আকতার হোসেন : এক পাগলের কাহিনী। পাগলের গল্প শুনে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না। চাঁদের আলো নাম দেখে মনে হবে এটা প্রেমের গল্প। কিন্তু গল্পটা যে প্রেমের নয় তাও বলা মুশকিল। আসলে পাগলদের মনের কথা আমরা বুঝবো কী ভাবে? আমাদের আশেপাশে হাসান পাগলের মতো দু’একজন পাগল যে নেই তা কিন্তু নয়। যদি আপনার জানাশোনা কোনো পাগলের সাথে হাসান পাগলের কোনো মিল খুঁজে পান তাহলেই গল্পটি ভালো লাগবে। নাহলে পুরো পরিশ্রমটাই বৃথা।
প্রশ্নটা সে আরো দু’বার করেছিল। কোনো উত্তর পায়নি বলে থেমে থাকেনি। মাতব্বর যতক্ষণ কোনো উত্তর না দেবে ততক্ষণ সে একই প্রশ্ন করে যাবে।
নারকেল সুপারি জাম্বুরা গাছের মাঝখানে ছোট্ট একটা পুকুর। ঘন ছায়ায় ঢাকা শান্ত পরিবেশ। শত বৎসরের বুড়োদের চলাফেরায় যেমন বেগ থাকে না, শান্ত পুকুরের পানিতে তেমন বেগ নেই। ঢেউ নেই। মসজিদের সামনের এই পুকুরটা শুধু ওজু করার জন্য ব্যবহার করা হয়। এখানে বাড়ির মেয়েরা বুকেতে গামছা জড়িয়ে সাপের মতো সাঁতার কাটে না। মাতব্বর সে সব করার জন্য বাড়ির উত্তরদিকে আর একটা পুকুর কেটে দিয়েছে। সেটাকে বলা হয় ভেতরবাড়ির পুকুর। যে পুকুরে বসে মাতব্বর ওজু করছে সেটা হলো মসজিদ ঘরের পুকুর। পুকুরটার পানি চুলের ফিতার মতো সবুজ। মনে হয় কে যেন পুকুরের ভেতর ডুব দিয়ে দম বন্ধ করে লুকিয়ে আছে তার চুলের ফিতার রঙটা উপর থেকে দেখা যাচ্ছে। শ্যাওলা আর কচুরিপানার অভাব নেই এখানে।
আছরের নামাজ পড়তে তেমন কেউ মসজিদটাতে আসে না। মাঝে মাঝে ইমাম সাহেবের পেছনে দাঁড়িয়ে মাতব্বর একা একা জামাতে নামাজ পড়ে। আজও হয়তো একা একা নামাজ পড়বে। ওজু করতে অন্তত তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। মাতব্বর খেজুর গাছের সিঁড়িতে বসে ওজু করছে। পুকুরের পাড়ে বসে তাকে হাসান পাগলা একই প্রশ্ন বার বার করে যাচ্ছে। ইচ্ছে করলে সে হাসান পাগলার প্রশ্নের উত্তর প্রথমবারেই দিতে পারতো। কিন্তু হাসান পাগলার সাথে সে মোটেও কথা বলতে চায় না। হাসানকে দেখলে সে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। পাগলদের দেখলে ওজু ভাঙ্গে না বলে তাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে না। দাঁত কিটমিট করে পবিত্র ওজুর কাজটা চালিয়ে যাচ্ছে। ব্যাতিক্রম হলে যা হতে পারে হয়তো ওজুর দোয়ার বদলে সেই মুহূর্তে মাতব্বর মনে মনে বলছিল আর যদি একটা কথা শুনি তাহলে আজ তোর একদিন কি আমার একদিন। ঠিক এমন সময় হাসান পাগলা আবারো জিজ্ঞেস করলো, ও মাতব্বর কি করতাছ?
