জেন গেরসন : (ট্রান্স-কানাডা ২২ নং হাইওয়েটি ধরে চলতে ধূসর বাদামী রঙের পাহাড়ের পাদদেশ অতিক্রম করতে একটি প্রাসাদ দৃশ্যমান হয় যেটি অস্বাভাবিক রকমের বিশাল ১১,০০০ বর্গফুট আয়তনের বাসভবনের সামনের দরজাটি পাহারা দিচ্ছে কয়েকটি প্রমাণ সাইজের স্বর্ণালী ঘোড়ার ভাস্কর্য আর বিশাল পাখাওয়ালা মানুষ দ্বারা চালিত একটি স্বর্ণালী রথ, সেও স্বর্ণালী। হাইওয়ের পাশে এমন একটা বিশাল অদ্ভুত বাড়িটি কে কি উদ্দেশ্যে তৈরি করেছেন তা নিয়ে ম্যাক্লিন্সের সাংবাদিক জেন গেরসনের অনুসন্ধান এবং বিশ্লেষণ। অনুবাদ করেছেন ম মাসুদ হোসেন খান)
এটা যেন শূন্য স্থান থেকে হঠাৎই দৃশ্যমান হল। আপনি ট্রান্স-কানাডা হাইওয়ে ধরে ধূসর বাদামী রঙের পাহাড়ের পাদদেশ অতিক্রম করতে থাকেন যা বরফাচ্ছাদিত রকি মাউন্টেনের সমান্তরালে অবস্থিত, আপনি সেখানেই এটি দেখতে পাবেন। এই তো! একটি বিশাল আয়তনের বাড়ি নিমিষে চোখের আড়ালে চলে গেল আর আপনি নিজেকে জিজ্ঞেস করলেন: “এটা কি? কোন হোটেল?”
কিন্তু ২২ নং হাইওয়েটি খুব ব্যস্ত রাস্তা আর সেখানে দু দণ্ড থেমে ভাল করে দেখার কোন সুযোগ নেই।
ক্যলগেরির প্রতিটি মানুষ এই জায়গাটি দ্বারা তাড়িত – এখন একটি ল্যান্ডমার্ক – আর বিস্মিত। এটির পাথরের সম্মুখ দেওয়ালটি বসন্তের শুরুতে ধূসর-বাদামী ঘাস রঙের সঙ্গে মিলে যায়। বহু জানালা। তাম্রচ্ছাদিত ছাদ। ন’টি গাড়ি রাখার গ্যারাজ। এটির সামনের দরজাটি পাহারা দিচ্ছে কয়েকটি প্রমাণ সাইজের স্বর্ণালী ঘোড়ার ভাস্কর্য আর বিশাল পাখাওয়ালা মানুষ দ্বারা চালিত একটি স্বর্ণালী রথ, সেও স্বর্ণালী । শুধুমাত্র কয়েকটি নুয়ে পড়া চারা গাছ আর সবুজ গাছপালা ক্যালগেরি শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে ৩৫ কিমি দুরত্বে অবস্থিত ৩২ হেক্টরের বিশাল বাড়িটিকে ছায়া দেয়। তারা ম্যাক্লিন্সের সাহসী সাংবাদিকের অনুসন্ধিৎসু চোখ এড়ানোর জন্য তেমন কিছু করতে পারেনি যিনি লজ্জা-শরম না করে হাইওয়ে থেকে বের হয়ে লুকিয়ে তাঁর বাইনোকুলার দিয়ে দেখতে থাকেন যখন প্রচণ্ড ভারবহনকারী ট্রাকগুলো তাঁর বারবি জীপটাকে গর্তে উল্টিয়ে ফেলে দেয়ার উপক্রম করছিল।
কেউ এটা থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখতে পারে না, যেটা কিনা পুরো আলবার্টার মধ্যে – সম্ভবত পুরো দেশের মধ্যে – সবচেয়ে মেরুকৃত এবং বিতর্কিত ব্যক্তিগত রিয়েল এস্টেট। এটির সৌন্দর্য সামাজিক মাধ্যম, অনলাইন ফোরাম এবং কোশরেন ঈগল-এর সম্পাদকের কাছে লেখা একটি বিশেষ বাজে চিঠিতে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। এটি কেবলা হচ্ছে একটি “চোখের পীড়া”, “ভোগবাদী” এবং সবচেয়ে কঠোরভাবে “মালিকের আত্মঅহংকারের প্রতি একটি কুৎসিত শ্রদ্ধা।”
এই হাইওয়েপ্রাসাদের মালিক একটু রহস্যাবৃত ছিলেন ২০১৪ সালে এটির নির্মাণ শুরু হওয়ার পর। কিন্তু মালিকানার তালিকায় নাম ছিল আরনেস্ট হোন-এর যার পরিবার হংকংয়ে রিয়েল এস্টেটে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছিল, আলবার্টা ভেঞ্চার-এর সংক্ষিপ্ত প্রোফাইল অনুযায়ী, এবং ১৯৮৮ সালে কানাডায় অভিবাসন করেন আরনেস্টের জন্মের কয়েক বছর পর। হোন ক্যালগেরি শহরের কেন্দ্রস্থলে বৃহৎ আবাসিক রিয়েল এস্টেট প্রকল্পগুলোর প্রধান মুখপাত্রও ছিলেন।
যোগাযোগ মাধ্যমে এটি যে নেতিবাচকপ্রতিক্রিয়ার শিকার হয়েছে সে কারণে।
