শামীম আহসান মহাবুল্লাহ : তার ঠোঁট দু’টো নড়ছে, যেন সে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে, কিন্তু ওর গলা থেকে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। উঁচু স্বর কিংবা বিড়বিড় করে বলা কোন কথাই আমি শুনতে পাচ্ছি না। আমি বুঝতে পারছি না, আমি কি একটু ভয় পাচ্ছি? না কি আতঙ্ক আমাকে পুরোপুরি গ্রাস করেছে! একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পারছি, আসলে আমি এখান থেকে পিছু হটে যেতে চাচ্ছি দ্রুত, অতি দ্রুত! আমি উচ্চ স্বরে কেতাদুরস্ত পোশাকের দেহ রক্ষীকে তাড়া দিয়ে দ্রুত ঘোড়া ছুটাবার নির্দেশ দিলাম, এই পরিস্থিতিতে ওর কাছে ওর বিবেচনায়, এটা ছিলো একে বারেই অযৌক্তিক নির্দেশ।
কেতাদুরস্ত পোশাকের দেহ রক্ষীর দেহটা থর থর করে কাঁপছে, ওর অবয়ব ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, ও কেমন একটা সন্দেহ আর দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
“মেরে ফেলো”, আমি দেহ রক্ষীর পিঠে বাঁধা তীরাধারে কয়েক বার চাপড় মেরে এই কথাটা কয়েক বার বললাম। আমি দেখছি দেহ রক্ষী জানালার ফোঁকরে তীর ধনুক হাতে নিয়ে ইতস্তত করছে, ছুঁড়ছে না তীর! আমি বললাম,
“তাড়াতাড়ি করো, এখনই তীরটা ছোঁড়। যদি আমার হুকুম অমান্য করার সাহস দেখাও তা হলে ওকে এবং তোমাকে আমি, একই সাথে হত্যা করবো।”
কেতাদুরস্ত পোশাকের দেহ রক্ষী ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে চেয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বললো, “রাজকীয় রথ চলতে থাকার সময় দুলছে, খুব দুলছে। আমার ভয় হচ্ছে, আমার নিক্ষেপ করা তীরটা লক্ষ্য ভ্রষ্ট হবে!”
আমি জোর করে ওর হাত থেকে তীর ও ধনুক কেড়ে নিলাম। আমি বললাম, “তোমরা সবাই হচ্ছো আবর্জনা ছাড়া আর কিছু নও! দেখ আমার তীর নিক্ষেপের পদ্ধতি!”
সব শেষে জানালায় হেলান দিয়ে মুমূর্ষু ওষ্ঠাগত প্রাণ ইয়াং সোং-কে লক্ষ্য করে আমি পর পর তিনটা তীর নিক্ষেপ করলাম। এদের মধ্যে একটা তীর অস্বাভাবিক নিখুঁত নিশানায় ইয়াং সোং এর বুককে সামনের দিক থেকে ভেদ করলো। ইয়াং সোং দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থা থেকে পরে যাওয়া পর্যন্ত এই সময়টুকুতে আমি শুনতে পেলাম রাজকীয় শকট বহর থেকে আগত এক তীব্র আর্তনাদের শব্দ। হয়তো আমার সফর সঙ্গী সবাই এরই মধ্যে বুঝতে পেরেছে লালচে কালো রঙের রক্তে ভেজা ঐ মানুষটি হচ্ছে ইয়াং সোং। ওরা নীরব নিশ্চুপ থেকে অপেক্ষায় ছিলো আমার হুকুমের। আমার নিক্ষেপ করা তিনটা তীর নিশ্চিতভাবে কিছু মানুষকে করেছিলো স্তম্ভিত! আর এটাও ঠিক যে বাদ বাকী সব মানুষদের সবাই হয়তো ফেলেছে স্বস্তির নিঃশ্বাস!
