কামাল কাদের : ঢাকার স্বনামধন্য সার্জন ডাক্তার সেলিম চৌধুরী লন্ডনের একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স শেষ করে দেশে ফিরছেন। এমিরেটস এয়ার ওয়েজে দুবাই হয়ে ঢাকায় যাবেন। লন্ডন হতে দুবাইয়ের ফ্লাইট প্রায় ছয় ঘন্টার উপরে। দুবাইয়ে তিন ঘন্টার মতো বিরতী । তারপর সোজা ঢাকা। প্লেনে নিজের আসনে বসে সাথে করে আনা একটা বাংলা ম্যাগাজিনে মনোনিবেশ করলেন। প্লেনখানি ঘন্টা দুয়েক উড়াল দেবার পর বিমানবালারা যাত্রীদেরকে খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সুন্দরী ,সুঠাম দেহের অধিকারিণী বিমানবালাদের তত্পরতায় বিমানের ভেতরের নিঃস্থব্দতা ভেঙে ক্ষনিকের মধ্যেই বিমানটি মুখরিত হয়ে উঠলো।

ডাক্তার চৌধুরী অকৃতদার, অর্থাত চিরকুমার। তার বাবার অকাল মৃত্যুতে ছোট ভাই – বোনদের মানুষ করে বিয়ে -শাদী দিতে গিয়ে নিজের আর বিয়ে করা হলো না। অবশ্য কিছুটা নিজের ও খামখেয়ালি ছিল। বয়স ষাটের কাছা কাছি। চিকিত্সাকে ব্রত হিসাবে নিয়ে জীবনটাকে কাটিয়ে দিচ্ছেন। খাবার দাবার শেষ করার পর কিছুটা তন্দ্রা বা ঘুম ঘুম ভাব অনুভব করছিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে এক বিমানবালার আহ্বানে তন্দ্রা ভাবটা কেটে গেলো। চোখ মেলে তাকাতেই তিনি দেখলেন তার সামনে এক সুন্দরী বিমানবালা দাঁড়িয়ে। মেয়েটি খুবই স্মার্ট ,আর চেহারার মাঝে কেমন যেন এক অতুলনীয় মাধুর্যে ভরা। বয়স ২৫ /২৬ হবে। সময় মতো বিয়ে করলে হয়তো তারও এ বয়সী একটা মেয়ে থাকতো। মেয়েটি পরিষ্কার ইংরেজিতে ডাক্তার চৌধুরীকে অতি বিনীত সুরে জিজ্ঞাসা করলো, “স্যার, আপনি নিশ্চয়ই বাঙালি?” একটু চমকে ডাক্তার চৌধুরী পাল্টা প্রশ্ন করলো, “তুমি কি করে জানলে?” মেয়েটি জানালো, “স্যার, ঢাকা থেকে প্রকাশিত “প্রতিবিম্ব” বাংলা ম্যাগাজিনখানা আপনাকে পড়তে দেখেছিলাম, তাই ভাবলাম, আপনি বাঙালি, আর ঢাকার ম্যাগাজিন যখন, তখন হয়তোবা আপনি বাংলাদেশের বাঙালি”। তোমার ধারণা একদম সত্যি! ডাক্তার চৌধুরী জানালো।

এবার মেয়েটি করুণ সুরে বাংলায় বললো, “স্যার, আমার একটু উপকার করবেন?”
… এমন কি উপকার যা আমি তোমাকে করতে পারি? ডাক্তার চৌধুরী মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
… স্যার, ঐ যে, ওখানে পিছনের সিটে কয়েকজন বাঙালি যুবক বসে আছে, তারা আমাকে বাঙালি পেয়ে জ্বালাতন করছে। কিছুক্ষণ পর পর নানারকম কটুক্তি করছে আর প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে আমাকে ফাই-ফরমাশ করছে। মুরব্বি হিসেবে আপনি যদি ওদেরকে একটু বুঝিয়ে আসেন, তাহলে হয়তো ওরা আপনার কথা মানতে পারে,” মেয়েটি একনাগাড়ে কথাগুলি বলে গেলো।

