মনজুর মাহমুদ : তিশা দম্পতি ছুটি কাটিয়ে বাসায় ফিরে দেখেন গ্যারেজে রেখে যাওয়া তাঁদের বিলাসবহুল ফেরারি গাড়িটি সেখানে নেই। মিসিসাগায় তাঁদের এপার্টমেন্টের গ্যারেজ থেকে চার লক্ষ ৮০ হাজার ডলার মূল্যের দুষ্প্রাপ্য মডেলের গাড়িটি চুরি হয়ে গেছে। পরে ভিডিও ফুটেজে দেখেন, তিন জনের একটি দল মাত্র চার মিনিটের ব্যবধানে গাড়িটি নিয়ে পালিয়ে গেছে।
একটি টয়োটা ক্যামরি বিক্রির জন্য এক ব্যক্তি গত আগস্টে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেয়। গাড়িটি কিনতে সাদিদ সুলতান আহমেদ এবং ১৬ বছরের এক বালক বিক্রেতার সাথে দেখা করে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে তারা গাড়িটি নিয়ে পালিয়ে যায়। মাত্র দু’দিনের ব্যবধানে গাড়িটি বিক্রির জন্য পুনরায় ফেসবুকের বাজারে তোলা হয়। অন্য এক ব্যক্তি গাড়িটি কিনতে গেলে এ দু’জন তাঁর কাছ থেকে ৫,৫০০ ডলার নিয়ে গাড়িসহ পালিয়ে যায়। পুলিশ এ দু’জনকে আটক করেছে।
পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ বলছে, মূলত দু’টি কারণে গাড়ি চুরি হয়ে থাকে। কোন ব্যক্তি বা ছোট ছোট দল টাকা উপার্জন করতে গাড়ি চুরি করে কিন্তু সংঘবদ্ধ দল পরিকল্পিত অপরাধকে অর্থায়ন করতে এ পথ বেছে নেয়।
টরেন্টো ডাউনটাউনে এক ডিলারের শোরুম থেকে তিন জনের অন্য একটি দল দিনে দুপুরে বিলাসবহুল তিনটি গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায়। দু’টি রোলস রয়েস এবং একটি বেন্টলি বেনটাইগা গাড়ির মোট মূল্য এক মিলিয়ন ডলারের বেশি।
প্রতিদিন ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনার মধ্যে এগুলো কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। টরেন্টো পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর শুধু টরেন্টোতেই ৯,৭০০ এর বেশি গাড়ি চুরি হয়েছে যা এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। চলতি বছর এ সংখ্যা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ বছর ৭,৬০০ গাড়ি চুরি হয়েছে যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি। গত ২৫ জুলাই থেকে আগস্টের ২৬ তারিখ পর্যন্ত মাত্র ৩১ দিনে শুধু মিসিসাগা এবং ব্রাম্পটন শহরেই ৬০৬টি গাড়ি চুরির ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশের হিসাব মতে, এ বছর মোট চুরির এক তৃতীয়াংশ হয়েছে বড় বড় শপিং মল এবং সাবওয়ে স্টেশন সংলগ্ন পার্কিং থেকে। এর মধ্যে ইয়র্কডেল মল, স্কারবোরো টাউন সেন্টার, ইটোবিকোর উডবাইন ক্যাসিনো, ফিঞ্চ স্টেশন, পিয়ারসন এয়ারপোর্টের নিকটবর্তী কয়েকটি পার্কিং লট উল্লেখযোগ্য। এক তৃতীয়াংশ হয়েছে আবাসিক এলাকায় বাড়ির পার্কিং থেকে। এছাড়া বাকি এক তৃতীয়াংশ চুরি হয়েছে রাস্তা সংলগ্ন বিভিন্ন পার্কিং এবং অন্যান্য জায়গা থেকে।
ব্রাম্পটনের বাসিন্দা সাবিহা আলিভাই-এর বাড়ির পার্কিং থেকে গত জুলাই মাসে চুরি হয়ে যায় তাঁর টয়োটা হাইল্যান্ডার গাড়িটি। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “সকালে উঠে যখন দেখলাম গাড়ি নেই, তখন কেমন লাগছিলো ঠিক বলে বোঝাতে পারবো না। এটা অনেকটা দুঃস্বপ্নের মতো।”
বীমা কোম্পানি ক্ষতিপূরণ দিলেও প্রতি মাসে সাবিহার প্রিমিয়াম বেড়ে গেছে অনেক বেশি। “গাড়ি ছাড়া এখন কি একটা দিনও চলে? অফিসে যাতায়াত, বাচ্চাদেরকে স্কুলে পৌঁছে দেয়া ও নিয়ে আসা, বাজারঘাট ছাড়াও প্রাত্যহিক জীবনে গাড়ির ওপর নির্ভরশীলতা তো বুঝিয়ে বলার দরকার নেই!”
বিভিন্ন ধরণের জালিয়াতি রোধে বীমা কোম্পানিগুলোকে সহযোগিতা করে আসছে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান একোইত এসোসিয়েশন। এসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি এবং সাবেক প্রাদেশিক পুলিশ কর্মকর্তা ব্রায়ান গাস্ট বৃহত্তর টরেন্টোতে গাড়ি চুরি সম্পর্কে বলেন, “পরিস্থিতি বর্তমানে একটা সংকটে রূপ নিয়েছে। গাড়ি চুরি এখন জাতীয় সমস্যা হলেও অন্টারিও প্রদেশ এবং বিশেষ করে বৃহত্তর টরেন্টো অঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।”
একোইত এসোসিয়েশনের ২০২২ সালে অন্টারিও প্রদেশে গাড়ি চুরির তালিকা অনুযায়ী, লেক্সাস আরএক্স, হোন্ডা সিআরভি, হোন্ডা সিভিক, ফোর্ড এফ১৫০ এবং টয়োটা হাইল্যান্ডার শীর্ষে রয়েছে। তবে বেশি অর্থের লোভে সংঘবদ্ধ দল বিলাসবহুল দামি গাড়ির প্রতি বেশি আগ্রহী বলে পুলিশ এর আগে মালিকদেরকে সতর্ক করে দিয়েছিলো। এসব গাড়ির মধ্যে রয়েছে: ল্যাম্বরঘিনি, ম্যাকলারেন, রোলস-রয়েস, বেন্টলি, পোর্শে, মার্সিডিজ বেঞ্জ।
সময়ের সাথে সাথে গাড়ি চুরিতে আধুনিক কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে। পুলিশ বলছে, মাত্র তিন থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সংঘবদ্ধ দল গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম। ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে তারা কাছাকাছি থাকা গাড়ির চাবির (ফব) সংকেত নকল করতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গাড়ির ‘ডাটা পোর্ট’ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ইলেট্রনিক ব্যবস্থাও পরিবর্তন করতে পারে। এক পর্যায়ে তারা গাড়িটি সচল করে দ্রুত পালিয়ে যায়। অনেক সময় চুরির পর গাড়ির এতটাই পরিবর্তন করা হয় যে, পরবর্তীতে ঐ গাড়ি সনাক্ত করা খুবই কঠিন।
আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে চোরের দল ক্যাটালিটিক কনভার্টারসহ গাড়ির মূল্যবান যন্ত্রাংশ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত ৫ বছরে অন্টারিও, কুইবেক, আলবার্টা প্রদেশে এ ধরণের চুরির ঘটনা ১৭ গুন্ বেড়ে গেছে।
এক হিসাবে কানাডাতে বর্তমানে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার মূল্যের গাড়ি প্রতি বছর চুরি হচ্ছে। চুরি নিয়ন্ত্রণ করতে গাড়ির কিছু কিছু কারিগরি নিরাপত্তা বিষয় আরো কার্যকর করতে পুলিশ বিভাগ বর্তমানে নির্মাতাদের সাথে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি এড়াতে মালিকদেরকে সম্ভব হলে তালাবদ্ধ গ্যারেজে গাড়ি রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ভিডিও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা, গাড়ির পার্কিংয়ের জায়গায় অস্থায়ী নিরাপত্তা খুঁটি (পপ-আপ বোলার্ড) স্থাপন এবং স্টিয়ারিং হুইলে বিশেষ ধরণের তালা ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে পুলিশ।