ফরিদ আহমেদ : ১৯৩০ সালের এক গ্রীষ্মকাল। ভারতবর্ষের এক নিস্তব্ধ শহর চট্টগ্রামে ঘটে প্রবল বিস্ফোরণ। ১৮ই এপ্রিল ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির মাত্র চৌষট্টি জন বিপ্লবী ইংরেজদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় চট্টগ্রামের কর্তৃত্ব। সেদিন ছিলো শুক্রবার, গুড ফ্রাইডে। আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের ইস্টার বিদ্রোহের দিনটিকে বেছে নেওয়া হয় চট্টগ্রাম দখলের জন্য। বিপ্লবীদের অন্যতম একজন ছিলেন অনন্ত সিংহ। তিনি তাঁর লেখা ‘মহানায়ক সূর্যসেন ও চট্টগ্রাম বিপ্লব’ বইতে লিখেছেন, “এই কর্মসূচীকে বাস্তব রূপ দিতে প্রথম আক্রমণ আরম্ভে আমরা চৌষট্টি জন যুবক সংঘবদ্ধ হয়েছিলাম। আমাদের সবার খাকী মিলিটারী ইউনিফর্ম। সবাইকে আমরা গোপনে অস্ত্রশিক্ষা ও হাতবোমা ছোড়া ও মোটরগাড়ি চালানো শিখিয়েছিলাম। সর্বোপরি শিখিয়েছিলাম চরম স্বার্থ ত্যাগ ও চরম যুদ্ধের সম্মুখীন হবার মানসিক প্রস্তুতি। ….. আমাদের হাতে আছে – তেরটি রিভলভার, ছটি শটগান ও চারখানা মোটরগাড়ি মাত্র।”
এই সামান্য অস্ত্র এবং স্বল্প সংখ্যক বিপ্লবীরা চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা পুলিশ হেডকোয়ার্টার অস্ত্রাগার ও অক্সিলিয়ারি ফোর্স অস্ত্রাগার দখল করে নেয়। টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন ভবন ধ্বংস করে দেয়া হয়। রেল লাইন তুলে ফেলা হয়। চট্টগ্রামকে ভারতবর্ষ হতে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়।
গত শতাব্দীর বিশ এবং ত্রিশের দশকে সারা ভারতবর্ষকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলো চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা। অথচ চট্টগ্রাম তখন কোনো প্রধান শহর নয় ভারতবর্ষের। একটা প্রান্তিক অঞ্চল থেকে বের হয়ে এসেছে ঝাঁকে ঝাঁকে বিপ্লবী। এইসব বিপ্লবী তৈরির পিছনে মূল অবদান রেখেছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। তাঁর নাম সূর্যসেন। সবাই তাঁকে মাস্টারদা নামেই ডাকতো। সাধারণের চেয়েও ভীষণ সাধারণ দেখতে তিনি। গড়পড়তা বাঙালির চেয়েও ক্ষুদ্রকায়, ক্ষীণদেহী একজন ব্যক্তি। মাথার চুল পাতলা হয়ে গিয়েছে সামনের দিকে। বেশ খানিকটাই দৃশ্যমান টাক সেখানে। পোশাক আশাক অতি সাধারণ। শান্ত-সমাহিত মুখে মৃদু একটা হাসি লেগে থাকে সবসময়। চোখ দুটোই যা একটু ব্যতিক্রম। অত্যন্ত উজ্জ্বল দুটো চোখ। এই চোখ দুটোকে খেয়াল করলেই বোঝা যায়, অতি সাধারণ চেহারার এই মানুষটি সাধারণ কেউ নন। অত্যন্ত বুদ্ধিমান একজন মানুষ, অসাধারণ একজন ব্যক্তিত্ব।
সফলভাবে বিপ্লব শেষে বিপ্লবী দলটি পুলিশ অস্ত্রাগারে সমবেত হয় এবং সেখানে মাস্টার দা সূর্যসেনকে মিলিটারি স্যালুট প্রদান করা হয়। সূর্যসেন ভারতের ত্রিরঙা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার ঘোষণা করেন। স্বাধীন ভারতের পতাকা এর আগে ভারতবর্ষের আর কোথাও উড়েছে কিনা জানা নেই আমার। চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার দখল ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক অনন্য অংশ। চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহ স্ফুলিঙ্গ সারা ভারতবর্ষে প্রচণ্ড দাবানল ছড়িয়ে দিয়েছিলো।
