নাদিরা তাবাসসুম : সেদিন মেয়ে রেশাকে স্কুল থেকে আনতে গিয়েছিল মিনারা। বাসায় ফেরার পথে দেখতে পায় তিন চারজন ছেলেমেয়ে হাতে হাত ধরে হাঁটছে আর হৈ চৈ করছে। পাশ দিয়ে যেতে বুঝতে পারে ওদের মধ্যে পাশের বাড়ির বিলাল সাহেবের ছেলে এবং রিমা ভাবীর মেয়েরাও রয়েছে। তারা দেখেও না দেখার ভংগীতে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। মিনারাও না দেখার ভাব করে মেয়েকে নিয়ে সোজা বাসায় ফিরে আসে। রেশা হঠাত বলে- মা তুমি কি ওদের চিনতে পারনি? ওরা তো আমাদের প্রতিবেশী।
মিনারা- চিনে আর কি হবে
রেশা- তুমি তো জাননা যে, আমাদের ক্লাশের ছেলেমেয়েরাও এরকম একসাথে হৈ চৈ করে। আমি যাইনা দেখে আমাকে নিয়ে ওরা হাসাহাসি করে। আমার কোন বয়ফ্রেন্ড নেই, এ নিয়ে অনেক কথা শোনায়।
মিনারা- এজন্যেই বুঝি বেশির ভাগ সময় আজকাল মন খারাপ করে রাখ। কিন্তু তোমার মতো অনেকেই আছে যাদের কোন বয়ফ্রেন্ড নেই এবং যারা ওরকম হৈ চৈ করতে যায় না।
রেশা- খুব কম আছে যারা যায় না। আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড রুমকিও প্রায় যায়।
রাতের বেলা মিনারা বিষয়টি নিয়ে রেশার বাবার সাথে কথা বলে। রেশার বাবা রেহমান সাহেব একটু চিন্তা করে মিনারাকে বললো, দেখো বিষয়টি নিয়ে অনেক বন্ধুদের সাথে আমার আলাপ হয়েছে। তাদেরও একই দুশ্চিন্তা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে। কিন্তু এর মধ্যেও অনেক বাবা মা ছেলেমেয়েকে নিজেদের আদর্শে বড় করে তুলছে। আবার অনেকে ভয় পেয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু রুশ্নান সাহেবের ছেলেমেয়েদের দেখেছো? কেমন নম্র, ভদ্র ও সুশৃংখল নিয়ম নীতি মেনে চলাফেরা করে।
মিনারা- তাদের বাবা মা দুজনেই অনেক ধার্মিক এবং ছেলেমেয়েদের সেই শিশুকাল থেকে সেভাবে কঠোর ধর্মীয় রীতিনীতিতে লালন পালন করছে।
রেহমান- এখানেই আমাদের ভুল হয়েছে। আমরা মধ্যম পন্থায় চলতে গিয়ে দুই ধরনের আদর্শের টানাপোড়নটা সামলাতে হচ্ছে। তবে এটা ঠিক ধর্ম এবং নীতিবোধ পাশাপাশি থাকে। অর্থাত একজন মানুষ ধার্মীক মানেই তিনি নীতিবান। কিন্তু একজন নীতিবান মানুষ, তিনি ধার্মীক নাও হতে পারেন। ধর্ম হলো মানুষে মানুষে এবং অতীন্দ্রিয় সত্ত¡ার সাথে সম্পর্ক সংশ্লিষ্ট। তাছাড়া অসত্য ও ভুলকে অযৌক্তিক বিবেচনায় তা থেকে বিশ্বাস দ্বারা সত্য ও সঠিকটাকে বুঝতে পারা। আর নৈতিকতা হলো অসত্য ও ভুল থেকে সত্য ও সঠিকটাকে বুঝতে পারা এবং সর্বদা সত্য ও সঠিক কাজে অবিচল থাকা।
নৈতিকতাকে ভাবা হয় মানবীয় চারিত্রিক বিষয় এবং মানুষে মানুষে সম্পর্ক সংক্রান্ত। এটা গুরুত্বপূর্ণ সত্য ও সঠিক আচরণ বিষয়ক নিয়ম কানুন – এর লঙ্ঘন মানব এবং সমাজ জীবনের বিধি নিষেধে চরম বিশৃংখলা আনয়ন করে। যেমন ধরো আমরা জানি যে, অশ্লীলতা ও অহংকার করা উচিত নয়। আদব কায়দা মেনে চলা ও সত্কর্ম করা উচিত ইত্যাদি। নৈতিকভাবে এবং সামাজিকভাবে পরিবারে ও সমাজে শান্তি শৃংখলা বজায় রাখার জন্য প্রতিটি মানুষের এগুলো যেমন অবশ্য মেনে চলা উচিত তেমনি ধর্মও একই উপদেশ দিয়ে থাকে। সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহতায়ালা সৃষ্টির সেরা মানবজাতির জন্য মহাগ্রন্থ ‘আল কোরআন’-কে পুরোটাই উপদেশ স্বরূপ নাযিল করেছেন। তিনি সূরা কামারের ১৭ নং আয়াতে বলেন “কোরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করেছি, কে আছে তা গ্রহণের?” তিনি আরও সূরা ইউনুসের ৫৭ নং আয়াতে বলেন” হে মানুষ! তোমাদের নিকট এসেছে উপদেশ তোমাদের রবের পক্ষ হতে এবং অন্তর রোগের ওষুধ এসেছে; মুমিনদের জন্য হেদায়েত ও রহমত“। “তা (কোরাআন) বিশ্ববাসীর জন্য উপদেশ মাত্র। আর এর খবর অনতিকাল পর নিশ্চয়ই জানবে” (সূরা সোয়াদ; আয়াত ৮৭-৮৮)।