সাথে সাথে মাতব্বর ওজু ফেলে চিৎকার করে উঠলো, তোর বাপের মাথা করতাছি। হারামজাদা, দেখতাছোস না ওজু করতাছি।
ক্ষেপে গেলে মাতব্বর লুঙ্গিটাকে টেনে টেনে হাঁটুর ওপর তুলে ফেলে। শুধু লুঙ্গি তোলার জন্য নয়, হারামজাদা বলার জন্য তার ওজু ভেঙ্গে গেল। তাকে আবার প্রথম থেকে ওজু করতে হবে।
হাসান পাগলা বললো, অতো চ্যাতো ক্যান মাতব্বর। বুঝি না দেইখ্যাতো জিগাই। বুঝতে পারলে কি আর জিগাইতাম?
মাতব্বর খেঁকিয়ে উঠলো, তুই না মুসলমানের বাচ্চা। নামাজ করতে হইলে ওজু করতে হয়, পাক-সাফ হইতে হয় হেইডা জানোস না?
হাসান পাগলা নারকেল গাছের গোঁড়ায় বসে ছিলো। সেখানে বসেই জিজ্ঞেস করলো, মাতব্বর, তুমি কী এমন নাপাক কাজ করো যে বার বার তোমারে পাক হইতে হয়। একবারে পাক-সাফ হইয়া থাকতে পারো না?
খিটমিট করতে করতে মাতব্বর একটা ঢিল কুড়িয়ে হাসান পাগলার দিকে ছুড়ে মারলো। হাসানের গায়ে না লেগে ঢিলটা তিন হাত দূরে গিয়ে পড়লো। হাসান পাগলা নির্ভয়ে বলে যেতে লাগলো, এইটারে কেমন পরিষ্কার হওয়া কয়। মুখের ময়লা লাগা কুলি যেই পানিতে ফেলো, হেই পানিই আবার মুখে লইয়া কুলি করো!
এরপর দূরে বসেই ওজু করার মতো হাত পায়ে পানি দেবার ভঙ্গি করে বললো, যেই পানিতে হাতের ময়লা, পায়ের ময়লা সাফ করলা হেই হাত পা আবার সেই পানি দিয়া পরিষ্কার করলা। এই দ্যাহি যেই পাতে থুথু মারা হেই পাতে খাওয়া।
মাতব্বরের আর সহ্য হলো না। দৌড়ে গিয়ে পাগলার গলা ধরে পুকুর ঘাটে নিয়ে এলো। তারপর ঘাড় চেপে পানির কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে বললো, তুই আমারে ওজু শিখাইবি হারামজাদা বদমাইশ। পাগল সাজছোস, তোর পাগলামি আমি ছুটাইয়া দিমু।
হাসান পাগলা বললো, আমি পাগল হলেই দোষ? তোমরা যে একজনের জন্য পাগল হয়ে এই ময়লা পানিতে ওজু করতাছো তাতে দোষ হয় না? পাগলে পাগলে দোস্তি হয় না কেন মাতব্বর?
মাতব্বর হাসানকে কষে একটা থাপ্পড় দেয়। হাসান তাতে কিছু মনে করে না। উল্টো জিজ্ঞেস করে, কওতো মাতব্বর এক পাগাল খারাপ হইলে অন্য পাগল ভালো হয় কেমনে?
হাসান আরো একটা থাপ্পড় খায়।
হাসান বলে, আমি ক্যান পাগল সাজুম। তোমরা না আমারে পাগল কইয়া ডাকো। ছোটবেলায় মসজিদের ইমাম-সাহেবরে জিগাইলাম আম জাম কলা এইগুলি যদি লিখতে না পারলাম তয় আলিফ-বে-তে শিখা করুম কি? আলিফ দিয়া তো আম লেখা যাইবো না। আম লিখতে হইলে শিখতে হইবো স্বরে…আ। সাথে সাথে হাতির কানের লাহান বড়ো বড়ো হাত দিয়া ইমাম সাহেব আমার মুখে এমন জোর থাপ্পড় দিলো যে কান দিয়া গলগলাইয়া রক্ত ঝরতে লাগলো। হেইথন না আমি উল্টাপুল্টা কথা কই। আর তোমরা আমারে পাগল কইয়া ডাকো। আমি পাগল সাজুম ক্যান। আমার বুঝি খাইয়া কোনো কাম নাই।
মাতব্বরের লাথি খেয়ে হাসান পাগলা পুকুর ঘাটের কাদায় চিৎ হয়ে পড়েছিল। সেই পড়ে থাকা অবস্থায় তার কোমরের উপর আরো একটি লাথি মেরে মাতব্বর চেঁচিয়ে উঠলো, কি হইলো শিখাস না ওজু কেমনে করুম। আজ তোরে দিয়া ওজু করাইয়া ছাড়ুম।
মনে হলো হাসান পাগলার কিছুই হয়নি। কাদা থেকে উঠে এসে সে পুকুর ঘাটে ওজু করতে বসলো। হাত পা কিছুই ধুলো না। শুধু মুখ ভর্তি পানি নিয়ে ওজু করতে গেলো। কিন্তু কি কারণে যেন কুলি ফেলতে গিয়ে থেমে গেলো। কিছু একটা চিন্তা করে পুকুর ঘাট থেকে উঠে এলো নারকেল গাছের নিচে। নারকেল গাছের গোঁড়ায় কুলি ফেলতে গিয়েও ফেললো না। তারপর গেলো সুপারি গাছের গোঁড়ায়। এরপর জাম্বুরা গাছ। এভাবে মুখ ভর্তি পানি নিয়ে এ-গাছ থেকে সে-গাছ, সে-গাছ থেকে অন্য গাছের নিচে দৌড়াতে লাগলো। তাকে এইভাবে দৌড়াতে দেখে পাগলের মতোই লাগছিল। কিছুক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করে এক সময় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মুখের পানি পুরোটাই গিলে খেলো। হাসান পাগলার পাগলামি দেখতে ততক্ষণে বেশ লোক জমা হয়ে পড়েছে। বাড়ির বউঝিরা মুখে কাপড় গুঁজে হাসতে শুরু করেছে। ছোট ছোট বাচ্চারা হাতে তালি দিয়ে মজা লুটছে। মুখের পানি গিলে সে মাতব্বরের পায়ের কাছে কান ধরে বসে পড়লো।
মাতব্বরও ছাড়বার পাত্র নয়। তার ওপর লোকজনের সমাগমে তার পুরুষত্ব দেখানোটা বড়ই প্রয়োজনীয় হয়ে উঠলো। মাতব্বর তাই হাসান পাগলার চুল ধরে সোজা দাঁড় করিয়ে বললো, তোরে কইলাম ওজু করতে, ওজু না কইরা বান্দরের ফাল দেখাইলি ক্যান।
হাসান পাগলা বললো, পাইলাম না মাতব্বর, মুখের ময়লা ফেলানোর জায়গা খুঁইজ্যা পাইলাম না। যেই পানিতে কুলি করুম হেই পানি দিয়া কেমনে ওজু করুম। তারই জন্য পুকুর ঘাটের থন উইঠ্যা আইলাম। মাটি তো মায়ের মতো। হের গায়েও ফেলবার পারলাম না। শেষে নিজের ময়লা নিজেই খাইয়া ফেললাম। আমার ময়লা সাফ করার জন্য দুনিয়া ময়লা করতে পারুম না মাতব্বর। আমারে দিয়া ওজু ফজু হইবো না। আমারে মাফ কইরা দেও।
এক এক পাগলের এক একটি জিনিস নজরে পড়ে। কেউ গান গায়, কেউ বুকের আঁচল ফেলে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, কোনো পাগল শুধাশুধি মাছি মারে। বড় পাগল হলে নিজেকে নদী ভাবে। আবার হাটবাজারের পাগলারা বেশি বেশি গালাগালি করে। হাসান পাগলার পাগলামির একটা পরিচিত বুলি আছে। কথায় কথায় সে বলে, তুমি পারলা না, তিনি পারবেন ক্যামনে?
