Home কলাম গল্পের তুমি ও আশরাফ আল এলাহি

গল্পের তুমি ও আশরাফ আল এলাহি

ভজন সরকার : (১)
যে সময়ে দেশের বাইরে পা রেখেছি, তার কিছু দিন পরেই সমস্ত পৃথিবীটা বদলাতে শুরু করেছে। অথচ দেখো তুমি -আমি-আমরা কত না স্বপ্ন দেখেছি এই পৃথিবীটা বদলাতে! একেবারে শেকড় থেকে উপড়ে ফেলে দেবো সীমাবদ্ধতার সমস্ত শৃংখল, এমন সব স্বপ্নই তো দেখতাম আমরা। ঘন্টার পর ঘন্টা, প্রহরের পর প্রহর, রাতের পর রাত; কী উন্মাতাল সে দিনগুলো আমাদের! অথচ ভাংগনের যাত্রাটুকু যখন দেখলাম, তখন খানিকটা আশাহতও হয়েছিলাম সেই প্রথম ধাক্কায়। সমস্ত সম্ভাবনা নিয়েও সাম্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর পিলার যখন পড়তে শুরু করলো, হাল তখনও ছাড়িনি আমরা। এখনও ছাড়ছি না যেমন।

অথচ আরেকটা ধাক্কা দেখলাম একেবারে সাম্রাজ্যবাদের পিঠে কোলে বসে। মেলাতে পারি না একেক সময়। বুদ্ধির সীমাবদ্ধতায় আটকে যায় শেখা যুক্তিগুলো। সুচারু দাবাড়ুর মতো সু² চালের কৌশলের কাছে পরাজিত হই, আহত হই। মাঝে মাঝে আশাহত যে হই না- সে কথাটাই বা কিভাবে অস্বীকার করি তোমার কাছে? আশাহত বেদনার সে কথাটুকুই না হয় আজকে তোমাকে বলি।

আবাল্য জেনে আসা, শুনে আসা শত্রুর দেশে পা রাখলাম এক আগষ্ট মাসে। কানাডার এপারের নায়েগ্রা ফলসের পাশ দিয়ে পরিবহন বাস গ্রেহাউন্ড চলে গেল আমেরিকা-কানাডার সীমান্ত শান্তি সেতুর দিকে। এক অভাবনীয় অনুভূতি সেদিন আমার ইন্দ্রিয়কে নাড়া দিয়ে যাচ্ছিল। নিজেকে নানা প্রশ্ন করেও আমি উত্তর দিতে পারিনি সেদিন। কিসের এই উত্তেজনা আমার মধ্যে ভর করেছিল? সে কি সাম্রাজ্যবাদের কোলে নিজেকে বসিয়ে দেবার লজ্জা-ক্ষোভ-গ্লানি? না কি, অজেয় শত্রুর অসীম পরাক্রমের কাছে মাথা নত করবার বেদনা?

এসব কিছু ভাবতে ভাবতেই বাস থেকে নেমে অগ্রসর হলাম আমেরিকার ইমিগ্রশেন অফিসের দিকে। হাতে তখনো সযত্নে ধরা বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্ট। সারাক্ষণ ধরে থাকা এ গর্ব-গৌরবটুকুও সেদিন যেনো আমাকে বিদ্রুপ করছিলো অজান্তেই। বারবার মনে হচ্ছিলো, এত ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া এই সবুজ অহংকারটুকুকে আমরা শিক্ষিত মানুষেরা কতই না অবমাননা করে চলেছি প্রবাসে প্রতিদিন। বিভিন্ন সীমান্ত প্রবেশ পথে নানা তাচ্ছিলে- অবহেলায় বাংলাদেশের এই স্মারকখানি কতভাবে অপমানিত হচ্ছে। আমাদের কিছু কিছু মানুষের অসৎ ক্রিয়াকলাপের জন্য আজ অনেক দেশের প্রবেশ পথেই আমাদের অহঙ্কার এই সবুজ পাসপোর্ট যেনো সবুজ আতঙ্ক।

