সাজ্জাদ আলী : কাহিনী: এক
ঠেলেঠুলে বেঞ্চিতে বসেই আজাদের প্রথম কথা, তোদের কারো কাছে ম্যাচ আছে?
এতো একটা গাধা মার্কা প্রশ্ন! ম্যাচ থাকবে না কেন? সিগারেট ম্যাচ পকেটে থাকাটাই তো সাবালকত্বের প্রমাণ! সিগারেট টানায় আর এমন কী সুখ? আমরা যে “সিগারেট খাই” এটা শো-আপ করার মধ্যেই তো আসল আরাম। সার্টের বুক পকেটে বেনসনের সুদৃশ্য প্যাকেট। ভেতরে অবশ্য স্টার সিগারেট ভরা।

অ্যাই তুই ম্যাচ দিয়ে কী করবি? স্যার ক্লাস নিচ্ছে না? এখন সিগারেট ধরালে খবর আছে, এই বেঞ্চের সবকয়টারে ক্লাস থেকে বের করে দেবে, ওকে সতর্ক করলাম।
আরে সিগারেট না, অন্য কাজ আছে, ম্যাচটা দে, ফিসফিসিয়ে বলল আজাদ।
ক্লাসরুমের সামনের দুই সারি বেঞ্চে মেয়েরা বসেছে। ঠিক তার পেছনের বেঞ্চিতে গাদাগাদি করে আমরা বন্ধুরা আসন গেড়েছি। ইন্টারমিডিয়েট ফাস্ট ইয়ার। কেমিস্ট্রি ক্লাস চলছে। মাত্র ২০/২৫ জন স্টুডেন্ট আমরা। পেছনে অনেক বেঞ্চ ফাঁকা পড়ে আছে। তবুও মেয়েদের কাছে আমাদের ঘেঁষে বসা চাই!

আমরা বন্ধুরা সবাই পড়েছি মডেল বয়েজ স্কুলে। আর মেয়েরা সব গার্লস স্কুলে। বীনাপনি গার্লস স্কুলটি জেলখানার সমান উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। ছোট্ট মফস্বল শহরের সব দেবীরা ওই পাঁচিলে বন্দি। দুই স্কুলের মধ্যে ৮/১০ মিনিটের হাঁটা পথ। প্রতিদিনই টিফিন আওয়ারে গার্লস স্কুলের মোড়ে আমাদের জটলা। কোনো দেবী যদি গেটের কাছে ফজরের দোকানে চানাচুর কিনতে আসে! কারো সাথে যদি একটিবার চোখাচখি হয়! ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষার প্রহর গুনি। বিকালে দলবেঁধে থানাপাড়া থেকে ব্যাংকপাড়া অব্দি হেঁটে ফিরি। ওই দেবীদের বাসার সামনের রাস্তা দিয়েই আমাদের হাঁটার রুট। কিন্তু ওই হাঁটাহাঁটিই সার, দেবীদর্শন আর হয় না। উল্টো স্যান্ডেলের তলা ক্ষয়। রক্ষণশীল ছোট্ট মহাকুমা শহর আমাদের। আর সেই শহরটির দেবীবিহীন দেবতা আমরা।

কলেজে উঠে কপাল গেল খুলে। দেয়াল ঘেরা সেই সুন্দরীদের এখন কাছে থেকে দেখতে পাই। দেবীরা বসে সামনের বেঞ্চিতে, আর দেবতারা ঠিক তাদের পেছনে। কত কাছাকাছি আমরা, মাত্র দ’ফুটের ব্যবধান। মাথা ঘুরে যাবার জোগাড়! অনেকটা “কাকে রেখে কাকে দেখি” অবস্থা! আমাদের ছোট্ট শহরে সবাই সবাইকে চেনে। কার বাসা কোনটা, কে কার মেয়ে, এই মাত্র যারা রিক্সায় চড়ে সামনে দিয়ে গেল তারা কী স্বামী-স্ত্রী, নাকি শালি-দুলাভাই, এ সব খবর তখন শহরের সবাই জানতো।

