ভজন সরকার: (১) খুব ছোটবেলায় পড়েছিলাম ইস্কুল লাইব্রেরি থেকে এনে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ‘যোগাযোগ’। ভালো লেগেছিল। কিশোর বয়সে উপন্যাস পড়ে যা হয় খুব খুঁজেছিলাম কুমুদিনী বা কুমু-কে। কিন্তু নিজেকে মধুসূদন হ’তে ইচ্ছে হয়নি শুধু কুমুকে পেতে। বরং বিপ্রদাস হ’য়ে কুমুকে পেতে ইচ্ছে হ’তো দাদা হয়ে। তখন যেমন এখনও, উপন্যাসের শেষ অধ্যায়টি খুব প্রিয় এবং খুব কষ্টের।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি বই পড়েছিলাম, খুব চিন্তা-উদ্রেক করেছিল, ‘কুমু বন্ধন। যোগাযোগ’। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে ছিল ‘যোগাযোগ’-এর দ্বিতীয় পর্বটি লেখার; কিন্তু আয়ুর সীমানায় কুলিয়ে উঠতে পারেননি রবিঠাকুর। কিন্তু আমার মতো কোটি পাঠক কখনো মধুসূদনের মতো স্বামী কিংবা বিপ্রদাসের মতো দাদা হয়ে প্রতিমুহুর্তে কত কত পর্বকে লিখে নিয়ে চলেছি। আর কুমু-কে পেতে হ্যা-পিত্যেস করে পাওয়া-না-পাওয়ার দ্ব›েদ্ব গোটা জীবনটাই কাটিয়ে দিচ্ছি। যোগাযোগ তো হচ্ছেই রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’-এর সাথে!
শেষ অধ্যায়ে কুমুর বিদায়ের দিন। বিপ্রদাস বলছেন, “কুমু, তুই মনে করিস আমার কোনো ধর্ম নেই। আমার ধর্মকে কথায় বলতে গেলে ফুরিয়ে যায় তাই বলি নে। গানের সুরে তার রূপ দেখি, তার মধ্যে গভীর দুঃখ গভীর আনন্দ এক হয়ে মিলে গেছে; তাকে নাম দিতে পারি নে। তুই আজ চলে যাচ্ছিস কুমু, আর হয়তো দেখা হবে না, আজ সকালে তোকে সেই সকল বেসুরের সকল অমিলের পরপারে এগিয়ে দিতে এলুম”।

কুমু চলে যায় বিপ্রদাসকে ফেলে সংসারে স্বামীর কাছে। “ঘরে আজ কুমু নেই, এ শূন্যতা তার বুকে চেপে রইল। হঠাত শুনতে পেলে বিছানার নীচে টম কুকুরটা গুমরে গুমরে কেঁদে উঠল। কুমুকে সে চলে যেতে দেখেছে, কী একটা বুঝেছে, ভালো করে বোঝাতে পারছে না”।
আমরা অনেকেই সংসারের অনেক কিছুই দেখি। কিন্তু টম কুকুরটার মতোই সব সময়ই “কী একটা” বুঝি কিন্তু “ভালো করে বোঝাতে” পারি না কাউকেই। কেউ বোঝে না অব্যক্ত কথা! এক যোগাযোগহীনতায় তাল কেটে যায়; ছিঁড়ে যায় ‘যোগাযোগ’।

(২) ধর্ম নিয়ে শিক্ষিত আর আলোকিত মানুষদেরই বেশি বেশি আলোচনা করা দরকার। নইলে ধর্ম ধর্মান্ধদের দখলে চলে যায়। আজ সেটাই হয়েছে সারা পৃথিবীব্যাপি। বিশেষকরে ভারত, বাংলাদেশসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। অনেকে বলেন, “এর পেছনে রাজনীতি আছে, অর্থনীতি আছে”।

হ্যাঁ আছে। রাজনীতি আর অর্থনীতি ছাড়া কবেই বা কোন্ ধর্ম ছড়িয়েছে অন্যত্র? কিন্তু এখন যেটা ব্যতিক্রম ও ভয়াবহ তা হলো, আগে রাজনীতির মাধ্যমে ধর্মে যেটুকু মানবিকতা আছে তা প্রচার হতো। এখন ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করা হচ্ছে প্রতিরোধহীনভাবে।

(৩) এক সময় বাংলা ভাষাভাষী মানুষ, যারা বাঙালি জাতিগোষ্ঠী নামে পরিচিতি, তাঁদের পথ প্রদর্শক রাজনীতিক-সাহিত্যিকেরা বলতেন ধর্মের মানবিকতার দিকের কথা,যা মানবধর্ম নামে পরিচিত। উদাহরণ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুভাষ বোস কিংবা বংগবন্ধুর নাম বলা যেতে পারে। এঁদের প্রায় সবাই ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন; সেটা ছিল নিতান্তই ব্যক্তিগত। কিন্তু সবাই উচ্চকন্ঠ ছিলেন মানবধর্ম প্রচারে। রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল তো প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের বাইরে এসে মানবধর্ম গ্রহণ করার কথা বলেছেন সরাসরি। আর সুভাষ বোস আর বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিই ছিল ধর্ম বিশ্বাসের বাইরে এসে শোষনমুক্ত স্বাধীন দেশ গড়ার।
কিন্তু আমাদের সমস্যা হলো আমরা অতীতকে ব্যবহার করি কিন্তু অতীত থেকে শিক্ষা নিই না। সুভাষ বোস কিংবা বঙ্গবন্ধুর নামে রাজনীতি করি কিন্তু তাঁদের কাজ এমনকি ভুল-কাজ থেকেও শিক্ষা গ্রহণ করি না।

(৪) আজকের বাস্তবতায় ধর্ম নিয়ে কথা বলা বড় প্রয়োজন। কথা বলা প্রয়োজন সমাজের সকল স্তরেই- একবারে আমজনতা থেকে রাস্ট্রের উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সবার। কোনো রাখঢাক না রেখেই বলা প্রয়োজন, সকল প্রচলিত ধর্মেরই সংস্কার প্রয়োজন; কারও বেশি কারও কম।
অনেকেই হিন্দু ধর্মের হাজার হাজার বছরব্যাপি সংস্কারের কথা বলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। হ্যাঁ, হিন্দু ধর্মের সংস্কার হয়েছে। অনেক মনীষীই হিন্দু ধর্মের সংস্কার করে এ ধর্ম থেকে অনেক দার্শণিক তত্ত¡ তুলে এনেছেন। কিন্তু এ দার্শণিক তত্ত¡ যাঁরা বোঝেন, তাঁদের আর প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস কিংবা ধর্মচর্চা করতে হয় না।

আর এ দর্শণতত্ত¡ অনেকটাই ‘থিউরিটিক্যাল’; এর প্রায়োগিক দিকটা উপেক্ষিতই থেকে গেছে । প্রচলিত হিন্দু ধর্ম- যা অধিকাংশ হিন্দু পালন ও চর্চা করেন, তার সাথে এর বিন্দু মাত্র মিল নেই। উদাহরণ হিসেবে ভারতের উত্তর প্রদেশ, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের অসংখ্য অমানবিক ঘটনার কথা বলা যেতেই পারে।
আর এর বিপরীতে ইসলামের কথা বলা যায়। কারণ, যুগের উপযোগীতা মুসলমানদের নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই প্রয়োজন শুধু নয়, জরুরিও বটে। কিন্তু এ সংস্কার করতে হবে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদেরকেই। যেমন হিন্দু বা খৃস্ট ধর্মের সংস্কার হয়েছে (তা যতই সামান্য হোক না কেনো) এ সব ধর্মবিশ্বাসীদের হাত ধরেই।

(৫) গান্ধীজি বলেছেন, “তিনি একই সাথে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, ইহুদি, কনফুসীয়”।
অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ এ নিয়ে বলেছিলেন, “একে তিনি (গান্ধী) ও তাঁর অনুসারীরা মহত ব্যাপার ব’লে মনে করেছেন। কিন্তু এটা প্রতারণা, ও অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ব্যাপার,- তিনি নিজেকে ক’রে তুলেছেন সব ধরনের খারাপের সমষ্টি। এমন প্রতারণা থেকেই উত্পত্তি হয়েছে বাবরি মসজিদ উপাখ্যানের। তিনি যদি বলতেন আমি হিন্দু নই, খ্রিস্টান নই, মুসলমান নই, বৌদ্ধ নই, ইহুদি নই, কনফুসীয় নই; আমি মানুষ, তাহলে বাবরি মসজিদ উপখ্যানের সম্ভাবনা অনেক কমতো।”

মূলত মানুষ যখন প্রবলভাবে বিশ্বাসী হয়ে উঠে, তা শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস হ’তে হবে এমন নয়, তখন বিশ্বাসে বিশ্বাসে দ্বন্দ অবশ্যম্ভাবী। পৃথিবীতে এমন নজির নেই যে, ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাসীরা অনাদিকাল শান্তিতে বাস করছে। হয়ত এক-দুই-দশ-পঞ্চাশ বছর। কিন্তু একদিন একে অন্যের বিশ্বাসকে নিঃচিহ্ন করতে উদ্যত হবেই হবে।

কারণ, বিশ্বাস বস্তুটাই বড় গোলমেলে।বিশ্বাস আসে অজানা থেকে, অজ্ঞতা থেকে। কেউ দেখাতে পারবেন, যা আপনি জানেন তা বিশ্বাস করেন। কারণ, যা জানেন তা বিশ্বাস করার প্রয়োজনই নেই। তাই জানার আগ্রহটা বাড়াতে হবে, তবেই সব বিশ্বাস দূরে চলে যাবে। তাই হয়ত প্রাচীন দর্শণে আছে, “Know thyself” ।

শেষ কথাটি রবীন্দ্রনাথই বলে গেছেন,
“আমি হিন্দু” “আমি মুসলমান” এই কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেলো। কিন্তু আমি মানুষ এ কথা কাহাকেও বলতে শুনি না। যারা মানুষ নয়, তারা হিন্দু হোক বা তারা মুসলমান হোক, তাদের দিয়ে জগতের কোন লাভ নেই।”
(ভজন সরকার : কবি, সাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, ওন্টারিও)