চট্টগ্রামে সূর্যসেনের নেতৃত্বে যুব বিদ্রোহের প্রস্তুতি যখন চলছিলো, পুলিশও বসে ছিলো না। এরা বিপ্লবীদের অনেককেই চেনে, জানে তারা বিপ্লবী দলের সাথে যুক্ত, কিন্তু সরাসরি কোনো প্রমাণের অভাবে তাদের ধরতে পারে নাই। এদের অনেকের পিছনেই প্রকাশ্য বা অ-প্রকাশ্যভাবে গুপ্তচর লাগিয়ে রেখেছিলো পুলিশ। বিপ্লবীরাও তা জানতো। পুলিশের চোখে ধুলো দেবার জন্য তারাও বখাটে ছেলের অভিনয় শুরু করেছিলো। সারাদিন সিনেমা, থিয়েটার দেখতো তারা, রেস্টুরেন্টে বসে হইচই করে খেতো, হাসি-ঠাট্টা, গল্প-গুজবে মেতে উঠতো নিত্যদিন। এদের দেখে পুলিশ ধন্ধে পড়ে যেতো। এইসব হালকা চরিত্রের বখাটে ছেলেপেলে কি বিপ্লবী হতে পারে? বিপ্লবীরা, যারা নিজেদের জীবনের বিন্দুমাত্র পরোয়া করে না, প্রতি মুহূর্তে মৃত্যু-সংকল্প নিয়ে ঘোরে, সেইসব ছেলেরা এমন হতেই পারে না। তলে তলে যে এই ‘বখাটে’ ছেলেরা যে চট্টগ্রাম দখল করার সব ব্যবস্থা করে আনছে, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্রও কোনো ধারণা ছিলো না পুলিশের।
চট্টগ্রাম দখল এবং স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করলেও এই অবস্থাটা বিপ্লবীরা ধরে রাখতে পারে নাই অবশ্য। ইংরেজরা প্রাথমিক আঘাতের ধাক্কা সামলে উঠে বিপ্লবীদের উপর আক্রমণ চালায়। রাত ভোর হবার আগেই বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম শহর ত্যাগ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীরা যখন বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তখন কিছু কাঠুরিয়া তাদের দেখে ফেলে এবং সেই খবর সরকারী বাহিনীকে জানিয়ে দেয়। কয়েক হাজার সৈন্য এসে ঘিরে ফেলে জালালাবাদ পাহাড়। শুরু হয় প্রাণঘাতী এক যুদ্ধের। যে যুদ্ধ জালালাবাদ যুদ্ধ নামে বিখ্যাত হয়ে আছে ইতিহাসে।
দু’ঘণ্টা প্রচণ্ড যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ৭০ হতে ১০০ জন সৈন্য এবং বিপ্লবী বাহিনীর ১২ জন বিপ্লবী শহীদ হন। বিপ্লবী শহীদরা হচ্ছেন নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, হরিগোপাল বল, মতিলাল কানুনগো, প্রভাস চন্দ্র বল, শশাঙ্ক শেখর দত্ত, নির্মল লালা , জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিন চন্দ্র ঘোষ এবং অর্ধেন্দু দস্তিদার। জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধ অংশ নিয়ে দু’জন পালাতে সক্ষম হলেও পরবর্তীতে পুলিশের আক্রমণে শহীদ হন তারা হলেন অপূর্ব সেন ও জীবন ঘোষাল। সূর্যসেন ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে বাকি বিপ্লবীদেরকে পার্শ্ববর্তী গ্রামে লুকিয়ে রাখেন।
চট্টগ্রামের এই যুব বিদ্রোহের কাহিনিই মানসী ভট্টাচার্য তাঁর, ‘Chittagong: Summer of 1930’ বইতে তুলে ধরেছেন। বইটা প্রকাশ করেছে হার্পারকলিন্স। এর জন্য তিনি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র, পুলিশের গোপন ফাইল, সরকারী ভাষ্য, সংবাদপত্রের উপর নির্ভর করেছেন। তবে, সম্পূর্ণ বইটাই তথ্যভিত্তিক নয়। তিনি কিছু কিছু জায়গায় কল্পনারও আশ্রয় নিয়েছে। যদিও সেগুলো সত্যের সাথে যাতে দ্ব›দ্ব না হয় সেদিকে তিনি লক্ষ্য রেখেছেন। তাঁর ভাষাতেই, “A minimal amount of fiction has been used to create settings that enable the telling of side stories which cannot be accommodated in the normal flow. These fictitious settings have been meticulously researched and counterchecked with the families.”
