ডঃ বাহারুল হক : লাগেজের চিন্তায় ঘুম আসে না। কখন লাগেজ ফিরে পাব নাকি পাবোই না। না পেলে কি হবে; দেরিতে পেলে কি হবে, এ সব থাকছে ভাবনার মধ্যে। লাগেজ পাওয়ার সৌভাগ্য যদি থাকে তবে তা যেন জানুয়ারির ২ তারিখের আগে হয়। কারণ ২ জানুয়ারি আমরা মেলবোর্ন যাব। মেলবোর্ণ যাওয়ার টিকেট করা আগেই হয়ে গেছে। প্রতিদিন কয়েকবার ফোন করি সিডনী এয়ারপোর্টে। আমার উৎকন্ঠার কথা তাদের জানাই। ভাগ্য হঠাৎ সুপ্রসন্ন হলো। পাঁচ দিন পর ৩১ তারিখে আমি সুটকেস তিনটি পেয়ে গেলাম। সুটকেস একেবারে আমার ভায়রার বাসায় (যে বাসায় আমরা আছি) পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আমাকে এয়ারপোর্টে গিয়ে আনতে হয়নি। সিডনী এয়ারপোর্টের বদান্যতায় আমি খুশি না হয়ে পারিনি। তবে ক্যাথি প্যাসিফিক এয়ারলাইন্সের বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ রইলো। আমার তিনটা সুটকেসের একটা দারুনভাবে ড্যামেজ হয়েছে। এটি এখন ব্যবহার অনুপযোগী। আর একটা কথা না বললেই নয়; তা হলো, সুটকেসের কোন দ্রব্য খোয়া যায়নি। সব আমি পেয়েছি।

আমার কাজ হলো এখন সিডনীতে বেড়ানো। অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছি ৩১ ডিসেম্বর দিনটির জন্য। এই দিনটির অপেক্ষায় থাকে অগণিত মানুষ। এ দিনে আতশবাজি হয় এবং তা দেখার জন্য সিডনী শহরে মানুষ জড়ো হয়। আতশবাজি শুধু সিডনী শহরে হয় না। পৃথিবীর বহু দেশে শহরে নগরে নব বর্ষ বরণ উপলক্ষ্যে আতশবাজি হয়। কিন্তু সিডনীর আতশবাজি দুনিয়ার সেরা। এর কোন তুলনা নাই। এ আতশবাজি দেখতে প্রচুর লোক সমাগম ঘটে সিডনীতে।

এ সকল দর্শক যে শুধু অস্ট্রেলিযার নানা অঞ্চল থেকে জড়ো হয় তা নয়, এ নয়ন জুড়ানো আতশবাজি দেখতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকেও দর্শক আসে সিডনীতে। এ আতশবাজির রুপ সৌন্দর্য্য বর্ণানাতীত। প্রচুর অর্থ ব্যায় হয় এই আতশবাজিতে। ২০২২ সনে অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে উদযাপিত আতশবাজিতে ব্যায় হয়েছে ৫.৮ মিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার। আতশবাজি শুরু হয় ঘড়ির কাঁটা ১২টা অতিক্রম করার সাথে সাথে। আলোয় আলোয় ভরে উঠে আকাশ। নানা রঙের আলোর চমকে বিমোহিত হয় দর্শক। মুহর্মুহ শব্দে আকাশে ফোটে উঠে আলোর সিম্ফনী। নানা স্পটে হয় আতশবাজি । তবে প্রধানস্থানগুলো হলো সিডনী অপেরা হাউজ, সিডনী হার্বার ব্রিজ, ডার্লিং হার্বার, ব্যারাঙ্গারু রিজার্ভ, অবজার্ভ্যাটরী হিল এগুলো। এ বছর উৎক্ষেপন করা হয়েছে প্রায় ছয় টন শেল। এ সকল শেল আকাশে উৎক্ষেপনের পর সৃষ্টি হয়েছে নানা আকৃতির আলোকধারা; সে আলোকধারা দেখে দর্শক হয়েছে উল্লোসিত মাতোয়ারা। আমি দেখেছি ডার্লিং হার্বার থেকে। এখান থেকে দেখতে টিকেট করতে হয় না। কিন্তু হার্বার ব্রিজ এবং অপেরা হাউজ থেকে দেখতে হলে প্রবেশ ফী দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। মধ্যরাতের এই আতশবাজি চলে বিরামহীনভাবে টানা বার মিনিট। আতশবাজি শেষ হলে আমরা পথ ধরলাম দূরে পার্ক করা গাড়ির দিকে। সে আরেক যুদ্ধ। হাজার হাজার লোকে ভরে গেল পথ। সবার পথ যার যার গাড়ির দিকে। প্রচন্ড ভীড়। হাঁটা মুস্কিল। তারপরও ধীর পায়ে এগিয়ে চললাম। অবশেষে পৌঁছে গেলাম পার্ক করা গাড়ির কাছে। বাসায় যখন ফিরলাম তখন রাত একটা বেজে ত্রিশ মিনিট।

