শারমীন শরীফ: সমাজের আর দশজনের চেয়ে একজন শিল্পীর সামাজিক দায়িত্ব অনেক বেশি। তার কারণ, শিল্পী তাঁর সৃষ্টকর্ম দিয়ে সাধারণকে প্রভাবান্বিত করার ক্ষমতা রাখেন। মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। মানুষের জানার স্পৃহা রয়েছে তার সহজাত প্রবৃত্তির ভিতরে। শিশুকালের অজস্র প্রশ্নের ভিতর দিয়ে সে জগৎকে জানতে চায়। শৈশবের অজস্র প্রশ্ন ও বড়দের কাছ থেকে পাওয়া উত্তর এবং নিজের উপলব্ধি দিয়ে শিশুর জগৎ তৈরি হতে থাকে। বড় হওয়ার সাথে সাথে শিশুর জগৎ পাল্টায়, জিজ্ঞাসার ধরনও পাল্টায়। প্রাপ্তমনস্ক হতে হতে, তার জ্ঞানের জগৎ নানাভাগে বিভাজিত হয়ে যায়। এই জগতে স্থান পায়, তার প্রাত্যহিক চাহিদা এবং তা পূরণের জ্ঞান, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জ্ঞান, এমনি আরও কত কি। এর সাথে থাকে ভালো লাগার বোধ, নিজের পছন্দ-অপছন্দের ধারণা। জীব হিসেবে প্রকৃতিতে টিকে থাকার জ্ঞান মানুষ অর্জন করেছে প্রয়োজনে। এই প্রয়োজন হতে পারে নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য বা কোনো সত্য উদ্ঘাটন করার জন্য। টিকে থাকার জীবনযুদ্ধটা হলো মানুষের জৈবিক ধর্ম। এর ভিতরে মানুষ অনুভব করে, বেঁচে থাকার আনন্দ। কিন্তু শুধু বেঁচে থাকার আনন্দটা ক্ষণস্থায়ী, অল্পেতেই তাই একঘেঁয়েমিতে রূপ লাভ করে। এই ঘেঁয়েমি দশা থেকে মুক্তির জন্য মানুষ চায় বৈচিত্র্য। আনন্দের বৈচিত্র্যে সৃষ্ট মিশ্র-আনন্দের মধ্য দিয়ে তৈরি হয় সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য মানুষ পেতে পারে, প্রকৃতি থেকে, অন্যের বা নিজের সৃষ্টি কর্ম থেকে।
এনামুল কবির বাংলাদেশের একজন নিবেদিতপ্রাণ সংগীতশিল্পী। এনামুল কবির গিটারবাদক। তাঁর হাত ধরে দেশে অনেক গিটারশিল্পী তৈরি হয়েছেন। পাঁচ দশক ধরে তিনি দেশের অন্যতম সেরা হাওয়াইয়ান গিটারিস্ট হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন। আজ আমি একটি সুযোগ পেয়েছি তাঁর কাছ থেকে তাঁর সংগীত জীবনের গল্প শোনার।
শর্মী : চাচা আপনি কেমন আছেন?
এনামুল কবির : আমি ভাল আছি শর্মী, তোমরাও ভাল আছ নিশ্চয়ই?
শর্মী : আপনার ছেলে বেলার গল্প শুনতে চাই চাচা।
এনামুল কবির : আমার জন্ম ১৯৪২ সালের ০৫ই জুলাই, নড়াইল জেলার কালিয়া থানার ডুমুরিয়া গ্রামে। আমরা সাত ভাইবোন। ৮ বছর বয়স পর্যন্ত ওখানেই ছিলাম। আমার শিশুকাল কেটেছে কোলকাতাতেই। ১৯৪৭ এ দেশ ভাল হোল কিন্তু চাকুরির সুবাদে আমার বাবা থেকে গেলেন কোলকাতাতে সেই সাথে আমরাও। দেশভাগের মাত্র ৩ বছর পরেই শুরু হল সা¤প্রদায়ক দাঙ্গা। জীবন বাঁচাতে আমরা এক কাপড়ে, খালি হাতে পালিয়ে চলে এসেছিলাম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থান, খুলনায়। আমরা তখন খান এ সবুর সাহেবের বাসায় উঠেছিলাম। তিনি ছিলেন বাবার ঘনিষ্ট বন্ধু। মনে আছে সবুর কাকা আমাদের কাপড়-চোপড় কিনে দিয়েছিলেন। দাঙ্গা শেষ হলেও আমরা আর কোলকাতায় ফিরে যাইনি কারণ না বলে পালিয়ে আসার কারণে বাবার চাকরি চলে গিয়েছিল। আমরা অনেকদিন সবুর চাচার বাড়িতে ছিলাম। এরপরে গ্রামের বাড়ি ডুমুরিয়া তে চলে আসি। বাবা অনেক খুঁজে একটা উপযোগী কোন চাকরি পাচ্ছিলেন না। ফলে আমাদের আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বড়ভাই একরামুল কবির ম্যাট্রিক পাশ করে তখন পাকিস্থান বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। বাবাও তাঁর এক বন্ধুর অফিসে চাকরি পেলেন। আমি, মা আর ছয় বোন গ্রামে থেকে গিয়েছিলাম। আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে বাবা কয়েকটি গরু ও ছাগল কিনে দিয়েছিলেন। আমি সকালে স্কুলে যেতাম, বিকেলে মাঠে গরু চরাতাম। এভাবেই চলছিল আমার ছোট্ট জীবন।
শর্মী : চাচা সংগীতের জগতে এলেন কিভাবে?
এনামুল কবির : আমার এক চাচা কাওসার শেখ প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, তিনি মাঝে মাঝে বাঁশি বাজাতেন। আমি একদিন তাঁর কাছ থেকে বাঁশি বাজানোর নিয়মটা শিখে নিলাম। আস্তে আস্তে সুর তুলতে লাগলাম। লাইলি মজনুর পালা শুনে আমি সেই গানের সুর তোলার চেস্টা করতাম। প্রতিদিন বিকেলে গরু-ছাগল চারানোর সময় নিয়ম করে বাঁশি বাজাতাম। আমার বাঁশি শুনে কাওসার চাচাও এসে আমার সাথে বাঁশি বাজাতেন। হঠাৎ একদিন খেয়াল করলাম চাচা আর আসেন না, আমি গিয়ে জানতে চাইলাম তিনি আমারর সাথে বাঁশি বাজাতে আর আসেন না কেন? চাচা বলেছিলেন, ‘তুই আমার থেকে ভাল বাজাস, তাই আর তোর সাথে বাঁশি বাজাবো না। আমি দোয়া করি তুই যেন বড় শিল্পী হতে পারিস।’ এরপরে চাচা বাঁশি বাজানো একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। বিষয়টা নিয়ে আমি একটা অস্বস্তির মধ্যে ছিলাম। মনে করতাম কাকা আমার উপরে রাগ করেছেন। কিন্তু কাকার আন্তরিক পরামর্শ ও আমার বাঁশি বাজানোর খোঁজ-খবর নেয়াতে সে ভুল আমার ভেঙ্গে যায়।
মনে আছে বিলের মাঝখানে নৌকায় বসে আমি বাঁশি বাজাতাম।। ছোট চাচা আবুল খায়ের শেখ আমার এই বাঁশি বাজানো পছন্দ করতেন না। একদিন রাগ করে তিনি মায়ের কাছে নালিশ জানালেন যে কেন আমি বিলের মধ্যে নৌকায় বসে বাঁশি বাজাই? আমার কারণে পাড়ার অন্য ছেলেমেয়েরা নষ্ট হয়ে যাবে। মা বলেছিলেন, ‘ কেউ নষ্ট হবে না কারণ মানিক ছাড়া আর কেউ বাঁশি বাজাতে পারে না, অতএব তাদের নষ্ট হবার কোন কারণ নেই।’
আমাদের একটি কলের গান ছিল। কলকাতা থেকে পালানোর সময় ওই একটি জিনিসের সাথে করে আনতে পেরেছিলাম। রোজ সকালে আমি আর ছোট বোন কলের গান বাজিয়ে গান শুনতাম। চুরি হয়ে গেলে বাবা একটা ব্যাটারিওয়ালা রেডিও কিনে দিয়েছিলেন। শুরু হলো আমাদের সকাল বিকেল গান শোনা। গ্রামে কোন বাড়িতে রেডিও ছিল না বলে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমাদের বাড়িতে প্রচুর লোক আসতে রেডিও শুনতে। মা উঠানে খেজুর পাটি বিছিয়ে দিতেন, সেখানে বসে আমরা সবাই রেডিও তে গান শুনতাম।
শর্মী : চাচা আপনার ছেলেবেলার গল্প শুনতে শুনতে পুরো দৃশ্যটা যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। কি অনাবিল সুন্দর ছিল আপনার ছেলেবেলা।
এনামুল কবির : ঠিকই বলেছ, অনেক সহজ সরল, অনেক সুন্দর ছিল আমার ছেলেবেলা। ছোটবেলায় অনেক দুরন্তপনা করতাম আমি, ক্রিকেট খেলা, চাঁদা তোলা, আম কাঁঠাল চুরি করে খাওয়া সবকিছুই ছিল নির্মল আনন্দ। তবে মজার কথা হলো কাঁঠাল চুরি করতাম ঠিকই কিন্তু কাঁঠাল খাওয়াটা ছিল একটা অসম্ভব ব্যাপার। প্রথমত কাঁঠাল খোলাটা অনেক কষ্ট ছিল, দ্বিতীয়তঃ কাঁঠালের ঘ্রানে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল অনেক বেশি। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কাঁঠাল চুরি বাদ দিয়ে আম চুরির দিকে মনোযোগ দিয়েছিলাম। সে সব হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি আজো স্মৃতিতে উজ্জ্বল। কত দুষ্টুমি না করেছি ভাবলে হাসি পায়। হায়! সে দিনগুলো কত দ্রুত চলে গেল।
শর্মী : এর ফাঁকে ফাঁকে কি আপনার সংগীত চর্চা চলছিল? নাকি থেমে গিয়েছিল?
এনামুল কবির : আমার বোনের জামাই, আমার দুলাভাই একটি মাউথ-অর্গান কিনে দিয়েছিলেন। তো বাঁশি বাজানোর পাশাপাশি মাউথ অর্গান বাজানো সমানতালে চলতে থাকলো। স্কুলের বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বন্ধুদের উৎসাহে আমি বাঁশি ও মাউথ-অর্গান বাজনা অংশ নিলাম। অনুষ্ঠানের সামনে শাড়িতে প্রধান শিক্ষকসহ সব শিক্ষকরা বসে আছেন, পেছনের সারিতে বসা কয়েকশো ছাত্র-দর্শক। স্টেজে উঠে এদের দিকে তাকিয়ে আমার হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছিল কিন্তু সাহস করে কাঁপাকাঁপা হাতে বাজানো শুরু করেছিলাম। প্রথমে বাঁশিতে আব্বাস উদ্দিনের গাওয়া, ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে’ গানের সুরটি বাজালাম। বাজনা শেষ হলো কিন্তু আমি বুঝে উঠতে পারছি না কেমন হলো। দর্শকদের তুমুল করতালিতে আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। বুঝলাম ভাল হয়েছে এবং সাথে সাথে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। মঞ্চভীতি আর নেই। এরপরে মাউথ অর্গানে বাজিয়েছিলাম জনপ্রিয় হিন্দি গান, ‘হ্যয় আপনা দিল তো আওয়ারা’। দর্শকরা আবার করতালের মাধ্যমে উৎসাহ দিল। বাচেনা শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে এলাম, সবার অভিনন্দন এবং ভালোবাসায় আপ্লæত হলাম। দেখলাম অঙ্কু স্যার আসাদুজ্জামান আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। ভাবলাম স্যার বকা দিবেন কিন্তু আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে তিনি কাছে এসে বললেন, ‘ অনেক ভালো বাজিয়েছিস, অংক না পারলে কি হয়েছে, তুই ভালো বাঁশি বাজাতে তো পারিস।’ ওই অনুষ্ঠানের পর স্কুলের স্যারেরা আমাকে বেশ সমীহের চোখে দেখতেন। পড়া না পারলে বা অঙ্ক না পারলে আর তেমন বকাঝকা করতেন না। ব্যাস স্কুলে আমার একটা পরিচিতি হয়ে গেল, সবার বেশ স্নেহ পেতে শুরু করলাম।
শর্মী : চাচা, ছেলে বেলায় আপনি একবার বেশ অসুস্থ হয়েছিলেন জানি। সেই স্মৃতিটা একটু আমাদের সাথে শেয়ার করুন।
এনামুল কবির : স্কুলে পড়াকালীন সময়ে আমার শরীরটা হঠাৎ ভালো যাচ্ছিল না। মাঝে মাঝেই বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম। সারা শরীরে ব্যথা আর গায়ে জ্বর থাকতো সবসময়। বাবা তখন মহাখালী ওয়ারলেস গেটে থাকতেন। বাবাকে আমি বললাম আমার অসুস্থতার কথা। তৎকালীন প্রসিদ্ধ ডাক্তার নন্দী ওয়ারীতে বসতেন। বাবা আমাকে তার কাছে নিয়ে গেলেন। আমার সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তার নন্দী একটা ছোট লাঠি দিয়ে আমার হাঁটু, হাতের গিরায় আস্তে আস্তে আঘাত করে দেখলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তার বাবাকে বললেন আপনার ছেলে বাতজ্বরে আক্রান্ত। ডাক্তারের পরামর্শে বাবা আমার খেলাধুলা বাঁশি বাজানো বন্ধ করে দিলেন। কারণ এই রোগের কারণে হার্টের সমস্যা হতে পারে, অতএব খুব সাবধানে চলতে হবে। ডাক্তার বলেছিলেন শহরের আবহাওয়া আমার জন্য ভালো নয় বরং গ্রামের আবহাওয়া থাকলে আমার ভালো হবে। অন্তত একটি বছরের জন্য আমাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। অতএব সব ওষুধ কিনে বাবা আমাকে গ্রামের বাড়িতে রেখে গেলেন। আমার গান-বাজনা খেলাধুলা সব মাথায় উঠলো। ঘোর অবসর, কিছুই করার ছিল না।
শর্মী : সে কি! তাহলে আবার গানের জগতে ফেরা হলো কি করে?
এনামুল কবির : তখন মন খুব খারাপ থাকতো, খেলা বন্ধ, বাঁশি বাজানো বন্ধ, কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। মনে মনে স্থির করলাম গিটার বাজানো শিখব। আমার বড় বোনের দুই ছেলের গৃহ শিক্ষককে দেখেছি গিটার বাজাতে। আমি স্যার কে বললাম যে আমি গিটার বাজানো শিখতে চাই এবং একটি গিটার কিনতে চাই। স্যার তখন তৎকালীন ৭০ টাকা দামে আমার কাছে একটি গিটার বিক্রি করলেন। এটা নিয়ে আমি কোন দরদাম করিনি কিন্তু স্যারকে একটি শর্ত দিয়েছিলাম যে কয়েকদিন আমাকে গিটার বাজানোর তালিম দিতে হবে। স্যার বললেন দুই-একদিনের তালিমে গিটার বাজানো সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি রাজি হলেন। পরের দিন স্যার গিটার নিয়ে এসেছিলেন। গিটার দেখে তো আমি মহা খুশি। স্যার বললেন, ‘আমি বাজাচ্ছি তুমি দেখে নাও’। তার বাজানো শুনলাম এবং মোটামুটি দেখে নিলাম কিভাবে বাজাতে হয়। মাস্টার সাহেব গিটারের ছয়টা তারে সুর বেঁধে দিলেন। আমি সবগুলো তারে আঘাত করে দেখি দারুন একটা সুরের মূর্ছনা সৃষ্টি হচ্ছে। খুব পুলকিত হয়েছিলাম এবং একটা প্রবল আত্মবিশ্বাস জেগেছিল যে – আমিও পারবো।
বাড়িতে গিয়ে পৌঁছালাম, অসুস্থ আমাকে দেখে মা খুব মন খারাপ করলেন। আমাকে রেখে বাবা কর্মস্থলে ফিরে গেলেন। মাকে শিখিয়ে দিয়ে গেলেন কি করে ইনজেকশন দিতে হয়, ঔষধের বিধি নিষেধ সব মাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন। কোন কাজ নেই, পড়াশোনা, খেলাধুলা কিচ্ছু না। শুধু বসে থাকা। মাঝে মাঝে গিটারে হাত বুলাই আর স্যার যেভাবে দেখিয়ে গিয়েছিলেন সেভাবে বাজাতে চেষ্টা করি কিন্তু তেমন হয় না। মন খারাপ করে রেখে দেই, আবার চেষ্টা করি এভাবেই চলছিল। গ্রামের বাড়িতে এসে শরীর ভালো হওয়ার বদলে আরো খারাপ হলো। সমস্ত শরীর ফুলে গেল, জয়েন্টে ব্যথা আরো বাড়লো। বাবা আবার ঢাকায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে এলেন। দেখেশুনে তিনি আরও দুটো ওষুধ যোগ করে দিলেন। মাঝে মাঝে ব্যথা কমে যেত তখন আমি টুংটাং করে গিটার বাজাতাম। সন্ধ্যা হলে হারিকেন জ্বালিয়ে গিটার বাজাতে বসতাম আর যা মনে আসতো তাই বাজাতাম। রেডিওতে কলকাতার গান শুনতাম এবং গিটারে নতুন নতুন গান তোলার চেষ্টা করতাম। মা-বাবা দুজনেই আমাকে উৎসাহ দিতেন। এক বছরে আমি প্রায় ২০-২৫টি গান গিটারে রক্ত করে ফেললাম।
শর্মী : চাচা, তাহলে গিটার বাজানোটা কি সম্পূর্ণ আপনি একা একাই শিখেছিলেন? নাকি কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও নিয়েছিলেন?
এনামুল কবির : আমার বাবার ফুফাতো ভাই আশরাফুল হক বিশ্বাস আমার গিটার বাজানো শুনে বলেছিলেন যে আমার বাজনা ভালই হচ্ছে কিন্তু ঢাকায় গিয়ে বুলবুল একাডেমিতে ভর্তি হলে আরো ভালো করে শিখতে পারবো। বুলবুল একাডেমির নাম সেই আমি প্রথম শুনেছিলাম। অপেক্ষা করছিলাম কবে শরীরটা সুস্থ হবে এবং ঢাকায় গিয়ে আবার পড়াশোনার পাশাপাশি বুলবুল একাডেমিতে গিটার শিখব। কিন্তু রোগটা কিছুতেই ভালো হচ্ছিল না। ডাক্তার বলেছিলেন এ রোগের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সময় লাগবে অতএব চিকিৎসা চলবে।
মোটামুটি সুস্থ হবার পরে গ্রাম থেকে আবার ঢাকায় চলে এলাম এবং স্কুলে ভর্তি হলাম। এতদিনে স্বপ্ন পূরণে একটি উপায় হল, বুলবুল একাডেমিতে ভর্তি হয়ে গিটার শেখা শুরু করলাম। এর মধ্যে আমি কচিকাঁচার মেলার ও সদস্য হলাম। মাঝে মাঝে অসুস্থতা বেড়ে যেত তখন লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যেত। এভাবে আমি পড়াশুনাতে অনেক পেছনে পড়ে গিয়েছিলাম। ১৯৬১ তে কোনভাবে স্কুল জীবন শেষ করলাম। তারপর লক্ষী বাজারে তৎকালীন কায়দ-ই- আজম কলেজে ভর্তি হলাম। স্বাধীনতার পরে কলেজের নামকরণ হয় সোহরাওয়ার্দী কলেজ।