মানসী ভট্টাচার্য তাঁর বইতে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত গিয়েছেন। এর পরের কিছুটা অংশ আমি পাঠকদের জানাচ্ছি। এই বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে বহু বিপ্লবীর দ্বীপান্তর হয়েছিলো। সূর্যসেন তখন পলাতক। অর্ধেন্দু দস্তিদারের মাধ্যমে শরৎ বসু তাঁকে খবর পাঠিয়েছিলেন এই বলে যে তিনি যদি চান তবে তাঁকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিতে পারবেন। এর উত্তরে সূর্য সেন তাঁকে জানালেন, “শরৎবাবুকে আমার সশ্রদ্ধ নমস্কার জানিয়ে বলবে, এখনও আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে অনেক দেরি। আমার বিশজন সাথী স্বাধীনতার বেদিমূলে জীবন উৎসর্গ করেছেন। আরও কতোজনকে হারাতে হবে জানি না। এ মতো অবস্থায় কর্মক্ষেত্র ছেড়ে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।”
বেশিদিন অবশ্য পলাতক থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না। এক পর্যায়ে তাঁর অনেক বিপ্লবী সাথীসহ ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়ে যান তিনি। চট্টগ্রাম হাইকোর্টে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল বসে তাদের বিচারের জন্য।
১৯৩৩ সালের ১৪ই অগাস্ট চট্টগ্রাম হাইকোর্টের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণা করে। এই রায়ে সূর্যসেন এবং তারকেশ্বর দস্তিদারকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। কল্পনা দত্তের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের শাস্তি হয়। ২২শে অগাস্ট কোলকাতার হাইকোর্টের তাঁদের তিনজনের পক্ষে থেকেই আপিল করা হয়। এতে লাভের লাভ কিছু হয়নি। রায়ের কোনো পরিবর্তন হয় না, একই রায় বহাল থেকে যায়। সূর্যসেনকে পুরে দেওয়া হয় কনডেম সেলে। পরবর্তীতে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় তাঁকে। ফাঁসি দেবার পরে সেই লাশ ইংরেজরা তাঁর আত্মীয়স্বজনের কাছে হস্তান্তর করে নাই। স্রেফ গুম করে দেওয়া হয় সেই লাশ।
আমাদের দেশে এক সময় জন্ম নিয়েছে অসংখ্য সূর্য সন্তান। হাতে জ্বলন্ত আগুন আর অন্তরে বিস্ফোরক বারুদ নিয়ে চলাফেরা করতো তারা। ১৯৩০ সালের এক গ্রীষ্মে তারাই বুকের ভিতরে জমানো বারুদ দিয়ে দাবানল জ্বালিয়েছিলো চট্টগ্রামে। সেই দিন এখন আর নেই। এই জনপদ এখন প্রতিক্রিয়াশীলদের দখলে। সেই সব সূর্য সন্তানদের দেখা পাবার আর আশাও করা যায় না। বন্ধ্যা ভূমিতে ফসলের আশা করাটাই বোকামি। এখানে জন্মাবে এখন শুধু আগাছাই। শস্যের চেয়ে টুপির আবাদই হবে বেশি।