সাজ্জাদ আলী : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাষ্টিন ট্রুডোর বাবা পিয়ের ইলিয়ট ট্রুডো দুই মেয়াদে প্রায় ১৫ বছর কানাডার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন (১৯৬৮-১৯৭৯ এবং ১৯৮০-১৯৮৪)। দেশের জন্য তার অবদান কানাডিয়ানরা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে। দেশ জুড়ে তার নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন স্থাপনা, এমনকি এয়ারপোর্টও রয়েছে। তবে সে সব নামকরণের একটিও তার ছেলে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাষ্টিন ট্রুডোর উদ্যোগে বা শাসনামলে হয়নি। জাষ্টিনকে আমরা কখনোই এমনটা বলতেও শুনিনি যে, “আমি অমুকের ছেলে”।
ক্ষমতায় বসে “বাবার কীর্তি” প্রচারের মধ্যে যে এক ধরণের “কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেষ্ট এবং রুচিহীনতা” আছে; তা বোঝার শিক্ষাটুকু জাস্টিনের আছে। সব থেকে বড় সত্যটি হলো, পিয়ের ট্রুডো’র ছেলে বলে জাষ্টিন ট্রুডো প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছেন, এমন অপবাদ তার চরম রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাও মুখে আনতে পারবে না। যথাযথ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিজের যোগ্যতা শতভাগ প্রমাণ করে তবেই তাকে প্রধানমন্ত্রী হতে হয়েছে। কানাডিয়ানদের এটাই শান্তনা যে তাদের দেশের সরকার প্রধানদের নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করেই বড় চেয়ারখানায় বসতে হয়।
রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত যোগ্যতা এবং প্রজ্ঞার খতিয়ান যখন ফাঁকা কলসির মতো টুংটাং শব্দে বাজে, তখনই তাদের উত্তরাধিকারের জমাখাতা নিয়ে টানাহেচড়া করতে দেখা যায়। একটু পেছন ফিরে তাকালেই আমরা দেখতে পাবো পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু, ভারতপিতা মোহন চাঁদ গান্ধি, বঙ্গপিতা শেখ মুজিবুর রহমান- এরা কেউই উত্তরাধিকারের পরিচয়ে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত নন। স্বীয় যোগ্যতায় জনতার মননে তাঁরা স্মরণে আছেন, সহস্রবর্ষ টিকেও থাকবেন।
গণতন্ত্র মোটেই কপচাবার বুলি নয়, এটি চর্চার বিষয়। আর সে কাজটির শুরু ব্যক্তি পর্যায় থেকে। তারপরে তা চর্চিত হবে সমাজে, রাজনৈতিক দলে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায়। “ভিন্ন মতের প্রতি সহনশীলতা” গণতন্ত্রের প্রথম পাঠ। আর দ্বিতীয় পাঠ বোধকরি “গণরায়ের উপর ভরসা” রাখা। একটি রাজনৈতিক দলের পরিচালনা পর্ষদ এবং নেতা নির্বাচনে ওই দলটির কর্মী-সমর্থকদের প্রত্যক্ষ মতামত বা ভোট নেবার প্রয়োজন রয়েছে। কেউ যদি ভিন্ন কোনো উপায়ে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের নেতা নির্বাচিত হয়ে পড়েন, তবে দিনে দিনে তার স্বেচ্ছাচারি হয়ে উঠবার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। দলকানা ছাড়া সবাই এটা মানেন যে, “অমুকের ছেলে” বা “তমুকের বউ”-এমনতর যোগ্যতায় যারা দেশ শাসন করেছেন, তারা কেউই জনসাধারণের জন্য সুশাসনের বন্দোবস্ত করতে পারেননি।
তো এই সুশাসন নিয়ে না হয় আরেক দিন লিখবো, আজ বলছিলাম কানাডিয়ান রাজনৈতিক দলগুলোর আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চার কথা। সেই ১৮৬৭ সাল থেকে লিবারাল পার্টি ও কনজারভেটিভ পার্টি ঘুরেফিরে কানাডা শাসন করেছে। বিনে পয়সায় দল দুটোর সমর্থক হওয়া যায় বটে। তবে নিবন্ধিত সদস্য, অর্থাৎ যারা পার্টির সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভোট দিতে পারেন; তেমন কর্মী-সদস্য হতে হলে দলীয় ফাে বাৎসরিক ১৫/২০ ডলার চাঁদা দিয়ে নাম রেজিষ্ট্রি করতে হয়। এ দেশের ছোটখাট দলগুলোরও প্রাথমিক সদস্যপদ তালিকাভুক্তির ওই একই তরিকা।
সব দলেরই রেজিষ্টার্ড কর্মী-সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটে কমিটি নির্বাচিত হয়। দলীয় সম্মেলনের ডেলিগেটরা (ভোটাররা) কখনোই কমিটি গঠনের দায়ভার বড় নেতা বা নেত্রীর (!) উপর ছেড়ে দেন না। ভোটবিহীন মনোনয়ন পদ্ধতিতে দলের কমিটি গঠন কানাডিয়ান রাজনীতির অনুশীলন নয়। দেশটির প্রধানমন্ত্রী যে দলের হয়ে ভোটে জিতে ক্ষমতায় বসেন, তিনি কিন্তু প্রথাগতভাবে সেই দলটির প্রেসিডেন্ট নন। যেমন, জাষ্টিন ট্রুডো লিবারাল পার্টি গঠিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী বটে। তিনি কিন্তু দলটির সভাপতি নন, সুজানি কোয়ান নামক একজন মহিলা রাজনীতিবিদ লিবারাল দলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট। “সব ক্ষমতা একই ব্যক্তির হাতে”- এমন ভয়ঙ্কর ব্যবস্থা কানাডিয়ানরা চিন্তাও করতে পারে না।
দেশটির ফেডারেল ইলেকশনকে সামনে রেখে (সাধারণ নির্বাচন) দলগুলো দলীয় কনভেনশন ডাকে। সেখানে রেজিষ্টার্ড ভোটারদের সরাসরি ভোটে “দলীয় লিডার” নির্বাচিত হয়। এই “লিডার” কিন্তু প্রথাগতভাবে দলের সভাপতি বা সম্পাদক কেউ না। আসন্ন ইলেকশনে দলকে ভোটে জিতিয়ে আনার “লিডার” তিনি। দল জয়ী হলে তিনিই হবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। বস্তুত লিডার কে হবে সেটা ঠিক করা দলগুলোর কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়। আর সে ক্ষেত্রে বিবেচ্য হলো কোন প্রার্থী কতটা যোগ্যতর নেতৃত্বদানে সক্ষম, রাজনৈতিকভাবে প্রজ্ঞাবান, চরিত্রগতভাবে স্বচ্ছ ইত্যাদি। এসব গুণ বিবেচনায় দলের কর্মী-ভোটাররা ভোটের বাক্স বেছে নেন। সংগত কারণেই দলগুলোর এই “লিডারশীপ” নির্বাচন নিয়ে কানাডিয়ানদের বিপুল আগ্রহ আছে। কোন বড় দলের কে প্রেসিডেন্ট, এদেশের আমজনতার তা নিয়ে ভ্রæক্ষেপ নেই। কিন্তু দলগুলোর লিডারদের সম্পর্কে দেশবাসীর আগ্রহ আছে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল কনজারভেটিভ পার্টির “লিডারশীপ” নির্বাচনের কনভেনশন। এই দলটির নিবন্ধিত সদস্য হতে হলে বাৎসরিক ১৫ ডলার চাঁদা দিয়ে নাম রেজিষ্ট্রি করতে হয়। আগেই বলেছি এই রেজিষ্টার্ড সদস্যদের প্রত্যেকের দলীয় ফোরামে ভোটাধিকার আছে। অর্থাৎ দলের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো বা কমিটি গঠন ইত্যাদি এই ভোটারদের ভোটেই চূড়ান্ত হয়। এ বছর পার্টির “লিডার” নির্বাচিত হবার জন্য চারজন ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। তারা প্রত্যেকেই সুশিক্ষিত, নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এবং দীর্ঘদিন রাজনীতি করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন।
করোনা পেনডামিকের কারণে ভোটাররা এবারে ডাকযোগে “লিডারশীপ” নির্বাচনের জন্য ভোট দিয়েছেন। ব্যালট গ্রহণের ডেড-লাইন ছিলো ২১ আগষ্ট, ২০২০। এ বছর সারা দেশে দলটির হালনাগাদ রেজিষ্টার্ড ভোটার সংখ্যা ছিলো ২৮০,০০০। তিন ধাপের নির্বাচনে মোট ১৭৫,০০০ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। ব্যালট গণনা শেষে কাস্টিং ভোটের ৫৭% ভোট পেয়ে “লিডার” নির্বাচিত হয়েছেন এরিন ও’টোল। তার নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী পিটার ম্যাকি পেয়েছিলেন ৪৩% ভোট। এই “লিডার” নির্বাচিত হওয়ার প্রক্রিয়া অসম্ভব রকমের প্রতিদ্ব›দ্বীতাপূর্ণ।
দলীয় কাঠামোর মধ্যে ডেলিগেটরা এই লিডার পদপ্রার্থীদের শিক্ষা, দীক্ষা, কর্ম-উদ্যম, সততা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ইত্যাদি বিষয়ের পুন্খানুপুংখ যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে ভোট দেয়। প্রার্থীদের জন্য সে এক মস্ত চ্যালেঞ্জ। “আমার বাবা অমুক”, “মা তমুক”, “স্বামী এটা ওটা ছিলেন” এমন সব কথা যদি কোনো প্রার্থী আকারে ইঙ্গিতেও বলেন, তবে সে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল ঠুকলো। কানাডা’র আগামী সাধারণ নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা নতুন লিডার এরিন ও’টোলের প্রধান কাজ। দল ভোটে জিতলে এরিনই হবেন প্রধানমন্ত্রী।
কানাডা’র ছোট-বড় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের আভ্যান্তরীণ গণতন্ত্র চর্চার চিত্র এই একই রকম। স্বচ্ছতা, সততা, জবাবদিহিতাই দেশটির রাজনৈতিক সংস্কৃতির সৌন্দর্য। পৃথিবীর যে কোনো দেশ বা রাজনৈতিক দলই এদের মডেল গ্রহণ করে গণতন্ত্রকে সাজাতে পারেন।
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)