শর্মী : বুলবুল ললিত কলা একাডেমিতে আপনি কতদিন গিটার শিখেছিলেন? সেখানকার স্মৃতিকথা আমাদেরকে কিছু বলুন চাচা।
এনামুল কবির : বুলবুল নলিত কলা একাডেমী আমার গিটার বাঁধনে একমাত্র ভ‚মিকা রেখেছে সেটা বলা যাবে না। কারণ আমি যখন সেখানে ভর্তি হই তখন আমি ২০-২৫টি গানের সুর গিটারে বাজাতে পারি। তবুও একাডেমিক শিক্ষা বলে যে একটি কথা আছে সেটা আমার শুরু হয় এখান থেকেই।
প্রথম বর্ষে গীতার শাখায় প্রায় ১০০ ছাত্রছাত্রীর ছিল। তারা কেউই গিটারে গানের সুর বাজাতে পারত না। আমি ক্লাসে আসলেই সবাই আমার গিটার শোনার জন্য ঘিরে বসত। শ্যামল মিত্র, মান্না দে, লতা মঙ্গেশকর, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, অমল মুখোপাধ্যায়, তালাত মাহমুদ, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আব্বাসউদ্দিন আহমেদ, নিনা হামিদ, আব্দুল আলিম এবং আরো নামকরা শিল্পীদের গান আমি বাজাতে পারতাম। আমাদের ক্লাস শুরু হতে বিকেল পাঁচটায়। কিন্তু আমার গিটার শোনার জন্য চারটার মধ্যেই সবাই চলে আসতো। আমি সহপাঠীদের সামনে গিটার বাজাতে আনন্দ পেতাম। নিজেকে তাদের চেয়ে সেরা মনে হতো। তখন গিটারের শিক্ষক ছিলেন দুইজন। বোরহান উদ্দিন আহমেদ এবং পান্না আহমেদ। বোরহানউদ্দিন স্যার ছিলেন গীতার শাখার প্রধান। পান্না স্যার তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা কেন্দ্র গিটার বাজাতেন। এই যে আমি নিজে নিজেই ভালো গিটার বাজানো শিখেছিলাম এবং বন্ধুদের বাজিয়ে শুনাতাম কোন একটি অজানা কারণে পান্না স্যার এটা ভালো চোখে দেখলেন না। স্যার বলেছিলেন, ‘তুমি যখন অনেক কিছুই শিখে গেছো তখন তোমার আর বাফায় আসার দরকার কি?’ স্যারের কথায় অনেক দুঃখ পেয়েছিলাম। তিনি আমাকে উৎসাহ না দিয়ে বরং তিরস্কার করলেন। দুঃখে-ক্ষোভে বাফা ছেড়ে দিলাম। মাত্র ছয় মাস ক্লাস করেছিলাম বাফায় আর বলতে গেলে সেটাই আমার একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক গিটার শিক্ষা।
শর্মী : চাচা, এবারে আপনার প্রেম-বিয়ে এসব নিয়ে একটু গল্প শুনবো। আপনি এত সুন্দর গিটার বাজাতেন আর আপনার এই গিটার শুনে কোন মেয়ে আপনার প্রেমে পড়েনি এটা বিশ্বাস করিনা। একদম সত্যি করে বলবেন কিন্তু, কিছু লুকাবেন না।
এনামুল কবির : ‘প্রেম একবার এসেছিল জীবনে, আমারই এ দুয়ার প্রান্তে’, এটা মোটামুটি একটা লম্বা গল্প কিন্তু তোমাকে সংক্ষেপে বলছি। খুব না হলেও গিটার বাজিয়ে তখন মোটামুটি আমার একটা পরিচিতি হয়েছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও গিটার বাজানোর আমন্ত্রণ পাই। তখন নারিন্দা তে থাকি। বাসার নিচতলায় থাকতেন ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকার জেনারেল ম্যানেজার মাহবুবুর রহমান খান। আমার বোন এবং ওই পরিবারের মধ্যে মোটামুটি একটা সুন্দর সম্পর্ক ছিল। মাহবুব সাহেবের ছোট মেয়ে আমার কাছে গিটার বাজানো শিখতো। ডলি তখন কলেজের ছাত্রী। গিটার বাজানোতে সে খুব একটা সিরিয়াস ছিল না, কিন্তু সাংস্কৃতি পরিবারের মেয়ে বলে সে গিটার শিখতে চাইতো।
