অনলাইন ডেস্ক : চীনের সাংহাই শহরের পুরাতন এলাকায় দুই রুমের একটি ফ্ল্যাট নিয়ে থাকেন পিয়ানো শিক্ষক মেরি জুয়ে। ৩২ বছর বয়সী এই তরুণীর সঙ্গে ওই ফ্ল্যাটে সঙ্গী হিসেবে থাকে দুটি বিড়াল। স্টুডিওতে পিয়ানো শেখানোর কাজ করা ছাড়া মেরির সময় কাটে বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে, আড্ডা দিয়ে। এছাড়া বাড়িতে তিনি ব্যস্ত থাকেন তার পোষা দুই বিড়াল নিয়ে। প্রায়ই বিড়ালদের নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ছবি পোস্ট দেন তিনি।
মেরির ভাষায়, বেশ তো কেটে যাচ্ছে জীবন। কেন শুধু শুধু বিয়ে করতে হবে?
শুধু মেরিরই নয়, চীনের অনেক তরুণীর মধ্যেই একা থাকার প্রবণতা বাড়ছে। অথচ চীনে এখনও পারিবারিক মূল্যবোধের যথেষ্ট গুরত্ব রয়েছে। সেখানে মেয়েদের একা থাকার বিষয়টি এখনো সবাই ভালোভাবে নেন না।
তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দেশটিতে অল্প বয়সী মেয়েদের মধ্যে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। চীনের সিভিল অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৩ সাল থেকে চীনে বিয়ের হার হ্রাস পাচ্ছে। গত বছর ৯০ লাখ বিয়ে নিবন্ধিত হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৮ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে।
চীনের অর্থনৈতিক তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে ইতিমধ্যে ‘একক অর্থনীতি’ বৃদ্ধির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশের মতো একার জন্য খাবার, একক বিমান ব্যবহার, একক বিমানের টিকেট কেনা, এমনকি এক ব্যক্তির বুথ ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে।
চীনের কয়েকজন সিঙ্গেল নারী জানিয়েছেন, তারা অন্য কারো জন্য নয় বরং আত্মমর্যাদার দিকে মনোনিবেশ করতে চান।
বেইজিংয়ের একটি রেস্তোরাঁর বিপণন পরিচালক হিসেবে কাজ করছে ঝাং জিয়াকি। তিনি জানান, বয়ফ্রেন্ডের সাথে বিচ্ছেদের পর ২০১৩ সাল থেকে তিনি একা জীবনযাপন করছেন।
জিয়াকি জানান, তারা আড়াই বছর একসাথে ছিলেন। এর মধ্যে এক বছর তিনি বাড়িতে বয়ফ্রেন্ডের অপেক্ষায় থাকতেন, কখন সে বাড়ি ফিরবে বলে। সাংহাইতে যখন সে কাজে যেত তিনি তার জন্য প্রতিদিন রাতের খাবার তৈরি করে রাখতেন।
জিয়াকি বলেন, তার বয়ফ্রেন্ড জাপানে নতুন চাকরি পাওয়ার পর তিনি বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন। ওই সময় তার বয়ফ্রেন্ড তাকে তার সাথে বিদেশে যেতে বলেছিলেন।
জিয়াকির ভাষায়, তার মনে হচ্ছিল তিনি নিজেকে হারিয়ে ফেলছেন, জীবনের মূল্যবোধগুলি হারিয়ে ফেলছেন। তিনি জানান, তার মনে হয়েছে তিনি কোনও পুরুষের আনুষঙ্গিক বস্তু হতে পারবেন না।
তিনি বলেন, আমার বয়ফ্রেন্ড আমাকে খাঁচার মধ্যে আটকে রাখতে চেয়েছিল। যা থেকে আমি বেরিয়ে আসতে চেয়েছি।
বেইজিংয়ে ফিরে জিয়াকি আবার তার কাজ শুরু করেছেন। এখন নিজেকে তিনি পরিপূর্ণ মনে করছেন। অবসরে বন্ধুদের সাথে সময় কাটাচ্ছেন, বাইরে ঘুরতে যাচ্ছেন, ছবি আঁকছেন। জিয়াকির মতে, ভালোবাসার চেয়ে জীবনের মূল্যবোধ অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
পিয়ানো শিক্ষক মেরি জুয়ে জানান, সঠিক জীবনসঙ্গী পেলে বিয়ে করতে তার আপত্তি নেই। তবে তার মতে, বিয়েটা যতটা সহজ বলে দাবি করা হয় আসলে ততটা সহজ নয়। এর জন্য ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ত্যাগ করতে হয়।
চীনে যে হারে বিয়ের প্রতি নারীরা আগ্রহ হারাচ্ছে তাতে ধারণা করা হচ্ছে আগামীতে বিশ্বের অনেক দেশের মতো এখানেও জন্মহার কমে যাবে।
চীনের একজন নারীবাদী লেখক হও হংকবিনের মতে, এশীয় অন্যান্য দেশের মতো চীনে এখনো বিয়ের জন্য সামাজিক চাপ আছে। এ কারণে দেশটিতে বিবাহিতের তুলনায় অবিবাহিত মানুষের সংখ্যা এখনও তুলনামূলকভাবে কম।
দ্য কোরিয়া হেরাল্ডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী পুরুষদের মধ্যে ৯০ শতাংশ এবং ৭৭ শতাংশ নারী অবিবাহিত ছিলেন। ৩০ থেকে ৩৪ বছর বয়সের মধ্যে এই সংখ্যাটি ছিল ৫৬ শতাংশ এবং ৪০-৫৫ বছর বয়সীদের মধ্যে সংখ্যাটি ছিল ৩৩ শতাংশ।
হও হংকবিনের ভাষায়, চীনের বিয়ের আগ্রহ কমার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে চীনের এক সন্তান নীতি। বিশেষ করে ছেলে সন্তান লাভের আশা। তবে এখনকার নারীদের পছন্দ-অপছন্দও এ অবস্থা তৈরি করেছে বলে তিনি মত দেন।
হও হংকবিন বলেন, আগে কোনও নারী বিয়ে করতে চান না এমন কথা বলার সাহস পেতেন না। এখনকার নারীরা সেটা বলে। এর বিপরীত ঘটনাও আছে। তিনি বলেন, কিছু নারী টাকা জমাচ্ছেন বা বাড়ি কিনছেন যাতে তাদের বিয়ে করার বিকল্প কিছু থাকে।
শেনজেনের ভায়োলা জেং নামের এক তরুণী বলেন, গত কয়েক বছর ধরে তিনি তার বাবা-মাকে বিবাহিত বন্ধুদের দুরবস্থা ও ডিভোর্সের পরিসংখ্যান দিয়ে বিয়ের চাপ আটকে রেখেছেন।
তার ভাষায়, বিবাহিত, অবিবাহিত বা কোনও সম্পর্কের মধ্যে থাকুন না কেন নিজে ভালো থাকতে হবে। এটা নিয়ে অন্য কে কী বললো বা ভাবলো সেটা নিয়ে চিন্তিত হওয়া ঠিক নয়। সূত্র : সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট