অনলাইন ডেস্ক : কানাডার মুদ্রাস্ফীতির হার গত মাসে ৫.৭ শতাংশে পৌঁছেছে। গত ৩০ বছরের মধ্যে এটি দেশের সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতি। এর আগে ১৯৯১ সালের আগস্টে সর্বোচ্চ ৫.৫ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি হয়েছিল। করোনা মহামারি আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে জ্বালানি ও নিত্যপন্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে মুদ্রাস্ফীতির এই রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

পরিসংখ্যান কানাডা গত বুধবার তাদের  রিপোর্টে বলেছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের মুদ্রাস্ফীতির হার ১৯৯১ সালের আগস্টের পর সর্বোচ্চ ছিল। এটি জানুয়ারিতে থাকা ৫.১ শতাংশ থেকে বেড়ে এক লাফে ৫.৭ শতাংশে পৌঁছেছে। যা ১৯৯১ সালের আগস্টের ৫.৫ শতাংশের চাইতেও বেশি।

অবশ্য অর্থনীতিবিদেরা মুদ্রাস্ফীতির এই হার বৃদ্ধির আশঙ্কা আগে থেকেই করছিলেন। ব্লুমবার্গের জরিপেও ফেব্রুয়ারিতে মুদ্রাস্ফীতি ৫.৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে আভাস দেয়া হয়েছিল। মন্ট্রিল ভিত্তিক আর্থি পরিষেবা সংস্থা ডেসজার ডিনসের অর্থনীতিবিদ রয়েস মেন্ডেসের মতে, করোনার ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই অর্থনীতিতে যুদ্ধের ধাক্কায় সব কিছু ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। তাই মুদ্রাস্ফীতির হার রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, খাদ্য ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ হল, ইউক্রেনে চলমান সঙ্কট। শুধুমাত্র ফেব্রুয়ারিতেই খুচরা পেট্রলের দাম ৬.৯ শতাংশ বেড়েছে। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এই বৃদ্ধি প্রায় এক তৃতীয়াংশ।

ডাটা এজেন্সিগুলো বলছে, পূর্ব ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের ভুরাজনৈতিক সংঘাত বিশ্বব্যাপি তেল সরবরাহে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতি তেলের দামের উপর ঊর্ধ্বমুখী চাপ সৃষ্টি করছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ইতোমধ্যে ১৩০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। মার্চের শুরুতে কানাডায় পেট্রলের খুচরা মূল্য ৩২.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা সংস্থা মোনেক্স কানাডার একজন কর্মকর্তা জে ঝাও মারে বলেন, এটি উদ্বেগজনক। এই ধরনের ‘নাটকীয়’ মূল্যবৃদ্ধি পন্যের চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্য মূল্য বৃদ্ধিও মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ। গত বছরের তুলনায় এ বছরের শুরুতে কানাডায় খাদ্য মূল্য বেড়েছে ৭.৪ শতাংশ। ২০০৯ সালের পর এই খাতে এটি সর্বোচ্চ মূল্য বৃদ্ধি। কানাডার প্রেইরি অঞ্চলে খরার কারণে এবার গমের উত্পাদন কম হওয়ায় রুটি জাতীয় খাবারের দাম এমনিতেই বেড়েছে। তার মধ্যে এখন শুরু হয়েছে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই দু’টি দেশকে বলা হয় ইউরোপের ‘ব্রেড বাস্কেট’। ইউরোপসহ বিশ্বের প্রায় ৩০ শতাংশ গমের যোগান দেয় রাশিয়া ও ইউক্রেন। এখন যুদ্ধের কারণে গমের বাজার অস্থিতিশিল হয়ে পড়ায় রুটি ও বিস্কুটের দাম বেড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।

ক্যালগারি ইতালিয়ান বেকারির মালিক লুই বেনটোরিন বলেন, গমের দাম ইতোমধ্যে এক তৃতীয়াংশ বেড়েছে। এছাড়া ভিনেগার, কার্ডবোর্ড বাক্স এমনকি ব্যাগের মতো প্যাকেজিং উপকরণের দামও দ্বিগুণ বেড়েছে। সেই সাথে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি তো আছেই। মোট কথা প্রতিটি ক্ষেত্রেই মূল্য বৃদ্ধির আঘাতে আমরা জর্জরিত। এটি যেন উত্তাল সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়ার মতো অবস্থা। একটি ঢেউয়ের ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আপনাকে আরেকটি ঢেউ এসে আঘাত করবে। তিনি বলেন, একের পর এক বিভিন্ন জিনিসের মূল্য বৃদ্ধির ফলে এখন ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

অন্যদিকে খাদ্য ও জ্বালানির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আবাসন খরচ। লুই বলেন, মূল্য বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে টেবিলে খাবার রাখা যেমন কষ্টকর হয়ে পড়েছে। তেমনি মাথার উপর ছাদ রাখাও কঠিন হয়ে উঠেছে। খাবার টেবিল থেকে অনেকেই ড্রিংকস ও আইসক্রিমের মতো বিলাসি আইটেমগুলো বাদ দিয়েছেন। এতে দরকারি খাবারগুলো এখনো টেবিলে রাখা যাচ্ছে। কিন্তু বাসস্থানের খরচতো এভাবে সমন্বয় করা যায় না। আশ্রয়ের খরচ গত বছরের তুলনায় ৬.৬ শতাংশ বেড়েছে। ১৯৮৩ সালের পর এটি সর্বোচ্চ বৃদ্ধির হার। কম মূল্যে বাসা না পেয়ে অনেকে এখন গাড়িতেই রাত্রীযাপন শুরু করেছেন। ব্যাংক অব মন্ট্রিলের অর্থনীতিবিদ ডোগ পোর্টার বলেছেন, মহামারির প্রথম বছরে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি কিছুটা সংযত ছিল। কিন্তু গত বছর তা আবার ‘গর্জে উঠেছে’।

মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক অব কানাডা ২০১৮ সাল থেকেই নানান পরিকল্পনা করে আসছে। তারা কয়েক দফায় সুদের হার বাড়িয়েছে। কিন্তু কোন কিছুতেই মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। সূত্র : সিবিসি