১৯৬৪ সালের শেষের দিকে চট্টগ্রাম রেডিওতে ‘স্টাফ আর্টিস্ট’ হিসাবে চাকরির প্রস্তাব পেয়েছিলাম। ঢাকা ছেড়ে যেতে মন খারাপ করছিল কিন্তু তবুও রাজি হয়েছিলাম। সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। ডলি আমাদের বাসায় এসে বুবুর কাছে শুনেছিল যে আমি চট্টগ্রাম চলে যাচ্ছি, সে ঐদিন আর গিটার শিখতে এলো না, সিঁড়িতে তার সাথে আমার দেখা হল, মনে হচ্ছিল সে বেশ গম্ভীর। আমি বিষয়টি গুরুত্ব দিলাম না কেননা তার সাথে আমার এমন কোন সম্পর্ক তৈরি হয়নি যা নিয়ে আমার কোন বাড়তি চিন্তার কারণ হবে। যাবা ঠিক আগের দিন ডলি তা খালাতো ভাই টুনুর মাধ্যমে আমার কাছে একটা চিরকুট পাঠালো। কাগজটি খুলে পড়ে আমি তো হতবাক! লেখা ছিল, – ‘সাথী, তুমি চট্টগ্রামে যেও না। আমি খুব একা হয়ে যাব এবং আমার গিটার শেখাও বন্ধ হয়ে যাবে। আর যদি যাবি তবে আমার মৃত্যুর সংবাদ পাবে’। চিঠিটি পড়ে আমার খাওয়া ঘুম বন্ধ হয়ে গেল। আমার মত একজন সাধারন মানুষ তাও আবার অসুস্থ মানুষ তাকে যে কেউ বা কোন মেয়ে ভালবাসতে পারে সেটা আমার মাথাতেই ছিল না। দলে যে আমার প্রতি এতটা আকৃষ্ট আমি তা গুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি। সকালে সিঁড়িতে ডলের সাথে দেখা কলেজে যাচ্ছে, জানতে চাইলে, চিঠি পড়েছে কিনা এবং কি ভাবছি? আমি কোন উত্তর দিলাম না দ্রæত সিড়িবে উপরে উঠে এলাম। মনে হচ্ছিল জ্বর আসছে গায়ে। অনেক সাহস করে বুবুকে চিঠিটা দিয়েছিলাম। বুবু বলেছিল এসব চিন্তা বাদ দিতে এবং চট্টগ্রামের চাকরি নিয়ে চলে যেতে। বুবুর কথা মনে ধরেনি, মনে হলে চিঠিটা দুলাভাইকেও দেখাতে হবে। কাজ শেষে বাড়ি এলে দুলাভাইকে চিঠিটা দিলাম পড়বার জন্য। দুলাভাই চিঠিটি পড়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘মানিক তোর গিটারের জালে যে মাছটি জড়িয়ে গেছে, তাকে রেখে মনে হয় চট্টগ্রাম যাওয়া ঠিক হবে না। কারণ চিঠির ভাষা বিপজ্জনক-তুমি গেলে আমি আত্মহত্যা করব।’ দুলাভাইয়ের কথায় সাহস পেয়ে চট্টগ্রাম যাওয়া বাতিল করলাম। ডলির আর আমার সম্পর্ক ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে লাগলো। হঠাৎ দুলাভাই বদলি হয়ে গেলেন বরিশালের ঝালকাঠিতে। যাবার আগে বলে গেলেন, ‘মানিক আমি চলে যাবার পরে ডলির সাথে ঝুলে পড়ো, আমি থাকা অবস্থায় বিয়ে-শাদী করে ফেললে সবাই আমাকে দুষবে।’ একসময় ডলের পরিবার আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে গেলে তারা এটাকে খুব একটা ভালোভাবে নেয়নি। আমার এক ছাত্রীর স্বামী ছিলেন সৈকত শওকত আলী। তিনি ছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। আমাকে তিনি খুব স্নেহ করতেন। সব জেনে তিনি বলেছিলেন যে প্রয়োজনে তার বাড়িতেই আমাদের বিয়ে হবে। অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা পেরিয়ে আমরা একদিন কাজির অফিসে এসে হাজির হলাম। সাথে ছিলেন আমার ছোট বোন মিনির স্বামী বাসারুজ্জামান বাবু ও আমজাদ ভাই। তিন হাজার এক টাকা দেনমোহর ধার্য করে কাবিননামা লেখা হলো। দিনটি ছিল ১৮ই মে ১৯৬৫। সাথে মিষ্টি আনা হয়েছিল সেই মিষ্টি দিয়ে কাজী অফিসের সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো হলো কিছুদিন পর ডলির পরিবারের সবাই আমাদের বিয়ে মেনে নিয়েছিল। এ সময় আমি বেশ অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম আবার। ডলির অনেক সেবা যত্নে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়েছি। বিয়ের এক বছর পর ১৯৬৬ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের প্রথম সন্তান জন্ম নিল। নাম রাখা হলো এনায়েত কবির চঞ্চল। পুত্র সন্তান পেয়ে আমি তো মহা খুশি কিন্তু সন্তান নিয়ে ডলি ব্যস্ত থাকায় আমার রোগটা তখন বেশ বেড়ে গিয়েছিল। অসুস্থ শরীরে দিনরাত ডলি আমার সেবা করেছে সেজন্য আমার মা-বাবা ডলের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল। আর্থিক টানাপোড়েনও কম ছিল না কিন্তু ডলি আমার মুখ চেয়ে সব কষ্ট নিরবে হাসিমুখে সহ্য করেছে। ১৯৬৮ সালে আমার দ্বিতীয় সন্তান রিয়ার জন্ম হয় কিন্তু মাত্র সাত মাসের মাথায় আমাদের সুখে ভাসিয়ে রিয়া চলে গিয়েছিল। ডলি খুব ভেঙে পড়েছিল। ১৯৭০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আমাদের সংসার আলো করে আরেকটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। তার নাম রাখি নাহিদ কবির কাকলী।