৮/১০ জনের একটি দল আছে আমাদের। একেবারে রশুনের মতো। কোয়া আলাদা হলেও পাছা এক। বন্ধুদের মধ্যে আজাদই সব থেকে সুদর্শন। ‘চমক দেওয়া’ টাইপের স্বভাব ওর। হাসবে, হাসাবে, সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখবে সবাইকে। বন্ধুদের কারো কোনো আনন্দ, যেন ওর একার সম্পত্তি। আর বেদনাটুকুও ওরই দায়। বড়বাড়ির ছোট ছেলে সে। ওর বাপ দাদার নামে এক সময়ে ওদের অঞ্চলের বাঘে মহিষে একঘাটে জল খেতো। বংশধারার ঐতিহ্য ওর আচরণে স্পষ্ট হলেও গাম্ভীর্যটুকু অনুপস্থিত। বন্ধুরা যে যত সংকটেই পড়–ক না কেন, আজাদ এসে পড়লে সব মুশকিল আসান।

তো বলছিলাম ম্যাচ বাক্সের কথা। আজাদের ঠিক সামনে সেদিন দেবীশ্রেষ্ঠা বসেছে। রূপে সে দুর্গা, গুণে সরস্বতী। ক্লাসের মধ্যে সম্ভবত সেই সব থেকে মেধাবী। নৃত্য পটিয়সী সে, অতুলন তার নাচের মুদ্রা। সেদিন সে চুল বাধেনি। খোলা চুলে পিঠ ঢাকা। তার স্নিগ্ধ রূপের ছটা যেন শ্রেণীকক্ষের দেয়ালে আছড়ে পড়ছে। বঙ্গবন্ধু কলেজের উঠতি যুবা-ছাত্রদের “এক নম্বর পছন্দ” সে। তবে দেবী কাউকে কখনও “পাত্তা দিয়েছে” এমন অপবাদ বাজারে নেই। হাই বেঞ্চিতে বসা আমরা। সবার সামনেই খাতা কলম খোলা। দরকার মতো নোট টুকে নিচ্ছি। সহপাঠিনীরা কেউ কেউ আমাদের বেঞ্চিতে পিঠ ঠেকিয়ে বসেছে।

অন্য কোনো উদ্দেশ্য না, শুধুমাত্র বন্ধুদের চমক দেয়ার জন্যই আজাদ কাজটি করেছিলো। ম্যাচ থেকে একটি কাঠি বের করে ঘষা দিয়ে জ্বালালো। জলন্ত কাঠিটি আধামুহুর্ত ধরে রেখে আগুনের শিখাকে স্থির করলো। তারপর খুব দ্রুততার সাথে দেবীশ্রেষ্ঠার চুলের সাথে মেশালো সে আগুন। তেল লাগানো আলগা চুল তার পিঠ জুড়ে। সাথে সাথেই ফর ফর শব্দে ৫/১০টা চুলের আগা পুড়ে গেল। মুহুর্ত দেরি না করে আজাদ হাত দিয়ে চেপে ধরে আগুন নিবিয়ে ফেলল। পুরা ঘটনাটা ঘটতে ৪/৫ সেকেন্ড মাত্র সময় নিলো। চুল পোড়া গন্ধে সারা ক্লাশ ময়ময়। শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী সবার প্রশ্ন, পোড়া গন্ধ আসছে কোথা থেকে? তখনও ক্লাশের কেউই ঘটনা বুঝে উঠেনি। এমন কী যার চুল পুড়েছে সেও না। তবে আমাদের বেঞ্চির পান্ডারা সবাই ঘটনা দেখে চমকিত!

কী যে হুলুস্থুল হয়েছিলো তা নিয়ে! ঘটনাটি শুধু “চমকে” সীমাবদ্ধ থাকেনি। ছোট্ট শহরের “টক অব দ্যা টাউন” ছিলো বহু বহু দিন। বঙ্গবন্ধু কলেজের ডিসিপ্লিনারী কমিটি আজাদকে বহিস্কারের উদ্যোগ নিলো। কিন্তু সাক্ষীর অভাবে পেরে উঠল না। কারণ প্রত্যক্ষদর্শীরা সব ক’জনই অভিযুক্তের আপনার লোক!

কাহিনী: দুই
বিরাট টেনশনে আছি। এইমাত্র প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট সাইফুল ভাই রতœা আর আমার বিয়ে রেজিষ্ট্রি করে দিয়েছেন। কনে বিয়েতে রাজি কিনা, মেজিস্ট্রেট বাহাদুরের তা নিয়ে বিশেষ উদ্বেগ নেই। তার দুশ্চিন্তা আম্মাকে আমি সামাল দিতে পারবো কিনা। আজাদ আর এসকেন আমাদের বাসায় আগেই পৌঁছে গেছে। আম্মাকে রাজি করানোর দায়িত্ব ওদের। ওরা অবশ্য আমাকে ভরসা দিয়ে বলেছে যে চাচীআম্মকে নিয়ে ভাবিস না। দরকার লাগলে বাকি জীবন ওনার পা ধরে ঝুলে থাকবো। তুই বিয়া রেজিস্ট্রি করে বউ নিয়ে সোজা বাসায় চলে আয়।

দুই টাকা রিক্সা ভাড়া, তাও তো তখন পকেটে নাই। আজাদ দৌঁড়ে এসে ভাড়া মিটালো। ঘটনার আকস্মিকতায় রতœা বেচারি জড়সড় হয়ে আছে। উৎকন্ঠা চাপতে না পেরে আজাদকে বললাম, আম্মা কী রাজি হইছে? খুব ক্ষেপে গেছেন তাই না রে? এসকেন খিস্তি করে বলল, বউ নিয়া কী রাস্তায় দাঁড়ায়ে থাকবি নাকি? বাসায় ঢোক আগে, একটা কিছু ব্যবস্থা হবে।

তাই তো, রত্না তো এখন বৌ! আমার বোন পাঁচটি তো বেজায় খুশি। এতদিনে তাদের ভাই একটা কাজের মতো কাজ করেছে! মফস্বল শহরে এমন ঘটনা তো সচরাচর ঘটে না! আশেপাশের বাসার মহিলারাও ততক্ষণে আমাদের বাসায় এসে পড়েছে। জনাকীর্ণ বসার ঘর। ঘরের মাঝখানে আজাদ একখানা চেয়ার পাতিয়ে রত্নাকে বসতে বলল। ক্লান্ত রত্না নিশ্চিন্তে চেয়ারখানায় বসে পড়লো। কিন্তু বসবে কী ভাবে? চেয়ার তো আর সেখানে নেই! আজাদ একটানে পেছন থেকে তা সরিয়ে নিয়েছে! রত্না বেচারি ঝোঁক সামলাতে পারলো না। চিৎপটাং হয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পড়লো! নতুন বউ ভ‚মিতে গড়াগড়ি যায়! লজ্জার কী আর সীমা আছে? ভাগ্য ভাল রত্নার হাড়গোড় ভাঙ্গেনি, খুব একটা ব্যাথাও পায়নি। তবে আজ তিনযুগ পরে সেই ঘটনা মনে পড়লে রত্নার নাকি মাজাটা একটু একটু ব্যাথা করে ওঠে!

কাহিনী: তিন
শামছু কাকার বাসার উল্টো দিকে আমাদের বাসা। তিনি ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এবং বনেদি মানুষ। পোষ্ট অফিসের মোড়ে সুনীল কাকুর মিষ্টির দোকান। বিকালের দিকটায় প্রায়ই শামছু কাকা দোকানের সামনে চেয়ার পেতে বসেন। এই সময়টায় আমরা বন্ধুরা ওই দোকান থেকে চা-মিষ্টি যাই খাই সব ফ্রী। কাকাই সে সব বিল পরিশোধ করেন। তাঁর অবিবাহিতা পাঁচটি মেয়ে। ওদের মধ্যে কল্পনা সবার বড়, আর ছোটটি মিতা। সবাই ডাকসাইটে সুন্দরী। স্কুল কলেজে পড়–য়া সব। আমার পাঁচ বোনের কারো না কারো ক্লাসমেট ওরা। দু বাসার মধ্যে অবাধ যাতায়াত।

উড়ো উড়ো খবর শুনলাম শামছু কাকার মেয়ের সাথে আজাদের প্রেম চলছে। ওকে পাকড়াও করে জিজ্ঞাসা করলাম, কিরে লুচ্চা শুনলাম কল্পনাগো বাসার সামনে দিয়া ঘুরাঘুরি করিস?
কিডা কইল তোরে? যত্তসব গুজব, আজাদের সাফ অস্বীকার।
দেখরে আজাইদ্যা, আমাগো সামনাসামনি বাসা। ঘটনা তুই বেশি দিন আড়ালে রাখতি পারবি না, বললাম আমি।
আরে তেমন কিছু না। কিছু হইলে তোরা তো জানবিই। তগো না জানাইয়া কিছু করবো নাকি?
আচ্ছা আইজ তাইলে খালি এইটুকু ক’, কল্পনার পিছে ঘুরতিছিস তো, নাকি তার ছোট বোনরা কেউ, জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

আজাদ শুধু মুচকি হাসলো। মুখ ফুটে কিছু বলল না। এরপরে দিন যায়, মাস যায়, বছর গড়ায়। আমাদের রাস্তায় আজাদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। শামছু কাকার বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে কল্পনা আর আজাদকে কথা বলতে দেখা যায়। তবুও আমরা শতভাগ নিশ্চিত না যে কার সাথে ওর খাতির? আমাদের নায়কদর্শন আজাদ ও বাড়ির যে কোন মেয়ের জন্যই উপযুক্ত। তো একদিন পোষ্ট অফিসের বারান্দায় বসে বন্ধুরা মিলে সিগারেট ফুকছি। খবর এলো আজাদ আর কল্পনাকে এক রিক্সায় দেখা গেছে। যা বুঝার বুঝে নিলাম। এতদিন আজাদ যা গোপন রেখেছিল, আজ তা ফাঁস হলো।

এর বছরখানেক বাদে একদিন বিকালে আজাদের বিশ্বস্ত রিক্সাওয়ালা ছেলেটা এসে হাজির। বলে ভাই রিক্সায় ওঠেন তাড়াতাড়ি। আজাদ দাদা যাইতে কইছে, ব্যপার নাকি জরুরী। আমি পৌঁছানোর আগেই দলের কয়েকজন এসে পড়েছে। একজন বলল, ঘটনা জটিল আইজ রাইতেই আজাদের বিয়া।

আজাদ বেশ উদ্বিগ্ন! ওর ভেতরের ছটফটানি বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না। বলল, বাসায় কাউরে কিছু কই নাই। তোরা ক’জনই বরযাত্রী। দুইজন আমার সাথে ভিতরে যাবি। বাকিরা গেটে পাহারায় থাকবি। খালি লক্ষ রাখবি ভাবি আইসা পড়ে কিনা। তিনি আইলে আর আমারে বিয়া করতে দেবে না।

উদ্বেগ আজাদের একার না। সবাই দোটানায় পড়ে গেলাম। আমরা তো এখনও ছোট। আজাদের তো বিয়ার বয়স হয় নাই। প্রেম পিরিতি পর্যন্ত ঠিক আছে। তাই বলে একেবারে বিয়ের পিঁড়ি? পাড়ার বড় ভাইরা এখনও তো বিয়ের নাম নেয় নাই। লোকে তো আজাদরে “বিয়ে পাগলা” বলবে। আবার আরেক দিক থেকে মনে মনে খুশি। ভাবলাম, আজাদ বিয়া করতে পারলে তো আমরাও পারি। জীবনে প্রেম আসতে কতক্ষণ? বাসায় তখন বলা যাবে, কেন আমাদের আজাদ বিয়ে করছে না?

বিয়ের সেই রাতে শামছু কাকার বাড়ির গেটে বন্ধুরা সব জটলা করছি। আলোচনার বিষয় আজাদ আর কল্পনার বাসরসজ্জা। ওরা কী বলবে, কী করবে তাই নিয়ে রসালো সব অগ্রিম কথা। এমন সময় ম্যারেজ রেজিস্টার রিক্সা থেকে নামলো। ভাড়া চুকিয়ে তাকে নিয়ে বাসার ভেতরে বসালাম। কাউকেই বলা হয়নি, বর বা কনে পক্ষের তেমন কেউই উপস্থিত নেই। লম্বা ঘোমটা টেনে খাটের উপরে কনে বসা। তার পাশেই আমাদের রাজপুত্র। ম্যারেজ রেজিস্টারের আহবানে আজাদ “কবুল” বলল। আর কন্যা মাথা ঝেঁকে “কবুল” বলতে যেয়ে ঘোমটা গেল সরে। ওমা একি? বিয়ের কনে তো কল্পনা না! এতো তার ছোটবোন বিউটি “কবুল” বলছে!

পাদটিকা : ওরা এখন বেলজিয়ামের নাগরিক। দুজনে খাঁটাখাঁটুনি করে টাকার পাহাড় জমিয়েছে। আজাদকে বড়ই সুখে রেখেছে বিউটি। করোনা প্যানডামিকের আগে ওরা টরন্টোতে এসেছিলো। সে ক’টা দিন ভারি আনন্দে কাটিয়েছিলাম। তবে বড্ড ভয়ে ভয়েও ছিলাম! বলা তো যায় না, আজাদটা কখন কী কাহিনীর জন্ম দেয়!
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)