মণিজিঞ্জির সান্যাল : ভ্রমণ মানেই শুধু ঘুরে বেড়ানো নয়; আমার কাছে তো নয়ই। ভ্রমণ মানেই আমার কাছে নতুন কিছু আবিষ্কার, নতুন কিছু জানা, নতুন কিছুকে খুঁজে বের করা। ঘর থেকে বাইরে পা রাখলেই মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। মনে হয় পাখির পাখায় ভর করে আমি কোথায় যেন উড়ে বেড়াচ্ছি। মন মেতে ওঠে তখন মনময়ূরীর মতো। আর গন্তব্যস্থল যদি হয় সবুজ প্রান্তর তাহলে তো কথাই নেই। পাহাড় কেন যে ডাকে আমাকে বারবার, এই মনও তখন আকুল হয়ে যায়। সাত তাড়াতাড়ি ছুটে যাই তাই তার কাছে। এ বারের ঘুরতে যাওয়াটা ছিল একেবারেই নিজের স্বার্থে। বিশেষ করে হাত বাড়ালেই যদি সেখানে যাওয়া যায় তাহলে এই সুযোগ ছাড়ি কি করে? তাই অন্যবারের থেকেও এবারে একটু ঘোরের মধ্যে ছিলাম কারণ যেখানে যাচ্ছি বা যার জন্যে যাচ্ছি সত্যিই কি তাকে দেখতে পাবো! পাবো কি! আর এই অভিপ্রায়েই আবার ছুটলাম সেই স্বপ্নের শহরে। হ্যাঁ আমি কার্শিয়াং এর কথাই বলছি।
কার্শিয়াং মানেই এখন যেন অন্য অনুভূতি। এতবার কার্শিয়াং -এ ছুটে গেছি কিন্তু এবারের কার্শিয়াং-এর ছন্দ গন্ধ বর্ণ আমার কাছে যেন অন্য রূপে ধরা দিল। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না; নিজের উপস্থিতি সম্পর্কেও আমার মধ্যে দ্বিধা-দ্ব›দ্ব কাজ করছিল। সত্যিই কী আমি আমাদের বীর নায়কের বাসস্থানে দাঁড়িয়ে আছি!
আচ্ছা কারো মনে আছে গিদ্দাপাহাড়কে? কার্শিয়াংয়ের কাছে ছোট্ট একটি জনপদ যেখানে জড়িয়ে আছে দেশের এক বীরনায়কের ইতিহাস। সুভাষচন্দ্র বসুর স্মৃতিবিজড়িত এই জনপদ। এখানেই ছিল তাঁদের একটি পারিবারিক বাড়ি? বসু পরিবারের সদস্যরা প্রতি বছর গরমের ছুটি বা পুজোর ছুটিতে এই বাড়িতে এসে সময় কাটাতেন। আর সেই বসু পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নেতাজীও এসেছিলেন বেশ কয়েকবার।
এখানে শুধু যে ছুটি কাটানো বা বিশ্রামের জন্যেই আসতেন তা কিন্তু নয়, এখানে আছে আরো একটি রহস্যঘেরা গল্প। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। একটা সময় ভাইপো-ভাইঝিদের নিয়ে এই বাড়িটিতেই হৈ হৈ করে কাটাতেন আমাদের মহান নায়ক সুভাষ, পরবর্তী কালের নেতাজি? ভাইপো-ভাইঝিদের কাছে তিনি ছিলেন পরম প্রিয় ‘ছোটকাকা?’ ভীষণ আদর এবং প্রশ্রয় পেত ছোটরা, ছোটকাকা বলতে তারা ছিল অজ্ঞান। গিদ্দাপাহাড়ের বাংলোটির বাগান শিশুদের কলতানে মুখর হয়ে থাকতো; প্রতিটি শিশুই যেন এক একটি ফুল।
দুষ্টুমিতে ভরপুর ছোট্ট ছেলেমেয়েরা বড়দের শাসনকে অগ্রাহ্য করত অনায়াসে। বড়দের ধমক খাওয়ার ভয় নেই, ছোটকাকা ছিলেন যে। ভাইপো ভাইঝি-দের সেই পরম প্রিয় ছোটকাকাই পরবর্তী কালে গোটা ভারতবর্ষের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সে সময় ভাইপো-ভাইঝিদের একমাত্র খেলার সাথী সুভাষই। বন্ধুর মতো খেলা করতেন ছোটদের সঙ্গে। কখনও ওদের দোলনায় বসিয়ে দোল দিতেন, কখনও ওদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতেন।
