নাদিরা তাবাসসুম : রিহানের মাথায় হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ করেই চাকরিটা চলে গেল। যদিও চাকরি নেয়ার সময় তার মনে হয়েছিল দেখা যাক কত দিন চালানো যায়। কারণ আগে থেকেই জানতো ‘হায়ার এন্ড ফায়ার’ ব্যাপারটি কানাডায় অতি স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমানে করোনা ভাইরাস-এর কারণে ক্রাইসিস এখন সবখানে অহরহ ঘটছে। মেনে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে নিয়ে কিভাবে চলবে তারপর আবার সাথে রয়েছে বৃদ্ধা বাবা-মা। স্ত্রীর সাথে ঝগড়া রাগারাগি, ছেলেমেয়েদের সাথে বকাবকি। এখন কি করবে ভেবে পায় না। মাথায় ঘুরছে জীবন ও জীবিকা নিয়ে শত সমস্যা শত চিন্তা। এক সমস্যা থেকে আরেক সমস্যার চিন্তা, ভালো চিন্তা, খারাপ চিন্তা, নিজের চিন্তা, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, পৃথিবী অথবা মহাবিশ্ব নিয়ে চিন্তা। মাথায় চিন্তা ছাড়া কোন খালি জায়গা নেই। করোনা মহামারির সমস্যা বিশ্বজুড়ে এক মহাচিন্তা। ভ্যাক্সিন এলেও ‘কোনটা ভালো’ ‘কোনটা ভালো নয়’ নানা চিন্তা। চিন্তাগুলোর মাঝে আবার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আশংকাও আছে। শরীরের রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়ার মতো চিন্তা প্রক্রিয়াও সারাদিন কাজ করে চলেছে মাথার মধ্যে। যদিও রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়ায় মানুষের কোন হাত নেই। কিন্তু চিন্তা প্রক্রিয়ায় মানুষ ইচ্ছে করলে ভাল চিন্তা, মন্দ চিন্তা, শুভ চিন্তা, অশুভ চিন্তা (পজিটিভ চিন্তা, নেগেটিভ চিন্তা) বিষয়গুলো বাছ বিচার করতে পারে। ভালো মন্দ ঘটনাগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করা যায় এবং সমাধান বের করা যায়। তাই বুঝি মাথাকে সুপার কম্পিউটারও বলা হয়। হঠাৎ মাথায় এলো বন্ধু রেশাদের সাথে টেলিফোনে কথা বলে সমস্যাটা শেয়ার করলে যদি কোন একটা উপায় বের করা যায়। রেশাদ টেলিফোনে বন্ধু রিহানের সকল সমস্যা শুনে উত্তরে বলে, ‘বন্ধু চিন্তা করো না। করোনা চলাকালে মানুষের কাজ কর্ম কমে গেছে, তাই কর্মচারী ছাঁটাই হচ্ছে অহরহ। এ মুহূর্তে চাকরিটা চলে গেলো আসলে চিন্তার বিষয় কিন্তু এখন কোন উপায় নেই। তোমাকে আর একটা চাকরি খুঁজতে হবে এবং অনলাইনে খুঁজতে থাক। আর একটা কথা মনে রাখবে, এসময় মাথা ঠান্ডা রাখা কঠিন কিন্তু যেভাবেই হোক তোমার মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। অকারণে অস্থির ও উত্তেজিত হয়ে পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি করো না। এমনিতেই করোনা মহামারির জন্য মানুষের বিভিন্ন ধরণের মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাই দুশ্চিন্তায় নিজেকে হারিয়ে ফেলবে না। কিছুদিন আগে একটা ম্যাগাজিনে ‘পজিটিভ থিঙ্কিং’- এর গুরুত্ব বিষয়ে একটা লেখা পড়েছি। তাছাড়া মনোবিজ্ঞানী ডাঃ ক্রীস উইলিয়ামস-এর গবেষণা থেকে যা জানতে পেরেছি তা থেকে মনে হয় এ ধরনের সমস্যাসংকুল পরিবেশে মাথা ঠান্ডা রেখে মানসিক ও শারীরিক শান্তি বজায় রাখা খুবই জরুরি।
