বিনোদন ডেস্ক : জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা গান ‘কারার ওই লৌহ-কপাট’ বিকৃত করার অভিযোগ উঠেছে ভারতের জনপ্রিয় সুরকার এ আর রহমানের বিরুদ্ধে। সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত বলিউড নির্মাতা রাজা কৃষ্ণা মেনন তার ‘পিপ্পা’সিনেমায় গানটি ব্যবহার করেছেন। আর সেখানে গানটি নতুন ভাবে আয়োজন করেছেন এ আর রহমান। এই গানটিতে আরও কন্ঠ দিয়েছেন তীর্থ ভট্টাচার্য, রাহুল দত্ত, পীযুষ দাস, শালিনী মুখোপাধ্যায় সহ একাধিক বাঙালি গায়ক।
তবে গানটি শুনে খুশি হতে পারেননি দুই বাংলার শ্রোতা, ভক্ত কেউই। গানটি প্রত্যাহার করার প্রতিবাদ আর সুর বিকৃত করার অভিযোগ নিয়ে চলছে নানা বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের মতামত ও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সংগীতশিল্পীরা।
সংগীতশিল্পী ফাহমিদা নবী লিখেছেন, ‘দুই বাংলার প্রাণের আমাদের দেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমর এবং অবিস্মরণীয় এক সৃষ্টি এবং সেই ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনসহ, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, অধিকার আদায়ের সকল আন্দোলনে জাতিকে অসাধারণ অনুপ্রেরণা দেয়া কালজয়ী অমর সেই ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’গানটি কে নুতন করে সুর দিয়ে বিকৃত করেছে সঙ্গীত পরিচালক এ আর রহমান।
‘পিপ্পা’নামের ছবিটায়। আমি অবাক এবং বিস্মিত হয়েছি । সরকারী ভাবে গানটি বন্ধের জন্য অনুরোধ করছি। অবিলম্বে এ গানটি ‘পিপ্পা’চলচ্চিত্র থেকে অপসারণ করে নিষিদ্ধ করা হোক।
তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমরা খুবই লজ্জিত বোধ করছি। এ আর রহমান নিজেই গুণি সুরকার। নিজের সুরে অন্য কথায় ছবির প্রয়োজনের গান করতেই পারতেন। সঠিক সুরে গানটি ব্যবহার করতে পারতেন। আমাদের জাতীয় কবির প্রতি এই অসম্মানের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আজ কাল কোন কিছু লিখতে যদিও ভালো লাগেনা তবু এ অসম্মান নেয়া যাচ্ছেনা বলে প্রতিবাদ জানালাম। আশা করি সবাই প্রতিবাদ করবে।’
এদিকে, গতকাল শুক্রবার রাতে আনুষ্ঠানিক ভিডিও বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানালেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট-এর ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ নজরুল সংগীত সংস্থার সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আনাম শাকিল। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানান, এটি করে এ আর রাহমানের দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। শাকিল বলেন, ‘এটি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত একটি গান। যে গানটি ব্রিটিশ স্বদেশী আন্দোলনের সময় রচিত হয়েছিল। সেই সময় এটি বিপুলভাবে জনমনে নাড়া দিয়েছিলো। তাই নয়, আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সময়ও এই উদ্দীপনামূলক গানটি মুক্তিযোদ্ধাদের মনে সাহস যুগিয়েছিলও ও উদ্বুদ্ধ করেছিল। এমন একটি গান নিয়ে সাম্প্রতিককালে লক্ষ্য করেছি ভারতবর্ষের একজন বিখ্যাত সুরকার খুবই দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি এই গানকে নতুনভাবে সুরারোপ করেছেন। এই কাজটি করে তিনি কাজী নজরুল ইসলামকে অসম্মান করেছেন। এবং তিনি প্রতিটি বাঙালির মনে আঘাত করেছেন। এই কাজটার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’
এই শিল্পী আরও বলেন, ‘আমরা আশা করবো দেশের ও পশ্চিমবঙ্গের সকল শিল্পী এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবেন। এই গানটি যেন কোথাও কোনোভাবে প্রচারিত না হয়, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’
ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট নজরুল সংগীতশিল্পী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক শাহীন সামাদ। তিনি জানান, এটা জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের লেখা বিখ্যাত গান। যা আমাদের বাঙালী জতির আবেগ। এ আর রহমানের মত একজন বিশ্বমানের শিল্পী এই গানের সুর বিকৃতি করলো কি করে! এটা তিনি করতে পারেন না। আমরা নিজেরা তো এর প্রতিবাদ জানাচ্ছি, পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়ভাবে এর প্রতিবাদ জানানো হবে। আমি মনে করি সমস্ত নজরুল সংগীতশিল্পীদের একত্র হয়ে এর প্রতিবাদ জানানো জরুরি।
গানটি নিয়ে এই প্রতিবাদ শুধু যে বাংলাদেশে হচ্ছে, তা নয়। পশ্চিমবঙ্গে শিল্পীরাও এ নিয়ে কথা বলছেন। ভারতের অন্যতম সংগীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র গণমাধ্যম আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, ‘আমার যেন মনে হচ্ছে একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি! মনে হলো স্বপ্ন ভেঙে উঠে দেখব আসলে এ রকম কিছু ঘটেনি।’ সঙ্গে দেবজ্যোতি দু’টি গুরুত্বপূর্ণ দিকে আলোকপাত করলেন। বললেন, ‘এই গানটি তো কবিতা আকারেও রয়েছে। তা হলে কি আমার বন্ধু রাহমানকে শুধু কবিতাটি দেওয়া হয়েছিল? তার পরেও কিন্তু এটা অত্যন্ত নিম্নমানের কাজ।’ তাই এই সুর রাহমান নিজে করেছেন কি না সেই প্রশ্নও দেবজ্যোতির মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। তার ভাষায়, ‘আদালতে কি রাহমান সেটা স্বীকার করবেন যে, এটা তার করা সংগীত? যদি তাকে গানটি নতুন ভাবে সুর করতে দেওয়া হয়, তা হলেও বলতে পারি আমার বন্ধুটি প্রকৃতিস্থ নন।’
একই দেশের জাতীয় পুরস্কারজয়ী সংগীত পরিচালক প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়ও রাহমানের এই ‘কাণ্ড’কে মেনে নিতে পারছেন না। তবে সমালোচনা করার আগে তিনি বাংলায় আলোকপাত করতে চাইলেন। বললেন, ‘কপিরাইট নেই বলে বিগত কয়েক বছরে রবীন্দ্রসংগীতে শিল্পীরা তো যথেষ্ট স্বাধীনতা নিচ্ছেন! এর মধ্যে বহু প্রতিষ্ঠিত শিল্পীও রয়েছেন। প্রশ্নটা কোনও শিল্পীর সঙ্গে প্রতিযোগিতার নয়, সার্থকতা সেখানেই, যদি আমি নিজের আবেগ এবং নিষ্ঠা দিয়ে মূল সৃষ্টিকে ফুটিয়ে তুলতে পারি।’