শাহনুর চৌধুরী : এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে করোনা মহামারীর বিস্তার। এই দীর্ঘ সময়ে মানুষের জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই ওলট-পালট হয়ে গেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে সাথে রাজনীতিতেও মহামারীর প্রভাব পড়েছে। এক বছর আগে কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাসজনিত মহামারী শুরুর সময় কানাডার রাজনীতিবিদরা জনগণের উপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে অনেক আশার বাণী শুনিয়ে ছিলেন। সে সময় তাদের বাগ্মিতায় জনগণও আশ্বস্ত হয়েছিল। তারা ভেবেছিল, এসব বিধি-নিষেধ মেনে চললে দ্রæতই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। আবার তারা বিধি-নিষেধের বেড়াজাল থেকে বের হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে। কিন্তু দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময়েও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। এখন রাজনীতিবিদদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে পরিবর্তন এসেছে। জনগণও আর দীর্ঘ সময় ধরে কঠোর বিধিনিষেধের জালে আবদ্ধ থাকতে চাইছে না।
কানাডার প্রধান তিন প্রদেশ অন্টারিও, আলবার্টা আর কুইবেকের রাজনীতিতে মহামারীর প্রভাবের কথা বলতে গেলে প্রথমে নিশ্চিতভাবে যে বিষয়টি চলে আসে তা হলো, পার্টনারশীপ বা অংশীদারিত্ব। মহামারীর শুরুতে ক্ষমতাসীনরা একাই সব কিছু সামাল দিতে পারবে ভেবে অংশীদারিত্বের বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে অবস্থা যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন সবাইকে নিয়ে কাজ করার বিষয়টি ফিরে আসে। করোনা মহামারীর প্রভাবে সবচেয়ে বেশি টালমাটাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে অন্টারিওতে। এর জন্য অবশ্য প্রদেশটির প্রধানমন্ত্রী ডোগ ফোর্ডের অতিকথন অনেকটাই দায়ী।
গত এক বছর তিনি অনেক বড় বড় কথা বলেছেন। কিন্তু জনগণ এসব কথার কোন সুফল পায়নি। ফলে এক বছর পর এখন তার জনপ্রিয়তা কমতির দিকে। আসন্ন নির্বাচন নিয়ে এক জরিপে দেখা গেছে, মহামারী নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে তার প্রতি মানুষের আস্থা কমে গেছে।
আলবার্টা’র প্রিমিয়ার জেসন কেনির সমস্যা একটু ভিন্ন প্রকৃতির। তিনি ফোর্ডের মত বাগ্মিতাপ্রিয় নন। গত এক বছর তিনি তেমন কোন বড় প্রতিশ্রুতির কথা বলেননি। তবে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে দলের মধ্যেই এখন তিনি চাপে আছেন। মহামারীর শুরুতে কেনি সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ প্রশংসিত হলেও গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দলে এবং দলের বাইরে তার অবস্থান খুব একটা ভালো নয়। এই মুহূর্তে তাকে দুটি পক্ষকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এক. মহামারী মোকাবেলায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতার জন্য বিরোধী পক্ষের সমালোচনা। আর অন্যটি হচ্ছে, নিজ দলের পরামর্শ না শোনার কারণে দলের মধ্যেই নেতৃত্বের গুণাবলী নিয়ে প্রশ্ন।
অন্যদিকে কুইবেকের প্রিমিয়ার ফ্রাঁসোয়া ল্যাগো মহামারীর প্রথমদিকে সমালোচিত হলেও বছর পেরিয়ে এখন কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন। মহামারীর শুরুতে বেশ কিছু কঠোর কর্মসূচি নেন তিনি। এসবের মধ্যে কারফিউ জারি ছিল একটি প্রধান ব্যবস্থা। শুরুতে এর বিরুদ্ধে অনেকে সোচ্চার হলেও পরবর্তীতে এই কঠোরতার সুফল পাওয়া যায়। সংক্রমণ রোধে কুইবেকে কঠোর বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে বড় ধরনের বিক্ষোভ হলেও সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেননি ফ্রাঁসোয়া ল্যাগো। তার স্যানিটারি নীতি অনেকের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করলেও মহামারী নিয়ন্ত্রণে সাফল্যে তা ঢাকা পড়ে যায়।
অন্টারিও, আলবার্টা আর কুইবেকের রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যেও করোনা মহামারী ব্যাপক প্রভাব রেখে চলেছে। বিশ্বের অন্য অনেক দেশের মতো কানাডার অর্থনীতিও বলতে গেলে মুখ থুবরে পড়েছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এক বছর আগেও অন্টারিওর প্রিমিয়ার ডগ ফোর্ড তার প্রতিটি বক্তৃতায় বিরোধীপক্ষের তীব্র সমালোচনা করতেন। তার বক্তব্যে নিজের ও দলের সাফল্যের কথার চাইতে বেশি থাকত প্রতিপক্ষের সমালোচনা। আর ওই সমালোচনা ছিল এতটাই জ্বালাময়ী যে প্রতিপক্ষকে তা অনেক দূরে ঠেলে দিত। তাছাড়া বিরোধীপক্ষের ভালো-মন্দ সব পরামর্শকেই তিনি অবহেলা করতেন। কিন্তু এক বছর পর করোনা মহামারী এখন তার মনোভাবে পরিবর্তন এনেছে। তিনি এখন করোনার বিস্তার ঠেকাতে সব দল ও মতের লোককে নিয়ে একসাথে কাজ করার কথা বলেছেন। ইউনিভার্সিটি অফ অটোয়ার একজন অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জেনেভিব টেলিয়ার বলেছেন, ডগ ফোর্ড একা দ্রæতগতিতে এগিয়ে যাওয়ার পথ থেকে সরে এসেছেন। অন্টারিওর রাজনীতিতে ‘পার্টনারশিপের’ বিষয়টি আবার গুরুত্ব পাচ্ছে। করোনার তৃতীয় ঢেউ সবাইকে এক মঞ্চে নিয়ে এসেছে। সরকারি ঘোষণা এবং মন্ত্রীদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে ‘এক হয়ে’ কাজ করার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। তবে মহামারী নিয়ন্ত্রণে নীতিনির্ধারকদের ব্যর্থতা জনগণকে ভাবিয়ে তুলেছে। তারা আগামী নির্বাচনে ভোট দেয়ার আগে অবশ্যই চিন্তা-ভাবনা করবে যে, করোনার আরেকটি ঢেউ এলে বা অন্য নতুন কোনো মহামারী ছড়িয়ে পড়লে কে জনগণের নিরাপত্তার জন্য সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারবে। যারা দ্রæততম সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার সামর্থ্য দেখাতে পারবে, জনগণ তাদেরকেই ক্ষমতায় দেখতে চাইবে। সূত্র : রেডিও কানাডা