ভজন সরকার : অকালেই চলে গেলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ ২০১৩ সালের মে মাসের ৩০ তারিখে না-ফেরার দেশে। ক্রমশঃ দীর্ঘমান আয়ুষ্কালের এ সময়ে মাত্র ৪৯ বৎসর বয়সে মৃত্যু বরণ করা তো অকালেই চলে যাওয়া, নয় কি? তদুপরি সে চলে যাওয়া যদি হয় ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো এক প্রতিভাধর পরিচালকের, যাঁকে ইতিমধ্যেই চলচিত্রবোদ্ধারা সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন কিংবা ঋত্তিক ঘটকের সমান উচ্চতায় স্থান দিয়েছিলেন।

পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের চলচিত্রের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ‘উনিশে এপ্রিল (১৯৯৪)’ দেখার মাধ্যমে; যদিও তাঁর প্রথম চলচিত্র ‘হীরের আংটি (১৯৯২)’ ততদিনে বেরিয়েছে এবং সমাদৃত ও প্রশংসিতও হয়েছে। ‘উনিশে এপ্রিল’ দেখার পর এক ভালোলাগার আবহে কেটে গেছে অনেক অনেক সন্ধ্যা। প্রায় দুই যুগ পরেও সে আবেশ কাটেনি, এখনও সময় পেলেই ডিভিডি চালিয়ে দেই কোন অলস দিনে কিংবা নির্ঘুম মধ্যরাতে। দেখি কিভাবে ঋতুপর্ণ ঘোষ মাত্র দু’রুমের এক বাড়িতে সম্পূর্ণ চলচিত্রের কাহিনীকে ধারণ ও চিত্রায়ণ করেছেন? দেখি খ্যাতির শিখরে অধিষ্ঠিতা এক মা ও তার আধুনিকা মেয়ের পারস্পারিক টানাপোড়েন দেখাতে গিয়ে মাতৃত্ব, শিল্প ও জীবনবোধের যুগযন্ত্রণাকে ঋতুপর্ণ ঘোষ কিভাবে ঘন্টা দুয়েকের সেলুয়লয়েডে ফুটিয়ে তুলেছেন?

ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রতি সেই যে মুগ্ধতার শুরু, তা অন্তহীনভাবে চলছে যেন আজও। প্রতিভাবান কোন মানুষের প্রতি মুগ্ধতা যেন এক ধরণের অবুঝ আনুগত্যও। তাই তো কোন এক আড্ডায় যখন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ তাঁর চিরাচরিত উন্নাসিকতায় ঋতুপর্ণ ঘোষকে সমালোচনায় বিদ্ধ করেন; তারপর থেকে ঋতুপর্ণের প্রতি আকর্ষণ যেন আরো বেড়ে যায়।
সে সময় ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালক হিসেবে ততটা সুখ্যাতি অর্জন করেননি, যতটা না একজন বিজ্ঞাপন লেখিয়ে হিসেবে বোদ্ধামহলে নজর কেড়েছেন এবং সেই সাথে বিখ্যাত মানুষদের নিয়ে বিভিন্ন টিভি-চ্যানেলে সাক্ষাতকারমূলক অনুষ্ঠান উপস্থাপনাতেও খানিকটা সুনাম কুড়াচ্ছেন। একবার সে সূত্র-ধরেই তিনি কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদকে বোধহয় অনুরোধ করেছিলেন একটি টিভি সাক্ষাতকার দেবার জন্য। কলকাতার কথকতার প্রচলিত নিয়েমেই ঋতুপর্ণ ঘোষ অনেক বিখ্যাত সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের “তুমি’ বলে সম্বোধন করতেন এবং তাঁরাও ঋতুপর্ণকে কেউ “তুই”, কেউ “তুমি’ বলতেন। আমাদের বাংলাদেশের অনেকের কাছে এটা খটকা লাগাই স্বাভাবিক, যদিও ওপার বাংলার মানুষেরা এ ধরণের সম্বোধনে ছোটবেলা থেকেই অভ্যস্ত।

যা হোক, ঋতুপর্ণ ঘোষ কলকাতা থেকে হুমায়ুন আজাদ স্যারকে ঢাকার আরেক বন্ধুর মাধ্যমে সাক্ষাতকার দেয়ার অনুরোধ করেন। পূর্বাপর না ভেবেই হুমায়ুন আজাদ স্যার নাকি ব’লে দিয়েছিলেন যে, “এ ছোকড়া একটা বেয়াদব”, তাই তিনি সাক্ষাতকার দেবেন না। এখানে “নাকি” বললাম এ জন্য যে, যেহেতু সে সাক্ষাতকারটি আর নেয়া হয়নি এবং ঋতুপর্ণ ঘোষ কিংবা তাঁর ঢাকার সে বন্ধুর কাছে থেকেও এ বিষয়ে জানা যায়নি, তাই হুমায়ুন আজাদ স্যারের মুখের কথার ভিত্তিতেই নির্ভর করে এর সত্যাসত্য।

সোহরোওয়ার্দি উদ্যানের সে আড্ডায় হুমায়ন আজাদ স্যার যখন এ কথাগুলো বলছিলেন, তাঁর কিছুদিন পরেই ঋতুপর্ণ ঘোষের সাথে বাংলা সাহিত্যের আরেক প্রবাদপুরুষ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি সাক্ষাতকার শুনছিলাম। আর মুগ্ধ হচ্ছিলাম বাংলা সাহিত্যে বিশেষত রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রতি ঋতুপর্ণের অগাধ পড়াশুনা দেখে। সেই সাথে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রতি ঋতুপর্ণের শ্রদ্ধা ও বিনয়ের অভিপ্রকাশ দেখেও; হুমায়ুন আজাদ স্যারের উন্নাসিকতায় বেশ বিরক্তই হয়েছিলাম সেদিন।

কিন্তু ঋতুপর্ণ ঘোষের চলচিত্রের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ যেন আরও বেড়ে গেল যখন দেখলাম ‘দহন (১৯৯৭)’ সিনেমাটি। আমাদের সমাজের নিত্যদিনের ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা বা দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত এটি। একটি সদ্যবিবাহিতা মেয়ে স্বামীর সাথে কেনাকাটা শেষে বাড়িতে ফেরার পথে কিছু বখাটে ছেলের উশৃংখল আচরণের প্রতিবাদ করে শারীরিকভাবে নিগৃহিতা হোন। আশপাশের অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে দেখলেও মেয়েটিকে রক্ষা করতে কেউ এগিয়ে আসে না। একটি অফিস ফেরত মেয়ে অটোরিক্সা থেকে নেমে এসে মেয়েটিকে তুলে নেয়া থেকে রক্ষা করেন। কাহিনীটির শুরু এরকমই। তারপর চলে মেয়ে দু’টির পরিবারে এ নিয়ে অশান্তি। অকুতোভয় মেয়েটি থানায় মামলা ক’রে বখাটে ছেলেগুলোকে সনাক্ত করেন কিন্তু নিগৃহিতা মেয়েটি সমাজ ও পরিবারে চাপে আদালতে মিথ্যে বলে এড়িয়ে যায় যে, সে অন্ধকারে ছেলেগুলোকে চিনতে পারেনি। এই হলো চলচিত্রটির মোদ্দা কাহিনী। অথচ পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁর অসাধারণ পরিচালনা নৈপুণ্যে চলচিত্রটিকে এক অসাধারণ দ্যোতনায় দর্শকের কাছে উপস্থাপনা করেছেন বাণিজ্যিক ছবির “হল্লামার্কা” কলাকুশলীদের মাধ্যমেই। একজন অতি উঁচু মানের পরিচালকের বৈশিষ্ট্যই বোধহয় এটা যে, অভিনয়কে কলাকুশলীদের ভেতর থেকে নিংড়ে বের করে আনেন।

একটি কথা এখানে না বললেই নয়, সত্যজিত রায়ের প্রয়াণের পর যখন বাংলা-সিনেমার শুদ্ধধারার পরিচালকের আকাল চলছিল; বিশেষত আধুনিক সময়কে ধারণ করার ক্ষেত্রে; তখন ঋতুপর্ণ ঘোষের কল্যাণেই বোধহয় তরুন দর্শকেরা আবার চলচিত্রের দিকে মুখ ফিরিয়ে আনেন। ওপার বাংলার গৌতম ঘোষ, অপর্ণা সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তসহ আরও অনেক বিখ্যাত পরিচালকেরা যখন কিছুটা আটপৌরে এবং একই বৃত্তের ভেতর ঘুরপাঁক খাচ্ছেন, ঋতুপর্ণ ঘোষের আবির্ভাব এক ধূমকেতুর মতোই মনে হয়েছিল তখন।

এক্ষেত্রে ঋতুপর্ণ ঘোষের শুধু বাংলা-সিনেমাগুলোর তালিকা এবং দর্শকপ্রিয়তার পারদমাত্রার হিসেব দিলেই সেটা স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। শুধু সংখ্যা নয়, বিষয় নির্বাচনের বৈচিত্রে প্রতিটি চলচিত্র যেন এক একটি মাইলফলক। ‘হীরের আংটি (১৯৯২)’, ‘উনিশে এপ্রিল (১৯৯৪)’, ‘দহন (১৯৯৭)’-এর পর নির্মাণ করেন, ‘বাড়িওয়ালি (১৯৯৯)’, ‘অসুখ (২০০০)’, ‘তিতলি (২০০২)’, ‘শুভমহরত (২০০৩’, ‘চোখেরবালি (২০০৩)’, ‘অন্তরমহল (২০০৪)’, ‘দোসর (২০০৬)’, ‘খেলা (২০০৮)’, ‘সব চরিত্র কাল্পনিক (২০০৮)’, ‘আবহমান (২০১০)’, ‘নৌকাডুবি (২০১০)’ এবং ‘চিত্রাঙ্গদা (২০১২)’।

এতো শুধু মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা চলচিত্রের তালিকা। সর্বভারতীয় হিন্দি-সিনেমার ক্ষেত্রেও তাঁর ঈর্ষণীয় পরিচালনা-শক্তির প্রমাণ মেলে প্রথম হিন্দি চলচিত্র ‘রেইনকোট (২০০৪)’ কিংবা ‘সানগ্লাস (২০১২)’; এমনকি ইংরেজি ভাষায় নির্মিত ‘দ্য লাস্ট লিয়ার (২০০৭)’ সিনেমাটিতেও। অসমাপ্ত চলচিত্র ‘সত্যন্বেষী’ নির্মাণেও ঋতুপর্ণ ঘোষ রেখে গেছেন এক দূরদর্শীতার ছাপ। নিছক বিজ্ঞাপন লেখার মাধ্যমে সৃজনশীলতার জগতে প্রবেশ করে পরবর্তীতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সৃষ্টিশীলতার এক মহিরুহ। মাত্র দু’দশকেই সংখ্যাকে ছাপিয়ে- ছাড়িয়ে গেছে প্রতিটি চলচিত্রের চিত্রনাট্য রচনা, দৃশ্য নির্মাণ, সংলাপ রচনা, এমনকি বিষয় নির্বাচনও; তাই তো পুরষ্কার প্রাপ্তির তালিকা তাঁর নির্মিত চলচিত্রের চেয়েও খানিকটা দীর্ঘ। সত্যজিত রায়ের পর ঋতুপর্ণ ঘোষই বোধ হয় চলচিত্রে সংগীত বিশেষত রবীন্দ্রনাথের গানকে এমন সুনিপুন দক্ষতার সাথে ব্যবহার করেছেন। তাছাড়া কবি ও কবিতাকে, বিশেষত কবি জয় গোস্বামী ও তাঁর কয়েকটি কবিতাকে ঋতুপর্ণ ঘোষ এক প্রবাদপ্রতিম প্রচারের আলোতে পৌঁছে দিয়ে গেছেন। তাই ‘সব চরিত্র কাল্পনিক (২০০৮)’-এ দেশবিভাগের যন্ত্রণাবিদ্ধ ‘প্রিয়বালা’ কিংবা “হ্রদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে” কবিতা দু’টির ব্যবহার যেন অন্য এক ঋতুপর্ণ ঘোষকেই চিনিয়ে দেয়।

সমকামীদের নিয়ে তৈরী ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ চলচিত্রে অভিনয়ের পর থেকেই সাজ-সজ্জা ও পরিধেয় পোশাকেও পরিবর্তন এনেছিলেন ঋতুপর্ণ। নিজের শরীরের ওপর নানা পরীক্ষা নিরিক্ষাও করছিলেন লিঙ্গান্তরিত করার অভিপ্রায়ে। সে থেকেই বিপত্তির শুরু। তারপর একদিন যেন মৃত্যুই তাঁকে পরাজিত করল । নাকি, ঋতুপর্ণ ঘোষ মৃত্যুর কাছে নিজেই স্বেচ্ছা-পরাজয় মেনে নিলেন? যেটাই হোক, আরেকজন প্রতিভাধর বাঙালির মৃত্যু যেন প্রতিভার ক্ষয়িষ্ণু বামন-সময়ে গোটা বাঙালি জাতির এক অপূরনীয় ক্ষতি। ঋতুপর্ণ ঘোষের স্মৃতির প্রতি আমার আবারো অশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা। )