সাজ্জাদ আলী : দুখানা কড়াই-গরম লুচি আমার পাতে ঢেলে দিলো সে। একটু বাদেই বড়সড় এক বাটি তরকারী ডাইনিং টেবিলে এনে রাখলো। দেখি, বাঁধা কপি আর পাঠার মাংস কষিয়ে রেঁধেছে। আহারে, কী সুবাস, কী সুবাস! সুগন্ধের ঝাপটায় পেটের ক্ষুধা মোচড় দিয়ে উঠলো। তা বছর দেড়েক আগে হবে। বলছিলাম আমাদের জয়ীতার কথা। তুখোড় রাধুঁনী সে। শুধু কী রান্নাবাটি? কারণে অকারণে প্রিয়জনদের বাড়িতে ডেকে সে সব রান্না খাওয়ানোতেও তার জুড়ি মেলা ভার! আমি তো প্রায়ই কব্জি ডুবাই। তবে সে যত বড় রাধুঁনীই হোক, প্রথম দেখার দিন থেকেই আমার মনে হয় যেন সে নাচুনি হলেই ভাল হতো। কেন যে অমনটা মনে হয়, তা ঠিক জানি না!
মুখের কথা থামিয়ে দিয়ে চন্দন আমায় বললো, দাদা ঠাণ্ডা হলে লুচির আসল স্বাদ আর পাবে না। খাও আর কথা বলো। কথা ঠিক বটে। একটা লুচির আধাটা ছিঁড়ে তরকারী পেঁচিয়ে নিলাম। তারপর পুরোটাই বাম গালে ঢুকালাম। বাকি আধাটা লুচি তিন আঙ্গুলে নাড়াচাড়া করতে করতে বললাম, হ্যাঁরে চন্দন, চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যের ভিডিও ভার্সন বানাবো। তুই অর্জুনের গানগুলো ঠিকঠাক গেয়ে দিতে পারবি না? একেবারে হেমন্ত মুখার্জীর আদলে চাই কিন্তু?
পারবো দাদা। কবে গাইতে হবে বলো? খাঁটুনি দিয়ে গানগুলো গলায় তুলবো আমি। তোমার মান রাখবো, চিন্তা কোরো না, বলছে চন্দন। তবে হয়েছে কী জানো, রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদাটা আমাকে ভাল করে বুঝিয়ে বলবে তুমি। ঘটনাটা মাথার মধ্যে থাকলে প্রাণ খুলে গাইতে পারবো।
গাইতে যে সে পারবে, তা আমার জানা। ওকে সৃষ্টি করার সময়ে ঈশ্বর বোধ করি পরম যতনে ওর গলায় সুর বসিয়ে দিয়েছিলেন। নইলে ওর সুরে এত সুধা কেন? এত মধু কেন? অমন কন্ঠস্বর রেওয়াজ করে হয় না। এ শুধু প্রকৃতিই কখনও কখনও কাউকে দান করে থাকে।
চতুর্থ লুচিটা রসগোল্লার রসে ডুবিয়ে বললাম, চন্দন, পরশু সন্ধ্যা ৬টায় স্টুডিওতে বসবো আমরা। চিত্রাঙ্গদার ক্যারেক্টারগুলো ফাইনাল করবো সেদিন। তুমি চলে আসবে, দেরি করবে না যেন। আজ শুধু তোমাকে এটুকু বলে যাই, নাটক নিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রতিনিয়ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। নাটককে অধিক মনোগ্রাহী করতে কবি ‘গানের কথায় ও সুরে’ সংলাপ রচনা করেছিলেন। সেই পরীক্ষার ফলই তাঁর গীতিনাট্যগুলো। এক পর্যায়ে তাঁর মনে হয়েছিলো যে নাটকের সেই গানগুলোতে দেহছন্দ বা নৃত্যভঙ্গি প্রয়োগ করা যেতেই পারে। তাহলে তা দর্শকদের একেবারে মন ছুঁয়ে যাবে। যেমন কথা তেমন কাজ। একে একে আমরা পেলাম চিত্রাঙ্গদা, শ্যামা, চণ্ডালিকা প্রভৃতি নৃত্যনাট্যগুলো।
