অনলাইন ডেস্ক : দুই প্রকল্পের সমন্বয়হীনতায় ক্ষতির মুখে পড়েছে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগের নির্মাণ প্রকল্পের মাল ও বালিবাহী গাড়ির চলাচলে ইতোমধ্যে দেশের প্রথম ও ব্যয়বহুল এই এক্সপ্রেসওয়ের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নির্মাণাধীন রেলপথের ‘অ্যামবেঙ্কমেন্টে’র কারণে পানি নিস্কাশনের পথ রুদ্ধ হওয়ায় এক্সপ্রেসওয়ের বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তাই এক্সপ্রেসওয়েতে মাল ও বালিবাহী গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এতে কাজের গতি কমেছে সরকারের অগ্রাধিকারের পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে।

দুই প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসব তথ্য জানিয়েছেন। ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুকে রাজধানীর সঙ্গে যুক্ত করতে বাবুবাজার ও পোস্তগোলা সেতু থেকে মাওয়া হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। গত মার্চে যান চলাচলের জন্য সড়কটি খুলে দেওয়া হয়। এর পাশে চীনের ঋণে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে ঢাকা থেকে মাওয়া-ভাঙ্গা হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭৬ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে, যা দেশের ১০টি ‘ফার্স্টট্র্যাক’ প্রকল্পের একটি।

সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। চারলেনের এই মহাসড়কের দুই পাশে পাঁচ মিটার করে জায়গা ফাঁকা রেখে ধীরগতির যান চলাচলে নির্মাণ করা হয়েছে সার্ভিস লেন। মহাসড়কটির কোথাও সিগন্যালে পড়তে হয় না। সিগন্যাল এড়াতে নির্মাণ করা হয়েছে পাঁচটি আন্ডারপাস। পাশের ‘ফিডার রোড’ থেকে গাড়ি আসার সুযোগ নেই এক্সপ্রেসওয়েতে। পদ্মা সেতু চালু হলে মাত্র ৪০ মিনিটে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা যাওয়া যাবে এক্সপ্রেসওয়ে ধরে।

দ্রুতগতির যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য ঢাকা-মাওয়া-এক্সপ্রেসওয়ে যান চলাচল নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। এতে রিকশা, অটোরিকশাসহ ধীরগতির যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ। নির্ধারিত স্থান ছাড়া এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি প্রবেশের সুযোগ নেই।

পুরো ৫৫ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ের দুই পাশে রয়েছে নিরাপত্তা বেষ্টনী।

কয়েকটি অংশে বেষ্টনী খুলে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের মালামাল ও বালিবাহী ভারী গাড়ি চলাচল করত এক্সপ্রেসওয়েতে। গত ১১ জুন তা বন্ধ করে দেয় এক্সপ্রেসওয়ের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। পরে পাশের সার্ভিস লেন দিয়ে এসব গাড়ি চলতে শুরু করে। কিন্তু সার্ভিস লেন ভারী গাড়ি চলাচলের উপযোগী না হওয়ায় সড়কে ভাঙন দেখা দেয়। পরে সার্ভিস লেনেও মালমাল ও ভারী গাড়ির চলাচল বন্ধ করা দেওয়া হয়। রাস্তা নষ্ট হওয়ায় পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের কাছে ৫০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছে।

এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার মো. তৌহিদ হাসান বলেছেন, দুই প্রকল্পের মধ্যে সমন্বয়ে কমিটি মন্ত্রণালয়কে শিগগির প্রতিবেদন দেবে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে এ বিষয়ে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক গোলাম ফখরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

পদ্মা রেল সংযোগের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড (সিআরইসি) জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, প্রধান সড়ক দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। ফলে নির্মাণকাজের উপকরণ প্রকল্প এলাকায় নেওয়া যাচ্ছে না। সার্ভিস লেন দিয়ে নির্মাণ উপকরণ প্রকল্প এলাকায় পৌঁছানো সম্ভব হলে ওই সড়কে ভারী পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলে অনুমোদন নেই। এ কারণে প্রকল্পের কুচিয়ামোড়া থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার সেকশনের নির্মাণ কাজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ঢাকা বিভাগ) সবুজ উদ্দিন খান বলেছেন, এ অবস্থার জন্য পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নকারীরাই দায়ী। তাদের আগেই জানানো হয়েছিল, এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে রেলের ভারী মালামাল ও বালি পরিবহন করা যাবে না। বালিবাহী ট্রাক সড়কের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু প্রতিদিন হাজার হাজার বালিবাহী ট্রাক চলছে। এতে এক্সপ্রেসওয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সড়কের আয়ু ২০ ভাগ কমে যেতে পারে।

সিআরইসির দাবি, প্রকল্পের উপকরণ ও বালি পরিবহনে এক্সপ্রেসওয়ের যে ক্ষতি হবে, তা দিতে রাজি আছে। এক্সপ্রেসওয়ের ট্রাফিক ব্যবস্থ্যপনায় নিজস্ব জনবলও নিয়োগ দেবে। সবুজ উদ্দিন খান বলেছেন, এক্সপ্রেসওয়ের যে ‘লোড ডিজাইন’ করা হয়েছে, তাতে পদ্মা রেল সংযোগের মালামাল পরিবহন সম্ভব নয়। এক্সপ্রেসওয়েতে দিনে কত সংখ্যক ভারী গাড়ি চলবে তা নকশায় নির্ধারিত। তাই বালি ও ভারী মালামাল বহনে এক্সপ্রেসওয়ের যে ক্ষতি হবে, তা পরে মেরামত করে পূরণ করা সম্ভব নয়। তার দাবি, ‘লোড ডিজাইনে’ নির্ধারিত সংখ্যকের চেয়ে বেশি মালমাল ও গাড়ি চললে রাস্তার মূল কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

শুধু গাড়ি চলাচল নয়, নকশা নিয়েও সমস্যা চলছে দুই প্রকল্পের। কুচিয়া মোড়া থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের পাশের বিভিন্ন অংশ বিক্ষিপ্তভাবে রেলপথ নির্মাণের কাজ চলছে। এ জন্য সড়কের পাশের জমিতে বালি ফেলে ‘অ্যামবেঙ্কমেন্ট’ বা বাঁধ বানানো হয়েছে। এর ওপর বসানো হবে রেললাইন।

এক্সপ্রেসওয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেছেন, কিছু কিছু অংশে রেলের বাঁধ সড়কের চেয়ে ১০ থেকে ১২ ফুট উঁচু। ফলে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে পানি নিস্কাশণের কোনো পথ নেই। অথচ তিন বছর আগে ‘অ্যামবেঙ্কমেন্ট’ নির্মাণের আগেই রেল কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছিল পানি নিস্কাশনে সড়ক ও রেলপথের মাঝখানে ড্রেন নির্মাণ করতে। তা না করায় এক্সপ্রেসওয়েতে বিশ্বমানের ‘ক্রস ড্রেন’ থাকা সত্ত্বেও সড়ক ও রেলের অ্যামবেঙ্কমেন্টের মাঝে পানি জমছে। জলবদ্ধতায় এক্সপ্রেসওয়ের স্থায়ী ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

রেলের প্রধান প্রকৌশলী আবদুল জলিল বলেছেন, তাদের অ্যামবেঙ্কমেন্টের দুই পাশেই ড্রেন নির্মাণ করা হবে। তখন জলাবদ্ধতা থাকবে না। এসব সমস্যা সমাধানে সেনাবাহিনী, রেল, সওজ প্রতিনিধিদের কমিটি হয়েছে। কমিটি শিগগির প্রতিবেদন দেবে।

তবে সওজ কর্মকর্তারা বলছেন, রেলের কাজ শেষ হতে আরও কয়েক বছর লাগবে। ততদিন ড্রেন না হলে এক্সপ্রেসওয়ের বড় ক্ষতি হবে। প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই কেন এসব সমস্যার সমাধান হলো না? এ প্রশ্নে দুই সংস্থাই পরস্পরকে দায়ী করছে। সওজ বলছে, বৈঠক হয়েছিল। কিন্তু রেল সিদ্ধান্ত মানেনি। আর রেল বলছে, তাদের কিছুই বলা হয়নি।

দুই প্রকল্পের টক্করের মধ্যে রেলের ঠিকাদার চাইছে, আপাতত ব্যবস্থা হিসেবে তাদের সড়ক ব্যবহার করতে দেওয়া হোক। এক্সপ্রেসওয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, শুধু ঢাকা-মাওয়া পথে পদ্মা রেল সংযোগের কাজ যশোর থেকে টেকেরহাট পর্যন্তও চলছে। সেখানে সড়ক নেই। ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে রেললাইন বানানো হয়েছে। প্রকল্পের মালামাল, বালি পরিবহনে সেখানে অস্থায়ী রাস্তা বানিয়ে নিয়েছে রেলের ঠিকাদার। চাইলে ঢাকা-মাওয়া অংশেও বানাতে পারে। প্রয়োজনীয় জমিও রয়েছে।

তবে গত ৬ জুলাই দুই প্রকল্পের সমন্বয় সভায় রেলের প্রতিনিধি জানান, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা অংশে মালামাল পরিবহনে রাস্তা নির্মাণের জমি নেই। এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ ড্রোন দিয়ে ম্যাপিং করে দেখায়, বালি পরিবহনের জন্য রাস্তা নির্মাণ সম্ভব। ওই সভা থেকে এক্সপ্রেসওয়ে ও সার্ভিস লেন দিয়ে বালি পরিবহন বন্ধের সিদ্ধান্ত হয় বলে জানিয়েছেন সবুজ উদ্দিন খান। তার দাবি, রেলের ঠিকাদার সিদ্ধান্ত অমান্য করে বালি পরিবহন অব্যাহত রাখে। তাই পরদিন রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।