Home কলাম চিঠির সেই রঙিন পাতার প্রেম থেকে ভার্চুয়াল প্রেম

চিঠির সেই রঙিন পাতার প্রেম থেকে ভার্চুয়াল প্রেম

মণিজিঞ্জির সান্যাল : দেখতে দেখতে আজ শেষ হল ৫০ পর্ব
একটু কি মন খারাপ হচ্ছে আমার? উত্তর- একেবারেই না। কারণ আমি মনে করি একটা শেষের পরেও তার রেশ থেকে যাবে আজীবন। পথ দেখাবে নতুন আরো একটা শুরুর। সেই ভাবনা থেকেই আগামী পর্ব থেকে অপেক্ষা করছে একেবারেই অন্যধারার একটি লেখা। কি সেই বিষয়?
থাক না আজ, একটু অপেক্ষা মনকে অনেক বেশি জীবন্ত রাখে তাই না? সব কথা বলতে নেই, কিছু থাক তোলা।

তবে আমার বিশ্বাস নতুন রূপে, নতুন অলংকারে নিজেকে সাজিয়ে একেবারে উপস্থিত হচ্ছি আগামী সপ্তাহে আপনাদের কাছে। ভাল লাগবেই লাগবে। আমার এই লেখা শুরু হয়েছিল আজ থেকে একবছর আগে। সময়টা ছিল গতবছর জুন মাসের তিন তারিখ অর্থাৎ ৩ ঔঁহব ২০২১. সেদিন ছিল আমার এই লেখার প্রথম পর্ব। দেখতে দেখতে আজ পঞ্চাশ পর্ব শেষ করলাম। এই দীর্ঘ সময় এতটা পথ চলতে পেরেছি এই লেখাকে সঙ্গী করেই, আর অবশ্যই সকলের শুভকামনায়। তাই আপনাদের সকলের প্রতি রইল আমার শ্রদ্ধাপূর্ণ ভালোবাসা। আর টরেন্টোর এই বাংলা কাগজ যে সুযোগ আমাকে দিয়েছে তার জন্যে এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।

একটা সময় ছিল যখন প্রেম শব্দটা প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের মধ্যেই অদ্ভুত এক অনুরণন ঘটাত। “তুই প্রেমে পড়েছিস” শব্দটা শোনা মাত্র হৃদয়ের মধ্যে কি সুন্দর একটা দোলা দিত। মুখের মধ্যে নিমেষে ফুটে উঠত একটা গোলাপী আভা! সারা মুখ জুড়ে লজ্জা লজ্জা অনুভূতি, সঙ্গে ভালোবাসা আর ভালোলাগা শরীর আর মনকে জড়িয়ে ধরত পরস্পর। কাউকে ভালোবাসি মুখ ফুটে বলতেই কেটে যেত কতোটা সময়। ‘হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল’ মন অস্থির হয়ে উঠলেও বলা হতো না কত কিছুই; আর বললেও তার জন্যে দীর্ঘ দিনের অপেক্ষা। বুক ফাটলেও মুখ ফুটতো না। জীবন প্রদীপ নিভে গেলেও প্রেম ছিল নিঃশেষিত। প্রেমের জন্য এমন কত আত্মদানের নজির, সাহিত্যে এমন কি বাস্তবেও দেখা যেত।
ভালোবাসার মানুষটির জন্য রাত জেগে লেখা হতো চিঠি। শব্দের পর শব্দের সারি। ভয় ভয় চোখে চারপাশ আরও একবার দেখে নেওয়া, কেউ দেখে ফেলল নাতো! হৃদয় নিংড়ানো শব্দ একে একে ঝাঁপি খুলত সন্তর্পণে। তারপর সেই চিঠি কাক্সিক্ষত মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া ছিল আরেক দুঃসাহসিক অভিযাত্রা। এটা যে খুব বেশি আগের কথা তা নয়। দেড় দশক আগেও প্রণয় এতটা দুঃসাহসিক হতে উঠতে পারেনি। ভাঙতে পারেনি সামাজিকতার দেওয়াল।

কিন্তু আজ? মুহূর্তে মুহূর্তে প্রেম বা প্রণয় সম্পর্ক গড়া সহজ হলেও ভিত নড়বড়ে। বন্ধনও অতটা পোক্ত নয়। তাসের ঘরের মতো সম্পর্ক। এই আছে। এই নেই। সহজ প্রেমের এই সুযোগ এনে দিয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি। বিজ্ঞানের কল্যাণে আরও অনেক কিছুর মতো এই সম্পর্কও হাতের কাছে এসেছে। মাধ্যম হয়েছে ফেসবুক, টুইটার, লিংকড ইন, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসআপ, ভাইবার, ইমো, স্নাপচ্যাট, জি-প্লাস, ইনস্ট্রাগ্রাম ইত্যাদি কত কিছু। প্রতিদিনই যোগাযোগের এই মাধ্যমগুলো সহজ থেকে সহজতর হচ্ছে। নিত্যনতুন সুবিধাজুড়ে দেওয়া হচ্ছে ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করতে। ইন্টারনেট থাকলে তাই আর কিছুই প্রয়োজন হয় না। কেউ চাইলেই যে কারো সঙ্গে, যেকোনো সময় কথা বলতে পারে। পৌঁছে দিতে পারছে মনের কথা। তরঙ্গের হাওয়ায় ভাসিয়ে মনের কথা পৌঁছে দেওয়া সহজ হলেও এটি বড় ধরনের অপরাধের পথও তৈরি করেছে। বাড়ছে প্রতারণা। জন্ম নিচ্ছে অবিশ্বাস। আলগা হচ্ছে পারিবারিক বন্ধন। দূরত্ব বাড়ছে কাছের মানুষের সঙ্গ, নষ্ট হচ্ছে সময়। তৈরি হচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়। আত্মহত্যা, খুনের মতো ঘটনাও ঘটছে অহরহ। ভার্চুয়াল এই প্রেম বা ভালোবাসার জগৎ ঠুনকো করে দিচ্ছে বাস্তবের সম্পর্ক। প্রতিদিনের বেঁচে থাকার সুন্দর মুহূর্তগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। চাকচিক্য প্রিয় মানুষ, সুন্দরের পুজারি মানুষ বিশ্বাস হারাচ্ছে অন্তর্জালিক প্রতারণায়, যা বড় ধরনের বিপদও ডেকে আনছে সময়ে সময়ে।

যোগাযোগ সহজ হওয়ায় মানুষের মনের টানও কমে আসছে। আগে প্রিয় মানুষটির সঙ্গে দেখা পাওয়ার জন্য যে উত্তেজনা বা টান অনুভূত হতো হৃদয়ের অন্তরালে, এখন আর সেসব নেই বললেই চলে। কারণ চাইলেই মুহূর্তেই ভিডিও কলে দেখে নেওয়া যায় একে অন্যের মুখ। ভার্চুয়াল এই সাক্ষাতে কিছু ক্ষেত্রে প্রিয়জনকে কাছে টানা গেলেও আত্মিক বন্ধনে ভাটা তৈরি করেছে।

আসলে মুখোমুখি বা পাশাপাশি কথা বলার মধ্যে আলাদা একটা অনুভূতি কাজ করে। তখন দুজনই দুজনের প্রতি মনোযোগী হয়। তৃতীয় কেউ আসতে পারে না। কিন্তু ম্যাসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলার সময়ে একাধিক জনের সঙ্গে আলাপ হয়। তখন আর মনোযোগ একমুখী থাকে না। একই সময়ে চিন্তাশক্তি এবং মনোযোগও ভাগ হয়ে যায়। এতে গুরুত্বও অনেক ক্ষেত্রে কমে আসে। এই ধরনের ভার্চুয়াল সম্পর্ক খুব বেশি দৃঢ় হয় না। দীর্ঘদিন একসঙ্গে পথচলাও সম্ভব হয় না।