এটা কেবল ১১,০০০ বর্গফুটের একটি বিশাল ম্যানশন নয় – পৃথিবীর এই অংশে এমন বেশ কয়েকটি বাড়ি বাগান বা পাহাড়ের মাঝে করা হয়েছে। আপনি যদি “ক্যালগেরি ও পার্শ্ববর্তী এলাকার” ঐতিহাসিক রিয়েল এস্টেটের তালিকা খোঁজেন, আপনি বহু প্রশ্নবোধক নান্দনিক অলংকার সম্পন্ন পাথরের স্মৃতিস্তম্ভ দেখবেন: নকলদ্বীপ,ড্রেসাজ এলাকা, বিশাল স্তম্ভ আর ৯০ দশকের স্টাকো।
এটি এমন একমাত্র কুৎসিত বাড়ি নয়। এটির সমস্যা হচ্ছে যে এটি বিশেষভাবে প্রকাশিত। এটি হাইওয়ের খুব নিকটে, পার্শ্ববর্তী প্রাকৃতিক পরিবেশ তেমন ভাল না আর এর জন্য অনুতপ্ত নয়। আর এখানেই রয়েছে রিয়েল এস্টেটের মাধ্যমে মর্যাদা বৃদ্ধি করার কানাডীয় বৈপরীত্যমূলক প্রচেষ্টা।

শ্রেণী বিভাজন বিষয় নিয়ে আলোচনা মার্জিত কানাডীয়রা এড়িয়ে চলেন। আমরা নিজেদের দেশকে তুলনামূলক শ্রেণীহীন বলে মনে করি আর আমরা যাদের বাসস্থান আছে আর যাদের নেই তাদের মধ্যে মানসিক দূরত্ব কমাতে আমাদের ধনিক শ্রেণীর মানুষদেরকে চুপ থাকতে আহবান জানাই। তাঁদের ভাল করে কাটা ভাল ডিজাইনের পোশাক পরিধান করা উচিৎ তবে সেটা যেন অতি উজ্জ্বল না হয়। মিলিয়ন ডলারের গাড়ি কিনুন তবে সেটির রঙ যেন প্রশান্ত হয়। ধনিক শ্রেণীর মানুষের বসবাসের এলাকার আঁকাবাঁকা রাস্তাগুলো যেন পূর্ণ বয়স্ক বৃক্ষ আর বড় বড় জিনিস দ্বারা সজ্জিত হয় যাতে বাড়িগুলোর প্রকৃত সাইজ বোঝা না যায়।
এই অলিখিত নিয়মগুলো অবমাননা করা অশিষ্টতার পরিচায়ক; এটাই কুৎসিতের অর্থ বহন করে। এই কারণেই হাইওয়ে ২২ এর এই বিশাল বাড়িটি চোখের স্নায়ুকে রগড়ায়। দরিদ্র মানুষেরা যে সম্পদের মালিকানা অর্জন করতে পারবে না সেগুলো নিয়ে ভেবে তারা বিব্রত হতে চায় না। আর ধনী মানুষজন রিয়েল স্টেটের মাধ্যমে সামাজিকমর্যাদাবৃদ্ধির ব্যাপারটা হাইওয়ের পাশে এমন প্রকাশ্য হয়ে যাওয়াতে তাঁরা অস্বস্তিতে পড়েছে।
এই ধরণের রিয়েল এস্টেটের আকাংখাকে শক্তিশালী করছে অবাস্তব ঔপনিবেশিক কল্পনা। নগর জীবনের ভিড় থেকে পালিয়ে দূর সমতলের একটা ছোট্ট বাড়ি – বাড়িটি ছাড়া, যেটি তেমন ছোট নয়, সব ধরণের আধুনিক জিনিসপত্র দ্বারা সজ্জিত।
কল্পনাটি যদিও সমানভাবে সকলের কাছে সহজলভ্য নয়। পশ্চিম কানাডার অধিবাসীরা প্রায়ই এশিয়া থেকে আগত ধনী মানুষদের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করে থাকে যাদের বাসগৃহগুলো স্থানীয় (ব্রিটিশ, ইউরোপিয়ান এবং আমেরিকান) নান্দনিকতার সঙ্গে সম্পর্কহীন। অথবা, আরও খারাপ হচ্ছে যে, তাঁরা বাড়ির মূল্য বৃদ্ধি করে শহরতলী থেকে “স্থানীয়দেরকে” বের করে দেয়ার জন্যে দোষারোপ করা হয়েছে। এই তিক্ততার পিছনে জাতিগত শত্রæতা প্রায়ই হালকা আবরণে ঢাকা থাকে, এবং আমি এই বাড়ি সম্পর্কে সাক্ষাৎকার দিতে অস্বীকার করার জন্যে হোনের প্রতি বিরক্ত নই – যদিও বাড়িটি সম্পর্কে নিজের বক্তব্যটি অসামঞ্জস্য বলে প্রতীয়মান হয়। কেন একটা হাইওয়ে থেকে পরিস্কারভাবে দৃশ্যমান বাড়ির সামনে প্রমাণ সাইজের স্বর্ণালী ঘোড়ার আর বিশাল পাখাওয়ালা মানুষ দ্বারা চালিত একটি স্বর্ণালী রথের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে যদি আপনি এ সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তর না দিতে চান? অট্টালিকাটি নির্মাণের উদ্দেশ্য কি যদি এটি সামাজিক মর্যাদা ও প্রচারের জন্য না হয়ে থাকে?
হোন অন্য বিষয়ে একেবারে অনাগ্রহী নন। তিনি প্রায়ই রিয়েল এস্টেট সম্পর্কে বিশ্লেষণ দিয়ে থাকেন, এবং তাঁর কোম্পানীর উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের প্রধান মুখপাত্র হিসাবে কাজ করেন। আলবার্টা ভেঞ্চারের একটি লেখায় তাঁকে ক্যালগেরি শহরের কেন্দ্রস্থলের একটি বড় আবাসিক রিয়েল এস্টেট প্রকল্পগুলোর প্রধান মুখপাত্র হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। খুব সম্ভবত সেটা ছিল গার্ডিয়ান, একটি ৪৪ তলা বিল্ডিং যেটাকে শহরের সবচেয়ে উঁচু কণ্ড টাওয়ার বলা হচ্ছে। “আমি শহরগুলোর ভবিষ্যৎ নগরায়নের মধ্যে দেখি।” তিনি নির্মাণ কাজ শুরুর আগে ওয়েবসাইটকে এটি বলেছিলেন। “জনগণ শহরতলীতে বসবাস করতে বেশী আগ্রহী। ক্যালগেরি এ ক্ষেত্রে দেরি করেছে, কিন্তু আপনি ৬০, ৭০, ও ৮০’র দশকে শহরতলীর পুনঃজাগরণ দেখেছেন – এটি ছিল ৩০ বছরের অবহেলা।”
এটি সত্য।
ক্যালগেরি শহরের কেন্দ্রস্থল প্রচণ্ডভাবে নিস্তেজ, এবং এটি পরিবর্তনের একমাত্র উপায় হচ্ছে আরও বাসিন্দাকে তাঁদের শহরতলীর ম্যাকম্যানশন ছেড়ে দিয়ে ছোট ঘনবসতিপূর্ণ বাসা পছন্দ করা। সস্তা কৃষি জমি উন্নয়ন করে বড় করা শহরটিতে এই ধারণা জনপ্রিয় করা কঠিন।
এমনকি গার্ডিয়ানও মনে হচ্ছে তাঁর রিয়েল এস্টেট মার্কেটিংয়ের ব্যাপারে খুবই সচেতন কেননা এটি সবচেয়ে বড় এবং সম্ভবত একমাত্র সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য শ্রেণী অবস্থানের চিহ্ন। এর লোগো – দুর্গের চুড়ায় দুটি সিংহের থাবা একটি হেরালডিক সিলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এর ওয়েবসাইটটি মসৃণ সাদা কাউন্টার টপস, মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত জানালা, পেশাদার ডিজাইন, একটি শেয়ার করা বাগানের টেরেস এবং একটি সামাজিক ক্লাব নিয়ে গর্বিত। এটি কেবল একটি থাকার জায়গা নয়।
এতে সমস্ত আনুসঙ্গিক জিনিস রয়েছে যা উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যাচেলর বা প্রচেষ্টা ব্রতী দম্পতি আশা করতে পারে একদিন পাথরের সম্মুখ দেয়াল, তামার-গিল্টের ছাদ ও সামনের ফটকে পাথরের স্তম্ভওয়ালা তাদের নিজস্ব প্রাসাদে ওঠার আগে আপাত অবস্থানের জন্য কোন একটি জায়গা খোঁজ করতে থাকে। যতদিন পর্যন্ত তাঁরা এটির সামনে একটি গাছ লাগিয়ে রাখবেন।
https://www.macleans.ca/economy/realestateeconomy/the-mystery-mansion-near-calgary-that-has-everyone-talking/