সামনে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ভিড়ে সে আশঙ্কাটুকু বুকে নিয়েই আমার গর্বটুকু তুলে দিলাম আমেরিকান ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে। আজন্ম লালন করে আসা ঘৃনা ক্ষোভ আর যৌবনের সেই লড়াকু শ্লোগানকে এক নিমিষেই মুছে ফেলে আমি আজ সেই সাম্রাজ্যবাদের সূতিকাগার আমেরিকাতেই প্রবেশের অনুমতি চাচ্ছি। মুষ্টি ভিক্ষের মত লাল ইমিগ্রেশন অফিসারের দয়াদাক্ষিণ্যের প্রত্যাশায় দাঁড়িয়ে থাকা আমি অতীতকে ভুলে যেতে চাচ্ছিলাম সেদিন। পেরেছিলাম কি সে আত্মগøানি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে?

মনে পড়ছিল ভারতে বামপন্থী নেতা সোমনাথ চট্রোপাধ্যায় একবার অষ্ট্রেলিয়া সফর বাতিল করেছিলেন। তিনি তখন ভারতের লোকসভার স্পিকার। তাঁর প্রোটকল অফিসারের কাছে শুনলেন, অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় তাঁকে বাধ্যতামূলক পায়ের জুতো জোড়া খুলতে হবে বিমান বন্দরের নিরাপত্তার জন্য। তিনি জানতে চাইলেন, ভারতেও কি অস্ট্রেলিয়ার স্পিকারকে বিমান বন্দরে জুতো খুলতে হয়? তাঁর প্রটোকল অফিসার বললেন, অষ্ট্রেলিয়ার স্পিকারকে ভারতে ভি আই পি মর্যাদার জন্য এটা করতে হবে না। সোমনাথ চট্রোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন, ভারতের লোক সভার স্পিকারের মান সম্মান রক্ষার জন্যেই তিনি অষ্ট্রেলিয়া সফর বাতিল করলেন।

অথচ আমাদের নেতারা নিজের মান সম্মান বাঁচানোর জন্যে দেশকে হেয় করে হলেও বিদেশে আশ্রয় নিতেও কার্পন্য করেন না। তোমাকে বলতে এতটুকু দ্বিধা নেই,আজকাল যেনো বাংলাদেশের চোর-ডাকাত-দূর্নীতিবাজ আর রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দ্বিতীয় বাসস্থান হয়ে উঠছে প্রবাসের অসংখ্য দেশ। সুবিধে মত সময়ের অপেক্ষায় আপাত আশ্রয়ের জন্য দেশকে হেয় করার এমন কোন পন্থা আজ আর বাকী নেই যা প্রয়োগ করা হয় না।

ক্ষমতার পালাবদলে একদিন এরাই আবার দেশে গিয়ে লুট-তরাজ করে। পাঠিয়ে দেয় আরেক গ্রুপকে। একবার তুমিই ভাব, সরকারি পৃষ্টপোষকতায় দুনীর্তির দায়ে জেলে আটক কোন নেতাকে বিদেশে পাঠায় কোন সভ্য দেশ? নিজের দেশের কাছে যে অপরাধী,অন্যদেশে তাকে ঠেলে ধাক্কে পাঠিয়ে দেয়া কি কোন সভ্যতার নিদর্শন?

বাংলাদেশের কোনো তুচ্ছ ঘটনায়ও আমেরিকা- ব্রিটেন- অষ্ট্রেলিয়ায় মিছিল হয়। মিছিল না হলেও নিজেদের ভাড়া করা ক্যামেরায় ছবি তোলা হয়, প্রকাশ করা হয়। কী তার উদ্দেশ্য? নিজের পঙ্কিলতাকে নিজেরা ধুঁয়ে মুছে ছাপছুতর করার সাহস নেই। অক্ষমতা অথবা অপকর্মের জন্যে বিদেশে পাড়ি দিয়েই এরা থেমে থাকে না, সেটাকে নির্লজ্জের মত বাইরে প্রকাশ করার ধৃষ্টতাও দেখায়। দেশের প্রতি, স্বাধীনতার প্রতি এদের দায় কতটুকু?