রিহান – বন্ধু উপায়টা বলো, কারণ আমি খুউব অশান্তিতে আছি। পরিবারের সবার সাথে খারাপ ব্যবহার করে যাচ্ছি তাই ঝগড়াবিবাদ লেগেই আছে।
রেশাদ – আমি এসব পড়াশোনা করে যা বুঝেছি এবং যতটুকু বুঝেছি তাই তোমাকে বলছি মন দিয়ে শোনো। পৃথীবিতে যত সমস্যা বা ঘটনা ঘটছে বা ঘটে চলেছে তা মানুষ প্রথম চোখ দিয়ে দেখছে তারপর চিন্তা করছে ও মন দিয়ে অনুভব করছে, এরপর শরীরে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া হিসেবে, মানুষের সাথে কথা বলা, হাঁটা চলা ফেরা এবং ব্যবহার আচরণ করছে। বাহ্যিক পৃথিবীর সমস্যা বা ঘটনাগুলো উত্তেজক হিসেবে কাজ করছে আমাদের শরীরের সব অংগ প্রত্যংগে। শরীরটা দৃশ্যমান পৃথিবী এবং পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর সাথে সম্পর্কযুক্ত। যেমন- তোমার চাকরি চলে যাওয়ায় তোমার আয় রোজগার বন্ধ হয়ে গেলো। স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, বৃদ্ধ বাবা-মা সবাই তোমার উপর নির্ভরশীল, কিভাবে সংসার চলবে ইত্যাদি নানা রকম দুশ্চিন্তা। এই দুশ্চিন্তা উত্তেজনা থেকে তোমার মেজাজ রাগ, খারাপ ব্যবহার ও ঝগড়াবিবাদ এমনকি মারামারি শারীরিক বিপর্যয়, হার্ট এট্যাক ইত্যাদি ঘটতে পারে।
আমরা শরীরের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো প্রকাশ্যে দেখতে পাই কিন্তু মাথার মধ্যে যে ঘটনার চিন্তা ও তার বিচার বিশ্লেষণ দেখতে পাই না। চিন্তাজগত একেবারেই অদৃশ্যে থেকে যায়। আমাদের চিন্তাগুলো তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য বলা হয় ‘একজন মানুষ তাই যা সে চিন্তা করে, যেমন সে চিন্তা করে’। অবশ্য মানুষের সকল চিন্তা সব সময় কাজে পরিণত হয় না। অনেক চিন্তা মাথার ভিতরেই বসবাস করে বছর বছর ধরে। আবার কিছু চিন্তা আনাগোনা করছে যখন তখন যা ঘটছে তা নিয়ে। তাই কিছু চিন্তা ‘সেটেল্ট থটস’ এবং কিছু চিন্তা ‘পাসিং থটস’।
জন্মগতভাবে মানুষ মাত্রই চিন্তাশীল। চিন্তা আছে বলেই আমরা আছি। চিন্তা করতে পারি বলেই আমরা মানুষ। ফরাসী দার্শ নিক রেনে দেকার্তের মতে “আই থিংক, দেয়ারফোর আই এয়াম”। পশুপাখি তাই সহজেই পশুপাখি কারণ তাদের চিন্তা-ভাবনা করতে হয় না। মানুষকে তার চিন্তাসমূহের মধ্যে ভালো চিন্তা মন্দ চিন্তা; পজিটিভ চিন্তা নেগেটিভ চিন্তা বেছে বুঝে কথা বলতে হয়, কাজ করতে হয়। সাধারণভাবে নিজের জন্য বা পরের জন্য খারাপ বা ক্ষতিকর চিন্তাগুলো ‘নেগেটিভ’ আর যেসব চিন্তা নিজের জন্য