ভার্চুয়াল এই জগতে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ ‘ভালোবাসা’। তরুণ-তরুণীদের একটি বড় অংশ এই মোহে আবিষ্ট হয়ে আছে। তাদের কাছে মানব-মানবীর সম্পর্কে ভালোবাসা বা প্রেমই গুরুত্বপূর্ণ। এর বাইরেও যে কত রকম সম্পর্ক থাকতে পারে বা আছে, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তার সময় খুব একটা নেই কারো কাছে। বিজ্ঞানের উৎকর্ষের এই সময়ে নর-নারীর মধ্যকার প্রণয়ঘটিত উষ্ণতাই তরুণ মনকে বেশি স্পর্শ করছে, দাগ কাটছে গভীরে। তাই স্কুলজীবন থেকে প্রেম-প্রেম খেলা এখন খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনকার ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে দেখলে অবাক হওয়ার মতো অনুভূতিও কেমন পানসে হয়ে গেছে। যেন এটাই স্বাভাবিক।

বাল্যপ্রেম যে অতীতে ছিল না, তা নয়। তবে এখনকার বাল্যপ্রেমের সঙ্গে অতীতের তফাত বিস্তর। সংজ্ঞাটাও পাল্টেছে। এখন বাল্যপ্রেম বা অপরিণত বয়সের ভালোবাসা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিপদ ডেকে আনছে। এই সম্পর্কগুলো কেমন যেন হালকা আর ফিকে হয়ে গেছে আজকাল।
বিয়ের আগে এরকম সম্পর্ক যতটা না জীবনে ক্ষত তৈরি করে, বিয়ের পর তা হয়ে ওঠে ভয়ংকর বিধ্বংসী।
ফরাসি সাহিত্যিক এমিল জোলারের ‘তেরেসা’ উপন্যাসের চিত্রনে এমন একটি নিষিদ্ধ প্রেমের কাহিনিই ফুটে উঠেছে। স্বামী ক্যামিলাসের চোখ ফাঁকি দিয়ে লঁরার সঙ্গে তেরেসার প্রেম-সংসর্গ অন্যরকম এক অভিজ্ঞতায় পাঠককে হৃদ্ধ করে।

এই সমাজেও তেরেসার মতো এমন অনেক সম্পর্ক অন্তরালের যত্নে টিকে আছে। কোনোটা আবার প্রকাশ্যেও এসেছে। গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এ ধরনের অসামঞ্জস্য ও ‘নিষিদ্ধ’ সম্পর্ক জীবন থেকে জীবন কেড়ে নিচ্ছে। তছনছ করে দিচ্ছে একটি পরিবারকে। অবক্ষয় ডাকছে সমাজে। তৈরি হচ্ছে অপরাধ প্রবণতা।

ভার্চুয়াল ভালোবাসার এই যুগে এ ধরনের অহরহ সম্পর্কের খবর আমাদের কানে আসে। চোখে পড়ে। এটি আসলে সম্ভব হয়েছে ভার্চুয়াল সহজলভ্যতার কারণে। মানুষ একা থাকতে পারে না, কথাটা যেমন সত্যি; তেমনি ভার্চুয়ালের এই সুবর্ণ সময়ে একা থাকাও কঠিন। একা মানুষের সঙ্গ দেওয়ার জন্য অনেক মাধ্যমই খোলা আছে। যে কেউ চাইলেই বেছে নিতে পারে পছন্দের জন বা মাধ্যমকে। এসব কারণে পারিবারিক ও দাম্পত্যজীবনে সন্দেহপ্রবণতাও জন্ম নিয়েছে। সন্দেহ নামক এই ব্যাধি মানুষের জীবনে একবার ঢুকে গেলে তা ভয়াবহতায় রূপ নেয়, যা ক্যানসারের চেয়েও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভয়াবহ।
ভার্চুয়াল যুগের ছেলেমেয়েরাও এসব সম্পর্কের ব্যাপারে উদাসীন। তারা প্রণয়কে জীবনযাত্রার অংশ বলেই মনে করে। এটি যে একেবারেই একান্ত বিষয়, তা আর ভাবনায় থাকে না। রাকঢাক না রেখেই নিজের এসব সম্পর্কের কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারেও পিছপা হয় না তারা। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীও বদল হয় তাদের। এটি যেন খুবই মামুলি ব্যাপার। ভার্চুয়াল সম্পর্কে জড়িয়ে প্রতারিত হওয়ার ভূরিভূরি উদাহরণ আমাদের সামনে আছে।

