাহস দেখাতে পারে! কিন্তু আমি কেনো ওদের প্রতিরোধ করার পূর্ব প্রস্তুতি নেই নাই! কেন আমাকে আমার সারা জীবনের সঞ্চয় হারিয়ে ফেলতে হলো, ডাকাত দল ছিনিয়ে নিয়ে গেলো! কেন আমি ঠিক মতো চোখ কান খোলা রাখি নাই!”, ইয়েন লাঙ করুণ স্বরে কথা বলছে, কাঁদছে! সে ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছে না, টলতে টলতে এগিয়ে গেলো গাধাটার দিকে, চেষ্টা করলো তাড়াতাড়ি গাধাটাকে ধরতে, গাধার পিঠে এখন আর কিছু নাই, সে দুই হাতে গাধার শূন্য পিঠটায় হাত বুলিয়ে দিলো।

“কিছুই যে নাই”, সে বললো, “আমি কি নিয়ে আমার বাবা-মাকে মুখ দেখাবো, কি দিয়ে বাড়ি করার জন্য জমি কিনবো, কি দিয়ে জাঁহাপনার সেবা করবো?”
আমার জন্য এবারের বিপর্যয়টা হচ্ছে তুষারপাতের মধ্যে কুজ্ঝটিকার আবির্ভাবের মতো, মন্দের মধ্যে আরও মন্দের আগমন! আর ইয়েন লাঙ-এর ক্ষেত্রে এটা যেন হয়েছে প্রাণঘাতী বিপর্যয় না হলেও এর খুব কাছাকাছি পর্যায়ের কিছু একটা! আমি জানি না, আমি কি ভাবে ওকে সান্ত¡না দেবো! খানিকটা অন্যমনস্কতার ঘোরের মধ্যেই দেখতে পেলাম গাধাটার খুরের নীচে পাড়া পরেছে একটা কুন্ডলী পাকানো বস্তু, একটা বই! যার পাতাগুলো এরই মধ্যে ছুটে গিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে! অংশ বিশেষের উপর লেগে আছে গাঢ় সবুজ রঙের গাধার গোবর! আর ওটা হচ্ছে সিয়ে রাজ প্রাসাদ ত্যাগ করার আগে তাড়াহুড়া করে গোছগাছ করা ভ্রমণ লট বহরে থাক ভাষা তত্ত¡ গ্ধ নামের বইটা! দেখে মনে হচ্ছে ডাকাতরা যেন লট বহরের সোনা, রূপা, মুক্তা আর রত্নের মধ্য থেকে ওটা বের করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে! আর বর্তমানে আমার কাছে ওটাই হচ্ছে লুটের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া একমাত্র সম্পদ! আমি ধীরে ধীরে ‘ভাষা তত্ত¡’ বইটা উঠিয়ে আনলাম। আমি জানি আগামীতে আমার সাধারণ মানুষ হিসেবের কর্ম জীবনে ওটার কোন মূল্য নাই! একটুও কাজে আসবে না! কিন্তু আমি আরও জানি, এটাই হচ্ছে ঈশ্বরের ভিন্ন ধরনের একটা ইচ্ছা! আমি অবশ্যই ভাষা তত্ত¡ নামের গ্রন্থটাকে সাথে নিয়েই যাবো আমার নির্বাসনের গন্তব্যে!

আঁধার ঘনিয়ে আসার পর চোখে আসছে ঘুম ঘুম ভাব, কালো মেঘ থেকে আসা বৃষ্টির ফোঁটা পাথর খনি জেলার ঘন বসতি পূর্ণ নীচু উচ্চতার সাধারণ মানুষের ঘর-বাড়ির ছাদগুলোকে স্পর্শ করছে। ভারী বৃষ্টি আসতে গিয়েও আসছে না, কাঁধে করে ফলফলাদি ও শাকসবজী বহনকারী ফেরিওয়ালারা তাদের ঝুড়িগুলো নিয়ে যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে! আমাদের পুরো শরীর ধূলায় ধূসর! কপর্দকহীন অবস্থায় যাচ্ছি ইয়েন লাঙ-এর বাড়ির দিকে। শ্বেত লৌহ নগর এলাকার কাছাকাছি আসার পর কোন এক জন মানুষ ইয়েন লাঙ-কে চিনতে পারলো। ভাতের বাটি হাতে নিয়ে এক মহিলা দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়ে গাধাটার পিঠের দিকে লক্ষ্য করলো। সে ভাত খাওয়ার কাঠি দিয়ে ইয়েন লাঙ-কে ইশারা করলো। নানা আওয়াজের মধ্যে ওর নীচু স্বরের একটা মন্তব্য শোনা গেলো। “ওরা কি তোমাকে কিছু বলছে?”, গাধার দড়ি টেনে দ্রুত হাঁটতে থাকা ইয়েন লাঙ-কে আমি প্রশ্ন করলাম। ইয়েন লাঙ অত্যন্ত বিব্রত অবয়বে উত্তর দিলো, “গাধার পিঠ তো শূন্য, কোন জিনিস পত্র নেই কেনো? ফ্যাকাশে মুখের কোন্ রাজকুমারকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছো?”
ওরা বোধ হয় রাজধানীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সম্পর্কে অবগত নয়!