মেলবোর্ণ সিডনী থেকে ৮৬৬ কিঃ মিঃ দূরে। ট্রেনে যেতে সময় লাগবে দশ ঘন্টা। প্লেনে গেলে লাগে এক ঘন্টা বিশ মিনিট। ২ জানুয়ারি সকালে সিডনী সেন্ট্রাল রেল স্টেশন থেকে উঠলাম মেলবোর্ণগামী ট্রেনে। অসুস্থ শরীর নিয়ে যাত্রী হিসেবে কম সময় ব্যায় করার জন্য আমি প্লেনে চড়ে মেলবোর্ণ যাব এটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু আমি তা করিনি। আমি রেলে চড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অস্ট্রেলিয়ার ভু-প্রকৃতি, ফ্লোরা, এবং ফনা সম্মন্ধে একটা ধারণা পাবো এ আশায় আমি রেলে চড়ে মেলবোর্ণ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ট্র্যাকে দাঁড়ানো ট্রেনটা দেখে আমার মন ভরলো না। পুরাতন ট্রেন যে তা স্পস্ট বুঝা যায়। ট্রেন লম্বা নয় বেশি কারণ কারের সংখ্যা কম। আমি আর আমার স্ত্রী আমাদের কারে উঠে আমাদের সিটে বসলাম। প্রতিটি কারের মধ্যখানে আছে একটা করিডোর। করিডোরের দুই পাশে সিটের দুইটি কলাম। প্রতি কলামে দুইটি করে সিট। ঠিক ৭টা বেজে ৪০ মিনিট হলে ট্রেন ছেড়ে দিল। পরিস্কার আকাশ। বাতাসে জলকণা কম। ফলে রোদ প্রখর হলেও অস্বস্থিভাব নাই।
আমাদের ট্রেন এগিয়ে চলছে। আমার দৃস্টি ট্রেনের বাহিরে; কখনো কাছে আবার কখনো দূরে বহু দূরে। এভাবে কয়েক ঘন্টা কেটে গেল। আমি কিছু খাওয়ার তাগিদ অনুভব করলাম। ট্রেনে খাবারের কার আছে একটা। সৌভাগ্যক্রমে সেটি আমার কারের পাশেই। হাঁটতে হাঁটতে গেলাম সেই কারে। খাবারের নামসহ মূল্য লেখা আছে ডিসপ্লে বোর্ডে। দাম দেখে বেশ আশ্বস্থ হলাম। আমেরিকান ডলারে মূল্য পরিশোধ করতে চাইলাম, কিন্তু ক্যাশের মেয়েটা আমেরিকান ডলার নিলো না। আমি খাবার নিয়ে সিটে চলে আসলাম। দুইটি ইউগার্টের একটি স্ত্রীর হাতে দিয়ে ভারমুক্ত হলাম। ইউগার্টটা খুবই মজাদার। এমন সুস্বাদু ইউগার্ট টরন্টোতে পাওয়া যায় না। দুপুরের লাঞ্চটা আমাদের কিনে খেতে হয়নি। আমার শ্যালিকা দুপুরের খাবারটা তৈরি করে দুইটা প্যাকেট করে আমাদের ব্যাগে ভরে দিয়েছিল। সিটে বসে আমরা সেই খাবার খেয়েছি।

ট্রেনের যাত্রীদের দেখলাম। অবাক হলাম দেখে যে বেশির ভাগ যাত্রী বয়স্ক, আমার এবং আমার চেয়ে বেশি বয়সী। মধ্য এবং কম বয়সী যাত্রীর সংখ্যা কম। যাত্রীদের এ ধরনের এজগ্রাফ- এর কারণ নিয়ে আমার স্ত্রীর সাথে কথা বলছিলাম। আমার স্ত্রীর ধারণা সঠিক বলে আমার মনে হলো। তার ধারণা কর্মব্যাস্ত মানুষের জন্য ট্রেন নয়। তাদের সময়ের দাম আছে। দশ ঘন্টা ব্যায় করে সিডনী থেকে মেলবোর্ণ যাওয়ার সময় তাদের কোথায়? তারা তাই প্লেনে বা গাড়িতে চড়ে মেলবোর্ণ – সিডনী যাওয়া-আসা করে। রিটায়ার্ড এবং ভিজিটরদের জন্য ট্রেন। রিটায়ার্ড মানুষদের কাছে অর্থ কম; ভিজিটরদের উদ্দেশ্য হলো দেশ দেখা। তাই এই দুই শ্রেণীর মানুষে ট্রেন ভরা থাকে। আমার পাশের বয়স্ক ভদ্রলোকটার সাথে আলাপ জুড়িয়ে দিলাম এবং জানতে পারলাম তিনি পাশে বসা স্ত্রীকে নিয়ে ভ্রমণে বের হয়েছেন সেই সুদুর অস্ট্রিয়া থেকে। আমার অবস্থাও তথৈবচ। আমি এসেছি কানাডা থেকে। সিডনী থেকে মেলবোর্ণ যেতে দশ ঘন্টা লাগলে আমার কোন ক্ষতি নাই। অনুসন্ধিৎসু দৃস্টি আমার রেল লাইনের দুই ধারে জমির উপর। জমি দেখলাম কোথাও সমতল নয়। ট্রেন পথ চলছে আর আমি দেখে যাচ্ছি জমি। পথ পরিক্রমনে কখনো পড়ছে উপত্যকা তবে সে রকম খুবই কম। বেশির ভাগ ভ‚মি টিলায় টিলায় ভরা। তবে কোথাও উর্বর ভুমি চোখে পড়লো না।

জমিতে ঘাস আছে। সে সব ঘাস পানির অভাবে (সম্ভবতঃ) সতেজতা আর সবুজত্ব হারিয়েছে। গাছ আছে তবে সেগুলো কোথাও বনভুমি সৃস্টি করেনি। গাছগুলো ঘন হয়ে বড় হয়নি। ইউক্যালিপ্টাস অনেক হলেও অন্য গাছও কম নয়। ইউক্যালিপ্টাস ছাড়া বাকি গাছগুলোর কোনটি টিম্বার ভ্যালু বেশি হবে না। কোন গাছেরই ট্রাংক সোজা এবং দীর্ঘ নয়। শাখাগুলোর বিস্তার জ্যামিতিক নয়; ফলে ক্রাউন হয়েছে অআকর্ষণীয়। গাছে গাছে পাখির ছুটা ছুটি কলরব তেমন নাই-ই। নানা রকম পাখি ভুমিতে চরে বেড়াচ্ছে। শালিক, ঘু ঘুর মত কিছু পাখি চোখে পড়লো। তবে যেখানে একটু লোকালয় আছে সেখানে দেখলাম কাকের কত একটা পাখি, কবুতর, আর কাকাতুয়া। তবে ভুমিতে চরে বেড়াতে দেখলাম অসংখ্য গরু আর ভেড়া। ভেড়ার পাল আর গরুর পাল একসাথে থাকে। মাঝে মাঝে দেখা মিলেছে ঘোড়ারও। ঘাসের উপর নির্ভয়ে নেচে বেড়াচ্ছে নানা রকম ফড়িং। গাছে ঘাসে কোথাও ফুল নাই, তাই কোথাও কোন প্রকার প্রজাপতি চোখে পড়লো না। অস্ট্রেলিয়া সাপের অভয়ারণ্য বলে শুনেছিলাম, কিন্তু এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমনকালে রেল লাইনের ধারে কোন সাপ আমার চোখে পড়েনি। সজারু বা কাঠবিড়ালিও আমার চোখে পড়েনি। মাঝে মাঝে কিছু বাড়ি-ঘর চোখে পড়েছে রেল লাইনের পাশে। তবে সেগুলো দেখে আমি হতাশ হয়েছি শুধু। বাড়ি-ঘরগুলোতে দৈন্যতার ছাপ স্পস্ট। অস্ট্রেলিয়ার মত একটা ধনী দেশে সেগুলোকে বেমানান লেগেছে আমার।

বাড়িগুলোতে কারা থাকে যারা থাকে তাদের পেশাই বা কি জানতে পারিনি। কানাডার প্রত্যন্ত অঞ্চলে রাস্তার ধারে মাঝে মাঝে বারি-ঘর চোখে পড়ে। সে সব বাড়ির আর্কিট্যাকচারাল ডিজাইন, প্রবেশের রাস্তা, বাড়ির ফ্রন্ট ইয়ার্ড, ব্যাক ইয়ার্ড, বাড়ির গ্যারেজ, গাড়ির সংখ্যা, বিনোদনের জন্য বাগান ইত্যাদি আওয়াজ দিয়ে বলে দেয় এটা অতি বিত্তবানদের আবাস স্থল। এখানে কোন কিছুর কোন অভাব নাই। এ ধরনের কোন কোন বাড়ির লনে হেলিকপ্টারও আমি দেখেছি। কানাডার গ্রাম জীবন আর শহর জীবন সমান তালে চলছে।
গ্রাম জীবন শহর জীবনের মত পরিপুর্ণ। প্রাপ্তির আনন্দ গ্রাম জীবনেও কম নয়। যাইহোক, কখনো জোরে কখনো আস্তে আস্তে চলে আমাদের ট্রেন সন্ধা ৬টায় মেলবোর্ণ সেন্ট্রাল রেল স্টেশনে প্রবেশ করলো। স্টেশনটি যে বহু পুরানো তা ট্রেন থেকে নেমেই বুঝতে পারলাম। স্টেশনে আমার ভাগিনা গাড়ি নিয়ে আমাদের অপেক্ষায় ছিল। তাই স্টেশনে আমাদের দেরি হয়নি। ভাগিনার গাড়িতে উঠে বসলাম। ভাগিনার গাড়ি আমাদের নিয়ে ৪০ মিনিট পর পৌঁছে গেল তাদের বাড়িতে। বহু বছর পর এই প্রথম আমার বোনের মেলবোর্ণের বাড়িতে আমার পা রাখা। বোনের ছেলের বিবাহ উপলক্ষ্যে আমার এবং আমার স্ত্রীর মেলবোর্ণ আগমন। (চলবে)