কানামাছি ভোঁ ভোঁ
যাকে পাবে তাকে ছোঁও।
এই খেলাতে সবচাইতে বেশি মজা পেতেন তিনি, তাঁর-ই ছিল সবচেয়ে বেশি উৎসাহ? তখন কি কেউ বুঝতে পেরেছিলেন বা জানতে পেরেছিলেন যে পরে এই ছেলেটি-ই ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে কানামাছি খেলবেন। রহস্যঘেরা যে গল্পের কথা বলছিলাম তা হল, গিদ্দা পাহাড়ের এক বাড়িটিতেই পরোবর্তীকালে ব্রিটিশ পুলিশেরা নেতাজীকে নজরবন্দি করে রেখেছিলেন। এ এক আশ্চর্য কাহিনী।
১৯৩৬ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত নেতাজি এই বাড়িতে ব্রিটিশের হাতে গৃহবন্দি ছিলেন। পরে মুক্ত অবস্থাতেও এই বাড়িতে এসেছিলেন।
বসু পরিবারের সবচেয়ে প্রিয় ফুল ছিল ক্যামেলিয়া। এই ফুলে ছেয়ে থাকত এই পাহাড়ি বাংলোটি। শিশুদের হৈ চৈ-তে রঙিন হয়ে উঠত এই গিদ্দা পাহাড়, হাসিখুশির রামধনুর রঙে ঝলমল করে উঠত চারপাশ, সুভাষের ছেলেমানুষির ছটা গিদ্দা পাহাড়সহ আরো দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ত। ছোট্টবেলার এই রোদ ঝলমলে দিনগুলো বসু পরিবারের কাছে ছিল এক অমূল্য মুহূর্ত। তাঁর দাদা দেশনেতা ও ব্যারিস্টার শরৎচন্দ্র বসু ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৫ পর্যন্ত অন্তরীণ ছিলেন এই বাড়িতে। তাঁর সহধর্মিণী বিভাবতী বসু একজন গান্ধীবাদী সমাজকর্মী ও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সহায়ককারী মহিলা কর্মী ছিলেন।
এই বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি রাখলেও নেতাজীকে দমিয়ে রাখতে পারেনি ইংরেজরা। চব্বিশ ঘণ্টা ইংরেজ পুলিশ ও তাদের গোয়েন্দাদের নজরদারি। নেতাজী এখানে গৃহবন্দি থাকার সময়ে চৌকিদারের মাধ্যমে গোপনে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে অনেক নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন।
এই বাড়ি থেকেই নেতাজির নির্দেশে একের পর এক চিঠি পৌঁছে যেত কলকাতায় স্বাধীনতা সংগামীদের কাছে। বাংলোর বিশ্বস্ত চৌকিদার কালু সিং লামা সকালের জলখাবার দিতে গেলে পাঁউরুটির মধ্যে চিঠি ঢুকিয়ে দিতেন তিনি? ট্রেতে দু-চার পিস পাঁউরুটি ফের হেঁসেলে ফিরে এলে, কারোর-ই নজর থাকে না।কালু আবার তাঁর এক বিশ্বস্ত মুচিকে দিয়ে জুতোর সুকতলার ভিতর সেই চিঠি সেলাই করে গোয়েন্দাদের নাকের ডগা দিয়ে যথাস্থানে পাচার করতেন? সবচেয়ে যেটা আসল গল্প, তা হলো এই যে বাড়ি যাকে নিয়ে এতো আলোচনা অর্থাৎ কার্শিয়াংয়ের এই বাংলোটি কিন্ত্ত পুলিশের বাংলো? অসম প্রদেশের তৎকালীন ডেপুটি সুপারিনটেন্ডেট অফ পুলিশ পিটার লেসলি ওয়ার্ড বাড়িটি বানিয়েছিলেন? ১৯২২-এ শরৎ বসু বাড়িটি কিনে নেন? কার্শিয়াংয়ের গিদ্দাপাহাড়ের বাংলোটি তাই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক গুরুত্বপুর্ণ অধ্যায়ের সাক্ষী?