অশ্লীলতা সম্পর্কে সূরা নাহলের ৯০নং আয়াতে আছে “নিশ্চয়ই আল্লাহ নির্দেশ প্রদান করেন সুবিচার, সদাচরণ ও আত্মীয়স্বজনদেরকে দান করার জন্য আর নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসত্কর্ম ও সীমা লঙ্ঘন করতে। উপদেশ দেন যেন তোমরা তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ কর”। “আর যারা মহাপাপ ও অশ্লীল কাজ হতে দূরে থাকে, আর ক্রোধের সময় মাফ করে দেয়…. আল্লাহর কাছে তার পুরস্কার রয়েছে” (সূরা শূরা; আয়াত ৩৭-৪০)।
অহংকার সম্পর্কে সূরা লোকমানের ১৮ নং আয়াতে আছে “আর তুমি অহংকারের বশবর্তী হয়ে মানুষের প্রতি অবজ্ঞা করো না, আর যমীনে দম্ভভরে চলো না, নিশ্চয়ই কোন দাম্ভিক ও কোন অহংকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন না”। “আর যদি আমি মানুষকে রহমতের স্বাদ দিয়ে পুনর্বার ছিনিয়ে নেই,তবে সে অবশ্যই নিরাশ ও অকৃতজ্ঞ হয়। আর যদি আমি দুঃখের পরে সুখের স্বাদ দেই, তবে সে বলে, আমা হতে বিপদ কেটেছে, তখন সে উত্ফুল্ল ও দাম্ভিক হয়ে ওঠে” (সূরা হুদ; আয়াত ৯-১০)।
আদব-কায়দা, শিষ্টাচার ও সৌজন্য মানব গুণের একটি বিশেষ দিক। সৃষ্টির স্রো মানুষ যখন সৌজন্যহীন ও শিষ্টাচারহীন হয়ে পড়ে তখন তারা পশুত্যের পর্যায়ে নেমে যায়। বয়োজ্যষ্ঠদের সম্মান এবং ছোটদের স্নেহ করা সকল মানুষেরই কর্তব্য। তাই পবিত্র কোরআনে আদব-কায়দার প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সূরা লোকমানের ১৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “তুমি সংযত হয়ে চলবে, তোমার কণ্ঠস্বর নীচু করবে, নিশ্চয়ই গর্দভের স্বরই স্বরসমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট” আবার সূরা ফুরকানের ৬৩ নং আয়াতে তিনি বলেন, “দয়াময়ের বান্দা তারাই যারা যমীনে নম্রভাবে চলাফেরা করে, যখন অজ্ঞরা তাদেরকে সম্বোধন করে তখন শান্তিসূচক কথা বলে”।
সত্কর্ম সম্পর্কে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, “যে কেউ আল্লাহতে সমর্পিত এবং সত্কর্মপরায়ণ হয়, তবে তার ফল রয়েছে তার রবের নিকট, আর তাদের নেই কোন ভয় আর না তারা দুঃখিত হবে” (সূরা বাকারা আয়াত ১১২)।
তিনি আরও বলেন, ”আর যারা ঈমান এনেছে এবং সত্কাজ করেছে তাদের পাপসমূহ অবশ্যই আমি মিটিয়ে দেব আর তাদের কর্মের উত্তম ফল দেব“ (সূরা আনকাবুত; আয়াত ৭)
মিনারা- এই উপদেশগুলো খুবই মূল্যবান কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েরা কতটুকু শুনবে ও মেনে চলবে – এটাই চিন্তার বিষয়। কারন শিশুকাল থেকেই ওদের মাথায় আমরা এই শিক্ষা ঢোকাতে পারিনি।
রেহমান- সেটা ঠিক বলেছো কিন্তু আমরা এখন চেষ্টা করতে পারি। সামনে কোন এক ছুটির দিনে ওদের নিয়ে আমরা বসতে পারি এবং ওদের এই বিষয়গুলো নৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝানোর চেষ্টা করি। বাকী হেদায়েত করার মালিক আল্লাহতায়ালা। হেদায়েত হচ্ছে মহান শ্রষ্টার করুণা বা ইচ্ছায় সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া; যাতে করে মানুষ এই পৃথিবীতে পূত-পবিত্র জীবন যাপন করতে পারে। যুগে যুগে নবী-রাসুলগণ মানুষের হেদায়েতের এই আহবান করেছেন ।
আল্লাহতায়ালা সূরা কাসাসের ৫৬ নং আয়াতে বলেন, “আপনি আপনার প্রিয়কে পথ দেখাতে পারবেন না, বরং আল্লাহই ইচ্ছামত পথ দেখান এবং তিনিই পথপ্রাপ্তদের চেনেন”।
সূরা নাহলের ৯৩ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “আর আল্লাহ ইচ্ছা করলে তোমাদেরকে এক জাতি করতেন, কিন্তু তিনি যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা হেদায়েত দেন। তোমরা অবশ্যই তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।”
সূরা যুমারের ২৩ নং আয়াতে তিনি আরও বলেন, “এটাই (কোরআন) আল্লাহর হেদায়েত, ইচ্ছামত হেদায়েত প্রদান করেন, আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার আর কোন পথ প্রদর্শক নেই”।