মাসুদ আলম, যশোর : মোড়ের নাম ফুল মোড়। তিন দিক দিয়ে তিনটি রাস্তা এসে এই মোড়ে মিশেছে। রাস্তার পাশে একটি ফুল বিক্রির দোকান। নাম গ্রিন ভয়েস। দোকানে থরে থরে সাজানো রয়েছে নানান জাতের নজরকাড়া সতেজ ফুল। কিন্তু কোনো ক্রেতা নেই। এই দোকানের মালিকের নাম জালাল উদ্দীন। তাঁর এই দোকান যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা গ্রামের ফুল মোড়ে। তিনি বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির কারণে একদম বেচাকেনা নেই। প্রতিদিন দোকান খুলে বসে থাকি। যদি কিছু হয়। আগে দিনে দুই থেকে তিন হাজার টাকা বেচাকেনা হতো। এখন কোনো দিন ১০০ টাকা হয়, কোনো দিন একেবারেই হয় না।’
জালাল উদ্দীনের পাশের দোকানটির নাম আশিক সাকিব ফুল ঘর। দুটি টেবিলের ওপর বালতিতে সাজানো রয়েছে নানা ধরনের ফুল। মাটিতে দুটি বালতিতে রয়েছে ঝাউয়ের চারা। কিছুটা ওপরে দুই বাঁশের খুঁটিতে একটি দড়ি টানানো হয়েছে। দড়িতে ঝুলছে ফুল দিয়ে তৈরি দুটি রিং। তার ওপরে ঝুলছে একটি লালসালু। দোকানের দুই দিক খোলা। পেছনের দিকে বেঞ্চে বসে ছিলেন দোকানি তারেক রহমান (৩৯)। সম্প্রতি সরেজমিনে ফুলের বেচাকেনা কেমন হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোনো বেচাকেনা নেই। সৌন্দর্য উপভোগ করতে মানুষ ফুল কেনে। করোনার কারণে মানুষের মনে কোনো শান্তি নেই। তাই ফুলের বেচাকেনাও নেই। আগে দিনে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকার ফুল বিক্রি হতো। বিশেষ দিনগুলোতে এক লাখ টাকা পর্যন্ত ফুল বিক্রি করেছি। এখন কোনো দিন ৩০০ টাকা, কোনো দিন ৫০০ টাকা আবার কোনো দিন ৭০০ টাকার ফুল বিক্রি হয়।’
রাস্তার ওপারে আরেকটি ফুলের দোকান। জামাল ফুল স্টোর। দুটি টেবিলের ওপর চারটি বালতির মধ্যে সাজিয়ে রাখা হয়েছে কয়েক ধরনের ফুল। ওপরের দিকে দড়ি টানানো রয়েছে। পেছনের দিকে বেঞ্চে বসে আছেন দোকানি জামাল উদ্দীন। বেচাকেনার বিষয় তুলতেই বলেন, ‘কিছু ফুল কিনে সাজিয়ে বসে আছি। বিক্রি হচ্ছে না। আড়াই বিঘা জমিতে ফুলগাছ এবং সাড়ে পাঁচ বিঘা জমিতে ফুলের নার্সারি করেছি। ওই জমিতে আটজন শ্রমিক কাজ করতেন। বছরে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকার চারা ও ফুল বিক্রি হতো। কিন্তু করোনা শুরুর পর থেকে কোনো কেনাবেচা নেই। আম্পানে প্রায় দেড় বিঘা জমির ফুল গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন কোনোভাবে টিপটিপ করে চলছি।’
স্থানীয় কয়েকজন বলেন, পানিসারা গ্রামের ফুল মোড়ে বিশেষ দিবস সামনে রেখে ১৫-১৬টি দোকান বসে। ১০ বছর ধরে দোকানগুলো বসছে। বিভিন্ন দিবসের আগে ফুলের দোকানগুলোতে মানুষের ঢল নামে। করোনা পরিস্থিতির কারণে ফুলের দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন এখানে দোকান আছে মাত্র চারটি। এগুলোতেও বেচাকেনা নেই বললেই চলে।
ফুল ছেড়ে অন্য ফসল চাষ
ফুল বিক্রি কমে যাওয়ায় অনেক কৃষক তাঁদের জমিতে ফুলের বদলে ধান, পাটসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করছেন। আগে ফুল চাষ করে মাসে কয়েক লাখ টাকা আয় করতেন নিসারা গ্রামের ফুলচাষি মহিদুল ইসলাম। এখন আয় একেবারেই শূন্য। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘চার বিঘা জমিতে রজনীগন্ধা ছিল। লিজ নিয়ে ফুল চাষ করেছি। বিঘাপ্রতি প্রায় তিন লাখ টাকার ফুল বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু করোনার কারণে বিক্রি না হওয়ায় খেতে ফুল নষ্ট হচ্ছিল। এর মধ্যে আম্পানে ব্যাপক ক্ষতি হয় ফুলখেতের। কোনো উপায় বের না করতে পেরে এক বিঘা জমি আমন ধান চাষের জন্য প্রস্তুত করেছি।’
একইভাবে পানিসারা গ্রামের ফুলচাষি ও ব্যবসায়ী জালাল উদ্দীন এবার ফুলের বদলে তাঁর এক বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এক বিঘা জমিতে গাঁদা ফুলের চাষ ছিল। এখান সেই জমিতে পাট বুনেছি। দুই ছেলে কলেজে পড়ছে। তাদের লেখাপড়ার জন্য বেশ খরচ হচ্ছে। সব জিনিসের দাম বেশি। সংসারে খরচ বেড়েছে। সব মিলিয়ে খুবই করুণ অবস্থা।’
করোনার মধ্যে আম্পানের ছোবল
আড়াই বিঘা জমিতে জারবেরা এবং দুই বিঘা জমিতে চায়না গোলাপের চাষ করেছেন দীন মোহাম্মদ (৬১)। এ জন্য তিনি পলিথিন দিয়ে পাঁচটি পলিশেড নির্মাণ করেছিলেন। ঘূর্ণিঝড় আম্পানে তাঁর পাঁচটি শেডই লন্ডভন্ড হয়ে যায়। ৫০ হাজার টাকা খরচ করে তিনি দুটি শেড মেরামত করেছেন। ছেলে শাহ আলমকে (৩৫) নিয়ে তিনি খেত পরিচর্যা করছিলেন। তিনি বলেন, ‘থাই পলিথিন দিয়ে পলিশেড নির্মাণ করতে হয়। এক বিঘা জমির একটি পলিশেড নির্মাণ করতে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা লাগে। আর টিন দিয়ে শেড নির্মাণ করতে লাগে ২০ লাখ টাকা। করোনার আগে মাসে এক লাখ থেকে শুরু করে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ফুল বিক্রি করতাম। করোনার কারণে গত চার মাসে এক টাকার ফুলও বিক্রি করতে পারিনি। এর মধ্যে ঝড়ে শেডগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে আড়াই লাখ টাকা ধার করে চলছি। কখনো কারও কাছে টাকার জন্য হাত পাতিনি। এবার তা-ই করতে হয়েছে।’
ইমামুল হোসেন ও সাজেদা বেগম দম্পতি ২৫ বছর ধরে ফুলের চাষ করছেন। বর্তমানে তিন বিঘা জমি ইজারা নিয়ে তাঁরা ফুলের চাষ করেছেন। ঝড়ে তাঁদের একটি শেড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁদের ছোট সংসার। মেয়ে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে এবং ছেলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ফুল বিক্রি কমে যাওয়ায় সংসার এবং ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার ব্যয় মেটাতে তাঁদের রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠেছে। তার ওপর রয়েছে ব্যাংক ও এনজিওর ঋণের কিস্তির চাপ।
সাজেদা বেগম বলেন, ‘ব্যাংক থেকে চার লাখ এবং একটি এনজিও থেকে তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ফুল চাষ করেছি। গত চার মাসে এক টাকার ফুলও বিক্রি করতে পারিনি। ঝড়ে অনেক ক্ষতি হয়েছে। ঋণের কিস্তির জন্য ব্যাংক ও এনজিওর লোকজন প্রতিনিয়ত বাড়িতে আসছেন। কিন্তু ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছি না। কী খাব আর কী দিয়ে ঋণ শোধ করব, ভাবতেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হয়েছে।’ সাজেদার স্বামী ইমামুল হোসেন বলেন, ‘এমন খারাপ অবস্থা আমার জীবনে আর আসেনি। আমার একটি টিনের শেড ছিল। প্রতিটি টিন ১ হাজার ৫০ টাকা করে কিনে শেডটি তৈরি করেছিলাম। ঝড়ে শেডটি ভেঙে গেছে। এখন প্রতিটি টিন ২০০ টাকা করে বিক্রি করেছি। টিন বিক্রির টাকা দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।’
সাড়ে পাঁচ বিঘা জমিতে ফুল এবং দেড় বিঘা জমিতে নার্সারি আছে আজিজুর সরদারের (৪২)। বিঘাপ্রতি বছরে ২০ হাজার টাকা করে বন্ধকি নিয়ে তিনি ফুল চাষ ও নার্সারি করেছেন। ছয়জন শ্রমিক কাজ করতেন তাঁর খেতে। মাসে ১ লাখ ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত তাঁর ফুল ও চারা বিক্রি হতো। গত চার মাসে তিনি ফুল ও চারা বিক্রি করেছেন মাত্র ৯৫০ টাকার। ঘূর্ণিঝড় আম্পানে তাঁর দেড় বিঘা জমির জারবেরা ও চায়না গোলাপের দুটি পলিশেড উড়ে গেছে। পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে তিনি শেড ঠিক করেছেন। সব শ্রমিককে অব্যাহতি দিয়েছেন। স্ত্রী তপুরা বেগম (৩৭) এবং সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে আরিফ হোসেনকে (১৩) নিয়ে তিনি এখন খেত পরিচর্যার কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকে ১৩ লাখ টাকা এবং দুটি এনজিওতে সাত লাখ টাকার ঋণ রয়েছে। গত চার মাসে এক টাকাও ঋণের কিস্তি দিতে পারিনি। ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য ব্যাংক ও এনজিও থেকে চাপ দিচ্ছে। কী করব বুঝতে পারছি না। সার ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ বাকিতে কিনেছিলাম। এখন সেসব দোকানে হালখাতা চলছে। উপায় না দেখে গ্রাম্য একটি সমিতি থেকে বেশি সুদে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে হালখাতা করছি। ঝড়ে ভেঙে পড়া শেডের ৩০০টি টিন ২০০ টাকা করে ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। এই টাকা দিয়ে কোনোরকমে সংসারের খরচ চালাচ্ছি।’ কোনো সহায়তা পেয়েছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত সাত কেজি চাল এবং এক কেজি আলু পেয়েছি।’
কেমন আছেন জানতে চাইলে আজিজুর সরদারের স্ত্রী তপুরা বেগম বলেন, ‘একদম ভালো নেই। খুব দুশ্চিন্তা হয়। রাতে ভালো ঘুম হয় না। আগে খেত থেকে ফুল তুলে বাড়িতে আনা হতো। আমরা সবাই মিলে বাছাই করতাম। এরপর বাঁশের তৈরি ঝুড়িতে সাজিয়ে ফুল বাজারে নেওয়া হতো। এখন খেতে ফুল নেই। বাড়িতেও আর ফুল আসে না।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, লোহা ও বাঁশের কাঠামোর ওপর সাদা পলিথিন দিয়ে তৈরি করা হয়েছে পলিশেড। আবার টিনের ছাউনি দিয়েও শেড তৈরি করা হয়েছে। এসব পলিশেডের মধ্যে চাষ হয় জারবেরা ও চায়না গোলাপ। সবচেয়ে বেশি চাহিদা জারবেরার।
ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন বলেন, যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের প্রায় ৬২৫ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ হচ্ছে। ফুল চাষের সঙ্গে এখানকার ৭ থেকে ১০ হাজার কৃষক এবং প্রায় ১ লাখ শ্রমিক সম্পৃক্ত রয়েছেন। এবার ২৭২ হেক্টর জমিতে গ্লাডিওলাস, ১৬৫ হেক্টর জমিতে রজনীগন্ধা, ১০৫ হেক্টর জমিতে গোলাপ, ৫৫ হেক্টর জমিতে গাঁদা, ২২ হেক্টর জমিতে জারবেরা এবং ৬ হেক্টর জমিতে অন্যান্য ফুলের চাষ করা হচ্ছে।
১৯৮২ সালে ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা এলাকায় ফুলের চাষ শুরু করেন শের আলী সরদার নামের এক কৃষক৷ দেশে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষের পথিকৃৎ বলা যায় তাঁকে। তাঁর সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে পানিসারা, গদখালী এলাকায় ৭৫টি গ্রামের প্রায় ১০ হাজার চাষি ঝুঁকেছেন ফুল চাষে। নানান জাতের দেশি-বিদেশি ফুলের চাষ হয় এসব এলাকায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রজনীগন্ধা, গোলাপ, চায়না গোলাপ, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জারবেরা, রথস্টিক, জিপসি, গ্যালেনডোলা, চন্দ্রমল্লিকা ইত্যাদি। প্রায় চার দশক আগে ফুল চাষের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তার এখন বিস্তার ঘটেছে পুরো অঞ্চলে। এখন আসছে নিত্যনতুন জাতের ফুল।