অর্জুনের গান তো চন্দন নেপথ্যে গাইবে, কিন্তু পর্দায় নৃত্যাভিনয়টা করবে কে? টরন্টোতে বাঙালীদের মধ্যে পুরুষ নৃত্যশিল্পী দুই একজন আছেন বলে শুনেছি। কিন্তু তাদের কারো সাথেই কখনও কাজ করা হয়ে ওঠেনি। চিত্রাঙ্গদার মতো এমন জটিল একটা প্রকল্পে অচেনা কোনো শিল্পীকে কাস্ট করার ঝুঁকি অনেক। তিনি হয়তো খুব ভাল নাচবেন, কিন্তু দেখা গেল তার ভঙ্গিমায় রাবীন্দ্রিক মেজাজটা এলো না। অথবা এমনও তো হতে পারে যে পরিচালকের নির্দেশনা মতো কাজ করাটা সেই শিল্পীর স্বভাবে নেই।
এমনি কিছু সংকটে যখন মন উড়োতাড়া তখন জয়ীতা উদ্যোগী হয়ে সংকট তাড়ালো। একদিন সকাল সকাল ফোন করে বললো, দাদা, অর্জুনের ভ‚মিকায় যুৎসই একজন শিল্পী খুঁজে পেয়েছি। উপমহাদেশের নৃত্যসম্রাট পণ্ডিত বিরজু মহারাজজীর শিষ্য সে। তার নাচবার দক্ষতা টরন্টোতে অতুলন। আপনি যা চান, তা শুধু বলবেন তাকে। তাৎক্ষণিক কোরিওগ্রাফি করে দেখাবে। তবে দাদা, তাকে নিয়ে দুটো সমস্যা আছে।
প্রথমটা বলো শুনি, কন্ঠে হতাশা নিয়ে বললাম আমি।
দাদা, সে নারী শিল্পী! এটুকু বলে মুহুর্ত দম নিলো জয়ীতা। তারপর ঢোক গিলে বললো, আমি জানি আপনি অর্জুনের জন্য পুরুষ শিল্পীর কথা ভাবছেন। কিন্তু রেশমী অর্জুনের ভ‚মিকায় অনায়াসে ফিট করবে দাদা। সে অনেক লম্বা, আপনার থেকেও ইঞ্চিদুয়েক বেশি। আর চওড়া আপনার অর্ধেকেরও কম! ওকে আমি পুরুষের বেশে সাজিয়ে দেবো। সহশিল্পীদের সাথে মিলেমিশে কাজ করায় তার জুড়ি মেলা ভার। আর রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যের কথা শুনে সে খুবই আগ্রহ দেখিয়েছে দাদা। আজ সন্ধ্যায় ওকে আমার বাড়িতে আসতে বলেছি। যত ঝুট-ঝামেলাই থাকুক আপনারও আসা চাই।
আচ্ছা ঠিক আছে আসবো। এবার দ্বিতীয় সমস্যাটা বলো দেখি শুনি, বললাম আমি।
দাদা, দ্বিতীয়টা হয়তো আপনার জন্য কোনো সমস্যাই না। আনন্দের কারণও হতে পারে, বলে ফিক করে দুষ্টু-হাসি হাসলো জয়ীতা। হয়েছে কী জানেন ও বাংলা বলে না, হিন্দি ভাষী। তবে ইংরেজীটাও ফটাফট বলে। ওই পুরো চিত্রাঙ্গদাটা ওকে ইংরেজীতে বোঝাতে হবে। দু-পাঁচবার ওর সাথে কফি আড্ডায় বসতে হবে আপনার। তবে দাদা সে ভারি হাস্যরসিক এবং প্রীতিময় একজন মানুষ। মনেও সুন্দর, রূপেও সুন্দর। এমন একজন সুন্দরীকে অর্জুন-প্রেম বোঝানোতে আপনার অন্তত অনীহা হবে না। এটুকু বলে হো হো করে হেসে উঠলো জয়ীতা!
গীতিনাট্যে নাচের উপযোগী গান যুক্ত করার নেশায় ঝুঁকেছিলেন কবিগুরু। মহাভারতের একটি টুকরো কাহিনী নিয়ে তিনি রচনা করেছিলেন তার কালজয়ী নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা। জগৎখ্যাত ধনুর্বীর তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন এবং মণিপুর রাজার কন্যা চিত্রাঙ্গদার প্রেম-বৈচিত্রই এই নাটকের উপাখ্যান। এর চিত্রায়ণ করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম যে প্রবাসে বসে এমন ঐতিহাসিক প্রেম-কাহিনীর চিত্ররূপ দেওয়া কতটা জটিল! এখানে কোথায় পাবো মণিপুর রাজবাড়ি, কোথায় মিলবে অর্জুনের গাণ্ডীব (ধনুক)?
