ইব্রাহীম চৌধুরী, নিউইয়র্ক : বিশ্বের কোলাহলমুখর নগরী নিউইয়র্ক আবার জেগে উঠছে। নগরীতে টানা ১০০ দিন পরে প্রথম ধাপে খুলে দেওয়ার দুই সপ্তাহ হয়ে গেছে। এরই মধ্যে নগরী আবার কোলাহলমুখর হয়ে উঠছে। নিউইয়র্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো বলেছেন, নগরী দ্বিতীয় ধাপে খুলে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। ২২ জুন গ্রীষ্মের প্রথম দিন থেকে দ্বিতীয় ধাপে খুলছে নগরী।

করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে নিউইয়র্কেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তিন মাসে ২৫ হাজারের বেশি মানুষ হারিয়ে এ নগরী বদলে গেছে। নতুন বিন্যাসে এ নগরীর লড়াকু মানুষ আবারও নেমে আসছেন জনারণ্যে নতুন প্রত্যয় নিয়ে। খুলছে ব্যবসা–বাণিজ্য। কর্মহীন লোকজন বেরিয়ে পড়ছেন কাজের খোঁজে। উল্লাস–আনন্দের নগরীতে গ্রীষ্মের উষ্ণ আবহাওয়ায় লোকজন ভাসিয়ে দিচ্ছেন নিজেকে। যদিও পর্যটনের এ নগরীতে করোনা–পরবর্তী কোনো পর্যটক নেই। হোটেল, রেস্তোরাঁয় তেমন গ্রাহক নেই। তবু প্রত্যাশা একটাই, বিপর্যয় জয় করে আরও জোরালো হয়ে উঠবে নিউইয়র্ক।

২২ জুন থেকে দ্বিতীয় ধাপে নগরী খুলে দেওয়া হবে। রিয়েল এস্টেট, রিটেইল স্টোরসহ বাইরে বসার ব্যবস্থা নিয়ে খুলছে রেস্টুরেন্ট। সামাজিক দূরত্ব ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার শর্ত অনুসরণ করে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো জানিয়েছেন, করোনা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের সব সূচকে আশানুরূপ উন্নতি হয়েছে। এমনকি প্রথম ধাপে খুলে দেওয়ার দুই সপ্তাহ পরেও উন্নতি অব্যাহত আছে। এর মধ্যেই ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে টানা বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। লকডাউনের নিয়ম ভঙ্গ করেই নাগরিক আন্দোলন করেছেন বিক্ষোভকারীরা। এতে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল।

নিউইয়র্কে ব্যাপকভাবে করোনা টেস্টিং করা হচ্ছে। গত ১ এপ্রিল দেখা গেছে, টেস্ট করা মানুষের মধ্যে ৫৭ শতাংশের রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে। ৮ জুনে যা ছিল ২ শতাংশ। এখন এ হার ১ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রতি সপ্তাহে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যাও কমছে। ভাইরাসের সংক্রমণ তুঙ্গে থাকার সময়ে নিউইয়র্কের হাসপাতালে দিনে ১২ হাজার রোগী ভর্তি হয়েছিল। ৮ জুনে যা ছিল দিনে গড়ে ১ হাজার ২০০ জনের কাছাকাছি। ১৭ জুন জানানো হয়েছে, আগের ২৪ ঘণ্টায় করোনা সংক্রমণ নিয়ে ৭৬১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
নিউইয়র্কে নগরকেন্দ্রের বাইরে হাডসন ভ্যালি নামে পরিচিত এলাকাগুলো তৃতীয় ধাপে খুলবে ২৩ জুন। লং আইল্যান্ড খুলবে ২৪ জুন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিউইয়র্কে শুরু হওয়ার পর থেকে এখন সবচেয়ে কম সংক্রমণ হচ্ছে বলে গভর্নর জানান। ১৬ জুন নিউইয়র্ক রাজ্যে করোনায় সংক্রমিত হয়ে মোট ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সংখ্যাটি এ পর্যন্ত সর্বনিম্ন। একই দিনে রাজ্যের ৬০ হাজার মানুষের করোনার পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ শতাংশেরও কম মানুষের পজিটিভ ফল পাওয়া গেছে।

রাজ্য গভর্নর বলেন, ‘আমরা সম্ভব করতে পেরেছি। সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ এখন আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। আমরা সবাই মিলে এখানে আসতে পেরেছি। আরেক দফা ভাইরাস ফিরে আসতে পারে। এ জন্য সতর্ক থাকতে হবে। চোখ–কান খোলা রেখে আমাদের এখন অন্য বিষয়ের ওপর নজর দিতে হবে।’

করোনাভাইরাস নিউইয়র্কে ছড়িয়ে পড়ার প্রথম দিন থেকে প্রতিদিন গভর্নর কুমো প্রেস ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। ১৯ জুনের পর থেকে করোনাভাইরাস নিয়ে তাঁর প্রতিদিনের প্রেস ব্রিফিং আর হচ্ছে না। এখন থেকে কেবল প্রয়োজন হলেই প্রেস ব্রিফিং করবেন বলে জানিয়েছেন কুমো। গত ১ মার্চ নিউইয়র্কে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঘটনা সামনে আসে। নিউইয়র্কে এ নিয়ে প্রথম সংবাদ সম্মেলন করেন রাজ্যের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো। রাজ্যে করোনায় প্রথম মৃত্যুর ঘটনা সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয় ১৪ মার্চ। করোনাভাইরাস নির্মূল না হওয়া বা প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। নতুন স্বাভাবিকত্ব নিয়েই চলতে হবে বলে মনে করছেন এ নগরীর লোকজন।

সংক্রমণের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা হয় এল্মহার্স্ট হাসপাতালের সংক্রামক রোগবিষয়ক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অমর আশরাফের সঙ্গে। তিনি বলেন, ভাইরাসটি তার রূপ পরিবর্তন করছে। ইতালির একটি গবেষণার সূত্রের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের তীব্রতা কমেছে। ভাইরাসটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

অমর আশরাফ বলেন, রোগীদের পরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৮০ শতাংশেরই শরীরে অ্যান্টিবডি পাওয়া যাচ্ছে। এসব লোকজন নিজের অজান্তেই সংক্রমিত হয়েছেন। কোনো উপসর্গ ছাড়াই বা সহনীয় উপসর্গের পর সেরে উঠেছেন তাঁরা। শরীরে করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়া এসব লোকজন আর নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে না বলে তিনি মনে করেন।

ফিলাডেলফিয়ার ড্রেক্সেল ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক জিয়াউদ্দিন গত তিন মাস করোনাভাইরাসে সংক্রমিতদের নিয়ে নানা কাজ করছেন। তিনিও মনে করেন, নিউইয়র্কে ভাইরাসের ধরন পরিবর্তিত হয়েছে।

নিউইয়র্ক খুলে দেওয়া হলেও অনেক কোম্পানি আগের অবস্থায় আর ফিরে যেতে পারছে না। যে নগরী এক মুহূর্তের জন্য নিদ্রা যায় না, সে নগরী যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল। লোকজনকে এখন ধাতস্থ হতে দেখা যাচ্ছে। দেশ–বিদেশের পর্যটকে নিউইয়র্কের এ সময়টি থাকে চরম কোলাহলের। এখন পর্যটক নেই, পুরো অচেনা লাগছে। যদিও লোকজন বেরিয়ে আসছে। ভিড় করছে পার্ক, খোলা জায়গা বা নদীর পাড়ে।

স্বদেশিদের কোলাহলের এলাকা জ্যাকসন হাইটস, ব্রুকলিনের চার্চ ম্যাকডোনাল্ডস, ব্রঙ্কসের স্টার্লিং অ্যাভিনিউ বা জ্যামাইকার হিলাসাইড অ্যাভিনিউয়ে বেরিয়ে পড়েছেন প্রবাসীরা। সপ্তাহের শুরুতে দেখা গেছে অধিকাংশ মানুষ মাস্ক পরে বেরিয়েছেন। করমর্দন করা থেকে বিরত থাকছেন। সামাজিক দূরত্ব মেনে আড্ডা করছেন। স্মরণ করছেন, গত তিন মাসে করোনায় হারানো কমিউনিটির সদস্যদের।