অনলাইন ডেস্ক : গত শনিবার হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে আয়োজিত অনুষ্ঠান ছিল মহামারি পূর্ব সময়ের উল্লাসপূর্ণ ফ্ল্যাশব্যাক। যখন জনসমাবেশে জনস্বাস্থ্য নীতি আরোপের প্রয়োজন ছিল না কিন্তু জনগণকে মাস্ক পরা বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার আহ্বান জানানো হতো না।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প দেড় শতাধিক অতিথিকে অভ্যর্থনা জানান। সুপ্রিম কোর্টের জন্য তার মনোনীত বিচারক অ্যামি কনে ব্যারেটকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেন। উতাহ-এর মাইক লিসহ বেশ কয়েকজন রিপাবলিকান সিনেটর উপস্থিত ছিলেন। অতিথিদের সঙ্গে আলিঙ্গন ও তাদের সঙ্গে মিশে যান মাইক লি। একই কাজ করেন প্রেসিডেন্টের সিনিয়র উপদেষ্টা হতে সদ্য অপসারিত কেলিয়ানে কনওয়ে, ইউনিভার্সিটি অব নটর ডেম-এর প্রেসিডেন্ট জন আই. জেনকিন্স।

অনুষ্ঠানটি ছিল সাফল্যে ভরা। করোনাভাইরাস মহামারি থেকে জাতীয় আলোচনার মনোযোগ অন্যত্র সরাতে পেরেছিলেন ট্রাম্প। যে মহামারিতে যুক্তরাষ্ট্রেই মৃতের সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়ে গেছে এবং আরও বাড়ছে। এছাড়া এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে আরেকজন সম্ভাব্য রক্ষণশীল বিচারক মনোনীত হতে যাচ্ছিলেন, যা ট্রাম্পের জন্য সহায়ক।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ব্যক্তিরা অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, হোয়াইট হাউসের মতো নিরাপদ স্থানে সংক্রমণের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে না, বলছিলেন জেনকিন্স। কারণ অনুষ্ঠানে প্রবেশের আগে অতিথিদের পরীক্ষা করা হয়েছিল এবং তাদের ফল নেগেটিভ আসে। ফলে তাদেরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়, মুখ ঢাকা বা মাস্ক পরার প্রয়োজন নেই। মাস্ক না পরার মন্ত্র হোয়াইট হাউসের অভ্যন্তরেও কার্যকর হয়। মন্ত্রিসভার সদস্য, সিনেটর, ব্যারেটের পরিবারের সদস্য ও অন্যান্যরা হোয়াইট হাউসের অভ্যন্তরের অভ্যর্থনার কূটনৈতিক কক্ষ ও ক্যাবিনেট কক্ষে প্রায় গাদাগাদি করে ছিলেন।

পাঁচ দিন পর সংক্রমণ থেকে অদৃশ্যমানতা নৃশংসভাবে ফুটো হয়ে যায়। বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হোপ হিকস করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে রিপোর্ট আসে। বুধবার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মিনেসোটা সফরের সময় তার শরীরের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ ধরা পড়ে। শুক্রবার সকালে ট্রাম্প ঘোষণা দেন, তিনি ও ফার্স্ট লেডি করোনা পজিটিভ এবং হোয়াইট হাউসের বাসায় নিজেদের আইসোলেশনে রেখেছেন।

শুক্রবারেই লি, কনওয়ে ও জেনকিন্স ঘোষণা দেন তারাও করোনা পজিটিভ। অনুষ্ঠানে হাজির হওয়া সিনেটর টম টিলিস ও রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটির চেয়ারওম্যান রন্না ম্যাকড্যানিয়েলও করোনায় আক্রান্ত। ম্যাকড্যানিয়েল সম্প্রতি ট্রাম্পের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। এর মধ্যে গত সপ্তাহে একটি তহবিল সংগ্রহের অনুষ্ঠান ছিল। হোয়াইট হাউসের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া অন্তত তিনজন সাংবাদিক শুক্রবার করোনা পজিটিভ বলে খবর এসেছে। আর হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ মার্ক মিডোজ আশঙ্কা করছেন, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে আরও আক্রান্ত হতে পারেন।

শুক্রবার সন্ধ্যায় ট্রাম্পের অবস্থার অবনতি হয় বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি ভালো আছেন বলে জানানো হয়েছে। ট্রাম্পের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত দুই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্টের হালকা জ্বর, কাশি ও নাক বন্ধ হওয়ার মতো লক্ষণ দেখা দিয়েছে।

শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা ১৬ মিনিটে ট্রাম্পকে ওয়ার্টার রিড ন্যাশনাল মিলিটারি মেডিক্যাল সেন্টারে নেওয়া হয় চিকিৎসার জন্য। হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে এই পদক্ষেপকে সতর্কতামূলক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

ট্রাম্পের পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার ফলে তিনি ও তার টিম দ্রুত ওয়াল্টার রিড হাসপাতালে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নেন। জনসংযোগের কথা মাথায় রেখে ট্রাম্প নিজে হেঁটে মেরিন ওয়ান হেলিকপ্টারে চড়েন বলে জানিয়েছেন হোয়াইট হাউসের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক থাকা এক বহিরাগত উপদেষ্টা। তাদের আশঙ্কা, ট্রাম্পের অবস্থার আরও অবনতি হতে পারে যা প্রেসিডেন্টের স্বাস্থ্য ও রাজনৈতিক লক্ষ্যের জন্য অশনি সংকেত।

হোয়াইট হাউসে করোনার সংক্রমণ শুক্রবার ওয়াশিংটনে সতর্কতা বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনের মাত্র এক মাস আগে প্রেসিডেন্টের অসুস্থতায় তৈরি অনিশ্চয়তার কারণে। বয়স ৭৪ বছর এবং অতিরিক্তি কো-মরবিডিটিজ, স্থূলতা, উচ্চ কোলেস্টেরল, রক্তচাপ থাকার কারণে নেতিবাচক ফল আসার ঝুঁকি বেড়েছে ট্রাম্পের।

হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা আক্রান্তের সংস্পর্শে আসাদের চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে সংক্রমণের উৎস শনাক্তের চেষ্টা শুরু করেছেন। তবে প্রকাশ্যে রোজ গার্ডেনে ব্যারেটের মনোনয়ন ঘোষণার অনুষ্ঠান থেকেই সংক্রমণ ছড়িয়েছে কিনা তা জানা যায়নি।

তবু গত শনিবার রোজ গার্ডেনে ভাইরাসের প্রতি বেপরোয়া মনোভাব, দাম্ভিব আচরণ এবং বৃহস্পতিবার রাতে ক্ষতিকর জাগরণ শেক্সপিয়ারীয় ট্রাজেডির কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।

বুধবার হোপ হিকসের লক্ষণ ধরা পড়া থেকে শুক্রবার রাত ১টায় ট্রাম্পের সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়ার সময়কে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও অব্যবস্থাপনার একটি কেস স্টাডি হতে পারে এই সময়টুকু।

প্রশাসনের কর্মকর্তারা শুরুতে জনগণের সঙ্গে স্বচ্ছ ছিলেন না। এরপর থেকেই ট্রাম্পের অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানানো হয়নি। যদিও হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ সাংবাদিকদের শুক্রবার সকালে শুধু বলেছেন, ট্রাম্পের মৃদু লক্ষণ দেখা দিয়েছে। তবে লক্ষণগুলো কী কী তা জানাননি।

শুক্রবার সন্ধ্যায় হোয়াইট হাউসের চিকিৎসক শ্যেন কনলির বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে তিনি ট্রাম্পকে ‘ক্লান্ত কিন্তু প্রফুল্ল’ বলে উল্লেখ করেছেন। যদিও কনলি ট্রাম্পকে দেওয়া ওষুধের নাম জানিয়েছেন কিন্তু প্রেসিডেন্টের অবস্থা ও পদক্ষেপ সম্পর্কে বিস্তারিত জানাননি।

হোয়াইট হাউসের ওয়েস্ট উইংয়ের সংকীর্ণ করিডোরে কর্মীরা মাসের পর মাস মোটামুটি মাস্ক পরা ছাড়াই কাজ করেছেন। ভাইরাস থেকে তাদের অদৃশ্য থাকার মানসিকতা এখন আতঙ্কে গড়াচ্ছে। এক বহিরাগত উপদেষ্টা বলেন, তারা এখন কী করবে ভেবে পাচ্ছে না।

প্রথমত এখন তারা নিজেদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। যদি প্রেসিডেন্ট করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন তাহলে তারাও হবেন।

এরপরই তারা ভাবছেন এই সংক্রমনের রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে। কারণ ৩ নভেম্বরের নির্বাচন আর বেশি দূরে নয়। ওই বহিরাগত উপদেষ্টা বলেন, আমরা চাইনি করোনাভাইরাস নিয়ে কথা বলতে কিন্তু এখন আমরা তা-ই করছি। এই সংক্রমণ বলছে, ট্রাম্প দেশকে রক্ষা করতে পারবেন না। এমনকি তিনি নিজেকেও রক্ষা করতে পারেননি।

তৃতীয়ত তারা প্রেসিডেন্টের গুরুতর অসুস্থ হতে পারার বাস্তবতা বিবেচনা করছেন। শুক্রবার ট্রাম্প অস্বাভাবিকরকম নীরব ছিলেন। ক্যামেরার সামনে হাজির হননি, এমনকি ফক্স নিউজ চ্যানেলকে ফোনও করেননি; যেমনটি তিনি সচরাচর করে থাকেন।

শুক্রবার সকালে করোনা নেগেটিভ আসা ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ন্যাভাল ওবজারভেটরি থেকে দিনের বাকি সময় কাজ করেছেন। কিন্তু হোয়াইট হাউসের অন্য কর্মকর্তারা এমন সতর্কতা অবলম্বন করেননি।

দুই উপদেষ্টা মেয়ে ইভাঙ্কা ও জামাতা জ্যারেড কুশনার এই সপ্তাহে ট্রাম্প ও হোপ হিকসের সংস্পর্শে এসেছিলেন। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র ক্যালোনাইনা হার্লে জানিয়েছেন, তারা করোনা নেগেটিভ। তবে তারা স্বেচ্ছা বিচ্ছিন্ন থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিনা সম্পর্কে জানাতে অস্বীকৃতি জানান হার্লে। শুক্রবার হোয়াইট হাউসে কাজ করতে দেখা গেছে কুশনারকে।

ট্রাম্প ও হিকসের সঙ্গে নিয়মিত সংস্পর্শে এসেছেন হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ মিডোজ। শুক্রবার সকালে যখন সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন তখনও তিনি মাস্ক পরা ছিলেন না। কেন মাস্ক পরেননি জানতে চাইলে তিনি নিজের সমর্থনে বলেন, আমার অবশ্যই পরীক্ষা হয়েছে। আশা করি আমরা ছয় ফুট দূরে আছি।

ট্রাম্প কখন ও কীভাবে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু তার সফরসূচিতে গত কয়েক সপ্তাহে অনেক স্থান ছিল। রবি থেকে সোমবার তিনি পাঁচটি অঙ্গরাজ্য সফর করেছেন এবং শতাধিক মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন।

প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ মহলে প্রথম লক্ষণ দেখা যায় বুধবার মিনেসোটায়। সেখানে তিনি একটি তহবিল সংগ্রহের সমাবেশে হাজির হয়েছিলেন। অন্যান্য কর্মীদের তুলনায় ট্রাম্পের কাছাকাছি বেশি সময় থাকা হিক বুধবার সকালেও করোনা পরীক্ষা করান। ওই পরীক্ষায় নেগেটিভ ফল আসলেও মিনেসোটা সফরের সময় অসুস্থবোধ করতে থাকেন। এয়ার ফোর্স ওয়ানে থাকতেই তিনি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেন। তবে ওই বিমানযাত্রার অনেক সফর সঙ্গীই তার এই পদক্ষেপ সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। বৃহস্পতিবার সকালে তিনি আরেকবার করোনা পরীক্ষা করান এবং ফলাফল আসে পজিটিভ। সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট