ফরিদ আহমেদ: প্রকৃতিতে টিকে থাকলে গেলে শক্তির প্রয়োজন হয়। তবে, এর পাশাপাশি আরও অনেক কৌশলও নিতে হয়। যে প্রাণী যতো বেশি কৌশল অবলম্বন করতে পারবে, সেই প্রাণীর টিকে থাকার সম্ভাবনা ততো বেশি থাকবে। ধরুন, পোলার বিয়ারের কথা। এর গায়ের রঙ সাদা। শুরুতে কিন্তু, গায়ের রঙ সাদা ছিলো না এই সব ভাল্লুকদের। এদের গায়ের রঙ ছিলো কালো বা বাদামি। সাদা বরফের মধ্যে খুবই দৃশ্যমান একটা রঙ। এই রকম দৃশ্যমান রঙ নিয়ে সীল মাছের ধারে কাছে যাওয়া সম্ভব নয়। এক মাইল দূর থেকেই সীল মাছের নজরে এসে যাবে। মিউটেশনের ফলে কোনো এক সময়ে হয়তো সাদা রঙের পোলার বিয়ারের জন্ম হয়েছে। বাদামিগুলোর চেয়ে এই সাদাটা টিকে থাকার সুবিধা বেশি পেয়েছে উত্তর মেরুতে। ফলে, সেখানে সাদা বর্ণের পোলার বিয়ারের বিস্ফোরণ ঘটেছে। বাদামিগুলো হারিয়ে গিয়েছে প্রকৃতির সাথে নিজেদের খাপ না খাওয়াতে পারার কারণে।
এই ধরনের স্ট্রাটেজিক সুবিধা প্রকৃতিগতভাবে হয়, কখনো কখনো প্রাণী নিজেও কৌশল উদ্ভাবন করে নেয় টিকে থাকার স্বার্থে। অস্ট্রেলিয়ান কাটল মাছের কথাই ধরুন। এগুলো বিশাল আকারের হয়, দেখতে অনেকটা স্কুইডের মতো। এরা আসলে স্কুইড এবং অক্টোপাসের কাজিন। এই মাছের গায়ের রঙ এবং আকার পরিবর্তন করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। প্রয়োজন দেখা দিলে মুহূর্তের মধ্যে এরা গায়ের রঙ এবং আকার পরিবর্তন করে ফেলে। পরিবর্তনের এই সুবিধা এদেরকে শিকারিদের হাত থেকে বাঁচতে সহায়তা করে।
শুধু শিকারিদের থেকে বাঁচার জন্যেই এই কৌশল ব্যবহার করা হয় না। কাটলফিশের আকৃতিতে ছোট দুর্বল পুরুষগুলো এই কৌশলকে ব্যবহার করে মেটিং এর ক্ষেত্রেও।

প্রজনন ঋতুতে অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ সমুদ্র উপক‚লের অগভীর পানিতে হাজার হাজার কাটলফিশ এসে ভিড় করে। এই প্রজনন সময়কালটা খুব সংক্ষিপ্ত। মাত্র ছয় সপ্তাহ হয় এর স্থায়িত্বকাল। হাজার হাজার কাটলফিশ এখানে এসে জড়ো হবার পরেও পুরুষদের জন্য বিশেষ করে ছোট আকৃতির পুরুষদের জন্য সঙ্গী খুঁজে পাওয়াটা খুবই দুরূহ একটা কাজ। এর মূল কারণ হচ্ছে কাটলফিশের নারী এবং পুরুষের সংখ্যার অসমতা। পুরুষ কাটলফিশের সংখ্যা নারী কাটলফিশের চেয়ে চারগুণ বেশি থাকে। অর্থাত একজন নারীর পিছনে সেখানে পাণিপ্রার্থী পুরুষের সংখ্যা দাঁড়ায় চারজনে। কখনো কখনো এই সংখ্যা দশে গিয়েও দাঁড়ায়। পিছনে এমন বিশাল লাইন থাকলে যে কারোরই মাথা খারাপ হবার দশা হয় অহংকারে। নারী কাটলফিশও তার ব্যতিক্রম কিছু না। সত্তর ভাগ প্রেম প্রস্তাবকেই তারা তাই নাকচ করে দেয়। শক্তিশালী এবং বিশালদেহী পুরুষদের প্রতিই মূল আগ্রহটা থাকে তাদের। ফলে, ছোট আকারের প্রেম-প্রার্থী পুরুষ কাটলফিশগুলো প্রায়শই প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয় শুধুমাত্র তাদের শারীরিক ত্রুটির কারণে। প্রায় সব নারী কাটলফিশই বয়ফ্রেন্ড জুটিয়ে ফেলে। পুরুষদের একটা বড় অংশ পড়ে থাকে একাকী হিসাবে। একা থাকলেও মিলনের আগ্রহতো আর কমে না। এ কারণে সুযোগ খুঁজতে থাকে তারা ঠিকই। ছোঁক ছোঁক করতে থাকে কোনো নারী কাটলফিশকে একা পেলেই।

শক্তিশালী পুরুষ কাটলফিশগুলো প্রচণ্ড রকমের ঈর্ষাপরায়ণ এবং হিংস্র ধরনের হয়। অন্য কোনো পুরুষ মাছ এসে তার প্রেমিকার সাথে ফ্লার্টিং করছে, কাছে এসে ছোঁক ছোঁক করছে, এগুলো তারা পছন্দ করে না। ছোট পুরুষগুলোকে দেখলেই দাঁত মুখ খিঁচিয়ে সেগুলোর দিকে তাই ধাওয়া করে তারা। তার প্রেমিকার দিকে অন্য কেউ নজর দেবে, এটা সহ্য করা তার পক্ষে মুশকিল। সম্রাট শাহজাহানের মতো বীর দর্পে নিজের হেরেম রক্ষা করার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালায় তারা।

সম্রাট শাহজাহানের ভয়েতো আর দুর্বল পুরুষেরা প্রেম ভালবাসা ত্যাগ করতে পারে না। পারে না লাইলিদের আকর্ষণকে উপেক্ষা করতে। তো, তখন তারা করে কি, শরীরের আকার এবং বর্ণ পরিবর্তন করার যে দক্ষতা তাদের আছে, সেটাকে দারুণভাবে কাজে লাগায়। নারী কাটলফিশ শুধু আকারেই ছোট হয় না, এর শারীরিক গড়ন এবং রঙও আলাদা হয়ে থাকে। ছোট পুরুষগুলো তখন নারী কাটলফিশের রূপ ধারণ করে। এটা করে সুযোগ নেবার অপেক্ষায় থাকে এই সুযোগসন্ধানীরা। বিশালদেহী পুরুষগুলো তাদেরকে নারী কাটলফিশ মনে করে আক্রমণ করতে যায় না।

এই প্রতারণা কৌশলের সবচেয়ে বড় রূপ দেখা যায় সবল পুরুষের অতিরিক্ত স্বার্থপ্রবন আচরণের সময়ে। কখনো কখনো বিশালদেহী পুরুষ, কোনো সুন্দরীর প্রেমে দিওয়ানা হয়ে গেলে, তাকে পুরোপুরি দখল করে নেয়। নারী মাছটিকে সে নিয়ে আসে নিজের বিশাল শরীরের নীচে। অনেকটা সুরক্ষিত দুর্গের মধ্যে রাজকন্যাকে আটকে রাখার মতো। এখান থেকে কিছুতেই বের হতে দেয় না সে তাকে। এই রকম পাহারা দিলে আর কোনো পুরুষ এই নারীর ধারে কাছেও আসতে পারবে না, সেটাই তার ধারণা। এই রকম চরম রক্ষণাত্মক কৌশল যে কতোখানি গলদে ভরা সেটা অবশ্য তারা নিজেরাও জানে না। লখিন্দরের লোহার বাসরেও যেমন ফুটো থাকে, এই দুর্গেও তেমনি দুর্বলতা থাকে। নারীর ছদ্মবেশ ধরে ছোট কিন্তু ধূর্ত পুরুষগুলো বিশালদেহী পুরুষের পেটের নীচে আশ্রয় নেয়। স্বেচ্ছায় আরেক সুন্দরী তার বাহুবন্ধনে ধরা দিচ্ছে, এই খুশিতে সেও নিশ্চিন্তে জায়গা করে দেয় তাকে। পেটের নীচে আশ্রয় নেবার পরেই শুরু হয় আসল খেলা। পিচ্চি পুরুষ তার পুরুষালি রূপে ফিরে যায়। মাথার উপরের বিশাল পুরুষ মাছ যেখানে ভাবছে দুই বিবি নিয়ে কতোই না সুখের জীবন যাপন করছি, তখন তারই ঘরে বসে, তারই আশ্রয়ে থেকে, তারই পেটের নীচে কৃষ্ণলীলার আসর বসে যায়। জন্ম হতে থাকে অসংখ্য বাচ্চার, যেগুলোর আসল বাবা সে না।

পিচ্চি পুরুষের এই সুখ যে সবসময় চিরস্থায়ী হয়, তা নয়। তার প্রেম-লীলা দ্রুত সম্পাদন করতে হয় তাকে। ধরা পড়ে গেলে খবর আছে। বিশালদেহীর হাতে বিশাল মার খাওয়ার হাত থেকে তাকে বাঁচানোর কেউ থাকে না। এ কারণে পিচ্চি পুরুষদের ছদ্মবেশ খুব নিখুঁতভাবে ধারণ করতে করতে হয়। তা না হলে ধরা পড়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

এই নিখুঁত ছদ্মবেশ ধারণের সমস্যাও আছে। অনেক সময় তাদেরকে সত্যিকারের নারী কাটলফিশ মনে করে তাদের সাথে মিলনের জন্যে বিশালদেহী পুরুষ কাটলফিশগুলো উন্মত্ত হয়ে ওঠে।

শুধু যে ছোট আকৃতির পুরুষগুলোই এই রকম ছদ্মবেশ ধরে প্রতারণা করে, তা নয়। অন্য পুরুষ কাটলফিশগুলোও অনেক সময় আংশিক ছদ্মবেশ নেয়। কোনো পুরুষ কাটলফিশ হয়তো কোনো নারী কাটলফিশের মনোযোগ আকর্ষণেরে চেষ্টা চালাচ্ছে। তার গায়ের উজ্জ্বল ডোরাকাটা রঙকে আরও উজ্জ্বল করে বলছে, দেখো আমার জামাটা কতো সুন্দর। ঠিক সেই সময়ে আশেপাশে যদি অন্য কোনো পুরুষ উপস্থিত হয় ডিস্টার্ব করার জন্য, তবে, এই প্রেমিক পুরুষ নারী কাটলফিশ এবং নবাগত পুরুষ কাটলফিশের মাঝামাঝি অবস্থান নেয়। তার যে অংশটা পুরুষের দিকে ফেস করা থাকে, সেই অংশকে সে মেয়েলি রঙে পরিবর্তন করে ফেলে। অন্য অংশটা পুরুষালিই থেকে যায়। নবাগত পুরুষের চোখের সামনেই অর্ধ ছদ্মবেশধারী প্রেমিক তার প্রেমিকা পটানোর কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। এই কৌশল অবশ্য একাধিক পুরুষ এসে উপস্থিত হলে আর কার্যকর থাকে না। আংশিক ছদ্মবেশধারী তখন তার ছদ্মবেশ খুলে ফেলে পুরোপুরি পুরুষের বেশে ফিরে যায়।

পুরুষদের সাথে সাথে অনেক সময় নারী কাটলফিশেরাও একই ধরনের ছদ্মবেশ নিতে পারে। তবে, সেটা প্রেমিক পাবার জন্য নয়। বরং আগ্রহী পুরুষকে দূরে রাখতে অনেক সময় এই কৌশলকে প্রয়োগ করে তারা। যে পুরুষে তার আগ্রহ নেই, তার হাত থেকে বাঁচার জন্য তারা পুরুষে ছদ্মবেশ নিয়ে দূরে সরে যায় বা সেই পুরুষকে দূরে সরিয়ে দেয়।