অখিল সাহা, টরন্টো : বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে উত্তর আমেরিকার কেন্দ্রস্থলে টরন্টোতে উপচে পড়া দর্শকের সামনে একে একে পরিবেশিত হলো বাঙালির আপন আত্মার অনুরণন। মনে হল, প্রবাসে নয় আমরা যেন বসে আছি দেশের কোথাও। ‘ফিরে চল মাটির টানে’ শ্লোগান নিয়ে ৯ই নভেম্বর ২০১৯ শনিবার টরন্টোর হিমাংকের নীচের শীতলতা মাখা সন্ধ্যায় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী কানাডা সংসদ আয়োজিত কানাডা উদীচী ৩য় লোক উৎসব ২০১৯ অনুষ্ঠিত হয়। যে লোক উৎসবের মধ্যমনি হয়ে ছিলেন বাংলা লোকসংগীতের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়। তাঁর সেই চিরচেনা কায়দায় বুক চিতিয়ে গলা উঁচিয়ে দর্শক-শ্রোতাদের জন্য গা গরম করা গণসংগীত ও লোক সংগীতের ডালি নিয়ে পার করলেন একটি অমলিন সন্ধ্যা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান থেকে শুরু করে সুকান্ত ভট্টাচােের্যর বিপ্লবী গান, বিভিন্ন উদ্দীপনামুলক গণসংগীত ও লোক সংগীত পরিবেশন করেন। তিনি সংগীত পরিবেশনের পাশাপাশি নিজের সংগীত জীবন গড়ে ওঠা, মুক্তিযুদ্ধের সময় শিল্পীদের ভ‚মিকা, দেশের বিভিন্ন সংকটজনক সময়ে সাংস্কৃতিক কর্মীদের ভ‚মিকা, উদীচী ও সত্যেন সেনের বাঙালী সংস্কৃতি ও লোক সংগীত রক্ষায় ভূমিকার কথা, দেশে সাংস্কৃতিক কাজে শিল্পী কলিম শরাফী ও ভাষা আন্দোলনের কর্মী জামিল চৌধূরীর কথা, লোকসংগীতের প্রতি তাঁর নিজের দার্য়িত্ব পালন সম্পর্কে উৎসাহমুলক বক্তব্য রাখেন। উদীচীর শিশু-কিশোর ও শিল্পীদের পরিবেশনায় লোকসংগীত, লোকনৃত্য ও অন্যান্য পরিবেশনার সাথে সাথে এই উৎসবে একাধিক মনকাড়া পর্ব ছিল, যার মধ্যে এক গুচ্ছ লালনসংগীত নিয়ে বিশেষ পরিবেশনায় ছিলেন শিল্পী সারাহ বিল্লাহ। কানাডা উদীচীর ৩য় লোক উৎসবের আরেকটি গুরুত্ত¡পুর্ণ অধ্যায় ছিল বাঙালী সংস্কৃতির সংগে আর্ন্তজাতিক লোক সংগীত শিল্পীদের পরিবেশনা। এই অনুষ্ঠানে কিউবা ও ইকুয়েডরের লোকসংগীত ও বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে মঞ্চ মাতিয়ে তোলেন কানাডার আদিবাসী লোকসংগীত শিল্পীদের একটি দল।
টরন্টো বাঙালীপাড়ার কেন্দ্রস্থলের সন্নিকটে ১০০ ব্রাইমলি রোড সাউথে বেøসড কার্ডিনাল নিউম্যান কাথলিক হাইস্কুলে অনুষ্ঠিত হয় কানাডা উদীচী ৩য় লোকউৎসব। শুরু হয় বিকাল ৫.৩০ এবং শেষ হয় রাত্র ১২.০০টায়। সভায় শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায় অভিবাসীদেরকে বাঙালীর পৃথক আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য শেকড়ে ফেরার আহ্বান জানানো হয়। এছাড়াও তিনি আবহমান বাঙালীর সাংস্কৃতিক স্বত্ত¡া প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত রাখার জন্য উদীচীকে সহযোগিতার আহ্বান জানান। সেখানে কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে উৎসবে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদ সদস্য আজিজুল মালিক। শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়ের সংগে এবং উদীচীর সমবেত সংগীতে যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন প্রখ্যাত কি বোর্ডে জাহিদ হোসেন, তবলা শিল্পী তানজির আলম রাজীব ও সজীব চৌধুরী, ড্রামসে সৌরভ ধ্রুব এবং দোতারায় জাহিদুল আলম চয়ন। উদীচীর শিল্পীরা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার অনেকগুলি লোক সংগীত পরিবেশন করেন। উদীচীর সমবেত সংগীত পরিবেশনায় এবং একক গানে অংশ নিয়েছেন ¯িœগ্ধা চৌধুরী, পাপড়ী গোস্বামী, মুক্তিপ্রসাদ, হাসমত আরা চৌধুরী জুঁই, রোকেয়া পারভীন, ভ্যালেন্তিনা ভৌমিক, উর্মি দাশ, অদিতি জহির, চিত্রা দেব, সুনীতি দাশ, প্রশান্ত সরদার, চঞ্চলা বিশ্বাস, ওমর হায়াত, কাজী জহির, সজীব চৌধুরী এবং সুভাষ দাশ। সমগ্র অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় ছিলেন ওমর হায়াত।
কানাডা উদীচীর উপদেষ্টা শিপ্রা চৌধুরীর আনন্দধারা ড্যান্স একাডেমীর শিক্ষার্থী শিল্পী অংকিতা সাহা, অন্বিতা সাহা, আরিশা জামান, তনুশ্রী সাহা (তিন্নি), স্মিতা বসাক এবং সিলভী রায়। অন্য একটি একক নাচে অংশ নিয়েছে শিশু শিল্পী সুকন্যা চৌধুরী। অনুষ্ঠানের আর্থিক সহযোগিতার জন্য শুভানুধ্যায়ীদের উদীচীর পক্ষ থেকে মঞ্চে নিয়ে শুভেচ্ছা জানান। মঞ্চ সজ্জায় ছিলেন শিল্পী জয় দাশ, শিল্পী অভিজিৎ পাল ও আরিফ হোসেন বনি। সার্বিক সহযোগিতায় ছিলেন আজিজুল মালিক, সৌমেন সাহা, স্বপন বিশ্বাস, সুলায়মান তালুত রবীন, রেজা অনিরুদ্ধ এবং স্বপন সরকার। অনুষ্ঠানে শব্দ ও আলোক নিয়ন্ত্রণে ছিলেন সুমন সরকার। উদীচীর পক্ষে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক মিনারা বেগম। আর্থিক ও সকল রকম সহযোগিতার জন্য উদীচীর শুভানুধ্যায়ী সকল ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও প্রচার মাধ্যমের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন সভাপতি সুভাষ দাশ।