Home কলাম গান রচনা-মুহূর্তের রবীন্দ্রনাথ

গান রচনা-মুহূর্তের রবীন্দ্রনাথ

ভজন সরকার : অনেকবার ভেবেছি, এখনো ভাবি, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমগ্র রচনার মধ্যে থেকে গানের কথাই কেন আলাদা করে বললেন যে, গানই বেঁচে থাকবে। কেন গল্প নয়? কেন উপন্যাস নয়? কেন কবিতা নয়? কেন প্রবন্ধ বা চিঠিপত্র নয়? অথচ ছোটগল্পের সংজ্ঞাটি তো রবীন্দ্রনাথেরই দেওয়া। উপন্যাসের আধুনিকতা রবীন্দ্রনাথের সাথেই চলেছে। কবিতা প্রবন্ধ বা চিঠিপত্র সে সবেও সমান দক্ষ এবং সফল রবীন্দ্রনাথ। তবে গান নিয়ে এমন কী করলেন যে, মহাকালের বিস্মৃতির সরণী চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে সে ভরসা এবং অভয় পেয়ে তিনি নিজেই নিজেকে আস্বস্ত করে গেলেন? বড় কঠিন এ প্রশ্ন। তাই উত্তরও খুব সহজ নয়।
বাঙালি জীবনে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির ঋণের অন্ত নেই। সে সব লিখতে গেলে ‘বাঙালি জীবনে ঠাকুরবাড়ির ঋণ’ নামে একটা ঢাউস বই হয়ে যাবে। তাই আমি সংগীত বা গানের দিকেই আলোচনাকে নিবিষ্ট করে রাখি আপাতত।

ঠাকুরবাড়িতে প্রবেশের আগে বাংলা সঙ্গীতের রূপ-স্বরূপ কেমন ছিল? বাংলা সংগীত বলতে যা বোঝাতো তা মূলত রামপ্রসাদীর মতো ধর্মীয় সংগীত এবং অঞ্চলভিত্তিক বাউল ও লোকসংগীতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ভারতীয় রাগসঙ্গীত বাংলা গানের মধ্যে তেমনভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। বাংলা রাগসংগীত বলতে যা বুঝাতো তা মূলত খুব অকিঞ্চিত্কর কথা এবং কখনো কখনো তা ‘ননসেন্স ভার্স’র মতো। ধ্রুপদ এবং টপ্পা গানের ওস্তাদগন বাংলার বিভিন্ন জমিদারের বৈঠকখানার গানের আসরে গান পরিবেশন করতেন।
তখন দুই ঠাকুর রাজপরিবারের অর্থাত পাথুরিয়াঘাটার যতীন্দ্রমোহন এবং শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর পরিবারের এবং জোড়াসাঁকোর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারের মধ্যে উচ্চাংগসংগীতের ঘরানার চর্চা হতো। পাথুরিয়াঘাটার রাজারা ছিলেন সেনী অর্থাত তানসেনী ঘরানার এবং জোড়াসাঁকোর ঠাকুর জমিদারেরা ছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার পৃষ্ঠপোষক।
বাংলা সংগীত তখন ভারতীয় সংগীতের অংশ হিসেবেই ওস্তাদেরা শেখাতেন। বাংলা সংগীতের স্বীকৃত স্বরলিপিও তখন ছিল না। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারই প্রথম আকারমাত্রিক স্বরলিপির প্রবর্তন করলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর আকারমাত্রিক স্বরলিপি উদ্ভাবন করেন। রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি গ্রন্থ যে স্বরবিতান- যা এখন বাংলা সংগীতের গ্রহনযোগ্য স্বরলিপির ধারা বা প্রণালী সেও রবীন্দ্রনাথের পূর্বসূরীদের হাত ধরেই এসেছে।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সংগীতের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন। ভারতীয় রাগ-রাগিনীকে বাংলা গানের সুরে বসালেন। আগে যে তিন কাঠামোর অর্থাত স্থায়ী, অন্তরা এবং আভোগ বা অস্থায়ী কাঠামোর সংগীত ছিল, রবীন্দ্রনাথ সেখানে সঞ্চারী নামের আরেকটা কাঠামো জুড়ে দিলেন। এতে স্থায়ী এবং আভোগের সুরের একঘেয়েমি থেকে শ্রোতার কান মুক্তি পেলো শুধু নয়, শিল্পীও তাঁর কন্ঠের বিশ্রাম পেলেন কিছুটা হলেও। এ শুধু সুরের বেলাতে নয়, গানের বাণীতেও সম্পূর্ণ গানের অর্থকে সঞ্চারীতে এসে কখনো বিস্তৃত আবার কখনো সারসংক্ষেপে ব্যক্ত করলেন রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ৮০ বছর পরেও বাংলা সংগীত রবীন্দ্রনাথের সুর ও কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। বিশিষ্ট রবীন্দ্রগবেষক ও লেখক অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী যথার্থই বলেছেন, “রবীন্দ্রনাথ বাংলা গানের সর্বস্ব এবং সর্বনাশ ।”

