মণিজিঞ্জির সান্যাল : বৈশাখ মানেই চারপাশে সাজো সাজো রব। বৈশাখ মানেই চারপাশে খুশির পরশ। বৈশাখ মানেই চারপাশে ভালোবাসার স্পন্দন। আসলে বৈশাখ মানেই সবটা জুড়ে শুধুই কবিগুরু। কবিগুরু মানেই বিশ্ব সেরা কবি, শিল্পী, লেখক, চিত্রশিল্পী, সুরকার, গীতিকার, আর? আর পৃথিবীর সেরা দার্শনিকদের একজন। আসলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু আমাদের দেশের নয়, এই পৃথিবীর অন্যতম সেরা মহা মানব। এশিয়ার প্রথম নোবেল পুরষ্কার প্রাপক রবি ঠাকুরের রচিত হাজার হাজার গান আমাদের প্রতিদিনের চলার পথের পাথেয়। আমাদের মন খারাপের সঙ্গী, আনন্দের সঙ্গী, হতাশার এমনকি একাকী জীবনের সঙ্গী।
তাঁর লেখা কবিতা, গল্প, নাটক এবং উপন্যাস যা পড়ে শেষ করা সম্ভব নয় এই একটা জীবনে। তাঁর অসামান্য সৃষ্টি “গীতাঞ্জলি”ই আমাদের প্রতিদিনের মন ভাল করার সম্পদ। শুধুমাত্র গীতাঞ্জলিই আমাদের জীবন বোধকে পাল্টে দিতে পারে নিমেষেই। গীতাঞ্জলির প্রতিটি শব্দের মধ্যেই আছে অদ্ভুত দর্শন। তাছাড়া উপনিষদের গভীর কথা যিনি সহজ করে বলে গিয়েছিলেন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। উপনিষদের গভীর উপলব্ধির বীজ তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল একদম ছোটবেলাতেই। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সন্তানদের প্রতিদিন উপনিষদের শ্লোক পড়াতেন, তর্জমা করে দিতেন। ছোট্ট রবীন্দ্রনাথের মনে তখন থেকেই এর অনুরণন ঘটতে শুরু করে। ঈশ্বর এবং তাঁর বিশালতার ব্যাপ্তি এবং অনুভূতির প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে যখন তিনি কৈশোরে তাঁর পিতার সঙ্গে হিমালয় ভ্রমণে যান।
রবীন্দ্রনাথের ৮০ বছরের পরিপূর্ণ জীবনে তাঁর মনন, চিন্তন এবং লেখায় যে আধ্যাত্মিকতার ভিত্তিভূমি, সেটি হল ভারতের প্রাচীনতম সনাতন ধর্মের সুপ্রাচীন শাস্ত্র উপনিষদ। তাঁর নিজের কথায় ‘আমার জীবনের মহামন্ত্র পেয়েছি উপনিষদ থেকে’। পরবর্তী কালে যা তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলির ছত্রে ছত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। কথায় বলে ‘ব্রাহ্ম জানাতি ব্রাহ্মণম’ অর্থাত যিনি নিজের ক্ষুদ্র সত্ত্বার মধ্যে ব্রহ্মহের বিশালত্বকে উপলব্ধি করেন তিনিই ব্রাহ্মণ। এই ব্রহ্মের উপলব্ধি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমস্ত জীবন ব্যাপি। তিনি সারাজীবন এই ব্রহ্মের অনুসন্ধান করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, উপনিষদের সব পুরুষ ঋষিদের জ্ঞানগম্ভীর বাণীর মধ্যে একটি নারীর ব্যাকুল বাণী ধ্বনি মন্ত্রিত হয়ে উঠেছে- যা কখনোই বিলীন হয়ে যায়নি, তিনি জানতেন “অসতে মা সদগময় তমসো মা জ্যোতির্গময় মৃত্যোর্মামৃতং গময়। অবিরাবীর্ম এধি রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম্”।
অর্থাত, হে সত্য, সমস্ত অসত্য হতে আমাকে তোমার মধ্যে নিয়ে যাও, হে প্রকাশ, তুমি একবার আমার হও, আমাতে তোমার প্রকাশ পূর্ণ হোক।
তাঁর সৃষ্টি, জীবনবোধ এবং সেই অনুযায়ী নিজের জীবনকে গড়ে তোলা সব কিছুতেই ছিল গভীর ঈশ্বরচিন্তা। প্রথম যে কাব্যগ্রন্থটিতে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরচিন্তার আভাস পাওয়া যায়, সেটি হল ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থ। ধীরে ধীরে তাঁর ঈশ্বরচিন্তার পরিপূর্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটে গীতিমালা, গীতালি ও ধর্মসংগীত প্রভৃতি কাব্য এবং গীতিসংকলনে। ব্রহ্মপনিসদ, ব্রহ্মমন্ত্র, উপনিষদ ব্রহ্ম, ভারতবর্ষ, মানুষের ধর্ম, ধর্মের অধিকার প্রভৃতি গদ্যগ্রন্থে বিকশিত হয়েছে তাঁর ঈশ্বরচিন্তা। তিনি বারবার বলেছেন ‘কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম আমার ধর্ম নয়। আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন, আমি পন্ডিতহারা, আমি তোমাদেরই লোক’। কোনও বিশেষ ধর্ম নয়, শান্তি, মৈত্রী, ব্রহ্মের কাছে নিজেকে বারবার সমর্পিত করতে চেয়েছেন। শুধু কাব্যগ্রন্থই নয় এই আকুলি দেখা গেছে তার গানেও।
‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার পরে’ গানের এই কথাগুলিতে আত্মসমর্পণের আকুতি ফুটে উঠেছে। শুধু এই গান নয় ব্রহ্মসঙ্গীত, প্রার্থনা সংগীতে বারেবারে তিনি ক্ষুদ্র আমিত্বকে বিশালত্বের কাছে বিলিয়ে দিতে চেয়েছেন। ঠাঁই চেয়েছেন ঈশ্বরের কাছে। তাঁর সৃষ্টির আধার ছিল উপনিষদ, পরম ব্রহ্ম, সত্যকে উপলব্ধি করা। উপনিষদের শিক্ষাকে তিনি অন্তরের অন্তঃস্থলে সত্যরূপে গ্রহণ করেছিলেন যা তাঁকে করে তুলেছিল ব্রহ্মপাসক। তিনি বলেছেন ‘উপনিষদ ভারতবর্ষের ব্রহ্ম জ্ঞানের বনস্পতি’। তাঁর এই ব্রহ্ম সাধনার মার্গ তাঁকে করে তুলেছে চিরকালীন। যা দেশ, কাল গন্ডির সীমানা ছাড়িয়ে তাকে দিয়েছে ঋষির মর্যাদা। করে তুলেছে অমরত্বের পথিক।
কবিগুরুকে নিয়ে লিখতে বসলে একের পর এক ভাবনাগুলো সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো এসে দোলা দিয়ে যায়। একটা ঢেউ সামলাতে না সামলাতেই আরো একটা ঢেউ এসে ধাক্কা মারে। ছোট থেকে মণিপুরী নৃত্যের সাথে যেহেতু জড়িয়ে আছি, তাই এই নৃত্য সম্পর্কেও আলাদা একটা কৌতুহল তো মনের মধ্যে কাজ করেই। বিশেষ করে মণিপুরী নৃত্য আর কবিগুরু কখনোই যখন অবিচ্ছেদ্য নয়, একবিন্দুতে যখন মিলেমিশে একাকার।
চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্য করতে গিয়েই অনুভব করেছিলাম সেই প্রভাব। মণিপুরের সঙ্গে কবির ভালোবাসার প্রতিটি অনুভব জড়িয়ে আছে এই চিত্রাঙ্গদায়।