সব কাজেরই কিছু ঝুটঝামেলা থাকে। এই যেমন নবরূপা চিত্রাঙ্গদার গানগুলো গাইবার জন্য একজন শিল্পীকে নির্বাচন করেছিলাম। তাকে উপযুক্ত বলেই মনে হয়েছিলো। কিন্তু প্রস্তুতিপর্বে দেখা গেল রবীন্দ্রপ্রেমিক নয় সে। গানগুলো নিয়ে বসে না। আজ তার এ কাজ তো কাল সে অজুহাত। তাগাদা দিলে বলে, চিন্তা কোরো না দাদা, রেকর্ডিংয়ের দিনে ঠিকঠাক গেয়ে দেবো। চেষ্টা-চর্চ্চার বালাই নাই, আবার ভাবছে ঠিকঠাক গাইবে। এ ধরণের “স্টেজে মাত করে দেবো” টাইপের গাইয়ে আমার পছন্দ না।
একেবারে শেষ মুহুর্তে শিল্পী বদল করতেই হলো। এ বড্ড অনাকাঙ্খিত কাজ! অগত্যা ছোট্ট মেয়ে অর্পিতাকে বেছে নিলাম। মাত্র ক’দিন সময় দিয়ে একগাদা গান তার গলায় ঝুলালাম। তবে সে বয়সে ছোট হলেও গাইবার সক্ষমতায় পরিণত। তার মা সব কাজ ফেলে মেয়েটাকে নিয়ে নিজ বাড়ির গান-ঘরে বসে গেল। আমার ভাঙ্গা তরীখানা অর্পিতা ক‚লে ভিড়িয়ে দিয়েছে।
এবার বলি আমাদের মধুমন্তী আর বহ্নি’র কথা। ওরা পর্দায় চিত্রাঙ্গদা আর নবরূপা চিত্রাঙ্গদার ভ‚মিকা বেছে নিলো। কী যে আগ্রহ আর আনন্দ নিয়ে ওরা রিহার্সালগুলো করলো! কী আর বলি! দুজনই প্রশিক্ষিত নৃত্যশিল্পী। বহ্নি তো রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃত্যের ওপরে সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী। চুয়ান্ন মিনিটের চিত্রাঙ্গদার কোরিওগ্রাফি নিয়ে ওরা আমাকে চিন্তামুক্ত রেখেছিলো।
চিত্রাঙ্গদা টিমে চারজনের একটা জোট ছিলো। একেবারে হরিহর আত্মা ওরা। আমি ওদের “জয়ীতার দল” বলে ডাকি। শিবানী, দেবীকা, ঈশানী আর জয়ীতা। এই চারজন পর্দায় এসেছে রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদার সখী হিসেবে। রাজকন্যার জন্য ওরা আনন্দকর হলেও আমার জন্য ঠিক তার উল্টো। সব সময় ওদের মাথায় আমার খরচ বাড়ানোর কৌশল কিলবিল করে। একদিন তো রিহার্সাল ফেলে দুজন দৌড়ে এলো। বলে, দাদা, আমাদের তো চারটা ব্যাকগ্রাউন্ডের শুটিংস্পট। প্রতিটি স্পটে আমাদের ভিন্ন ভিন্ন রঙের চার সেট করে পোষাক চাই। আপনি কিন্তু না করতে পারবেন না, ও আমাদের চাইই চাই, বলে দুজনেই মাটির দিকে অপেক্ষায় রইলো।
আমি একটু নড়েচড়ে বসে বললাম, চারটা করে তো মোট ষোল সেট ড্রেস রে! বলিস কী? এ তো অনেক খরচের ব্যাপার!
সাথে সাথে ওদের সুন্দর মুখশ্রী মলিন হয়ে গেল। ভারি কষ্টকর সে দৃশ্য! অমন মলিনতা তো আমি দেখতে চাই না। বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে কষ্টেশিষ্টে ডলার না হয় জোগাড় হলো। কিন্তু টরন্টোর দোকানে তোদের চারজনের জন্য একই রঙ মিলিয়ে এত কাপড় তো পাওয়া যাবে না।
মুহূর্তে ওদের মুখ ঝলমল করে উঠলো। বললো, সে নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আজ রাতেই অন-লাইনে অর্ডার করে দেবো। কলকাতার দুটো দোকানের সাথে আমরা কথা বলে রেখেছি। কুরিয়ারে পাঁচ দিনের মধ্যে সব পৌঁছে যাবে।
অসহায় আমি, ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে বললাম, আচ্ছা তবে তাই কর। রিহার্সাল ঘর থেকে দেবীকা চেঁচিয়ে বলে, অ্যাই তোরা প্রতি সেট পোষাকের সাথে মিলিয়ে গহনা অর্ডার করতে যেন ভুলিস না।
রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদার সখিদেরও পর্দায় রাজসিকী দেখানো চাই। জয়ীতার দলকে ভাল করে না সাজালে তা হবে কেন? মাথা নেড়ে আমি গহনার ব্যাপারটায় সম্মতি দিলাম। রাজ্যের খুশি ওদের মুখের ওপরে এসে বসলো।
তা সব মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশজনের দল। কী যে আনন্দ নিয়ে ওরা মহড়া দিয়েছে, শুটিং করেছে, তা লেখার বিষয় না। দেখে চোখ জুড়ানোর বিষয়। রবীন্দ্রপ্রেমী একঝাঁক তরুণ-তরুণী দেড়টি বছর খাঁটুনি করে চিত্রাঙ্গদা বানিয়েছে!
পাঠক বন্ধুরা, ওরা খেটেছে আপনাদের আনন্দ দেবার জন্য। বাংলা টেলিভিশন কানাডা প্রযোজিত চিত্রাঙ্গদা শীঘ্রই রিলিজ হবে । ওটি দেখে আপনারা নিরাশ হবেন না, আজ শুধু এটুকুই বলছি।
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডার নির্বাহী)