বা পরের জন্য ভালো এবং উপকার করে সেগুলো ‘পজিটিভ’ চিন্তা। আমাদের চারপাশে যখন কোন ঘটনা ঘটে, তখন মাথায় একটা চিন্তা আসে। যেমন উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক- চোখের সামনে একজন মানুষকে প্রচন্ড মারধোর করা হচ্ছে, তক্ষুনি মাথায় চিন্তা এলো ‘নিশ্চয়ই লোকটা কোন অপরাধ করেছে, আবার শরীর থেকে রক্ত পরার কারণে মনে একটু দয়ার অনুভূতি জাগছে, তারপর এগিয়ে হয়তো থামানোর চেষ্টা, তারপর হয়তো হসপিটালে নেওয়ার চেষ্টা। তাই ঘটনা দেখে চিন্তা আসে, চিন্তা থেকে আসে আবেগ অনভূতি, আবেগ অনুভূতি থেকে আসে কিছু করতে যাওয়া যা আমাদের আচার ব্যবহারে প্রকাশ পায়। আবার কখনো কেউ যেকোন কারণে আমাদের উপর রেগে চীৎকার করে খারাপ বকাবকি দিলে, আমরা তখন চিন্তা করি নানা কারণ খুঁজি ‘কেন এত খারাপ বকাবকি করলো; তখন মনে খারাপ অনুভূতি এসে মনটা অত্যন্ত দুর্বল ও ছোট করে দেয়; আবার আমরা কেউ কেউ ভীষণ রেগে গিয়ে প্রতিশোধ নিতে যাই, পাল্টা বকাবকি অথবা মারধোর এমন কি তা হাসপাতাল পর্যন্ত গড়াতে পারে। এটা এমন যে- ‘নেগেটিভ ‘ঘটনা ঘটতে দেখলে- নেগেটিভ চিন্তা মাথায় কাজ করে- তা থেকে নেগেটিভ অনুভূতি মনে জাগে- তা থেকে ‘নেগেটিভ’ ব্যবহার প্রকাশ পায় যা শেষ পর্যন্ত ‘নেগেটিভ শারীরিক’ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। এভাবে আমরা ‘নেগেটিভ’ “ভিশাস সাইকেলে” বা “স্পিনিং হুইল”এ ঘুরপাক খেতে থাকি। ধীরে ধীরে মানসিক ও শারীরিক বিপর্যয় আমাদের গ্রাস করে ফেলে এবং আমরা চোখে অন্ধকার দেখতে থাকি।
এমন পরিস্থিতির ক্ষেত্রে আমরা ‘নেগেটিভ’ চিন্তাগুলোকে গ্রহণ না করে সেসব জায়গায় ‘পজিটিভ’ চিন্তাকে জায়গা করে দেব। কারণ আমরা বাইরের জগতে ঘটে যাওয়া সমস্যা বা ঘটনাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না কিন্তু মাথায় উদিত চিন্তাগুলোর নিয়ন্ত্রণ করতে পারি; সাথে সাথে নিজের মধ্যে সংযম ও শান্ত ভাবের সৃষ্টি করে নিয়ে নিজেকে সরিয়ে নেয়া পারে। নিজেকে শান্ত করার পাশাপাশি কিছুক্ষণ দীর্ঘ সময় ধরে শ্বাস প্রশ্বাস নিতে হবে। নিজের দক্ষতা ও বিশ্বাস নিয়ে মনে চিন্তা করতে হবে এবং অশুভ পরিবেশ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। অন্যকে পরিবর্তন করার চেষ্টা না করে নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করতে হবে। নিজের ভেতরে শক্তি সঞ্চয় করে নিজের সাথে বোঝাপড়া করতে হবে এবং কিভাবে নিজের রাগ ও উত্তেজনা কমিয়ে ফেলা যায় তার প্রতিনিয়ত অভ্যাস ও চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
