অনলাইন ডেস্ক : অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যামামলায় একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচ্ছে তদন্তকারী সংস্থা র্যাব। বিশেষ করে গ্রেপ্তার হওয়া হত্যামামলার ৪ আসামিকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদে ইতোমধ্যে ঘটনার বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে। কেন সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যা করল পুলিশ, কীভাবে করল এ ব্যাপারে জানতে চায় র্যাব। এ রহস্য বের করতে কৌশলী ভূমিকা নেওয়া হচ্ছে।
সে কারণে কারাগারে থাকা ওসি প্রদীপ কুমার দাস এবং বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত (বরখাস্ত) এখনই জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় না তদন্তকারীরা। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে আরও একটু সময় নিতে চায়। র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যারহস্য উদ্ঘাটনে তারা আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদসহ তদন্তের সব দিক খতিয়ে দেখছেন। এ মামলার সাক্ষী শ্রিপা দেবনাথ ইতোমধ্যে র্যাবের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছেন বলেও র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।
পুলিশের গুলিতে নিহত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার সঙ্গে তথ্যচিত্র নির্মাণে যুক্ত থাকা স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাত গতকাল কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তবে মুক্তির পর গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। ঘটনার বিষয়ে আজকালের মধ্যে র্যাব সিফাতের সঙ্গে কথা বলবে বলে জানা গেছে। সিফাত ঘটনার অন্যতম প্রত্যদর্শী।
গতকাল সোমবার র্যাব সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেছেন, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যামামলার চার আসামিকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের পর এই চার আসামিকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চেয়ে গতকাল সোমবার আদালতে আবেদন করেছে র্যাব।
পাশাপাশি হত্যামামলার গুরুত্বপূর্ণ তিন আসামি টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাস, এসআই লিয়াকত এবং এসআই নন্দলাল রক্ষিতকে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়ার ক্ষেত্রে কৌশলী ভূমিকা নিচ্ছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী সিফাত এবং শিপ্রার সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত তথ্য পাওয়ার পর তাদের সুবিধাজনক সময়ে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তদন্ত সংস্থা হিসেবে র্যাব এ ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোর নিরপেক্ষ এবং প্রভাবমুক্ত হয়ে তদন্ত করবে। প্রকৃত আসামিদের শনাক্ত এবং কী কারণে এই অপ্রত্যাশিত ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে তা খুঁজে বের করাই মুখ্য উদ্দেশ্য বলে তিনি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, সিনহা হত্যামামলার গুরুত্বপূর্ণ দুই সাক্ষী সিফাত ও শিপ্রা জামিনে মুক্ত হয়েছেন। তারা এখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এর মধ্যে শিপ্রার সঙ্গে তদন্তকারী কর্মকর্তা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, তার জীবনে যে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে, এটা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও তিনি এই ঘটনার বিচার দেখে যেতে চান। প্রয়োজনে ন্যায়বিচারের স্বার্থে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। শিপ্রা এবং সিফাত এই ঘটনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্র্ণ সাক্ষী। প্রথমে তদন্তকারী কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। পরে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। তিনি আরও জানান, সিনহা হত্যামামলার গুরুত্বপূর্ণ আসামি সিফাত ও শিপ্রার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করা হয়। এর মধ্যে দুটি দায়ের করা হয় টেকনাফ থানায় এবং একটি রামু থানায়। এই মামলাগুলোর তদন্তভার র্যাবের কাছে ন্যস্ত করা হয়েছে। এখন এই ঘটনাকেন্দ্রিক দায়ের করা ৪টি মামলার তদন্তভারই র্যাবের হাতে এসেছে। দুই সাক্ষী সিফাত ও শিপ্রার সঙ্গে কথা বলার পর সাবেক ওসি প্রদীপ, এসআই লিয়াকত এবং এসআই নন্দলাল রক্ষিতকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
এদিকে ল্যাপটপ এবং মেমোরি কার্ড জব্দ তালিকায় না দেখানোর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে র্যাব কর্মকর্তা আশিক বিল্লাহ বলেন, সিজার লিস্টে ল্যাপটপ ও মেমোরি কার্ড জব্দ তালিকায় দেখানো হয়নিÑ বিষয়টি গণমাধ্যমের খবর থেকে জেনেছি। অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী সিফাত ও শিপ্রার সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে জেনে যারা জব্দ তালিকা করেছে তাদের সঙ্গে কথা বলা হবে। সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে এগুলো সংগ্রহ করার চেষ্টা করা হবে।
আদালতের নির্দেশে চার আসামিকে জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদ করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যে চারজনকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, প্রত্যেকইে ঘটনার দিন বাহারছড়া পুলিশ ফাড়িতে কর্মরত ছিলেন। ঘটনার বিস্তারিত খুঁটিনাটি ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা দিয়েছেন। আরও বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গতকাল আদালতে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে। বুধবার এই আবেদনের শুনানি হবে।
এদিকে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাসসহ অন্য আসামিদের রিমান্ডে নিতে আরও কয়েক দিন সময় নেবে মামলাটির তদন্ত সংস্থা র্যাব। কারণ হিসেবে র্যাব জানিয়েছে, ওসি প্রদীপ কুমার ও পরিদর্শক লিয়াকতসহ তিনজনের সাত দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। কিন্তু বাকি চার সদস্যকে র্যাব জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ওই জিজ্ঞাসাবাদে মিলেছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। এজন্য ওই চারজনকেও রিমান্ডে চায় র্যাব। ওই চারজনের জন্য ওসি প্রদীপসহ বাকি তিনজনকে রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে না।
শিপ্রার পর সিফাতও জামিনে মুক্ত
পুলিশের গুলিতে নিহত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার সঙ্গে তথ্যচিত্র নির্মাণে যুক্ত থাকা স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাতও কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
কক্সবাজার জেলা কারাগারের সুপার মো. মোকাম্মেল হোসেন জানান, দুই মামলায় আদালতের জামিন আদেশের কপি হাতে পাওয়ার পর সোমবার বেলা ২টা ৫ মিনিটে সিফাতকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তির পর পরই জেল গেট থেকে সাদা পোশাকধারী লোকজন তাকে দ্রুত নম্বরবিহীন একটি মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যান। সে কারণে কারা ফটকে উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি সিফাত।
এর আগে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের (টেকনাফ-৩) বিচারক তামান্না ফারাহ টেকনাফ থনায় দুই মামলায় সিফাতের জামিন মঞ্জুর করেন।
সিনহা নিহতের ঘটনায় এবং তার গাড়ি থেকে মাদক উদ্ধারের অভিযোগে পুলিশের দায়ের করা এ মামলা দুটির তদন্তভার আদালত র্যাবকে দিয়েছে বলেও সিফাতের আইনজীবী মোহাম্মদ মোস্তফা জানিয়েছেন।
শিপ্রার মতো সিফাতের মামলায় জামিন আবেদনের ওপরও রবিবার শুনানি করেন কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালত। তবে তাৎক্ষণিক আদেশ না দিয়ে তা সোমবারের জন্য রাখা হয়েছিল।
গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ।
দুই বছর আগে সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া রাশেদ ‘লেটস গো’ নামে একটি ভ্রমণবিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য প্রায় এক মাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকায় ছিলেন। ওই কাজেই তার সঙ্গে ছিলেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষার্থী সিফাত ও শিপ্রা।
সিনহা নিহতের ঘটনায় এবং গাড়ি থেকে মাদক উদ্ধারের অভিযোগে টেকনাফ থানায় দুটি মামলা করে পুলিশ, যাতে সিনহা এবং তার সঙ্গে থাকা সিফাতকে আসামি করা হয়। আর নিলীমা রিসোর্ট থেকে শিপ্রাকে গ্রেপ্তার করার সময় মাদক পাওয়া যায় অভিযোগ করে তার বিরুদ্ধে রামু থানায় মামলা করা হয়।