নিজের আর দেশের প্রতি আত্ম-মর্যাদার কতটুকু অবশেষ থাকলে এ রকম হতে পারে। তাই তো স্বাধীনতার এতগুলো বছর চলে গেছে, নাই নাই করেও অর্জনও হয়েছে অনেক কিছুই। অথচ বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করার মত অহংকারটুকু ঢাকা পড়ে গেছে এ সবের জন্যেই।

সেদিন আমেরিকা প্রবেশের সময় মনে পড়ছিলো কোনো এক সন্ধ্যা-সান্নিধ্যে আমরা বসেছিলাম তোমার কলেজ হোষ্টেলের পাশের শহীদ মিনার চত্বরে। মার্ক্সবাদের পোকা তখন কিলবিল করে সারাক্ষণ।

সহসা আমি বললাম, ‘জানো, পৃথিবীতে দু’ শ্রেণীর মানুষ আছে।’
‘সেটা আর না জানার কি আছে?’

আমাকে অবাক করে দিয়ে তুমি বললে, ‘ডাক্তার আর রোগী। এই দু’ধরনের মানুষই তো আমি দেখি সকাল থেকে সন্ধ্যে। বিশ্বাস না হয় এখনি কোনো রোগের কথা বল,দেখবে চারপাশে কত ডাক্তার, কত উপদেশ, কত ওষুধের প্রেসক্রিপশন। আর যদি বল যে তুমি একজন ডাক্তার, দেখো কত রোগী, কত রোগ তোমার চারপাশে। তাই তো বললাম, পৃথিবীতে মানুষ দুই শ্রেণীর, ডাক্তার আর রোগী।’

সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ানোর সমস্ত ধকল তোমার এমন হালকা চালের কথাতে কর্পূরের মত উবে যায় অন্যদিনগুলোর মতোই।

আমি বললাম, ‘আর একটু পরেই তোমাকে আমার একটা সমস্যার কথা বলতাম রোগী সেজে। কিন্তু এখন আর বলবো না। তবে যেটা বলবো তা হলো আমেরিকা যাবার চেষ্টাটা বাদ দিয়ে দিলাম। আজকে আমার টোফেল পরীক্ষা ছিল, পরীক্ষা হলে আর গেলাম না।’

‘ঠিকই করেছো শোষকের দেশে না যেয়ে। বরং শোষিত হয়েই না হয় থাকি আমরা। হে মহানিঃস্ব কমরেড, দারিদ্র্য রেখার অনেকখানি নীচে আজকে আমার অবস্থান, তোমার চেয়েও বিঘতখানিক নীচে। সোজা হাসপাতাল থেকে চলে এসেছি, পকেটে টাকাকড়ি কিছুই নেই। টিএসসির ডাসে যাবো সে রিক্সা ভাড়াটা পর্যন্ত নেই। হেঁটে যাবো, শরীরে ক্যালোরির ভান্ডারেও মহাআকাল। পকেটে টাকাকড়ি কিছু আছে?’

রাস্তায় নেমে এ্যানেক্স ভবনের সামনে থেকে রিক্সা নিয়ে তোমার হাতখানি সজোরে ধরে ফেলি আমি। জানুয়ারী মাসের শীতে তোমার উষ্ণতায় ভাগ নিতে চেষ্টা করি কখনও। এ ভাবেই কেটে যায় আমাদের ঘোর লাগা সাহসী সময়। কখনও নিমগ্ন থাকি অন্য সকল চিন্তার ভেতর।

সেদিনও আমেরিকান ইমিগ্রেশন অফিসে এই সব পাঁচমিশেলী চিন্তায় আটকে যাচ্ছিল বর্তমানের অবস্থানটুকু। হঠাৎ চমকে উঠি ইমিগ্রেশন অফিসারের প্রশ্নে, ‘আমেরিকাতে কোথায় যাবে?’
বললাম,‘ নিউইয়র্ক সিটিতে?’

‘কতদিন থাকবে? বিশেষ কোন পরিকল্পনা? না, শুধুই ভ্রমন।’
‘এই কিছু জায়গা দেখবো , যেমন স্ট্যাচু অব লিবার্টি, টুইন টাওয়ার, ম্যানহাটেন এই সব। সপ্তাহ দুইয়ের বেশী লাগবে না।’

হাসিমুখে পাসপোর্টটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘গুড লাক, শুভ হোক তোমার আমেরিকা ভ্রমন।’ (অসমাপ্ত)
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)

Exit mobile version