মণিপুরী সংস্কৃতির সবচেয়ে সমৃদ্ধ শাখা মণিপুরী নৃত্য। মণিপুরী নৃত্যকলা তার কোমলতা, আঙ্গিক, রুচিশীল ভঙ্গিমা ও সৌন্দর্য দিয়ে জয় করেছে ভারতর্ষের অসংখ্য দর্শকের মন। শুধুমাত্র মণিপুরী জীবনধারা ও ধর্মাচরনের সাথে জড়িত এই নৃত্যকে বহির্বিশ্বে পরিচিত করিয়াছেন স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিগুরুর ভ্রমনের ইতিহাস থেকে জানতে পারি ১৯১৯ সালে তিনি সিলেট ভ্রমনে এলে ৬ই নভেম্বর সিলেট শহরের অদুরে মাছিমপুর পল্লীতে বেড়াতে আসেন। সেখানকার বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী মেয়েরা কবিগুরুকে অভ্যর্থনা জানান এবং পরে তাঁর সম্মানে কবির বাংলোতে মণিপুরী নৃত্যের আসর আয়োজন করা হয়। দুপুরে কবিগুরুকে ঐতিহ্যবাহী মণিপুরী গোষ্ঠলীলা এবং রাতে মণিপুরী রাসলীলা দেখানো হয়। কবিগুরু মণিপুরী নৃত্যের সজ্জা, সাবলীল ছন্দ ও সৌন্দর্যে বিমোহিত হন এবং শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েদের এই নৃত্য শেখাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী নৃত্যশিল্পী ইমাগো দেবী। ইমাগো দেবীকে কবিগুরু শান্তিনিকেতনে নিয়ে যেতে চাইলেও মণিপুরীদের কঠোর সামাজিক বিধিনিষেধের জন্য তা সম্ভব হয়নি।
কবিগুরুর আমন্ত্রনে প্রথমে মণিপুর থেকে তিনজন নৃত্যশিক্ষক শান্তিনিকেতনে আসেন, কিন্তু বাংলা জানা না থাকার কারণে তার ফিরে যান। এরপর ১৯২৬ সালে আগরতলা থেকে গুরু বুদ্ধিমন্ত সিংহ এবং ত্রিপুরা থেকে গুরু নবকুমার সিংহ শান্তিনিকেতনে যোগ দেন। প্রথমবারের মতো মনিপুরী নৃত্য ব্যবহার করে শান্তিনিকেতনে মঞ্চস্থ হয় “নটীর পুজা” ও “ঋতুরঙ্গ”। ২য় পর্য়ায়ে কবিগুরুর আমন্ত্রনে যোগ দেন সিলেটের কমলগঞ্জের বালিগাঁও গ্রামের বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী নৃত্যগুরু নীলেশ্বর মুখার্জ্জী। এরপর শান্তিনিকেতনে মণিপুরী নৃত্যের জন্য আলাদা শাখা গঠন করা হয়।
রবীন্দ্রসংগীতের গভীরতা ও কাব্যময়তার সাথে মণিপুরী নৃত্যের সাবলীল গতি ও বিশুদ্ধ নান্দনিকতার মধ্যে বিশেষ সামঞ্জস্য থাকায় শান্তিনিকেতনে উচ্চাঙ্গ নৃত্যধারার মধ্যে মণিপুরী নৃত্য সর্বাপেক্ষা সমাদৃত হয়। এরপর বাংলাদেশে এবং সারা ভারতে মণিপুরী নৃত্যের প্রচার ও প্রসার ঘটে। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ মণিপুরী গানের সুর ও তাল দিয়েও প্রভাবিত হয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের “শ্যামা” ও “চন্ডালিকা” ও নৃত্যনাট্যে আংশিক এবং “চিত্রাঙ্গদা” নৃত্যনাট্যে সম্পুর্ণভাবে মণিপুরী নৃত্যের সুর ও তাল অনুসরন করা হয়েছে। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক গানে মণিপুরী সুর ব্যবহৃত হয়েছে।
১৯৩৬ সালের মার্চের মাঝামাঝি গুরুদেব কলকাতায় চিত্রাঙ্গদা অনুষ্ঠান করান। চিত্রাঙ্গদার কবিতাকেই প্রথম দেওয়া হয়। এই কবিতার সাঙ্গীতিক আবেগ নাচের সম্পূর্ণ উপযােগী। কবিতার চিত্রাঙ্গদা যেন সংগীতের মধ্য দিয়ে রেশ পরিবর্তন করেছেন মাত্র তারই শৈর্যের নিছক রূপ জেগে উঠেছে তাল ও সুরের বিচিত্র ছন্দে। এখানে বিষয় গৃহীত হয়েছে পাহাড়ঘেরা সুন্দর মণিপুর রাজ্যের রাজকন্যাকে নিয়ে।
শিবের বরে মণিপুর রাজবংশে কোন পুত্রী জন্মাবে না, এই আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন মণিপুরের রাজা। কিন্তু তথাপি পুত্রী চিত্রাঙ্গদার জন্ম হয়। রাজা তাকে পুত্ররূপে বিভিন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত করেন। রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা যুদ্ধবিদ্যায় অত্যন্ত পারদর্শী হয়ে ওঠে। শৌর্যে-বীর্ষে যেকোনাে বীর্ষবানের সমকক্ষ হয়ে ওঠে। একদিন ব্রতচারী অর্জুন তার যাত্রাপথে শয়ন করায় সে তাকে সেখান থেকে সরানাের জন্য সখীদের আহ্বান করে। কিন্তু এই বীর্ষবর্তী নারীকে না চিনে অর্জুন তাকে বালক বলে অভিহিত করেন এবং নিজের পরিচয় দেন। চিত্রাঙ্গদা স্তম্ভিত হতচকিত হয়ে পড়ে। কারণ তার চির আকাঙ্খিত বীরপুরুষ তাকে যুদ্ধে আহ্বান না করে তাকে প্রত্যাখ্যান করলেন। এই মনােবেদনা কোথায় রাখবে পুরুষবেশী রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা। এতদিনে নারীর স্বভাব সুলভ মুগ্ধতায় বীর্যবান অর্জুনকে স্বামী রূপে কামনা করেছে। কিন্তু নারীর কমনীয় লাবণ্য হীনতায় চিত্রঙ্গদা নিজেকে অর্জুনের মনােহরনের যােগ্য করে তুলতে পারেননি।
চিত্রাঙ্গদা মদন দেবের দয়া প্রার্থী হন এবং এক বছরের জন্য রূপ-লাবণ্য কামনা করেন। মদনের বরে সে রূপলাবণ্যময়ী হয়ে ওঠে। তার রূপে মুগ্ধ হয়ে অর্জুন তাকে কামনা করেন। এইখানেই দেহজ রূপ আত্মজ রূপকে পরাভূত করে। বহিরঙ্গের কাছে অন্তরঙ্গতার হার হয়। কিন্তু তবু এটাই সব নয়। প্রেম লীলায় অন্য স্বাদ আছে, আছে ক্লান্তি। গ্রামবাসীদের কাছে তাদের অর্জুন জানতে পারেন তাদের রক্ষাকারী একজন নারী। তিনি চিত্রাঙ্গদা। সে সময় তিনি তীর্থ গেছেন। ঐ বীর রমনীর পরিচয় পাওয়ার জন্য অর্জুনের মন ব্যাকুল হয়ে পড়ে। অবশেষে প্রকৃত প্রেমের উন্মেষ ঘটে। চিত্রাঙ্গদা আসেন সমস্ত মিথ্যার আবরণ ভেদ করে। সত্য উদ্ঘাটিত হয়। বীরাঙ্গনাকে অর্জুন গ্রহন করেন তার সাথী হিসেবে। অবশেষে এখানে প্রেমের জয় হয়। বাইরের রূপ অন্তরের অরূপের কাছে নতি স্বীকার করে।
লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা মণিপুরী নৃত্যের বিশ্বময় প্রচার এবং মণিপুরী সংস্কৃতির পুনর্জাগরনে অসামান্য ভুমিকা রাখার জন্য মণিপুরীরা আজও কবিগুরুকে মণিপুরী নৃত্যের পথিকৃত হিসাবে বিবেচনা করেন। মণিপুরী নৃত্যগুরুরা গভীর শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারন করেন কবিগুরুর নাম। সম্মানিত করার জন্য কবিগুরুর লেখা গান মণিপুরী রাসলীলায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সিলেটের মাছিমপুরের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী পল্লীতে স্থাপন করা হয়েছে কবিগুরুর প্রতিকৃতি।
মণিজিঞ্জির সান্যাল: শিলিগুড়ি, দার্জিলিং
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