বাড়িটিতে গিয়ে বিস্মিত হলাম! সব আছে ঠিকঠাক, কিচ্ছু বদলায়নি, নেতাজির ব্যবহৃত খাট, চেয়ার, টেবিল, ড্রেসিং টেবিল, লেখাপড়ার টেবিল-সহ নানা সামগ্রী? নেতাজির ব্যবহৃত ঘরগুলিকে তিনটি ভাগে ভাগ করে মিউজিয়াম করা হয়েছে? সুন্দর সুন্দর ফুলগাছের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক্যামেলিয়া ফুল যা আজও সেই স্মৃতি বহন করে চলেছে। ১৯৩৪ সালে শরৎচন্দ্র বসু ক্যামেলিয়া গাছ লাগিয়েছিলেন এই বাসভবনে যা আজও অক্ষত।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তখন কার্শিয়াং-এর গিদ্দা পাহাড়ে। সালটা ১৯৩৭ সালের ১৯ অক্টোবর। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নেতাজিকে চিঠি লিখেছেন। তাতে ‘বন্দেমাতরম’ গানের প্রসঙ্গ টেনে অনেক মত পোষণ করেছিলেন। কবি বলেছিলেন ‘বঙ্কিম এই গানে বাংলাদেশের সঙ্গে দুর্গাকেও একাত্ম করে দেখিয়েছেন। কিন্তু স্বদেশের এই দশভুজা মূর্তি রূপের যে পূজা যে কোনও মুসলমান স্বীকার করে নিতে পারে না।’ তারপরেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘যে রাষ্ট্র ভারতবর্ষের সকল ধর্ম স¤প্রদায়ের মিলনক্ষেত্র, সেখানে এই গান সার্বজনীন ভাবে সঙ্গত হতেই পারে না।’
এই নিয়ে জহরলালকে তিনি পত্র লিখবেন এই কথা ছিল। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে এই চিঠি লিখলে তার জবাবও দিয়েছিলেন নেতাজি। কিন্তু তাঁর সেই জবাবের হাতের লেখা চিঠিটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে এই চিঠিটি ছাড়া নেতাজির লেখা আরও চিঠি সেখানে সযত্নে রাখা আছে। পাহাড়ের বাসিন্দাদের সমস্যা নিয়ে নেতাজি যে কতোটা আন্তরিক ছিলেন সেটাও ফুটে উঠেছে তাঁর আরো একটি চিঠিতে।
কার্শিয়াং-এর গিদ্দা পাহাড়ে নেতাজি স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটিতে এসব মূল্যবান ঐতিহাসিক চিঠি ছাড়া নেতাজির অনেক ছবি আছে। নেতাজি এখানে এসে প্রতিদিন প্রাতঃভ্রমণে বের হতেন। পাগলাঝোরাতে পাহাড়ি ঝর্নার ধারে নেতাজির প্রাতঃভ্রমণের ছবিও আছে এখানে। এছাড়াও বসু পরিবারের সঙ্গে নেতাজির তোলা অনেক ছবিও আছে।
নেতাজি ইন্সটিটিউট ফর এশিয়ান স্টাডিজের তত্ত্বাবধানে সেই ঐতিহাসিক বাড়ি এখন নেতাজি মিউজিয়াম। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বাড়িটি বসু পরিবারের অধীনে ছিল। ১৯৯৭ সালে রাজ্য সরকার বাড়িটি সংস্কার করে। নতুন মিউজিয়াম আকারে বাড়িটি ২০০০ সালে উদ্বোধন হয়। হরিপুরা কংগ্রেসের ভাষণ এই বাড়িতে বসেই লিখেছিলেন নেতাজি। এখান থেকে গান্ধীজি ও জহরলাল নেহেরুকেও তিনি চিঠি লিখেছিলেন।
১৯২২ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত তার তথ্য আছে সেখানে। বসু পরিবারের সদস্য শিশির বসু, কৃষ্ণা বসুদের কাছ থেকে ১৯৭৩ সালে প্রতিদিন ২ টাকা হাজিরায় এই বাড়ি দেখভালের কাজ পান পদমবাহাদুর ছেত্রি। ১৯৯৬ সালে রাজ্য সরকার এটি সংস্কারের দায়িত্ব নেয়। পদমবাহাদুরের রোজ সকালে সেই বাড়িতে নেতাজিকে ধুপধুনো দিয়ে দিন শুরু করতেন ।
এখন যিনি আছেন, কেয়ারটেকার গণেশ প্রধান তিনিও যথেষ্ট মার্জিত এবং বিনয়ী। তিনি এই বাংলোর পাশেই থাকেন তার পরিবার নিয়ে। খুব সুন্দর করে, অনেক যত্নে রেখেছেন এই ভবনটিকে। এই মহান নেতার কতো কথা, কতো গল্প যে আমাদের শোনালেন। চোখের সামনে আমি যেন পরিস্কার দেখতে পেলাম আমাদের বীর নায়ককে। আমি এক অদ্ভুত শক্তি সঞ্চয় করছিলাম যেন। আমার চারপাশ – আকাশ -বাতাস তখন যেন এক বীর যোদ্ধার সেই শব্দগুলো উচ্চারিত হচ্ছিল “আমাকে তোমরা রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।” হ্যাঁ এতোদিন শুধু ইতিহাসের পাতায় পড়েছি দেশ নেতাদের বীরত্বের কথা, তাঁদের আত্মত্যাগের কথা, আর এখন যেন অনুভব করলাম স্বাধীনতার জন্যে, দেশের মানুষের জন্য এই মানুষটি কতোটা আত্মত্যাগ করেছিলেন; কতোটা কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। চোখে আমার জল চলে আসছিল। এমন আত্মত্যাগ ও হয়!
ফেরার সময় আমি যেন পরিস্কার উপলব্ধি করলাম এই মহান বীর ব্যক্তিত্বকে। আমার রক্তে রক্তে, শিরায় শিরায় তখন শুধু একটা শব্দ-ই উচ্চারিত হচ্ছিল “জয় হিন্দ”।
মণিজিঞ্জির সান্যাল : কথা সাহিত্যিক, শিলিগুড়ি, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত