ইব্রাহীম চৌধুরী, নিউইয়র্ক : করোনাভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রে লাখো মানুষের মৃত্যু ঘিরে খোঁজা হচ্ছে নানা প্রশ্নের উত্তর। সংক্রমণ ছড়ানোর দেড় মাসে ২০ হাজার মানুষ মারা গেছে নিউইয়র্কে। কিন্তু বিবর্ণ নিউইয়র্ক আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। সহনীয় হয়ে এসেছে সংক্রমণ। দিনে মৃত্যুর সংখ্যা হাজারের কাছাকাছি থেকে নেমে এসেছে দুই সংখ্যাতে। করোনার এই মহামারি থেকে রক্ষা পেতে অপেক্ষা বাড়লেও আশার আলো দেখছে নিউইয়র্কবাসী।

গত ১ মার্চ নিউইয়র্কে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঘটনা সামনে আসে। নিউইয়র্কে এ নিয়ে প্রথম সংবাদ সম্মেলন করেন রাজ্যের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো। রাজ্যে করোনায় প্রথম মৃত্যুর ঘটনা সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয় ১৪ মার্চ। ম্যানহাটানের ৮২ বছর বয়সী এক নারী করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মারা যান। এরপর সময় দ্রুত বদলে যেতে থাকে। দিনে দিনে পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে ওঠে। নিউইয়র্ক রাজ্যের গভর্নর ও নগরীর মেয়রের কণ্ঠে অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে।

২৫ মার্চ থেকে নিউইয়র্ক শহরে মৃত্যুর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। ৮ এপ্রিল এক দিনে মৃত্যু হয় ৭৯৯ জনের। তবে মাত্র তিন সপ্তাহের মাথায় ১৩ এপ্রিল থেকে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা কমতে থাকে নাটকীয়ভাবে। ৮ মে পর্যন্ত নিউইয়র্কে করোনাভাইরাসে ২০ হাজারের বেশি লোক মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়। ওই সময় নিউইয়র্ক নগরীতেই করোনায় সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭৪ হাজারে। ৪ মে দুপুরে আগের ২৪ ঘণ্টায় ২৯৯ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানানো হয়। হাসপাতালের বাইরে মৃত্যুসংখ্যা যোগ করে ৫ মে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৯৫২। এরপর থেকেই দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা কমতে থাকে। ৮ জুন মৃত্যুর সংখ্যা ৫০–এর নিচে নেমে আসে।

২০ মার্চ থেকে শুরু হওয়া নিউইয়র্কের লকডাউন প্রথম ধাপে খুলে দেওয়া হয় ৮ জুন। এদিন নিউইয়র্কে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৪৯। গতকাল ১৪ জুন রোববার নিউইয়র্কে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২৪ ঘণ্টায় মারা যায় ২৩ জন। এটাই এখনকার স্বাভাবিক মৃত্যুর সংখ্যা বলে মনে করেন স্বাস্থ্যসেবী থেকে শুরু করে সবাই। করোনাভাইরাস নির্মূল না হওয়া বা প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত এ রকম স্বাভাবিকতা নিয়েই চলতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন রাজ্যের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো।

মৃত্যু আর সংক্রমণের ভয়াবহতা থেকে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াল নিউইয়র্ক? এ নিয়ে কথা হয় এলমাহার্স্ট হাসপাতালের সংক্রামক রোগবিষয়ক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অমর আশরাফের সঙ্গে। তিনি বলেন, মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে তাঁদের হাসপাতালে দিনে তিন থেকে চার শ লোক জরুরি বিভাগে এসেছেন। হাসপাতালে আসা এসব রোগীর অধিকাংশের অবস্থা সংকটাপন্ন ছিল। কেউ কেউ সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরতে পারলেও অনেকেই ফিরতে পারেননি। কিন্তু ওই দুঃসময় পার হয়েছে। মাত্র দেড় মাসের মাথায় এখন দিনে মাত্র একজন হাসপাতালে আসছেন সংক্রমণ নিয়ে। অমর আশরাফ মনে করেন, এর পেছনে দুটি প্রধান কারণ রয়েছে। একটি হচ্ছে নগরী লকডাউনের ফলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। অন্য কারণটি হচ্ছে নিউইয়র্কের বেশির ভাগ মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে।

নগরীর জ্যাকসন হাইটসে চিকিৎসাসেবা দেওয়া অমর আশরাফ বলেন, তিনি অভিবাসীসহ সব ধরনের রোগী দেখেন নিয়মিত। নিজের রোগীদের মধ্যে পরীক্ষা করে দেখেছেন, প্রায় ৮০ শতাংশেরই শরীরে অ্যান্টিবডি পাওয়া যাচ্ছে। এসব লোকজন নিজের অজান্তেই আক্রান্ত হয়েছেন। কোনো উপসর্গ ছাড়াই বা সহনীয় উপসর্গের পর সেরে উঠেছেন তাঁরা। শরীরে করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়া এসব লোকজন আর নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে না বলে তিনি মনে করেন।

ভাইরাসটি তার রূপ পরিবর্তন করছে বলেও মনে করেন অমর আশরাফ। ইতালির একটি গবেষণার সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের তীব্রতা কমেছে। ভাইরাসটি পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তবে সংক্রমণ কমেনি। সংক্রমণের তীব্রতা কমেছে ভাইরাসের পরিবর্তনের কারণেই। নিউইয়র্কে এখন ভাইরাসটি তৃতীয় ধাপে রূপান্তর হয়েছে। এ ছাড়া অন্য কারণের মধ্যে রয়েছে, তা রোগীর জিনগত বৈশিষ্ট্যও থাকতে পারে। ভিন্ন রক্তের গ্রুপের লোকজনের ওপর এ ভাইরাসের আক্রমণের তীব্রতার ভিন্নতা রয়েছে।

ইংল্যান্ড ও নিউইয়র্কের আবহাওয়ার পার্থক্য ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান তুলে ধরে অমর আশরাফ বলেন, ইংল্যান্ডে সবচেয়ে বেশি দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীর মৃত্যু হয়েছে করোনাভাইরাসের কারণে। তবে নিউইয়র্কে তা হয়নি। এর কারণ হিসেবে আবহাওয়া এবং মানুষের শরীরে ভিটামিন ডির অপ্রতুলতাকে দেখা হচ্ছে। শরীরে ভিটামিন ডি স্বল্পতা আছে এমন লোকজনকে করোনাভাইরাস সহজেই কাবু করেছে। রোদেলা ও উষ্ণ আবহাওয়ার সঙ্গে এ ভাইরাসে আক্রমণের তীব্রতার সম্পর্ক রয়েছে। তবে নিউইয়র্কে আগের মতো আর ভয়ংকর হবে না করোনাভাইরাসটি। কারণ বেশির ভাগ লোকজনের মধ্যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে আছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য নগরীতে করোনাভাইরাস আবার ফিরে আসতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

ফিলাডেলফিয়ার ড্রেক্সেল ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক জিয়াউদ্দিন গত তিন মাস করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের নিয়ে নানা কাজ করছেন। তিনিও মনে করেন, নিউইয়র্কে ভাইরাসের ধরন পরিবর্তিত হয়েছে। যদিও এ ভাইরাসের সংক্রমণ বাংলাদেশে এখন ভিন্নভাবে হচ্ছে বলে তাঁর ধারণা।

জিয়াউদ্দিন বলেন, নিউইয়র্কে লোকজনের মধ্যে এখনো সংক্রমণ হচ্ছে। তবে লকডাউন ও ব্যক্তিগত সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে তা কম হচ্ছে। এ কৃতিত্ব সরকার ও জনগণের। তবে অন্যদের ক্ষেত্রে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু বন্ধের কৌশল নিউইয়র্কের থেকে ভিন্ন হতে হবে।