সাইফুল আলম চৌধুরী : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একেবারে প্রারম্ভিক সময়ে যে সমর নায়ক শত্রæর বিরুদ্ধে হাতিয়ার উদ্যত করেছিলেন, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, ছাত্র, গণমানুষকে সংগঠিত করে প্রতিরোধ-যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন, একাত্তরের ১ এপ্রিল সমগ্র কুষ্টিয়াকে শত্রæমুক্ত রাখেন, অগ্রবর্তী যুদ্ধক্ষেত্র হতে মুক্তিযোদ্ধা ও সেনা সদস্যদের নিয়ে ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথ তলার আমবাগানে পৌঁছান, নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে আনুষ্ঠানিকভাবে গার্ড অব অনার এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকে সালাম প্রদান করেন, সেই সময়ের সাহসী যোদ্ধাকে অন্যায়ভাবে আর গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ৮ নম্বর সে ক্টর কমান্ড থেকে বদলি করে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদর দপ্তরে বেকার বসিয়ে রাখা হয় ১৮ আগস্ট থেকে। এমনকি তাকে স্বাধীনতার উত্তর সময়ে প্রত্যেক সেক্টর কমান্ডারদেরকে দেয়া ‘বীর উত্তম’ থেকে বঞ্চিত করা হয়।
একাত্তরের ২৪ মার্চ থেকে এই সমর নায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরী সরকারি কার্য উপলক্ষে কুষ্টিয়ার সার্কিট হাউসে অবস্থান করছিলেন, যিনি ১৯৩৫ সালের ১ জানুয়ারি বর্তমান চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার মদনেরগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নিজ গ্রামের স্কুল থেকে ১৯৫১ সালে তিনি মেট্রিক পাশ করে প্রথমে ঢাকা কলেজে অধ্যয়ন করলেও চাঁদপুর কলেজ হতে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন সক্রিয় সংগঠক ও কর্মী। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া আবু ওসমান চৌধুরী স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থেকে কমিশন লাভ করে তিনি বিভিন্ন সেনানিবাসে পৃথক পৃথক ইউনিটে নিয়োজিত থাকনে। ১৯৬৮ সালে ‘মেজর’ পদে উন্নীত হয়ে একাত্তরের ২৫ ফেব্রæয়ারি তত্কালীন কুষ্টিয়ার অন্তর্গত চুয়াডাঙ্গায় অবস্থানরত ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের ৪ নম্বর উইংয়ের অধিনায়কত্ব লাভ করেন।
একাত্তরের ২৬ মার্চ প্রত্যুষে শত্রু সেনাদের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ এবং গতিবিধি লক্ষ্য করে অনুভব করেন ভয়াবহ কিছু সংঘটিত হবার। সেই কারণে কালবিলম্ব না করে তিনি ঝিনাইদহ হয়ে চুয়াডাঙ্গার পথে অগ্রসর হন। সেখানে পূর্বেই বাঙালি মুক্তিসেনারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন পতাকা উত্তোরন করে, মেজর চৌধুরী তাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে তড়িত্গতিতে প্রতিরোধ যুদ্ধেই কর্মসূচি নেন:
ক. ইপিআর উইং হেড কোয়ার্টার আর অধীনস্ত সকল সীমান্ত চৌকি (বিওপি) সমূহে অবাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করণ।
খ. কুষ্টিয়া জেলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মোতায়েন, শক্তি-সামর্থ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যাবলী সংগ্রহ করা।
গ. কুষ্টিয়ায় শত্রুপক্ষের আক্রমণ পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন।
মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর উইংয়ের অধীনে ছিলা পাঁচটি কোম্পানী, একটি সাপোর্ট প্লাটুন এবং একটি সিগন্যাল প্লাটুন। তার দুইজন সহকারী ছিলেন- বাঙালি ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরী, অন্যজন অবাঙালি ক্যাপ্টেন সাদেক হোসেন।
কোম্পানী ও প্লাটুনসমূহের অবস্থান ছিলো :
ক. প্রাগপুর – ‘এ’ কোম্পানী, অধিনায়ক বাঙালি সুবেদার মোজাফর আহমদ
খ. ধোপাখালী – ‘বি’ কোম্পানী, অধিনায়ক বাঙালি সুবেদার খায়রুল বাশার খান
গ. বৈদ্যনাথ তলা (মুজিবনগর – ‘সি’ কোম্পানী, অধিনায়ক সুবেদার মকিদ
ঘ. যাদবপুর – ‘ডি’ কোম্পানী, অধিনায়ক সুবেদার আবদুল মজিদ মোল্লা
ঙ. চুয়াডাঙ্গা – ‘ই’ কোম্পানী, অধিনায়ক আবদুর রাজ্জাক সুবেদার
চ. সিগন্যাল প্লাটুন – অধিনায়ক হাবিলদার মোসলেম উদ্দিন
ছ. সাপোর্ট প্লাটুন – অধিনায়ক পি. কে. ইব্রাহিম
ইপিআর আধা সরকারি বাহিনী হলেও এই উইংয়ের প্রতিটি কোম্পানীতে হালকা ট্যাংক বিধ্বংসী কামান – ‘লিরেট’ ছিলো ৩টি, হালকা মেশিনগান ৭টি, মাঝারি মেশিনগান ১টি, ৩০৩ রাইফেল আর চায়নিজ রাইফেল। সাপোর্ট প্লাটুনের ছিলো ৬টি ৩ ইঞ্চি মর্টার। কুষ্টিয়া বিজয়ের পর বহু চায়নিজ গোলাবারুদ উদ্ধার হলে মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস সেইসব অস্ত্রাবলী ব্যবহার নিশ্চিত হয়েছিলো।
২৬ মার্চ একাত্তরে পদ্মা-মেঘনার পশ্চিম পাড়ে বিস্তীর্ণ এলাকাকে ‘দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন’ নামকরণ করে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী একচ্ছত্র অধিনায়কত্বের দায়িত্ব নেন। সেই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক গোলাম রসুল, প্রকৌশলী সফিউদ্দিন, অধ্যক্ষ ফুলে হোসেন, ছাত্রনেতা সিদ্দিক জামাল নান্টু (পরে চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব), রাজা মিয়া প্রমুখ।
সামরিক ও বেসামরিক সকল পর্যায়ের কার্যাবলী ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে তত্ক্ষণাত একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। সেই পরিষদে অন্তভর্‚ত ছিলেন এমসিএ ডা. আসহাবুল হক জোয়ার্দার, এমপিএ এ্যাডভোকেট ইউনুস আলী এবং ব্যারিস্টার বাদল রশীদ। ডা: জোয়ার্দার, ডা: করিম, ডা: কোরেশীর সমন্বয়ে গঠিত মেডিক্যাল টিম রণাঙ্গনে ওষুধ সরবরাহ এবং আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিত্সার দায়িত্ব নেন।
৩০ মার্চ – ১ এপ্রিলের সাঁড়াশি আক্রমণে শত্রুর ২৭ বেলুচ রেজিমেন্টকে পরাস্ত করে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী কুষ্টিয়া মুক্ত করেন।