ডাক্তার চৌধুরী একনজরে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলেন, ছেলেরা সবাই শক্ত-সমর্থ যুবক। ওদেরকে কিছু বলার সময় যদি মুখে একটা ঘুসি বসিয়ে দেয় তাহলে এ বুড়ো বয়সে তিনি ধরাশায়ী হয়ে পড়বেন। পরে হয়তো আরো বিড়ম্বনা সহ্য করতে হতে পারে। তা ভেবে ডাক্তার চৌধুরী মেয়েটিকে বললেন, “তুমি তোমার বসকে ব্যাপারখানি জানাওনি?” মেয়েটি বললো, “স্যার, কাস্টমার ইজ অলওয়েজ রাইট” এটা হলো আমাদের কোম্পানির নীতিমালা, এখন যদি আমার বসকে এ ব্যাপারে কিছু বলি তাহলে আমার বস বলবেন যে, আমি প্রবেøম টেকেল করতে পারছি না মানে আমি এ কাজের যোগ্য নই।”

কথাগুলি শুনে ডাক্তার চৌধুরী গভীরভাবে কিছুক্ষণ ভাবলেন। এরই মধ্যে মেয়েটি আবার বলে চললো, “স্যার, অনেক কষ্ট করে চাকরিটা পেয়েছি, আর আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে আমাদের দেশে বিশেষ করে মেয়েদের একটা চাকরি পেতে কত কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। বাবা বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের একাউন্টেন্ট ছিলেন। স্ট্রোক হয়ে ঘরে পড়ে আছেন। ছোট দুই-ভাই আর মাকে নিয়ে আমাদের সংসার। বাড়িতে আমিই একমাত্র উপার্জনশীল।”

ডাক্তার চৌধুরী মেয়েটির করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, মেয়েটি এই বুঝি কেঁদে ফেলবে। ডাক্তার চৌধুরী মনে করলেন, হিন্দি ছবির নায়কদের মতো এর একটা বিহিত করতে হবে। আবার এও বুঝলেন এটা হিন্দী ছবি নয়। এটা বাস্তব। তবুও মেয়েটির এই আকুল আহ্বােনে সারা না দিয়ে পারলেন না।
সিট্ থেকে উঠে সোজা যুবকদের কাছে চলে গেলেন। সুন্দর, মার্জিত বাংলা ভাষায় তিনি যুবকদের উদ্দেশে বললেন, “দেখুন, আপনার কিছু মনে করবেন না। আমি এসেছি আপনাদের নিকট কিছু কথা বলার জন্য। জানি না, ব্যাপারটা কিভাবে নেবেন। ওই যে, অদূরে এয়ারহোস্টেসকে দেখছেন, সে আপনাদেরই একজন, অর্থাত আপনাদের মতোই বাংলাদেশী।

জীবিকার তাগিদে আজ মা-বাবা, ভাই-বোনদের ভরণ পোষণের জন্য মেয়ে হয়েও এরকম একটা হাড়ভাংগা কাজ করে যাচ্ছে, তারও জীবনে সুখ-দুঃখ আছে। শুধু শুধু কেন আপনারা তার চাকরিটা খোয়াতে বসেছেন।”
তিনি দেখলেন কথাগুলি বলার পর ম্যাজিকের মতো কাজে লেগে গেলো। যুবকগুলি জড়োসড়ো হয়ে বসলো, তাদের মধ্যে একজন সিট্ থেকে উঠে বললো, “স্যার, আমরা ভেরি সরি, আর কখনো এরকম বেয়াদবী হবে না।” ডাক্তার চৌধুরী আশ্বস্ত হয়ে যুবকদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের সিটে এসে বসলেন।