হাসান পাগল এক একবার মাতব্বরের হাতে কিলচড় খায় আর দুইদিন ঘরের ভেতর স্বেচ্ছায় বন্দী হয়ে বসে থাকে। কিন্তু তার রাগ দুদিনের বেশি থাকে না। দুদিন হলেই রাগ নেমে যায়। রাগ চলে গেলে সে আবার পথে নামে। মাতব্বরকে খোঁজে।
ওজু নিয়ে রাগ করেও সে দুদিন ঘরে ছিলো। দুদিন পর বাড়ি থেকে নেমে প্রথমেই পেলো একটা বাচ্চা ছেলেকে। ছেলেটি তার মায়ের কোল ঘেঁষে চুলার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। ছেলেটির মা হয়তো দশ সের পানিতে এক ছটাক চাউল ফুটিয়ে জাউ-ভাত রান্না করছিল। কিছু কিছু মায়েরা ইচ্ছে করে বেশি সময় নিয়ে জাউ রাঁধে। যতক্ষণ লাগার কথা নয় তার চেয়েও বেশি সময় চুলোর ওপর হাঁড়ি রাখে। দুপুর আর রাতের মাঝামাঝি সময়ে তারা হাঁড়ি নামায়।
বাচ্চাটাকে তার মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে হাসান পাগল বললো, ও-চাচী তোমার পোলাডারে আগুনে ছুইড়্যা মারোতো দেখি পারো কিনা? মানুষের গায়ে আগুন জ্বললে দেখতে কেমুন লাগে হেইডা দেখোনের বহুত শখ।
কি সর্বনাশের কথা ! ছেলেটির মা সাথে সাথে তার ছেলেকে হাসানের কাছ থেকে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো। হাসান তখন হেসে দিয়ে বললো, দেখলাতো চাচী, বুকের পুতরে আগুনে জ্বলাইতে পারলা না। তুমি পারলা না, তিনি পারবেন ক্যামনে? তুমি তো মা, আর তিনি হইলেন মালিক। চাচীগো, তোমরা কেউ মালিক চিনলা না। তার পরে হাসান পাগলা উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটতে শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতে সে সুর তুললো –
মালিক চিনলা না রে।
মালিক চিনলা না।
না জাইনা, না চিন্ন্যা তারে
ছোট কইরো না
মালিক চিনলা না।
একদিন খবর এলো দক্ষিণ কান্দির সোনামিয়া মারা গেছে। গরীব মানুষ, না খেতে পেয়ে সুচের মতো স্বাস্থ্য হয়েছিল। তবুও সেই সুচের মতো স্বাস্থ্য নিয়ে যেমন তেমন করে পৃথিবীটাকে শত বৎসর দেখে গেলো। কি দেখলো কে জানে। একই জিনিস দেখতে এতগুলো সময় লাগলো কেন তাইবা কে বলবে। শেষের বছরগুলো সে ছিল মসজিদ ঘাটের পুকুরের মতো শান্ত। মরবার আগে তারও গায়ে শ্যাওলা গজিয়েছিল। তাকে দেখাশোনার কেউ ছিল না সংসারে। কবে কখন মারা গেছে কেউ বলতে পারবে না। হাসান পাগল খবর দিলো তাই সকলে এগিয়ে এলো। গোসল কাফন সবই হলো। খাটে উঠিয়ে তাকে গোরস্তানে নিয়ে গেল। যে মানুষ সারাজীবন চাটাইয়ের উপর শুয়ে কাটিয়েছে সে আজ খাটের উপর শুয়ে দুলে দুলে চলছে। মায়ের কোলে যেমন শিশু দোলে, খাটের উপর তেমনি লাশ দোলে। সোনামিয়া তো সুচের মতো লাশ, বেশী দোলালে উড়ে যাবে।
হাসান পাগল আগের থেকেই কবরের কাছে বসেছিল। সোনামিয়াকে নিয়ে এসে গ্রামের সকলে বেশ মায়া দেখাতে লাগলো। আহারে উহুরে বলাবলি করতে লাগলো। কেউ বলছে আস্তে আস্তে রাখো। লাশের গায়ে যেন তুলার আঁচড়ও না লাগে। কেউ বললো এদিকে মাথা ঐদিকে পা ইত্যাদি। হাসান পাগল বললো, এতো খাতির-যত্ন ক্যান। যারে মাটি চাপা না দিলে গন্ধ ছুটবো, নাকে কাপড় দিয়া হাটতে হইবো, তারে এতো খাতির কইরা লাভ কি ? ও মাতব্বর, সোনামিয়ারে গর্তের মইধ্যে ছুইড়া মারতে পারবা না?
মাতব্বরের চোখরাঙ্গানী দেখে হাসান পাগল বললো, বুঝছি পারবা না। তুমি যদি ঐ মরা মানুষটারে চোট দিতে না পারো, তিনি পারবেন ক্যামনে। তুমি কি তার থাইক্যা বেশি দয়ালু হইয়া গেলা?
বেলা পড়ে গেছে। সোনামিয়ার কবরের আশেপাশে কেউ নেই। সূর্য ডুবে গেলে কেউ কবরস্থানে যায় না। সব ভয় কবরে। বাবা হোক ছেলে হোক সন্ধ্যা নেমে এলে তাড়াতাড়ি দোয়াদরুদ পড়ে যার যার ঘরে চলে যায়, কিন্তু হাসান পাগল অন্ধকারে হবে হবে করছে সেরকম সময় যাচ্ছে সোনামিয়ার কবরে। হাত বাঁধা না থাকলে অনেক আগেই যেতো। মাতব্বর তার উঠানে হাত বেঁধে হাসান পাগলকে আজ অনেক মেরেছে। নাকমুখ দিয়ে তার রক্ত ঝরছে। হাসানের কত্তবড় সাহস, এতগুলো মানুষের সামনে বলে ‘তুমি কি মালিকের থাইক্যা বেশি দয়ালু’? এই প্রশ্নের জন্য হাসানকে নতুন করে মেটানো হয়েছে। সন্ধ্যা নেমে এলে ওর বাঁধন খুলে দিয়ে মাতব্বর বললো, দূর হয় এখান থেকে।
হাসান পাগলা দূর হয়নি। সে সোনামিয়ার কাছে আসছে। হাসান পাগলা না এলে শিয়াল আসবে কবরে। মানুষের কবর মানুষকেই পাহারা দিতে হয়। কবর চুরি হয় না, কিন্তু কবরের মানুষ চুরি হয়ে যায়।
হাসান পাগলা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে আসলো। বগলে তার হাজার ফুটো হওয়া একটা চাটাই। সোনামিয়ার রেখে যাওয়া অস্থাবর সম্পত্তির সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য সম্পত্তি হলো এই হাজার ফুট হওয়া চাটাই। সোনা মিয়ার কপাল ভালো। সে যেদিন মারা গেল সেদিন চাঁদনী রাত ছিলো। চাঁদের আলো গরীব-বড়লোক মানে না। গরীবের ঘরে বরং সে বেশি ঢোকে। গরীবের ঘরে বেশি বেশি ফুটো থাকে। হাসান পাগলা ছেঁড়া চাটাইয়ের উপর শুয়ে সোনামিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো, আজ থাইক্যা তোমার চাটাইয়ের জিম্মা আমার। তুমি কোনো চিন্তা কইরো না। তোমার চাটাইয়ের কোনো ক্ষতি হইবো না। এরপর বললো, কি গো সোনামিয়া, মাটির ঘরে কেমন লাগতাছে? মইরা গিয়া তুমি বড়লোক হইয়া গেছ। এখন আর চান্দের আলো পাইবা না। বড়লোকের বন্ধ ঘর আর তোমার কবরের মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই। সেইখানে চান্দ-সুরুজের আলো ঢোকে না।
দূর থেকে কয়েকটা শিয়াল লাল চোখ দিয়ে কবরের দিকে চেয়ে আছে। পাগল বলেই হাসান বোঝে না যে শিয়াল-কুকুরও তাকে সহ্য করতে পারে না। কে কী বললো তার খেয়াল করলে তো আর পাগল হওয়া যায় না। পাগলের মন জানা-অজানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়ায়। আমরা তাদের প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর দিই না। কখনো ওদের তাড়িয়ে দিই, আবার কখনো গালমন্দ করি। চাঁদের আলোতে হাসান পাগলার বুক ভরা সুখ। আকাশে চাঁদ উঠলে সে আর মাটিতে চোখ ফেলে না। মাথা উঁচু করে চেয়ে থাকে আকাশে। মনে হয় আকাশে তার কোন আপনজন থাকে, যে তাকে পাগল বলে ডাকে না।
আমরা সবাই হাসানকে পাগল বলে ডাকি, আর সে আকাশের দিকে চেয়ে বলে, মালিক তোমার চেয়ে বড় পাগল কে? একপাটি কালো দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলে, মাতব্বর বাড়ির থন ছাড়া পাইয়া যখন সোনামিয়ার কাছে আইতে ছিলাম তখন শুনি হান্নান চাচী তার পাঁচবছরের মাইয়াটার পিছে ভাত লইয়া হাঁটতাছে আর কইতাছে মাগো ভাতগুলি খাইয়া ফেলা। তুমি তো জানো মালিক, ভাতের গন্ধ আমি বিশ মাইল দূরের থন পাই। ভাতের গন্ধ নাকে গেলে আমার নাড়ীর মধ্যে তুফান ওঠে। ভাতরে মনে হয় গাছের মধু। হান্নান চাচীর ঘরের কোনায় কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকলাম। চাচী ঝুটা ভাত ফালাইয়া দিলে টোকাইয়া খামু। হান্নান চাচী ওইটুকু ভাত বাঁচাইতে তার মাইয়ারে তোমার ভয় দেখাইয়া কইলো ভাত শেষ না করলে আল্লাহ গুনা দিবো। তোমার নামে উল্টাপুল্টা শুনলে পেটের ক্ষিধা মইরা যায়। মনে হইলো হান্নান চাচীরে জিগাই এইটুকু এক মাইয়ার কাছেও তুমি মালিকরে বিষাইয়া তুললা। মনে লইলো তারে কই, তুমি পারবা তোমার মাইয়ারে গুনা দিতে ? তুমি যদি না পারো তয় তিনি পারবেন ক্যামনে?
হাসান পাগলা কবরের উপর হাত দিয়ে দু’চারটা শব্দ করে জিজ্ঞেস করলো, ও সোনামিয়া, ঘুমায় গেলা নি? পর পর কয়েকটা শব্দ করেও কোনো উত্তর না পেয়ে বললো, ঘুমাও, তোমার পেটে তো আর ভাতের চিন্তা নাই। তোমার আর কি! খালি পেটে ঘুম তো দূরের কথা, মরণও আসে না। আমার এখন গান গাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নাই। গান হইলো গিয়া বিনা পয়সার খাদ্য। আকাশের দিকে তাকিয়ে সত্যি সত্যি হাসান পাগলা গান ধরলো।
মালিক চিনলা না রে।
মালিক চিনলা না।
না জাইনা, না চিন্ন্যা তারে
ছোট কইরো না।