ফরিদ আহমেদ : মানুষই একমাত্র প্রাণী যাদের প্রায় সবারই একটা করে নাম আছে। অন্য অনেক গৃহপালিত পশুরও নাম থাকে। কখনো কখনো চিড়িয়াখানাতে আবদ্ধ প্রাণীদেরও নামকরণ করা হয়। কিন্তু, এগুলো তাদের নিজেদের দেওয়া নয়। মানুষ তাদের সেই নাম দিয়ে থাকে। নিজের নাম দিয়ে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা শুধুমাত্র মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীর পক্ষেই করা সম্ভব হয় না।
আজ যেমন আমরা একজন আরেকজনকে নাম ধরে ডাকি, নাম দিয়ে পরিচয় করিয়ে দেই, এই প্রচলনটা আসলে ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে? প্রাচীন কালে, প্রাগৈতিহাসিক যুগেও কি সবার এমন করে একটা নাম ছিলো? একজন আরেকজনকে কি নাম ধরে ডাকতো তারা? নিজের নাম ডাকা হচ্ছে এমন শুনে সেই লোক কি প্রতি উত্তর দিতো? এর উত্তর আমরা জানি না। মানুষের লিখিত ইতিহাস জানার আগে, যা কিছু আমরা জানি সবই জানি তাদের ফেলে যাওয়া জিনিসপত্র, অস্ত্রশস্ত্র, কিংবা ফসিল থেকে। তাদের মুখ থেকে তাদের ইতিহাস জানার সুযোগ আমাদের হয়নি কখনো।
নাম থাকুক বা না থাকুক, মানুষ যে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সব সময়ই সচেতন ছিলো, তার প্রমাণ পাওয়া যায় গুহাবাসী মানুষের গুহার দেওয়ালে নিজের অস্তিত্ব জানিয়ে দেবার মধ্য দিয়ে। অসংখ্য গুহা পাওয়া গেছে যেখানে আদিম মানুষেরা নিজেদের হাতের ছাপ রেখে গেছে স্বেচ্ছায়, নিজেকে প্রকাশ করার অদম্য আগ্রহে। এই সব হাতের ছাপের মধ্যে রয়েছে পুরুষের হাত, নারীর হাত, কিশোরের হাত, কিশোরীর হাত, বাচ্চা-কাচ্চাদের হাত। এই হাতের ছাপগুলো সদম্ভে ঘোষণা করছে, এটাই আমি। তোমাদের মতো করে একদিন আমিও ছিলাম এই পৃথিবীতে। আমারও সুখ দুঃখের গল্প ছিলো, গল্প ছিলো প্রেম ও অ-প্রেমের, মিলন এবং বিচ্ছেদের। গল্প ছিলো পূর্ণিমা এবং আমাবস্যার, গল্প ছিলো প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তির, গল্প ছিলো আশা এবং হতাশার।
কিন্তু, এই সব গল্প আমাদের পক্ষে কোনোদিনই জানা সম্ভব হবে না। কারণ, তখনো লেখা আবিষ্কার হয়নি। লেখনীই কেবল পারে একজনের গল্প বহুকাল পরে আরেক প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে। এটা না থাকলে অনুমান করে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না সেই গল্প জানার।
শুধু গল্পই না, একজন মানুষের কী নাম ছিলো, সেটাও লেখনী আবিষ্কারের আগে আমাদের জানা ছিলো না। হয়তো লেখনী আবিষ্কারের অনেক আগে থেকেই মানুষ মানুষকে নাম ধরে ডাকতো, নবজাতক জন্মালে তার বাবা-মা কিংবা আত্মীয় স্বজনেরা তাকে একটা চমৎকার নাম দিতো। সেই নাম নিয়ে সে একদিন স্বতন্ত্র একজন মানুষে পরিণত হতো। কিংবা হয়তো নামের কোনো প্রয়োজনই ছিলো না। পৃথিবীতে আর কোনো প্রজাতির প্রাণীরা একে অন্যকে নাম ধরে ডাকে, কিংবা নাম দেয়, এমন কিছু জানা যায়নি। মানুষও হয়তো সেভাবেই চলেছে প্রকৃতিতে।
পৃথিবীতে কোনো একজন মানুষের নাম জানার প্রথম সুযোগ করে দিয়েছে লেখনী। লেখার আবিষ্কার হয়েছিলো এখন থেকে পাঁচ বা সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে। এখনকার ইরাক, সিরিয়া এবং ইরান নিয়ে যে এলাকা, সেই এলাকায় গড়ে উঠেছিলো এক প্রাচীন সভ্যতা। এই সভ্যতার নাম সুমেরিয়ান সভ্যতা। এই সভ্যতারই কোনো এক কিংবা একাধিক প্রতিভাবান ব্যক্তি আবিষ্কার করে বসে লেখনী। সেই লেখনী খুব সুসংহত কিছু ছিলো এমন না। এ দিয়ে মনের সব ভাব প্রকাশও করা সম্ভব ছিলো না। একজন কবির পক্ষে এই লেখনী দিয়ে তার কবিতার ভাব প্রকাশ করা সম্ভব ছিলো না। একজন রাজার পক্ষে সম্ভব ছিলো না তার রাজকার্য এই লেখনী দিয়ে লিপিবদ্ধ করা। একজন ইতিহাসবিদের পক্ষেও সম্ভব ছিলো না এই লেখনী দিয়ে ইতিহাস রচনা করে যাবার। তাহলে, কেন আবিষ্কার হলো এই লেখ্য ভাষার?
লেখ্য ভাষা আবিষ্কারের আগে, মানুষের মস্তিষ্কই মানুষের সব তথ্য সংরক্ষণ করতো। শিকারি-সংগ্রাহক যুগে মানুষ তার মাথার মধ্যেই এলাকার ম্যাপ বহন করতো। কোন গাছে পাকা ফল আছে, কোথায় গেলে পানি পাওয়া যাবে, এই এলাকায় বাঘ-ভাল্লুক আছে কিনা, নিজেদের গুহা ছেড়ে খাদ্য সংগ্রহের জন্য দূরে চলে গেলে ফিরে আসার উপায় কি, এগুলো সবই তারা নিজেদের মস্তিষ্কের কোষেই সংরক্ষণ করতো। শিকারি-সংগ্রাহক পর্যায় থেকে কৃষি ভিত্তিক সভ্যতায় যাবার পরে যে বিশাল তথ্যরাজি সংরক্ষণ করার প্রয়োজন পড়লো, সেটার জন্য মানব মস্তিষ্ক যথেষ্ট ছিলো না। সুমেরিয়ান সভ্যতায় মানুষ যেমন বৃদ্ধি পেয়েছিলো, তেমনি বৃদ্ধি পেয়েছিলো শস্যের ফলন এবং নগর এবং বন্দর। এই সভ্যতার সব কর্মকাণ্ডকে সুসমন্বয় করার জন্য যে বিশাল তথ্যের প্রয়োজন ছিলো। শুধুমাত্র মানব মস্তিষ্কের ভাণ্ডারে জমা রেখে এই বিশাল কর্মকাণ্ড চালানো সম্ভব ছিলো না। প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো বাইরেও তা সংরক্ষণের এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের। মানব মস্তিষ্ককে অতিক্রম করে বাইরে তথ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা থেকেই লেখনীর আবির্ভাব ঘটে।
শুরুতে লেখার জন্য কোনো কাগজ, কলম ছিলো না। লেখা হতো কাদামাটির ছাঁচের উপরে। কাঁচা মাটির ছাঁচের উপরে প্রথমে তথ্যগুলোকে খোদাই করা হতো, তারপর সেগুলোকে রোদে শুকিয়ে দীর্ঘদিন ব্যবহারের উপযোগী করা হতো। এগুলোকেই সংরক্ষণ করার মাধ্যমে তথ্য সংরক্ষণ করা হতো। প্রয়োজনে এই তথ্যকে সংরক্ষণাগর থেকে বের করে এনে তা বিশ্লেষণ করা হতো।
এরকমই কিছু কাদামাটির ছাঁচ আবিষ্কার করা হয়েছে বর্তমান ইরাক থেকে। ইউফ্রেতিস নদীর আশেপাশে অবস্থিত প্রাচীন শহর উরুখ থেকে। এদের বয়স পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি। এরকম একটা ছাঁচেই খোঁদাই করা রয়েছে মানুষের প্রথম জ্ঞাত নাম। এই নামটা হচ্ছে কুশিম।
যে ছাঁচটাকে কুশিমের নাম লেখা রয়েছে, সেটা মূলত শস্যের হিসাব রাখার ছাঁচ। খোঁদাই করা সেই ভাষাকে অনুবাদ করলে তা দাঁড়ায় এমন, ‘গত সাঁইত্রিশ মাসে ২৯,০৮৬ মাপের বার্লি গ্রহণ করা হয়েছে।’ এটাতে স্বাক্ষর করেছে কুশিম।
কুশিমের স্বাক্ষর করা মোট আঠারোটি ছাঁচ পাওয়া গিয়েছে এখান থেকে।
বিতর্ক হচ্ছে, কুশিম কি কারো নাম, নাকি কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা পদের নাম? এর উত্তর সঠিক উত্তর হচ্ছে, আমরা জানি না। প্রাচীন সুমেরিয়ান ভাষায় কু এবং শিম শব্দের আলাদা আলাদা অর্থ রয়েছে, কিন্তু, এই দুটো শব্দ যখন একত্রিত হয়, তখন এর আর কোনো অর্থ থাকে না। এ থেকে অনেকেই কুশিমকে পদের চাইতে নাম হিসাবেই ভাবতে বেশি পছন্দ করে।
কুশিম যদি সত্যি সত্যিই নাম হয়ে থাকে, তবে এটা বেশ আশ্চর্যজনকই বটে। ইতিহাসের প্রথম লিখিত প্রামাণ্য দলিলে কোনো রাজা-বাদশার নাম নেই, নেই কোনো অভিজাত ব্যক্তি কিংবা দার্শনিকের নাম। কোনো কবির নামও এখানে নেই। আছে সমাজের একেবারে সাধারণ স্তরে অবস্থানকারী একজন হিসাব রক্ষকের নাম। পৃথিবীর প্রথম লিখিত প্রামাণ্য দলিলে বিবৃত হয়নি কোনো রাজা-বাদশার ফরমান, লেখা হয়নি কোনো দার্শনিক চিন্তাধারা, প্রকাশ হয়নি বিখ্যাত কোনো কবির সুললিত রোম্যান্টিক কবিতা। একেবারেই অতি সাধারণ একটা অর্থনৈতিক দলিল এটা। নিত্য দিনের হিসাব-নিকাশ, কর এবং সম্পত্তির মালিকানার সংক্ষিপ্ত এবং প্রয়োজনীয় বিবরণ রয়েছে তাতে। আর তাতে স্বাক্ষর করে ইতিহাসের প্রথম জ্ঞাত নামের পরিচয় দিয়ে গেছেন সুমেরিয়ান সভ্যতায় বসবাস করা অতি সাধারণ এক ছা-পোষা হিসাবরক্ষক কুশিম।
কুশিম নামের সাথে কাশিম নামের বেশ মিল রয়েছে। সুমেরিয়ানদের সেই প্রাচীন ভাষা থেকে কুশিম বিবর্তিত হয়ে আরবিতে কাশিম হওয়াটা বিচিত্র কিছু না। এই নামের সাথে আমাদের কুসুম নামেরও যথেষ্ট মিল রয়েছে। কুশিম নামের লোকটা পুরুষ, নাকি নারী ছিলো, সেটাও আমরা জানি না। যদিও পুরুষ হবার সম্ভাবনাই বেশি। তারপরেও আমাদের দেশের হাজার হাজার কুসুমের কথা ভেবে আমরা না হয় কুশিমকে নারী হিসাবেই কল্পনা করে নিলাম।