খুন! আমি তীর ধনুক গুছিয়ে রেখে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা ইয়েন লাঙ-কে বললাম, “ইয়াং সোং অনুমতি না নিয়ে এলাকা ত্যাগ করে যুদ্ধ ক্ষেত্রে গিয়েছে, আর এই কাজটাই হচ্ছে তার করা মৃত্যু দন্ড যোগ্য অপরাধ! এর উপর আছে, যুদ্ধ ক্ষেত্রে সে একজন পরাজিত সৈনিক। মৃত্যুই তার জন্য উপযুক্ত শাস্তি হবে না কেনো?”
“জাঁহাপনা, আপনার তীর নিক্ষেপের পদ্ধতি খুবই ভালো।”, ইয়েন লাঙ খুব রিন রিনে গলায় বললো। ইয়েন লাঙের ছোট্ট মুখ অবয়বে ফুটে উঠেছে আতংক মিশানো বিস্ময় আর খানিকটা তোষামোদী ভাব! ওর দুই হাতের জড়ো করা তালুর মধ্যে সে এখনও ধরে রেখেছে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা কিছু বিশ্রী জিনিস, আমার করা বমি! আমি শুনতে পেলাম, সে আমারই কথার পুনরাবৃত্তি করছে, “পরাজিত সৈনিকের মৃত্যুই উপযুক্ত শাস্তি হবে না কেনো!”
“ইয়েন লাঙ, তুমি ভয় পেয়ো না। আমি শুধুমাত্র তাদেরকেই খুন করে ফেলি, যাদের আমি পছন্দ করি না।”, আমি ইয়েন লাঙের কানে কানে কিছু কথা বললাম, “আমার ইচ্ছাই সব, আমি যাদের যাদের খুন করতে চাই, তাদের অবশ্যই মরতে হবে, অন্যথায় আমার সিয়ে দেশের রাজা হয়ে থাকার দরকার নাই!
ইয়েন লাঙ, কারা মরে গেলে তোমার ভালো লাগবে, আমাকে জানাও, তুমি কার মৃত্যু দেখতে চাও?”
“আমি কারো মৃত্যুই দেখতে চাই না!”, ইয়েন লাঙ আকাশের দিকে চেয়ে বেশ খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললো, “জাঁহাপনা চলেন, আমরা মাটিতে দাগ টেনে লাফালাফি করার খেলাটা আবার খেলবো, কেমন?”
আমার পশ্চিম সীমান্ত পরিদর্শনের কাজটা ফং কুয়ো দেশের সৈন্যদের এক আকস্মিক আক্রমণের কারণে পন্ড হয়ে গেলো। হয়তোবা এর চেয়েও গুরুতর আরেকটা কারণ ছিলো, আর তা হলো, আমার নিজের করণীয় কর্তব্য অবহেলা এবং এর জন্য দায়ী ছিলাম আমি নিজেই! বিব্রতকর পলায়নের মতো চূড়ান্ত ফলাফল লাভ করার মধ্য দিয়ে শেষ হওয়া জাঁকজমকপূর্ণ পশ্চিম সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন সফরটা ছিলো বিদঘুটে আর হাস্যকর ব্যাপার! আমার সফরসঙ্গী সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তারা রাজকীয় শকট বহরের ভিতরে বসে পরস্পরকে দোষারোপ করছিলেন, প্রকাশ করছিলেন তাদের ক্ষোভ, রথ চলকদের হুকুম দেয়া হয়েছিলো তারা যেন দ্বিগুণ গতিতে দিন রাত গাড়িগুলো চালিয়ে যায়। যাতে করে সীমান্ত পরিদর্শনে আসা ঘোড়া এবং গাড়ির বহর যাত্রীদের নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিপদ সংকুল এলাকার বাইরে চলে যেতে পারে। আমি রাজকীয় শকটের মধ্যে একটা বিষন্ন অবয়ব নিয়ে উপবিষ্ট ছিলাম, আমি স্মরণ করছিলাম প্রাসাদ ত্যাগ করার আগে ভাগ্য গণনাকারী গণকের ভবিষ্যত বাণীর কথা, আমার মানসপটে ফুটে উঠেছিলো তাঁর অলৌকিক উপায়ে ভবিষ্যত ঘটনা সংগঠনের পূর্বাভাস দেয়ার দৃশ্যটা। তিনি বলছিলেন, গুপ্ত তীর যখন ছুটে আসবে, তখন উত্তরের বাতাস সেটাকে ভেঙ্গে দেবে। আমার মনে হচ্ছে, একটা ব্যাপার নিশ্চিত যে সবার অজ্ঞাত সারে আমার অবস্থানকে পশ্চাদ্ধাবন করছে একটা গুপ্ত তীর! কিন্তু আমি জানি না, উত্তরের বাতাস কি ভাবে বইবে, কি ভাবেই বা উত্তরের বাতাস গুপ্ত তীরকে ভেঙ্গে দেবে। এমনও তো হতে পারে, এই ভবিষ্যত বক্তার কথাগুলো সবটুকুই অসাড় আর অর্থহীন!