কিছুক্ষণ পর মেয়েটি ডাক্তার চৌধুরীকে ধন্যবাদ জানাতে এলো। ডাক্তার চৌধুরী মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “অরে এতো কিছু ঘটে গেলো, আমাদের এখনো তো পরিচয় হলো না।”
— আমার নাম কলি, ভালো নাম রচনা দাস-গুপ্তা, মেয়েটি মৃদু হেসে জানালো।
ডাক্তার চৌধুরী কলির হাতে তার কার্ডখানা দিয়ে বললেন, “আমি ডাক্তার সেলিম চৌধুরী, এক সময় তোমার বাবাকে আমাদের ক্লিনিকে নিয়ে এসো, ওনার সাথে পরিচয় হবে আর সেই সাথে তার শারীরিক চেক-আপও হয়ে যাবে। অবশ্য যদিও আমি একজন সার্জন তবুও আমার সহকর্মীদের মধ্যে অনেক ফিজিসিয়ানও রয়েছেন, তাই কোনো অসুবিধা হবে না।”
“ধন্যবাদ ডাক্তার চৌধুরী,” এই বলে কলি অপ্রত্যাশিতভাবে বলে উঠলো, “আমি এবারে আপনাকে একটা পুরস্কার দিতে চাই। আর সেটা কিন্তু আপনাকে নিতেই হবে, একদম না বলতে পারবেন না। এক্ষুনি চলুন আমার সাথে, আপনাকে বিজনেস ক্লাসে একটা সিট্ দেয়া হয়েছে।” “এটা একরকম ঘুষ হয়ে যাচ্ছে না?” ডাক্তার চৌধুরীর অবাক করা প্রশ্ন।

— “না, মোটেই না, কারণটা হলো ঘুষ তখনই হয়, যখন কোনো কাজ শেষ করার আগে শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। আর পুরস্কার তখনই হয়, যখন কোনো কাজ শর্তহীনভাবে শেষ হওয়ার পর প্রাপক খুশি হয়ে তাকে গিফট দেন। তার মানে হলো এটা আমার পক্ষ থেকে আপনাকে গিফট দেয়া হলো”। “তুমি তো অনেক বুদ্ধিমতী মেয়ে”, ডাক্তার চৌধুরী হেসে বললেন। কি আর করা, অগত্যা ডাক্তার চোধুরীকে বিজনেস ক্লাসে যেতে হলো।
বিমান যথাসময়ে দুবাই এয়ারপোর্টে পৌঁছালো। এরই মধ্যে দুজনার ঠিকানা আদান-প্রদান হলো এবং ভবিষ্যতে আবার দেখা হবে বলে একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিলো। কলি দুবাইয়ে তাদের কোম্পানির এক হোটেলে চলে গেলো আর ডাক্তার চৌধুরী ঢাকাগামী প্লেন ধরার জন্য অন্য এক টার্মিনালে চলে গেলেন। ঘন্টা তিনেক দুবাই এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করতে হবে, তাই হাতের ব্যাগ থেকে বাংলা ম্যাগাজিন খানি বের করে পাতা উল্টাতে লাগলেন। ম্যাগাজিনটা কিছুক্ষণ পড়ার পর, এক নজরে কলির দেয়া ঠিকানাটা দেখে নিলেন। ৭/১, টিপু সুলতান রোড, ওয়ারী, ঢাকা। ঠিকানাটা দেখে তার নানাবাড়ির কথা মনে পরে গেলো, সাথে সাথে ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি জেগে উঠলো। তখন ওই জায়গার নাম ছিল রেঙ্কিং স্ট্রিট। নানাবাড়ির পাশেই ছিল মস্ত বড় এক মন্দির। পালা পার্বনে সেই কাঁসার ধ্বনির শব্দে জায়গাটা সব সময় মুখরিত হয়ে থাকতো। অদূরেই ছিল গ্রাজুয়েট হাই স্কুল, সেই স্কুল প্রাঙ্গনে রাতে হতো ইন্টারমিডিয়েট নাইট কলেজ। বলদা গার্ডেনের কথা তো না বলার নয়। মামা-মামীরা মারা যাবার পর এবং সেখানে কেও না থাকাতে ওয়ারির সে বাড়িতে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। সেই কতকাল হয়ে গেছে। দুবাই এয়ারপোর্টে বসে ডাক্তার চৌধুরী ভাবলেন, একদিন সময় বুঝে কলিদের বাসায় বেড়াতে যাবেন। দু’কাজ এক সাথে হয়ে যাবে। কলিদের পরিবারের সাথে পরিচয় হয়ে যাবে আর সেই সাথে নিজের ছেলেবেলার জায়গাগুলি ঘুরে ফিরে দেখে আসতে পারবেন।

ডাক্তার চৌধুরী ঢাকা পৌঁছনোর পর কলিদের কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলেন। একাকিত্ব জীবন হলেও হাসপাতালের ব্যাস্ততার জন্য সময়গুলি বাতাসের মতো বয়ে যাচ্ছিলো। অবসর সময়ে হতাশায় মন ভেঙ্গে থাকে। মনে হয় হঠাত করেই জীবনটা ফুরিয়ে এলো। এই বৃদ্ধ বয়সে কখনো কখনো মনে হয়, জীবনের এই চলার পথে কোথাও কোনো ভুল করেননি তো? ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজনকে কোথায় ছিটকে পড়েছে। কেউ চলে গিয়েছে ইংল্যান্ডে, কেউ বা কানাডা, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ায় চিরস্থায়ী বাসস্থান করে নিয়েছে। কারো সাথে কখনও সখনো চিঠিপত্র কিংবা ফোনে আলাপ হয়, আবার কারো সাথে কোনো সম্পর্কই নেই। সময়ের স্রোতে ধীরে ধীরে সবকিছু মুছে যাচ্ছে। হয়তো একসময়ে কারোর আর কোনো খোঁজেই থাকবে না। এরকম কিছু ভাবতে ভাবতে কয়েক মাস পর একদিন কলিদের বাসায় ফোন করলেন। সেদিন কলির বাবাই ফোনটা ধরলেন। অসুস্থ কলির বাবাকে নিজের পরিচয় জানাতেই ডাক্তার চৌধুরীকে তিনি চিনতে পারলেন। কলির বাবা অতি অমায়িক স্বরে বললেন, “কি সৌভাগ্য আমার, কলির কাছে আপনার কথা অনেক শুনেছি। গরীবের বাসায় একদিন এলে নিজেদের ধন্য মনে করবো।”

— “সে জন্যেই তো ফোন করা”। ডাক্তার চৌধুরী হেসে জানালেন, “ওয়ারীতে আমার ছেলেবেলার অনেক সুখ – স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আমার ঠাকুরদার বাড়ি ছিল সেই বলদা গার্ডেনের পাশেই, তা বছর ৪০/৫০ তো হবেই।”
– “তা হলে আর দেরি কেন? চলে আসুন একদিন, চুটিয়ে আড্ডা দেয়া যাবে”। কলির বাবার সাদর আমন্ত্রণ।
যেদিন ডাক্তার চৌধুরী কলিদের বাসায় গেলেন, সেদিন সবাই বাসায় ছিল। ভদ্রলোকের স্ট্রোক হওয়ার ফলে উনার ডান হাতটা একেবারে অবশ হয়ে গেছে, অনেক কষ্টে কথা বলেন। কলির মা নিকটেই একটা প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। স্বামীর পরিচর্যার জন্য সেটা ছেড়ে দিতে হয়েছে। কলি অনার্স পাস্ করে এম, এ পড়তে চেয়েছিলো, তা আর হলো না। সংসারে হাল ধরতে বাধ্য হলো।

এক ভাই অজয়, বিজ্ঞান বিভাগে এইচ,এসসি পড়ছে, অন্য ভাই অমর, ক্লাস এইটে পড়ছে। ছাত্র হিসাবে অজয় ব্রিলিয়ান্ট। অজয় চাই ডাক্তার হতে, কলিরও তাই ইচ্ছে। ভাইটা ডাক্তার হতে পারলে তাদের সংসারের অভাবটা মোচন হতে পারবে। হাসতে হাসতে অজয় ডাক্তার চৌধুরীকে প্রশ্ন করলো, “কাকু, ডাক্তারি পাশ করার পর আপনাদের ক্লিনিকে চাকরি পাবো তো?” অজয়ের মা ছেলেকে ধমকিয়ে বললেন, “আগে পাশ কর, পরে ও কথা ভাবিস।”, তার পর মেয়ে কলির দিকে তাকিয়ে একটু ক্ষোভের সাথে বললেন “আমার এই পুতুলের মতো মেয়েটি খাটতে খাটতে কি অবস্থা হয়ে গেছে, ভগবান যেন ওকে সুস্থ রাখেন”। হঠাত করে সবাইকে চমকে দিয়ে ডাক্তার চৌধুরী বললেন, “কলির মতো এমন একজন ভালো মেয়ে অনেক কম মেলে, কলি শুধু আপনাদের মেয়ে নয়, কলি আমারও মেয়ে”। ঘরের সবাই ডাক্তার চৌধুরীর কথাগুলি শুনে খুশির আনন্দে হতবাক। অনেক দিন পর দাস-গুপ্ত পরিবারটির মাঝে ভুলে যাওয়া হাসির বন্যা আবার যেন ফিরে এলো।