প্রিয়জন বা মনের মানুষের কাছে রাত জেগে লম্বা চিঠি লেখার দিন হয়তো আর কখনো ফিরে আসবে না। কিন্তু ভালোবাসা বা ভালোবাসার মানুষের জন্য অকৃত্রিম আবেগ কি একেবারেই ফুরিয়ে যাবে? ভার্চুয়াল জগতেও ফিরে আসুক নিখাদ ভালোবাসা। বন্ধ হোক প্রতারণা। প্রতারকদের হৃদয়ে জন্ম নিন প্রকৃত ভালোবাসা। ভালোবাসার জয় হোক।

ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পেছনে মানুষ এখন অনেক বেশি সময় ব্যয় করছে। এসবের যে প্রয়োজন নেই তা নয় কিন্তু এর ব্যবহার হচ্ছে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি। পরিবারের সদস্যরা ইন্টারনেটের পেছনে অনেক বেশি সময় ব্যয় করায় বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে। দূরত্ব বাড়ছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও। তরুণদের মাঝেই ভার্চুয়াল জগতের প্রতি ঝোঁক-প্রবণতা তুলনামূলক বেশি। এ কারণে তরুণ সমাজের মধ্যে একধরনের আত্মকেন্দ্রিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি আসক্ত তরুণরা এখন আর আগের মতো একজায়গায় বসে গল্প-গুজব করতে খুব একটা আগ্রহী নয়। এর ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ও মনের টান কমে যাচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মনের দূরত্ব বাড়লে পরিবারের ভিত্তিই দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে যে কোনো সম্পর্কের বিচ্ছেদ সহজেই হচ্ছে এবং পরিবারের বিভিন্ন প্রজন্মের সদস্যদের মধ্যে অমিল ও মতবিরোধ আর স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকছে না। পারিবারিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়লেও পারিবারিক সহিংসতা কমছে না। এর কারণ হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও আলোচনার অভাব। এর ফলে তাদের মধ্যে প্রত্যাশিত সহমর্মিতা দেখা যায় না এবং ছোটখাটো বিষয়েও ঝগড়া লেগে যায়। বর্তমানে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ আলোচনা ও গল্প-গুজবের স্থান দখল করে নিচ্ছে ভার্চুয়াল জগত। এ অবস্থায় পারিবারিক কাঠামোকে দৃঢ? ও শক্তিশালী রাখতে ভার্চুয়াল জগতের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা জরুরি হয়ে পড়েছে। দূরত্ব বাড়ছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। বর্তমানে পারস্পরিক সম্পর্কের মাধ্যম হয়ে উঠেছে ভার্চুয়াল জগত। এ কারণে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে অনেকটাই পার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বড়দের অভিজ্ঞতা ও নির্দেশনা অনেকের কাছেই আগের মতো গুরুত্ব পাচ্ছে না। আবেগের বশবর্তী হয়ে সঙ্গী নির্বাচনের প্রবণতাও দিনদিন বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে স্বামী বা স্ত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সামাজিক দিকগুলো বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। অনভিজ্ঞ তরুণ-তরুণীরা জীবনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের মতামতকে গুরুত্ব না দেওয়ায় বিচ্ছেদ এখন স্বাভাবিক একটি ঘটনা। ইন্টারনেটভিত্তিক কথোপকথন কখনোই পারিবারিক বৈঠকগুলোর বিকল্প হতে পারে না। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভালোবাসা ও আকর্ষণ হচ্ছে পবিত্র। এই ভালোবাসা ও আকর্ষণের ভিত্তিতেই পারিবারিক সুখ নিশ্চিত হতে পারে।