ইয়েন লাঙ-দের বাড়ি, আসলে অতি মাত্রায় শব্দ বহুল অত্যন্ত জনাকীর্ণ ঘিঞ্জি লোহার দ্রব্যাদি তৈরীর একটা কারখানা! খালি গায়ে থাকা কয়েক জন কামার কাজে ব্যস্ত আছে আগুনের পাশে। ওর শরীর থেকে টপ টপ করে ঝরছে উত্তপ্ত ঘাম। কারখানার মধ্যে বয়ে যাওয়া গরম বাতাসের ঝাপটা যে কাউকে-ই ভয়ে সঙ্কুচিত করে তুলতে পারে! ইয়েন লাঙ সরাসরি গিয়ে দাঁড়ালো একজন কামারের পাশে, যে কিনা গরম উত্তপ্ত লোহাকে ঠান্ডা করার কাজের তো ছিলো। ইয়েন লাঙ হাঁটু গেড়ে মাথা নীচু করে বসলো। বয়স্ক কামার ব্যক্তিটি গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিলো, সে যেন কিছুই বুঝতে পারছিলো না! পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে, অনেক বছর আগে বাড়ি থেকে চলে যাওয়া তার এই পুত্রটিকে সে চিনতে পারে নাই! “মহাশয়, কোন কথা বলার থাকলে বলে ফেলুন।”, হতে থাকা আগুন চিমটা-টি উড়িয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে ইয়েন লাঙ-এর সামনে উঠে দাঁড়ালো, তারপর বললো, “মহাশয় কি হাতলসহ কোন ধারালো তলোয়ার বানিয়ে নিতে চান?”

“আব্বাজান! আমি তো আপনার ছেলে ইয়েন লাঙ! ইয়েন লাঙ বাড়ি ফিরে এসেছে!”, আমি শুনতে পেলাম ইয়েন লাঙের ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠার শব্দ! কামার শালের সব কারিগর তাদের হাতের কাজ বাদ রেখে, ভীড় করলো ইয়েন লাঙের পাশে। ভিতরের ঘরের পর্দাটা জোরের সাথে কে যেন গুটিয়ে ফেললো। একজন মহিলা সামনের জামা আধা খোলা অবস্থায়ই কোলে থাকা শিশুকে বুকের দুধ খাওতে খাওয়াতেই তাড়াহুড়া করে আসলেন কামার শালের আগুন জ্বলা স্থানে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন,
“ইয়েন লাঙ কি বাড়ি ফিরে এসেছে? আমার ছেলে ইয়েন লাঙ কি বাড়ি ফিরে এসেছে?”

“তুমি ইয়েন লাঙ নও, আমার ছেলে ইয়েন লাঙ সিয়ে রাজ প্রাসাদে সম্রাটের সেবায় নিয়োজিত আছে। কর্মজীবনে সে হচ্ছে একজন সফল মানুষ! সে আহার করে দুঃস্প্রাপ্য পাখীর গোস্তো, সে পরিধান করে উজ্জ্বল মসৃণ রেশমের পোশাক!”, প্রবীণ কামার তার পায়ের কাছে লুটিয়ে থাকা ইয়েন লাঙ-কে ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। তার চেহারায় ফুটে উঠলো একটা অবজ্ঞার হাসি। তিনি বললেন, “মহাশয়, আমাকে প্রতারণা করতে এসো না! তোমার আছে ছেঁড়া আর মলিন পোশাক আর হতভাগ্য চেহারা! তুমি কি ভাবে হলে আমার ছেলে ইয়েন লাঙ?”

“আব্বাজান, আমি সত্যিই ইয়েন লাঙ! বিশ্বাস না হলে আমার পেটের উপরে থাকা লাল জড়ুলটা দেখুন। ইয়েন লাঙ তার জামা খুলে ফেললো। তারপর তার মায়ের দিকে ফিরে কপাল মাটিতে ঠেকিয়ে শ্রদ্ধা জানালো। সে বললো, “আম্মাজান, আপনি অবশ্যই চিনবেন এই লাল জম্ম দাগটি! আমি সত্যিই আপনাদের পুত্র ইয়েন লাঙ!”

“না! অনেক মানুষই আছে, যাদের পেটের উপর লাল জড়ুল আছে!”, প্রবীণ কামার না ছোড়বান্দার মতো মাথা ঝাঁকিয়ে চললেন। “তুমি যে ইয়েন লাঙ, এটা আমার বিশ্বাস হয় না। মনে করো, তুমি যদি এক জন মানুষকে হত্যা করার জন্য একটা গুপ্ত অস্ত্র তৈরী করতে চাও, আমি তোমাকে সেটা তৈরী করে দেবো, কিন্তু আমার ছেলের নাম আর খ্যাতিকে নষ্ট করতে আমি তোমাকে দেবো না! তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে বিদায় হও!”, এ কথা বলেই প্রৌঢ় কামার হাতে তুলে নিলো একটা প্রসস্থ কুঠার। তিনি ইয়েন লাঙ-কে একটা লাথি মেরে গর্জে উঠে বললেন, “তুমি তো মানুষ নও, তুমি একটা কুকুর! ভাগো এখান থেকে, আমাকে দিয়ে এক আঘাতে তোমার কুকুর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাতে চেও না!”
আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম উল্টা পাশের একটা দোকানের দরজায়। রাস্তার ওপাড় থেকে কামার শালের ভিতরে ঘটে যাওয়া অকল্পনীয় নাটকের দৃশ্যগুলো দেখার চেষ্টা করছিলাম। ইয়েন লাঙ মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছিলো, এক পর্যায়ে ওর গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হচ্ছিলো না। আমি লক্ষ্য করলাম হঠাৎ করেই ইয়েন লাঙ, ওর পাজামা খুলে ফেললো। পাগলের মতো উচ্চ স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, “আব্বাজান! এটা দেখেন, ভালো করে দেখেন! আপনিই তো একটা গরম ছুরি দিয়ে নিজ হাতে আমাকে খোজা বানিয়েছেন! আমি যে ইয়েন লাঙ, এটা আপনাকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে!”

এতো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর কামার দম্পতি এবং তাদের পুত্র ইয়েন লাঙ পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে খানিক ক্ষণের জন্য কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। শ্বেত লৌহ নগর-এর ঐ এলাকার কামার শালগুলোর পেটা লোহা তৈরীর আওয়াজ হঠাৎ করেই থমকে গিয়েছিলো। বেশ কয়েকজন খালি গায়ের কিংবা শুধু মাত্র নেংটি পরা কর্মকার ভীড় করেছিলো ইয়েন লাঙ-দের বাড়ির দরজায়। তারা খুব আবেগ ভরা আনন্দের সাথে অপেক্ষা করেই অবলোকন করছিলো পিতাপুত্রের পুনর্মিলনী নাটকের প্রতিটি অঙ্ক! কর্মকার পিতা আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, এক রাশ পুরনো জমে থাকা অশ্রুর ধারা নেমে আসলো তার দু’চোখ বেয়ে।

“সবাই বলছে, তুমি বাড়ি ফিরবে রাজ প্রাসাদ থেকে পাওয়া জাঁকজমকপূর্ণ রেশমের আলখেল্লা গায়ে জড়িয়ে, বাড়ি ফিরে জমি কিনবে দালন উঠাবে, পুরনো সমাধি সৌধ, মন্দির-মঠগুলো ঠিকঠাক করবে। কে ভেবেছে, তুমি ফিরে আসবে এমন খালি হাতে!”, প্রবীণ কামার তার গাঢ় লাল হয়ে ওঠা চোখ মুছলেন, তারপর ফিরে গেলেন নমনীয় করে পেটা লোহা তৈরীর স্থানে। গরম লোহার পাতে বাড়ি মেরে হাতের বাকী কাজগুলো সারতে সারতে তিনি বললেন, “এরপরে কি হবে? একটা অথর্ব ছেলে, যে কিনা হাত দিয়ে তুলতে পারবে না, কাঁধে পিঠে ভারী মাল নিয়ে চলতে পারবে না, তুমি পারবে শুধু বাবার ঘাড়ে বসে বসে খেতে!”

আমার উপস্থিতি কেউ-ই যেন টের পায় নাই! আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, শেষ অবধি ইয়েন লাঙ যখন আমাকে ডাকলো, তখন নামলো প্রবল বৃষ্টি! শ্বেত লৌহ নগর-এর হলুদ রঙের কর্দমাক্ত পথ থেকে বেরিয়ে আসছে সোঁদা মাটির গন্ধ, আর রাস্তার উপর ভাসছে ধূলা ভরা কুয়াশা! বাইরে স্তুপ করে রাখা লোহার তৈরী নানা রকম কৃষি যন্ত্রপাতির উপর বৃষ্টির ছাঁট পড়ে ছিটিয়ে যাওয়ার শব্দ হচ্ছিলো। বৃষ্টির ফোঁটা আমার মুখের উপরও এসে পড়ছিলো। পড়ছিলো আমার জামার উপরও। আমি দরজার প্রলম্বিত ছাদের নীচের এক অংশ থেকে আরেক অংশে দৌড়িয়ে যাচ্ছিলাম। (চলবে)