ফেই চৌ এলাকার ডাক ছাওনিতে পৌঁছে শুনতে পেলাম ফং কুয়ো দেশ ফং হুয়াং গিরিপথ দখল করে ফেলেছে। আরও শুনতে পেলাম গিরিপথের ভেতর সিয়ে দেশের পঞ্চাশ লি উপত্যকা ভূমির খবরাখবর। উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের সুবাদার তা ইউ-এর সরকারি বাস ভবনে ফং কুয়ো দেশের সৈন্যরা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। তারা ধ্বংস করেছে অসংখ্য মদের মটকা, মদের ভান্ড! এই খবর শুনার পর তা ইউ রাগে ক্ষোভে ফেটে পরেছে, হয়ে গেছে বাক্য হারা! সে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দেয়া শুরু করেছে! সে কাঁদতে কাঁদতে হুমকি দিয়ে বলছিলো যে, সে নাকি অদূর ভবিষ্যতে ফং কুয়ো দেশের রাজা চাও মিয়েন এর অন্ডকোষ দু’টো কেটে ঐগুলো দিয়ে মদ চোলাই করে সেই মদ সে নিজে পান করবে! তা ইউ-এর প্রবল দুঃখ আর মনো কষ্টের বহিঃপ্রকাশের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়েও আমি রইলাম একে বারেই উদাসীন! আমার কাছে পশ্চিম সীমান্তের ফং হুয়াং গিরিপথ পরিদর্শনের ব্যাপারটা ছিলো আদিতে, প্রথমত নিতান্তই মজা করার বিষয়! কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন, ফং হুয়াং গিরিপথের পতন ঘটেছে, সেটা বর্তমানে ফং কুয়ো দেশের হাতে চলে গিয়েছে। এখন বাকী আছে শুধু একটা কাজ, নিরাপদে প্রাসাদে ফিরে যাওয়া!
আমার মনে পড়ছে আমি শুনেছি, আগের সম্রাটগণ নাকি চিয়াং শান সীমান্ত পরিদর্শনের সময় যে কোন ধরনের অপ্রত্যাশিত অঘটন ঘটতে পারে এমন আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন থাকতেন। আর অপ্রীতিকর ঘটনা মোকাবিলা করার জন্য মানসিক প্রস্তুতিও নিয়ে রাখতেন।
ফেই চৌ ডাক ছাওনিতে খাওয়া দাওয়া করার পর আমি আর ইয়েন লাঙ ছাওনির পিছনে গেলাম। আমরা খেললাম একটা খেলা। এবারের যাত্রা পথে এটা ছিলো সব চেয়ে মজাদার খেলা। আমরা পোশাক বদল করলাম, আমি পরলাম ওর জামা, আর সে পরিধান করলো আমার পোশাক! এরপর ড্রাগনের অবয়ব খোচিত রাজকীয় পরিচ্ছদ পরিহিত ইয়েন লাঙ-কে ঘোড়ার পিঠে আরোহন করার হুকুম দিলাম এবং ঘোড়ায় চড়ে ডাক ছাওনির চার পাশ থেকে একটা চক্কর দিয়ে আসার নির্দেশ দিলাম। আমি বললাম, “আসলে আমি দেখতে চাচ্ছি, কেউ আমার দিকে গুপ্ত তীর ছুঁড়ে কি না!”
ইয়েন লাঙ ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলতে শুরু করেছে, ওর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যেন ও’ বোধ হয় সারা জীবনের জন্যই সম্রাট বনে গেছে! সিয়ে দেশের সম্রাটের ভূমিকায় অভিনয় করার খেলায় ও’ খুবই দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে!
আমি একটা খড়ের গাদার উপরে বসে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলাম ইয়েন লাঙের চার পাশের অবস্থা, কান খাড়া করে শুনতে চাচ্ছিলাম যে কোন শব্দ! যে সব চকরেরা ঘোড়াকে খাওয়ানোর কাজে ব্যস্ত ছিলো, ওরা আমার আর ইয়েন লাঙের এই খেলার ব্যাপারটা মোটেও ধরতে পারে নাই!
আসলে অন্য কোন মানুষই টের পায় নাই যে, সত্যিকারের সিয়ে দেশের সম্রাট এই মুহূর্তে বসে আছে একটা খড়ের গাদায় হেলান দিয়ে! সব মানুষই ইয়েন লাঙের ঘোড়া বরাবর মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করে অভিবাদন জানাচ্ছে!
“জাঁহাপনা, কোন গুপ্ত তীর নিক্ষিপ্ত হয় নাই।”, ইয়েন লাঙ ডাক ছাওনির চার পাশে এক চক্কর ঘুরে আসার বিবরণ, যেন আনুষ্ঠানিকভাবেই আমার কাছে পেশ করলো! ওর ছোট মুখ অবয়বে প্রসারিত হয়েছে একটা বিচিত্র আনন্দ ধারা। সে আমাকে প্রশ্ন করলো, “জাঁহাপনা, আমি কি ঘোড়ায় চড়ে কৃষকদের বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে দেখে আসবো?”
“তুমি ঘোড়া থেকে নেমে আসো।”, হঠাত করেই আমার খুব মন খারাপ হলো। আমি মোটামুটি বিদ্বেষপূর্ণ আর নিষ্ঠুরভাবেই ঘোড়ার পিঠ থেকে ইয়েন লাঙ-কে টেনে নামিয়ে এনে খুব দ্রুত পোশাক পাল্টিয়ে নেয়ার হুকুম দিলাম।
রাজকীয় পোশাকের প্রয়োজনীয়তা আর গুরুত্ব আমি উপলব্ধি করতে পারছি! যদিও খুব অল্প সময়ের এই পোশাক বদলের খেলার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছিলো রাজকীয় পোশাকের প্রতি আমার অনিহার মনোভাব!
একটা অনুভূতির ব্যাপার, আমি ঠিক ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না, খড়ের গাদায় হেলান দিয়ে বসে আমি যখন রাজকীয় পোশাক পরিহিত ইয়েন লাঙের ঘোড়া ছুটিয়ে যাওয়ার দৃশ্য অবলোকন করছিলাম, তখন একটা উদ্বিগ্নতার হতাশা আমাকে গ্রাস করছিলো! আমি হঠাত করেই উপলব্ধি করলাম, সিয়ে দেশের সম্রাটের পোশাক অন্য মানুষের দেহে থাকলে, ঐ মানুষটিও সম্রাটের মতোই ক্ষমতাধর হয়ে উঠতে পারে! আমি মনে মনে নিজেকেই বললাম, তুয়ান পাই! তুমিও যদি নপুংসক খোজা দাসদের পোশাক পরিধান করো, তবে তুমিও হয়ে যেতে পারো এক জন খোজা দাস!