ভার্চুয়াল জগতের প্রতি আকর্ষণ ও নির্ভরতার কারণে নানা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তবে একইসঙ্গে একথাও মনে রাখতে হবে যে, ভার্চুয়াল জগতের প্রতি নির্ভরতা সৃষ্টির পেছনে যেসব বিষয় কাজ করে সেগুলোও চিহ্নিত করতে হবে। একটি পরিবারের অভিভাবকরা অর্থাৎ বাবা-মা উভয়ই কাজের ব্যস্ততার কারণে সন্তানদেরকে বেশি সময় পারেন না। এ অবস্থায় সন্তানেরা একাকিত্বে ভোগে।তারা সময় কাটাতে ভার্চুয়াল জগতের আশ্রয় নেয়। ইন্টারনেটে ঢুকে নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাঙ্খিত বন্ধু-বান্ধবীর খোঁজ করতে থাকে। বড়দের পরামর্শ ছাড়াই এ ধরনের জগতে প্রবেশ করার কারণে তারা ধাক্কা খায়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যুক্ত হওয়া এখন এতোটাই সহজ যে, সব বয়সের মানুষই সেখানে তৎপর। এ অবস্থায় পরিবারের অভিভাবকদের সচেতনতা জরুরি। বাবা-মা’র উচিত সন্তানদের জন্য কিছু সময় ব্যয় করা যাতে তারা একাকিত্ব অনুভব না করে। বর্তমান যুগের ব্যস্ত জীবন পদ্ধতিতে বাবা-মায়েরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যে ভুলটি করেন, তারা সন্তানকে সব কিছুই দেন শুধু সময় ছাড়া। বাবা-মা সন্তানের জন্য বাড়ি-গাড়ি কেনেন, ভালো স্কুলে ভর্তি করেন, ভালো খাবার ও পোশাক কিছুরই অভাব রাখেন না। কিন্তু তাদের সঙ্গে যে সময় কাটানো দরকার, তাদেরকে কিছু নৈতিক শিক্ষা দেওয়া দরকার সে কথা তারা ভুলে যান। সন্তানেরা স্কুল-কলেজে গিয়ে কী করছে, তার বন্ধু কে অথবা ইন্টারনেটে সে কাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলছে সেসব তথ্য বাবা-মায়েরা অনেক সময়ই জানেন না। এর ফলে বাবা-মায়ের অজান্তেই অনেক দুর্ঘটনা ঘটে যায়। এ ধরনের প্রবণতা বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের মানুষের মতো ইরানিদের মধ্যেও দেখা যায়। এ কারণে এ নিয়ে এ দেশে প্রতিনিয়ত গবেষণা হচ্ছে।

জীবনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাস্তবতার চেয়ে আবেগকে বেশি গুরুত্ব দেবার কারণেই পরবর্তীতে বিচ্ছেদের ঘটনা বেশি ঘটে বলে গবেষকরা জানিয়েছেন। অনেকেই আবার জীবনযাপনের সঠিক পদ্ধতি জানে না বা জানলেও তা প্রয়োগ করে না। এ কারণেও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে থাকে। অনেক সময় দেখা যায়, বিয়ের পর স্বামী বা স্ত্রী সামাজিক যোগাযোগের প্রতি বেশি আসক্ত হয়ে পড়ে। সাংসারিক সমস্যার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই কৃত্রিম সুখের সন্ধান করেন অনেক মানুষ। এ অবস্থায় কেউ কেউ সুস্থ্য বিনোদনের সন্ধান করতে গিয়ে বিপথে চলে যান। স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে সময় কাটানোর চেয়ে তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় কাটানো বেশি আকর্ষনীয় মনে হয়। এরপর তা এক ধরনের নেশায় পরিণত হয়। ফলে সাংসারিক যে ঝামেলা সহজেই মিটে যেতে পারত তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও জটিল হয়ে পড়ে। তবে মনে রাখতে হবে, ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম আমাদের জন্য নানা সুযোগ এবং সম্ভাবনাও তৈরি করেছে। আমরা কীভাবে, কী উদ্দেশ্যে তা ব্যবহার করছি তার ওপর নির্ভর করে আমরা এই জগত থেকে উপকৃত হবো নাকি বিপদগ্রস্ত হবো। বাস্তবে ভার্চুয়াল জগতকে এড়িয়ে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কাজেই এ জগতকে মেনে নিয়ে সচেতনভাবে তা ব্যবহার করতে হবে।
মণিজিঞ্জির সান্যাল: কথা সাহিত্যিক
শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ

Exit mobile version