অনলাইন ডেস্ক : গত ৩০শে সেপ্টেম্বর, শনিবার কানাডার ইন্ডিয়ান রেসিডেনশিয়াল স্কুলের এক শতাব্দীর বেশি সময়ের মর্মান্তিক ইতিহাস স্মরণে দেশ জুড়ে তৃতীয় বারের মত ন্যাশনাল ‘ট্রুথ এন্ড রিকন্সিলিয়েশন ডে’ পালিত হয়েছে। উল্লেখ্য, আদিবাসী তরুণদের জোরপূর্বক সমাজের মূল স্রোতে অঙ্গীভুত করার লক্ষ্যে উনিশ ও কুড়ি শতকে কানাডার সরকার ও ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ পরিচালিত আবাসিক স্কুলগুলোতে বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো হতো। প্রায় ১৮৬৩ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এক লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি আদিবাসী শিশুকে তাদের পরিবারগুলো থেকে নিয়ে এসে এসব আবাসিক স্কুলে রাখা হয়েছিল। এই শিশুদেরকে তাদের নিজেদের ভাষায় কথা বলতে ও তাদের সংস্কৃতি চর্চা করতে দেওয়া হতো না, তাদের অনেকের সঙ্গেই দুব্যবহার ও গালাগালি করা হতো। এই পদ্ধতির প্রভাবগুলি নথিবদ্ধ করতে ২০০৮ সালে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। তারা দেখতে পায়, বিরাট সংখ্যক আদিবাসী শিশু আর কখনোই তাদের নিজেদের সমাজে ফিরে যায় নি।

আবাসিক এই স্কুলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান ছিল কামলুপ্স ইন্ডিয়ান রেসিডেনশিয়াল স্কুল। রোমান ক্যাথলিকদের পরিচালিত এই স্কুলটি ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫০ এর দশকে স্কুলটিতে ভর্তি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল আর তখন এখানে ৫০০ জনের মতো শিক্ষার্থী ছিল। ১৯৬৯ সালে কানাডার কেন্দ্রীয় সরকার স্কুলটির প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং স্থানীয় শিক্ষার্থীদের আবাস হিসেবে ১৯৭৮ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত পরিচালনা করে। আদিবাসী শিশুদের নিজেদের সংস্কৃতি থেকে দূরে রাখার প্রক্রিয়া উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শুরু হলেও ১৮৭৬ সালের ইন্ডিয়ান এক্ট’এর মাধ্যমে এ বিষয়টি পাকাপোক্ত করা হয়। পরিবার থেকে দূরে রাখা এবং নির্যাতনের ফলে ইন্ডিয়ান রেসিডেনশিয়াল স্কুলে কত জন আদিবাসী শিশুর মৃত্যু হয়েছে, সে সম্পর্কীত কোন নথি না থাকলেও ধারণা করা হয়, সে সংখ্যাটি ৩২০০ থেকে ৬০০০ এর মধ্যে হবে।

কানাডার আদিবাদী সমাজে সরকারের এই আরোপিত শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তাদের জীবন ও সমাজ ব্যবস্থায়। অতি স¤প্রতি সময়ে, বিভিন্ন আদিবাসী স্কুল এলাকায় গণ কবর আবিষ্কৃত হবার ফলে দেশব্যাপী মানবিক মানুষদের নিন্দা এবং ক্ষোভের ঝড় বয়ে যায়। ফলে গত বছর ৩০শে সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মত সরকারীভাবে ‘ন্যাশনাল ডে অব ট্রæথ এন্ড রিকন্সিলিয়েশন’ পালিত হয়। শুধু তাই নয়, যে সব শিক্ষার্থীরা এই জোর জবস্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার বলি হয়েছে, তাদের স্মরণে এই দিনটির শ্লোগান ঠিক করা হয়েছে ‘এভরি চাইল্ড ম্যাটার্স’। দিনটিকে ফেডারেল সরকার সরকারী ছুটির দিন ঘোষণা করেছে। কমলা রঙের আভায় সজ্জিত এই দিনটি ‘অরেঞ্জ শার্ট ডে’ হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেছে।

এই দিনটিতে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তাঁর বক্তব্যে বলেন, ইতিহাসে যে ঘটনা ঘটে গেছে, সেটা আর কখনও ফিরে আসবে না। কিন্তু রাষ্ট্র এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যে সব শিশুদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়েছেন এবং যাদের এর ফলে মৃত্যু ঘটেছে, সেটা কানাডার শিক্ষা ও সমাজ ব্যবস্থায় কলঙ্কজনক। তিনি আরও বলেন, যারা মৃত্যু বরণ করেছে, তাদের এবং তাদের পরিবারের প্রতি আমাদের গভীর সমবেদনা এবং ভালোবাসা। সেই সাথে যারা আবাসিক স্কুলের বিভৎসতা থেকে বেঁচে গিয়ে ভয়ংকর মানসিক অশান্তি এবং ভীতির মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন বা কাটাচ্ছেন, তাদের সহযোগিতা করা এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সরকারের পাশাপাশি সমাজের সবার রয়েছে। ইন্ডিয়ান আবাসিক স্কুলের সত্য উদঘাটন এবং মানসিক ভীতি এবং অরক্ষার মধ্যে সময় পার করা সাবেক শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক জীবনের ফিরিয়ে আনার গুরুত্বের প্রতি জোর দেওয়ার জন্যই ‘ট্রæথ এন্ড রিকন্সিলিয়েশন’ শব্দগুলি ব্যবহার করা হয়। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে আরও জানান, এখন পর্যন্ত যে সব জায়গায় অনাবিষ্কৃত গণ কবর রয়েছে, সেগুলোর অনুসন্ধান করার প্রক্রিয়া চলছে। সেই সাথে আবাসিক স্কুলের যে সব শিক্ষার্থীরা এখনও বেঁচে আছেন, সঠিক ইতিহাসের প্রয়োজনে তাঁদের কথা, গল্প এবং স্মৃতিচারণ সুষ্ঠুভাবে ধারণ করা জরুরী। এ ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগের কথা তিনি উল্লেখ করেন।

কানাডার বিভিন্ন শহর এবং আদিবাসী এলাকায় অসংখ্য মানুষ কমলা রঙয়ের পোশাক করে এই দিনটি পালন করেন। তারা মৃতদের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করেন এবং বেঁচে থাকা শিক্ষার্থীদের প্রতি ভালোবাসা জ্ঞাপন করেন। ‘এভরি চাইল্ড ম্যাটার্স’ শ্লোগানে মুখরিত হয়ে তারা প্রত্যাশা করেন, এমন পরিস্থিতি আর কখনও যেন কোন জনপদে সংঘটিত না হয়।

উল্লেখ্য, গত বছর জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস ভ্যাটিক্যান সিটি থেকে কানাডায় এসে আবাসিক স্কুলের কর্মকাণ্ডে ক্যাথলিক চার্চের সংশ্লিষ্টতার জন্য কানাডার আদিবাসী সমাজের কাছে ক্ষমা চান।