তোমাকে এও চিন্তা করতে হবে যে সবকিছুর ভালো দিকও আছে। এই যে এখন চাকরি চলে যাওয়ায় তুমি পরিবারে সবার সাথে সময় দিতে পারছ যেটা চাকরির ছুটোছুটির কারণে এতদিন পারনি। ভালোভাবে সময় কাটালে নিজেও শান্তি পেলে অন্যদেরও শান্তি দিলে। ওদিকে চেষ্টা চালিয়ে গেলে কিভাবে একটা চাকরি পাওয়া যেতে পারে। আমাদের আরও বন্ধুবান্ধব ও পরিচিত আত্মীয়স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করো।
কারণ ভালো চিন্তা বা ‘পজিটিভ’ চিন্তা আমাদের সুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
‘পজিটিভ’ চিন্তার মাধ্যমে মানুষ যেসব উপকার পেতে পারে তা হলো :
* দীর্ঘায়ুজীবন লাভ করা যায়, হতাশা নিরাশা দুঃখ কমে যায়
* মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা বৃদ্ধি পায়
* হৃদরোগ সংক্রান্ত স্বাস্থের উন্নতি ঘটে
* যেকোন দুঃখ বা বিপদে-আপদে নিজেকে সুচিন্তিত উপায়ে সুরক্ষা করা যায়
* পরিবার এবং বন্ধুবান্ধব-এর সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা যায়
* জীবনের যেকোন পরিবর্তনকে সহজে মেনে নেয়া যায়
* নিজে নিজে সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে এই আশায় বসে না থেকে সমস্যা সমাধানে দ্রæত কার্যক্রম গ্রহণ করা যায়
আমেরিকান চিন্তাবিদ ও লেখক নরমান ভিন্সান্ট পিল- এর মতে, “নিজেকে বিশ্বাস করুন! নিজের দক্ষতার উপর বিশ্বাস রাখুন! নিজের ভেতরের দক্ষতার উপর বিনীত কিন্তু যুক্তিসংগত আত্মবিশবাস ছাড়া কখনও সাফল্য লাভ করা যায় না বা সুখী হওয়া যায় না।”
কান্সাস ইউনিভার্সিটি গবেষণা অনুযায়ী, অধিক পরিমাণে সাধারণ সহজ হাসি যদি কৃত্রিমও হয় (অর্থাৎ যেটাকে আমরা ‘ফেক’ বলি) তাহলেও সেই হাসি অত্যন্ত উদ্বেগ – উত্তেজনার মুহূর্তে ব্লাড প্রেসার এবং হার্ট রেট কমিয়ে দিতে পারে। সুতরাং কিছু সময়ের জন্য হলেও হাস্য কৌতুক থেরাপি গ্রহণ করা যায় মজার ‘ফানি’ কোন ভিডিও অথবা নাটক দেখে।
রিহান সবকিছু শুনে বলল – বন্ধু এত সুন্দর সুন্দর উপদেশ তো ভালোই মনে হয় কিন্তু বাস্তবে যার অবস্থা সেই বোঝে ব্যথাটা কি কষ্টদায়ক ও দুঃখজনক।
রেশাদ – এ ধরনের ঘটনা, সমস্যা, দুঃখ ও কষ্ট মানুষের জীবনে অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তাই কিভাবে এগুলোকে সামলে নিয়ে ধীর স্থীর ঠান্ডা মাথায় শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্য বজায় রেখে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যায় তা আমাদের অবশ্যই জানা উচিত। শুধু জানলেই হবে না, জেনে বুঝে এগুলোর অনুসরণ ও প্রতিনিয়ত অভ্যাস করা উচিত।
রিহান – বন্ধু, উপদেশের জন্য অনেক ধন্যবাদ। তবে তোমার অফিসে বা তোমার পরিচিত কারো অফিসে দেখ না একটা যদি চাকরি থাকে। যেকোন একটা কাজ আমার এখন খুউব প্রয়োজন।
রেশাদ – আমি বুঝতে পেরেছি । আমি তোমার জন্য নিজে খোঁজ করে দেখবো এবং অন্য বন্ধুদেরও বলবো। কোন খোঁজ পেলে আমি অবশ্যই তোমাকে জানাবো- এই বলে রেশাদ টেলিফোন রেখে দেয়।