তারপরের ঘটনা অতি সংক্ষিপ্ত। কয়েক মাস পরে কলি একদিন ডাক্তার চৌধুরীকে ফোন করে জানালো, “কাকু, আপনার ডাক্তারী পরামর্শ দরকার। বেশ কিছুদিন ধরে আমার পেটে সময়ে-অসময়ে ব্যথা হচ্ছে। প্রথমে ভাবছিলাম হয়তো দেশ বিদেশে নানা হোটেলে খাওয়া দাওয়া এবং তার সাথে সময় মতো না খাওয়ার জন্য ব্যথাটা হচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ হয়ে গেলো কিন্তু কোনো উন্নতি তো হচ্ছে না বরং পেটের ব্যথাটা বেড়েই চলছে। তাই আপনাকে না জানিয়ে পারলাম না”।
“তুমি আমাকে জানিয়ে ভালোই করেছো অতি সত্তর আমাদের ক্লিনিকে চলে এস”, কথাগুলি বলে ডাক্তার চৌধুরী একটু চিন্তায় পরে গেলেন। তারপর বললেন “কলি টাকা পয়সার জন্য কোনো চিন্তা করো না, তোমাকে মেয়ে হিসাবে যখন গ্রহণ করেছি, তখন আমাকে পিতার কর্তব্য করতে দাও”।

পরের দিনই কলি ডাক্তার চৌধুরীর ক্লিনিকে হাজির। টেস্ট করা হলো, পরে কোলোনস্কোপি করা হলো। ধরা পরলো প্রাইমারি স্টেজের ক্যান্সার। খবরটা শুনে কলি তো একেবারে দিশেহারা। ব্যাপারটা বাড়ির লোকদের কি ভাবে জানাবে আর সেটা তারা কিভাবে নেবেন, সে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। ডাক্তার চৌধুরী অবস্থাটা বুঝতে পেরে কলিকে আস্বস্ত করার জন্য বললেন “ঘাবড়িও না, প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়েছে, সু চিকিত্সা হলে তুমি সম্পূর্ণ সেরে যাবে, এখন মেডিক্যাল সাইন্স অনেক উন্নত হয়েছে”।
“চিন্তা কে করতে চায় কাকু, চিন্তা তো এমনিতেই এসে পরে”। কলির কথায় অজানা আশঙ্কা।

“তা বটে, তবু হাল ছেড়ে তো দিতে পারি না, এ ব্যাধির সাথে আমরা সবাই মিলে যুদ্ধ করে যাবো।” ডাক্তার চৌধুরী দৃঢ়তার সাথে বলে গেলেন। “বাড়ীতে কি বলবো?” কলি জানতে চাইলো ডাক্তার চৌধুরীর কাছ থেকে। “যা সত্যি, তাই বলবে, বলবে কাকু নিজে সার্জারি করবে, আর আগেই তো বলেছি, টাকা পয়সার জন্য কোনো চিন্তা কখনো মাথায় আনবে না”।
কঠিন ক্যান্সার ব্যাধির চিকিত্সা শুরু হলো। প্রথমে অপারেশন হলো, তারপর কেমোথেরাপি আর একনাগাড়ে ওষুধের পর ওষুধ কলিকে গিলতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে কলি এয়ার হোস্টেসের কাজ ছেড়ে একই কোম্পানীতে গ্রাউন্ড লেবেলে প্রশাসনিক কাজ নিয়েছে। কোম্পানীও কলির প্রতি অনেক সহানুভূতিশীল।
ছয় মাস পর পর কলির চেক-আপ চলছে এবং প্রত্যেক পর্বেই ওর স্বাস্থ্যের উন্নতী দেখা যাচ্ছে। এভাবে কয়েক বছর কেটে গেলো।