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন বটে যে, তাঁর গানই বেঁচে থাকবে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কি বলেছিলেন যে, গানের মাধ্যমেই রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকবেন? শিল্প বেঁচে থাকলেই যে যিনি এই শিল্প তৈরী করেছেন তিনি বেঁচে থাকবেন তেমন কোনো কথা নেই। মহত চিত্রকর্ম ‘মোনালিসা’ কে না চেনেন? কিন্তু লিওনার্দো দা ভিঞ্চি কে সবাই কি চেনেন? অথচ ‘মোনালিসা’ দা ভিঞ্চির অলস দিনের শখের চিত্রকর্ম। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আসল পরিচয় তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ বিজ্ঞানী এবং স্থপতি। ষোড়শ শতকের প্রথম দিকেই তিনি উড়োজাহাজের যে নকশা তৈরী করেছিলেন সেখান থেকেই আধুনিক উড়োজাহাজ তৈরী। তাই বলছিলাম, প্রতিভাবান মানুষের কোন্ সৃষ্টিকর্ম কিভাবে উত্তর-প্রজন্মের কাছে পৌঁছুবে তা এক বিস্ময়ই বটে।
তবে হ্যাঁ , রবীন্দ্রনাথ হয়ত বাঙালিকে চিনেছিলেন আর সবার চেয়ে বেশি। বাঙালির মনোজগতের, বাঙালির রুচি-বোধের পরিচয় তিনি অধিকাংশ বাঙালির সাথে মেলা-মেশা না করেই বুঝেছিলেন। বুঝেছিলেন নিজের তীব্র-তীক্ষ্ণ দূরদৃষ্টি এবং পর্যবেক্ষণ শক্তি দিয়ে। পদ্মার বোটে বা বজরার জানালা দিয়ে তিনি পূর্ববংগকে পর্যবেক্ষণ করতেন। একাকী পদ্মার পাড়ে সান্ধ্য-অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে গ্রাম বাংলাকে চিনতেন। তাই রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন যে, একদিন বাঙালি তাঁর অসংখ্য মহত এবং জীবনের জন্য অতি প্রয়োজনীয় রচনাকে উপেক্ষা করে স্বল্প প্রয়োজনীয় চিত্তের আনন্দ বাড়ানো গানকেই বাঁচিয়ে রাখবেন। আমি এখানে গানের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করছি না। বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন আলো এবং জলেরও। রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য রচনার সাথে গানের সম্পর্কটিও তেমনি।

রবীন্দ্রনাথ কি নিজেকে উন্মুক্ত করেছিলেন তাঁর গানের মাধ্যমেই শুধু? এ প্রশ্নটি খুব জটিল। বিশিষ্ট অধ্যাপক, গবেষক ও রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ আবু সয়ীদ আইয়ুব রবীন্দ্রনাথকে খুব কাছে থেকে দেখেছিলেন। তিনি তাঁর এক লেখায় বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ যখন লিখতেন তখন মনে হতো “এক নগ্ন রবীন্দ্রনাথ”। এখানে ‘নগ্ন’ শব্দটি খুব প্রতীকী অর্থে আবু সয়ীদ আইয়ুব ব্যবহার করে বুঝিয়েছেন, লেখায় মগ্ন রবীন্দ্রনাথ যেন এক ধ্যানমগ্ন এবং একাকী রবীন্দ্রনাথ- ঠিক সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুর মতো। পৃথিবীতে তিনি তখন একা এবং সব কিছুর উর্ধ্বে, সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন।

যদিও রবীন্দ্রনাথ গান রচনার মুহূর্তকে অন্যান্য রচনাকালের চেয়ে একটু আলাদা করে দেখেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন, “গান লিখতে যেমন আমার নিবিড় আনন্দ হয়, এমন আর কিছুতে হয় না”। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর অন্যান্য সাহিত্যকর্ম রচনার সময়েও একই নিবিষ্ট আনন্দ নিয়েই লিখিতেন। তা না হ’লে সমগ্র রবীন্দ্র রচনাবলীতে অতিরঞ্জিত এবং অপ্রয়োজনীয়- এমন কি অতিব্যবহ্নত শব্দ তেমন খুঁজে পাওয়া যাবে না, যা তাঁর রচনাকে ক্লিশে বা গতানুগতিক করে তুলেছে। গান এবং কবিতার ক্ষেত্রে তো নয়ই, যেখানে রচয?িতাকে ছন্দ, মাত্রা, তাল ও লয়ের বাতাবরণে আবদ্ধ থাকতেই হয়।

তাই এ প্রশ্ন যথার্থই যে, গান রচনার সময় সুর, তাল ও লয়ের মতো এতো সব সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও রবীন্দ্রনাথ কিভাবে নিজের ভাব ও ভাবনাকে উন্মুক্ত করেছেন?
(ভজন সরকার : কবি,কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন,কানাডা)

Exit mobile version