শর্মী : আপনার প্রেম এবং বিয়ের গল্প নিয়ে একটি সিনেমা বানানোর ইচ্ছা প্রকাশ করি চাচা, কি সুন্দর গল্প। আমি জানি যে খুব অসময়ে ডলি চাচি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। আমি এও জানি যে এই প্রসঙ্গে কথা বলতে আপনার কষ্ট হয় তবুও একটু বলুন।
এনামুল কবির : হ্যাঁ শর্মী সিনেমা বানানোর মতোই গল্প বটে! আমি পুরোটা বলতে গেলে একটা পত্রিকার সবটা জুড়েই তোমাকে লিখতে হবে তাই অনেক সংক্ষেপে আমাদের গল্পটা তোমাকে বললাম।
দিন আমাদের ভালই কাটছিল। কোনদিনই নিজের ঘরের দিকে তাকাতে হয়নি। সাংসারিক জীবনে কোন অভাব অভিযোগ বোধ করিনি। আমার সংগীতময় সুন্দর জীবনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে গেছে আমার প্রিয়তমা স্ত্রী, মমতাজ জাহান ডলি। ১৯৬৪ সালে আমি ছিলাম তার সংগীত শিক্ষক। তারপর নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে মমতাজ জাহান হল আমার সহধর্মিনী। এই আমি যে কি-না চিরকাল সংসারে থেকেও ছিলাম উদাসীন, সেখানে নিরবে-নিভৃতে, ভেতর-বাহির দুই দিক থেকেই ডলি আমাকে আগলে রেখেছিল। রাত জেগে আমাদের চা নাস্তার ব্যবস্থা করেছে, কখন কি লাগবে তার যোগান দিয়েছে হাসিমুখে। কখনো তাকে বিরক্ত হতে দেখিনি। ছেলে-মেয়েকে আদরে যত্নে শিক্ষা দীক্ষায় সে একাই বড় করেছে। এক্ষেত্রে আমার কোন কৃতিত্ব আছে বলে দাবি করি না। ডলি ছিল আমার সহযাত্রী, সহযোদ্ধা, প্রিয় সাথী। তারুণ্যের সময় পেরিয়ে নেমে প্রৌঢ়ত্ব এলো আমাদের জীবনে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই কেটেছে শুধু সুখ ভালোবাসা আর আনন্দে। কিন্তু হঠাৎই তার ছন্দপতন। পঞ্চাশের পর আমার স্ত্রী বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হলেও বুঝিনি ওর জীবন প্রদীপ নিভে আসছে। কোনদিন সে আমাকে বুঝতেও দেয়নি, কোনদিন কোন অভিযোগ দুঃখ বা হতাশা প্রকাশ করেনি। ভেতরে ভেতরে তার শরীরে কঠিন রোগ বাসা বাঁধতে শুরু করে। জীবনী শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে যা কখনোই সে আমাকে বুঝতে দেয়নি বা আমিও বুঝতে পারিনি।
তারিখটি ছিল জানুয়ারি মাসের নয়। ফজরের নামাজ আদায় করতে আমি নিচ তলায় নেমেছি মাত্র। তখনই কাজের মেয়েটি আমায় এসে বলল দলের শরীর খারাপ করেছে। ছেলে মাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তার জানালেন ‘সিভিয়র কার্ডিয়াক এরেস্ট’। ডলি ধীরে ধীরে কোমায় চলে গেল। লাইফ সাপোর্টে রেখে দেয়া হলো তাকে। সারাক্ষণ পরম করুণাময়ের উপরে ভরসা করে থাকি এই বুঝি ডলি সুস্থ হয়ে ফিরে এলো আমাদের কাছে। কিন্তু জীবন-মৃত্যুর অমোঘ সত্যের কাছে আমরা বন্দী। পরম করুণাময়ের ইচ্ছায় ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখ সন্ধ্যা ৬.৫৫ মিনিটে আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে মমতাজ জাহান ডলি। মৃত্যু যে কত নিষ্ঠুর, ডলি সে কথা আমাকে বুঝিয়ে দিল।
রবীন্দ্রনাথ হৈমন্তী গল্পে যেমন বলেছিলেন- ‘আমি তাকে পেয়েছি’, আমিও ডলিকে পেয়েছিলাম জীবনের তরে। আজ সে নেই। আমার সমস্ত কথাই তাকে ঘিরে, নতুন করে বলবার কিছু নেই। তবু একটা কথা,- ‘ডলি তুমি যেখানেই থাকো ভালো থেকো, তুমি এখনো আমার সমস্ত সত্ত¡া জুড়েই আছো, থাকবেও।’
শর্মী : চাচীর প্রতি অসীম শ্রদ্ধা! অনন্তে ভাল থাকুন তিনি। চাচা আপনাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছি। আর মাত্র ২টি প্রশ্ন। আপনার প্রকাশিত সঙ্গীতবিষয়ক স্বরলিপির বইয়ের তালিকাটি আমাদের একটু বলুন চাচা।
এনামুল কবির : এ পর্যন্ত আমার প্রকাশিত বই বের হয়েছে মোট ২৪টি। দেশের গানের স্বরলিপি থেকে ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, হাসনরাজা, পল্লিগান, আধুনিক, নজরুল গীতি, মুক্তিযুদ্ধের গান এবং বঙ্গবন্ধুর উপরে রচিত গানের সব স্বরলিপি। গিটার ও গানের ভিসিডি/অডিও ক্যাসেট।সিডির বেরিয়েছে মোট ৫৪টি। দেশের গান, পুরোনো দিনের গান, গিটারে হারানো দিনের গান, রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতি, পল্লিগীতি। কীবোর্ডে রবীন্দ্রসংগীত, হারানো দিনের গান ইত্যাদি। এতগুলো নাম বলে শেষ করা যাবে না।
আমার লেখা আমার জীবনী বেরিয়াছে একটি, বইটির নাম, ‘আমার সংগীত আমার জীবন’- এই বইটিতে আমার স্বরলিপি বইয়ের লিস্ট এবং আমার অডিও সিডির লিস্ট রয়েছে। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেরা ১১০ ভাষণ’ অ্যালবামে আবহ সঙ্গীত হিসেবে আমার মিউজিক ব্যবহৃত হয়েছে। তাছাড়া বর্তমানে সংসদ টিভিতে প্রতিদিন আমার একটি যন্ত্রসঙ্গীত ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
শর্মী : চাচা আপনার পুরষ্কার ও সম্মাননা বিষয় একটু বলুন।
এনামুল কবির : আমি অনেক সম্বর্ধনা, সম্মাননা পেয়েছি জীবনে, ক্রেস্ট, মানপত্র অনেক পেয়েছি। মোটামুটি ২২/২৩ বার সম্মাননা পেয়েছি। সর্বপ্রথম সিলেট যন্ত্রশিল্পী পরিষদ ১৯৮৮ সালে আমাকে ক্রেস্ট ও মানপত্র দিয়ে সম্মাননা জানিয়েছিল। ‘মৌলিক বার্তা’ আজীবন সম্মাননা-২০১৬’ পেয়েছি, আমার হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন দেশের সাংস্কৃতিক অভিভাবক, আইটিআইয়ের সম্মানিক সভাপতি রামেন্দু মজুমদার। এবং সর্বশেষ কানাডায় বিশেষ সম্মাননা পেয়েছি ২০২৩ জানুয়ারীতে। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত প্রথম নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ডলি বেগম আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে কুইন্সপার্কে সংসদ অধিবেশনে নিয়ে যান। পরে তিনি প্রাদেশিক সংসদ সদস্যদের সামনে আমাকে উপস্থাপন করেন এবং আমাকে বাংলাদেশের সেরা হাওয়াই গিটারশিল্পী হিসেবে উল্লেখ করেন, এ আমার পরম পাওয়া। বিদেশের মাটিতে আমি যে সম্মান পেলাম, তাতে আমি অভিভ‚ত এবং আবেগে আপ্লুত।
আমাকে সময় দেবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ চাচা। অনেক অজানা গল্প আজ আপনার কাছ থেকে শুনলাম।
সাধনা সফলতা আনে এই সত্যটি প্রমাণ করেছেন এনামুল কবীর। জীবন যুদ্ধ, অসুস্থতা সব কিছুকে পাশ কাটিয়ে সঙ্গীত সাধনায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন তাঁর জীবন। এদেশের সঙ্গীত ভুবনকে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁর সাধনার এবং সঙ্গীতের প্রতি তাঁর নিবেদিত প্রাণ দিয়ে। বয়স হয়েছে একাশি কিন্তু এখনো তাঁর সুরের মায়াজালে জড়িয়ে রেখেছেন আমাদের সবাইকে। গিটার বাজানো, গিটার শেখানো, স্বরলিপি লেখা, নতুন নতুন গানে সুর করাতে এনামুল করিম ক্লান্তিহীন। আসুন আমরা সকলে তাঁর সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন কামনা করি।