অজয় ভালো রেজাল্ট করে ডাক্তারী পড়ছে, আর অমর ইন্টারমিডিয়েট পড়ছে। আজ কলির ফাইনাল রিপোর্ট এসেছে। সে সম্পূর্ণ রোগমুক্ত। রিপোর্ট দেখে ক্লিনিকের সবাই মহাখুশী। এই খুশির সংবাদটি ডাক্তার চৌধুরী ফোনে কলিদের বাসায় জানাতে চাইলেন। কলি আবদার করে বললো, “কাকু, আপনি ফোন করবেন না, আমি তাদেরকে বিগ সারপ্রাইস দেব। আমি নিজে এই সুখবরটি জানাতে চাচ্ছি”। “ঠিক আছে, তোমার কথার আমি পয়েন্ট দেখতে পাচ্ছি।” হাসি মুখে ডাক্তার চৌধুরী বললেন।

পথে একটা ফুলের দোকান থেকে কলি এক গুচ্ছ রজনীগন্ধা ফুল কিনে নিলো। তার বাবার অতি প্রিয় ফুল। বাবা সুস্থ থাকার সময় অফিস থেকে ফেরার পথে মার্জন্য প্রায়ই এই ফুল নিয়ে আসতেন। কলি ভাবছে আজ অনেক দিন পর এই রজনীগন্ধা ফুল বাবাকে উপহার দিয়ে তার এই সুখবটা জানাবে। কলির এও মনে হলো অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তার অতি প্রিয় ঢাকা শহরটাকে অনেকদিন মনের মতো করে দেখেনি। আজ দেখছে তার ঢাকা শহর কত সুন্দর। খুশির আবেগে মন হারিয়ে যেতে চাইছে। একটা সি এন জির জন্য অপেক্ষা করছে, আর সে মুহূর্তেই হঠাত করে পেছন থেকে একটা ট্রাক ধাক্কা দিলো তাকে। কলি ধপাস করে পড়ে গেলো রাস্তার উপর। তার হাত থেকে রজনীগন্ধার গোছাটি উড়ে গিয়ে রাস্তার ইলেকট্রিক তারগুলির উপর ঝুলতে থাকলো। পথচারীরা কলির রক্তাক্তমাখা দেহখানি ধরা ধরি করে নিকটেই ডাক্তার চৌধুরীর ক্লিনিকে নিয়ে আসলো। কলির এই অবস্থা দেখে ডাক্তার চৌধুরী বাকহারা। তার হাতেই কলির দেহখানি নিথর হয়ে পড়লো। ডাক্তার হিসেবে তিনি মানুষের অনেক মৃত্যু দেখেছেন, কিন্তু আজ তার বুক ফেটে যাচ্ছে, তিনি যে তার মেয়েকে হারালেন।

ডাক্তার চৌধুরীর দুঃখটা এখানেই, মহাব্যাধি ক্যান্সার থেকে তিনি কলিকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু আজ একজন তথাকথিত মানুষ বলে পরিচয় দিয়ে বেপরোয়া গাড়ি চালনার কারণে অকালে ঝরে পড়লো একটা মানব জীবন। সেই সাথে গোটা একটা পরিবারকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হলো। তিনি নিজেই যখন কলিকে হারিয়ে এতো কষ্ট পাচ্ছেন, তখন একমাত্র উপার্জনশীল মেয়ে হারানোর এই ব্যথা দাস-গুপ্তা পরিবার কি সইতে পারবেন? শেষ
লেখক : কামাল কাদের (নিউবারি পার্ক, ইলফোর্ড, ইংল্যান্ড)
email : quadersheikh@gmail.com