সুব্রত নন্দী : কানাডায় সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা একটা উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে বেড়ে যাবার প্রধান কারণটা কি হতে পারে- এ বিষয়ে বাংলাদেশ থেকে অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। আমি বলেছিলাম অতিরিক্ত টিউশন ফি দিয়ে বেশিরভাগ ধনী পরিবারের সন্তানরাই কানাডাতে পড়তে আসে, যাদের ভেতর অনেকের প্রবাসে ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রসঙ্গে একটা ভুল মাইন্ডসেট থাকে যা তাদেরকে বেপরোয়া জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করে।
মধ্যবিত্তের সন্তানরা সম্পত্তি বিক্রি করে বিদেশে পড়তে আসে যাদের পঞ্চাশ ষাট হাজার ডলারে গাড়ি কেনার সামর্থ নেই। বাসে দাঁড়িয়ে উবার ডেকে তারা ক্লাস করার পরে সামান্য সময়টুকু যা পায় সেটা কাজ করে উপার্জন করে অভিভাবকের খরচটা কমাতে চেষ্টা করে।

ধনীর দুলাল-দুলারীদের সে সমস্যা নেই তারা এখানে এসেই বাপের অঢেল টাকায় ব্রান্ড নিউ গাড়ি কিনে পার্টিতে যায় মৌজ স্ফুর্তির উপর থাকে। দ্বিতীয় স্তরের জি-২ ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে এরা আইন অমান্য করে হাইওয়েতে উঠে পরে যেখানে গাড়ি চালানোর জন্য একটি নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার পর অন্তত জি-১ লাইসেন্স লাগে। গত ১৩ ফেব্রæয়ারি রাতে টরন্টোর ৪২৭ হাইওয়ের মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিন তিনটি বাংলাদেশী ছাত্র ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় আমি তাৎক্ষনিক যে আশংকা প্রকাশ করেছিলাম পরবর্তিতে পুলিশ ইনভেষ্টিগেশনে তাই বের হয়ে এসেছে।
আজ ফেসবুকে টরন্টো অধিবাসী বøগার একটিভিষ্ট হোরাস আহমেদের দেয়া পোষ্ট দেখে আমি বিস্মিত হলাম ঐ ঘটনায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া নিবিড় কুমারের ইনস্টাগ্রামে আপলোডকৃত কিছু ক্রেজি ড্রাইভিং ভিডিও দেখে যে দ্রুত ও বেপরোয়া গতির প্রতি তার অনেক আগে থেকেই একটা অবসেশন ছিল। এড্রোনালিন হরমোন ঘটিত উত্তেজনা থেকে এমনটা সাধারণত তরুণদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে । বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন কানাডার সড়ক দুর্ঘটনার পঞ্চাশভাগই হয় এমন বেপরোয়া গাড়ি চালানো থেকে। বাংলাদেশের একটি সংবাদ মাধ্যমের ভিডিওতে দেখলাম নিহত আরিয়ানের মা অভিযোগ করেছেন নিবিড় বাংলাদেশেও এমন কেয়ারলেস গাড়ি চালানো থেকে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। টরন্টোতেও নিবিড় টিকিট খেয়েছে। দুর্ঘটনার দিন অপর এক বন্ধুর সঙ্গে নিবিড় ফাঁকা হাইওয়ের উপর ১৪০ কিলোমিটার বেগে কার রেস করার কারণেই তার সন্তান দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা গেছে। আমি সঙ্গীত শিল্পী কুমার বিশ্বজিতের অত্যন্ত ভক্ত। দুর্ঘটনার দিন রাত জেগে আমি বাংলাদেশে সঠিক তথ্য সরবরাহ করেছি যে নিবিড় বেঁচে আছে। তাঁর মৃত্যুর খবর যারা বাংলাদেশে প্রচার করেছেন সেটা একটা দায়িত্বহীনতা। টরন্টোর আসবার পথে বিশ্বজিত দা হয়ত এমন মিথ্যা সংবাদে হার্ট ফেল করে মারা যেতেন।
আজ নিবিড়ের আপলোডকৃত ইনস্টাগ্রাম ভিডিও দেখে সত্যিই আমার খুব অবাক লাগছে একজন দায়িত্বশীল পিতার কাজ তিনি করতে পারেননি। দুর্ঘটনার দুই মাস আগে টরন্টো এসে কেন তিনি পুত্রের এই অবসেশন সম্পর্কে জেনে শুনেও সন্তানকে গাড়ি কিনে দিয়ে তাদের অকাল মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলেন? গত তিনদিন ধরে নিহত কচি তিনটি মুখ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে আমাকে বারবার অশ্রুসিক্ত করেছে। আমার একই বয়সের সন্তান আছে। গত বছর বাংলাদেশে আমার ভায়রার মেধাবী মেয়ে পরমাণু বিজ্ঞানী পুজা সরকারের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর শোক আমি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সড়ক দুর্ঘটনায় শিকার হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে আমার ছোটভাই সুবীর নন্দী দোলন। অথচ আমরা একটু সচেতন হলে বেঁচে যেত এরা। ভুক্তভোগীর কষ্ট ভুক্তভোগীরাই বোঝেন। এই মাসেই গত ২০২১ সালে বেপরোয়া গাড়ি চালাতে গিয়ে কানাডার ম্যানিটোবায় নিহত হয়েছিল নোমান আদিত্য, অরণ্য আজাদ ও বাঁধন নামের তিন বাংলাদেশী ছাত্র। উইন্ডসর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টরন্টো আসবার পথে মারা যায় আরও দুজন ছাত্র। এরা সবাই ধনী পরিবারের সন্তান যাদের গাড়ি ছিল। গাড়ি চালানো কোন অপরাধ নয়, তবে ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গ করে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে নিজে নিহত হওয়া এবং অন্যদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া কানাডায় দণ্ডনীয় অপরাধ।