আর তোমার পরনে যদি থাকে ড্রাগনের অবয়ব খোচিত সম্রাটের রাজকীয় আলখেল্লা তবে সত্যিই, তুমি তুয়ান পাই, হয়ে উঠবে সিয়ে দেশের সম্রাট!
এটা আমার কাছে যেন, একটা ধরনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা লব্ধ উপলব্ধি!
খেলা জমে ওঠার মাঝামাঝি পর্যায়ে খেলাটা বন্ধ করে দেয়ার অন্তর্নিহিত কারণ ইয়েন লাঙ বুঝতে পারলো না। সে কাপড় বদলাবার সময় হত বিহ্বলতার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি অত্যন্ত কর্কশভাবে ওকে জলদি করে কাজ শেষ করার নির্দেশ দিলাম। আমি বললাম, “যদি হুয়াং ফু ফুরেন এই পোশাক বদলের খেলার ব্যাপারটা জানতে পারেন তবে তিনি তোমাকে আস্ত রাখবেন না, সাথে সাথেই মেরে ফেলার ব্যবস্থা করে ফেলবেন, তুমি কি বুঝতে পারছো?”
ইয়েন লাঙ ভয়ে কেঁদে ফেললো, আমি পরে লক্ষ্য করেছি, সে ভয়ে পেশাব করে দিয়েছে, ভিজিয়ে ফেলেছে তার পরনের পায়জামা! সৌভাগ্য যে, সে এরই মধ্যে রাজকীয় আলখেল্লা খুলে আমার হাতে দিয়েছে। যদি ড্রাগনের অবয়ব খোচিত রাজকীয় আলখেল্লা পেশাব দ্বারা ভিজে যেতো, তা হলে এটা নিশ্চিত যে, এর পরিণাম হতো অকল্পনীয়!
ফেই চৌ-তে কাটানো একটা দিনই আমার দেহে সঞ্চারণ করলো উত্তাপ! আসলো জ্বর! এমনও হতে পারে অসুখ হওয়ার কারণই ছিলো আমার আর ইয়েন লাঙের পোশাক বদলের খেলা। তখন কি আর জানতাম, ডাক ছাওনির খড়ের গাদার পিছনে পোশাক বদল করার সময় শীতের বাতাস আমার ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহটার ভিতরে ঢুকে, একে বারে কাবু করে ফেলবে আমাকে! কিন্তু আমি ‘পোশাক বদল খেলা’-র ব্যাপারটা অন্য কারো কাছেই প্রকাশ করলাম না।
আমার সফরসঙ্গী রাজকীয় চিকিত্সক আমাকে এক পুরিয়া ঔষধ দিলেন সেবন করার জন্য। তিনি নিশ্চয়তা দিয়ে বললেন যে দ্বিতীয় দিনের মধ্যেই আমার অসুস্থতা পুরোপুরি কেটে যাবে। ঐ ঔষধের পুরিয়া থেকে বের হচ্ছিল মাছ কিংবা মাংসের আঁশটে গন্ধ। আমার ধারণা ঐ ঔষধ জীব জন্তু কিংবা মানুষের রক্ত মাখিয়ে তৈরী করা হয়েছে। আমি অর্ধেক খেতে পেরেছি, বাকী অর্ধেক বমি করে দিয়েছি। ফলাফল যা হলো, পরের দিন সবে ফেই চৌ নগর ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর, সারা দেহে আমি অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করলাম। আমরা সফরসঙ্গী সামরিক আর বেসামরিক কর্মকর্তারা সবাই খুবই হতবিহ্বল ও আতঙ্কিত হয়ে পরলেন। পুরো গাড়ি বহর রাস্তায় দাঁড়িয়ে পরলো, অপেক্ষায় রইলো কখন রাজকীয় চিকিত্সক আমার নাড়ীর স্পন্দন পরীক্ষা করা শেষ করে কি বলেন! রাজ চিকিত্সক আবারও লাল-কালো রঙের ঔষধের পুরিয়া নিয়ে আসলেন। আমি এক লাথি মেরে ঔষধগুলো শূন্যে উড়িয়ে দিলাম। আমি জ্বরের ঘোরে তার উদ্দেশ্যে চিত্কার করে বললাম, “আমাকে রক্ত খেতে দিয়ো না! আমি রক্ত খেতে চাই না।” রাজকীয় চিকিত্সক পরে যাওয়া ঔষধের পুরিয়াগুলো তুলে নিয়ে নিলেন। আর রাজ দরবারের প্রধান নজরদার লিয়াং ইউ শ্র-কে নিম্ন স্বরে কানে কানে কি যেন বললেন। এরপর রাজকীয় শকট বহর আবার পথ চলা শুরু করলো। তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলেন দ্বিগুণ গতিতে রাত দিন এক টানা পথ চলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিন চৌ শহরে পৌঁছাবার। লোকে বলাবলি করছিলো, পশ্চিম অঞ্চলের সুবাদার চাও ইয়াং, তার প্রাসাদে জড়ো করেছেন সিয়ে দেশের সবচেয়ে খ্যাতিমান, মেধাবী আর দক্ষ তিনজন রাজকীয় চিকিত্সককে!
দ্বিতীয় বারের মতো ফিন চৌ এসে আমার কাটানো কয়েকটা দিন কেটেছে অবসন্নতা আর জড়িমা গ্রস্ত অবস্থায়, প্রাসাদের রাজকীয় বিছানার পালঙ্কে শুয়ে বসে থেকে! আশেপাশে যে কি বিচিত্র ঘটনাবলী সংগঠিত হচ্ছে, সে সম্পর্কে আমি একে বারেই অবগত ছিলাম না। এরই মধ্যে পশ্চিম অঞ্চলের সুবাদার চাও ইয়াং কর্তৃক আমন্ত্রিত তিনজন বিখ্যাত চিকিত্সক আমাকে কয়েক বার দেখে গিয়েছেন। তাদের চেহারা, আর তারা কি কথাবার্তা বলেছিলেন তা আমার আর মনে পড়ছে না। পরে আমি ইয়েন লাঙের কাছ থেকে শুনেছি, বিভিন্ন ঔষধি গাছগাছড়ার নির্জাস থেকে তৈরী গরম সুরুয়ার সাথে রাজ চিকিত্সক ইয়াং তোং বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলেন। গোপনে গোপনে নিজেকে আড়াল করে এই ব্যাপারটা ইয়েন লাঙ যখন আমাকে অবগত করছিলো, তখন সে বেশ খানিকটা ঘাবড়িয়ে গিয়েছে! তাকে হুমকি দেয়া হয়েছে, সে যেন কোন সূত্র থেকে এ খবরটা পেয়েছে সেটা যেন কোনভাবেই ফাঁস না করে। অন্যথায় এই খবরটা যাদের কাছ থেকে এসেছে, ওরা ওকে খুন করে ফেলবে। আমার মনে আছে ঐ দিন ভোরে পশ্চিম সুবাদারের প্রাসাদ ছিলো একে বারে নিঃশব্দ নিঃস্তব্ধ! আমি সবে মাত্র সেরে উঠেছি। একটা হালকা সূর্য কিরণ পাশের জানালা দিয়ে আমার সদ্য রোগ মুক্ত দেহের উপর এসে পরছে। আর সেটা যেন কাঁটার মতো আমার গায়ে এসে বিঁধছে! আমি টান দিয়ে রতœ খোচিত হাতলের তরবারিটা বের করে এক কোপে পাশে রাখা ফুলের নকশা কাটা একটা কাঠের থালা দু’খন্ড করে ফেললাম। এটা দেখে ইয়েন লাঙ ভয়ে আতঙ্কে বসা অবস্থা থেকে পরে গেল মাটিতে! সে আমাকে অনুনয় করে বললো উত্তেজিত অবস্থায় অপরাধীকে দন্ড দেয়ার সময় আমি কোনভাবেই যেন ওর নামটা উত্থাপন না করি!
আমি রাজ দরবারের প্রধান নজরদার লিয়াং ইউ শ্র এবং তার সহযোগী কর্মকর্তাদের ডেকে পাঠালাম। তারা আমার অগ্নি শর্মা চেহারা দেখেই বুঝে ফেললেন আজকে আমার সাথে তাদের সাক্ষাত সভার আসন্ন ফলাফল! হাঁটু গেড়ে কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে আমার বিছানার চারি দিকে তারা বসে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন আমার ভত্সনা মূলক প্রশ্নাবলীর! শুধু মাত্র দরজার পাশে হাঁটু গেড়ে মাথা নীচু না করে বসেছেন, সাদা আলখেল্লা আর কালো জুতা পরিহিত, লম্বা দাড়ি আর কপালের দু’পাশের চুল ছুড়ির ফলার মতো করে ছাঁটা এক জন, তিনি হচ্ছেন পশ্চিম অঞ্চলের সুবাদার চাও ইয়াং। তার হাত দু’টো কোমরের পিছনে পিঠের দিকে জড়ো করে ধরে রেখেছে একটা কিছু!
“সুবাদার, তোমার হাতের মধ্যে ওটা কি?”,আমি তলোয়ারের ধারালো দিকটা তাগ করে চাও ইয়াং-কে প্রশ্ন করলাম।
“ওখানে আছে আমার রাজ বৈদ্য ইয়াং তোং-এর শিরশ্ছেদ করা শির!”, পশ্চিম অঞ্চলের সুবাদার কথা বলতে বলতে হঠাত করেই পিছন থেকে সামনে এনে দু’হাত দিয়ে উঁচু করে তুলে ধরলো জিনিসটা। যা আশঙ্কা করছিলাম, ওর হাতের মধ্যে আছে একটা রক্ত স্নাত মানুষের অবয়ব, একটা কর্তন করা মুন্ডু! জানি না কি কারণে, পশ্চিম সুবাদারের চোখ দু’টি অশ্রু জলে ভরে উঠেছে। সে বললো, “চাও ইয়াং নিজে উদ্যোগি হয়ে তার অতি প্রিয় ইয়াং তোং-এর শিরশ্ছেদ করেছে? জাঁহাপনার পক্ষ থেকে সে অপরাধীর শাস্তি কার্যকর করেছে!”
“তুমি তো নিজেই ষড়যন্ত্রকারী, তুমি তো নিজেই নির্দেশ দিয়েছিলে ইয়াং তোং-কে আমার খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে দেয়ার জন্য, তাই নয় কি?”, আমি মুখ ঘুরিয়ে বসলাম অন্য দিকে, আমি দেখতে চাচ্ছিলাম না ওটা! মানুষের কাটা মুন্ডুটা! কারণ আমি ভয় পাচ্ছিলাম, আমি নিজেকে সামলাতে পারবো না, আমি বমি করে ফেলবো!
আমি শুনতে পেলাম খুব অল্প ক্ষণের জন্য পশ্চিম সুবাদারের মুখ থেকে আসা একটা ব্যঙ্গাত্মক হাসির শব্দ! হঠাত করেই ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে আমি ক্রোধে ফেটে পরলাম, চিত্কার করে বললাম, “তুমি হাসছো কেনো? তুমি কি আমাকে পরিহাস করে হাসছো? তোমার কতো বড় সাহস!”
“জাঁহাপনা, মন দিয়ে লক্ষ্য করে বিচার করুন! পরিহাস করার সাহস আমার নাই। (চলবে)