এই এলাকায় ফুল চাষ শুরু হওয়ার গল্পটাও চিত্তাকর্ষক। তাই এই গল্প শোনার জন্য ছুটে গেলাম এই এলাকার ফুল চাষের পথিকৃৎ শের আলী সরদারের (৭১) কাছে। অনেক কষ্টে তাঁর দেখা মেলে। গল্পটা শুনুন তাঁর মুখেই, ‘১৯৮২ সালে এক বিঘা জমিতে রজনীগন্ধা দিয়ে শুরু করেছিলাম। আমার বাবার নার্সারি ছিল। একদিন আমি সেখানে বসে ছিলাম। ভারত থেকে আসা নূর ইসলাম নামের এক লোক নার্সারির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর হাতে রজনীগন্ধা। লাল রঙের গামছা দিয়ে ফুলের স্টিকগুলো পেঁচিয়ে কোলে করে তিনি হেঁটে যাচ্ছিলেন। নূর ইসলাম জানান, এই ফুল পশ্চিমবঙ্গে অনেক হয়। তো আমি ভাবলাম, পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের মাটি তো এক। এরপর নূর ইসলামকে দিয়ে আমি ভারত থেকে দুই মণ রজনীগন্ধার বীজ আনালাম। এক বিঘা জমিতে সে বীজ লাগালাম। রজনীগন্ধা দিয়ে সেই শুরু ফুল চাষ।’
ফুল বিক্রিতে ধস নামায় শের আলীও উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে মার্চ মাস থেকে ফুলের বেচাকেনা বন্ধ। ফুলচাষিরা চলতে পারছিলেন না। এর মধ্যে মে মাসের ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবে ফুলের বাগান ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার নিজের এক বিঘা জমির জারবেরার পলিশেড উড়ে গেছে। ৪১ বছরের ফুল চাষের জীবনে এমন ঘটনা আমি আগে কখনো দেখিনি।’
যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী এলাকা। গদখালী এবং এর আশপাশের এলাকায় হাজার হাজার একর জমিতে বছরজুড়ে উৎপাদন হচ্ছে দেশি-বিদেশি নানা জাতের ফুল। এসব ফুল সারা দেশের চাহিদা মেটাচ্ছে। রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও। ফুল বিক্রির জন্য ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীতে যশোর রোডের দুই পাশে গড়ে তোলা হয়েছে ফুলের বাজার। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ফুলের বাজার গদখালী৷ যশোর শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার পশ্চিমে যশোর রোড নামে পরিচিত যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের পাশে গদখালী ফুলের বাজার। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকারেরা এখানে আসেন ফুল কিনতে। করোনাভাইরাসের কারণে গত ২৪ মার্চ থেকে গদখালী ফুলের বাজার বন্ধ রয়েছে৷
সারা বছরই কমবেশি ফুল বিক্রি হয়। কিন্তু ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে ফুলের ভরা মৌসুম৷ এই সময়ে, বিশেষ করে বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, পয়লা ফাল্গুন, বসন্ত দিবস, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, বাংলা নববর্ষ এবং দুই ঈদে ফুলের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়৷ এবার ফুল বেচাকেনার পরিস্থিতি জানতে চাইলে গদখালী বাজারের দোকানি উজ্জ্বল হোসেন মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। একটু দম নিয়ে তিনি বলেন, ‘আসলে এবার কোনো অবস্থাই নেই। আগে বাইরে থেকে লোক আসত ফুল কিনতে। অনেক ফুল বিক্রি হতো। এখন লোক আসে না। অল্প কিছু ফুল কিনে বিক্রির জন্য বসে থাকি। কিন্তু ফুল কেনার লোক নেই। এভাবে আর চলতে পারছি না।’
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, দেশে ফুলের বাজার বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার। দেশের চাহিদার ৮০ ভাগ ফুল যশোর থেকে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। করোনার কারণে গত চার মাস ফুল বিক্রির সুযোগ না থাকায় এবার ৪৫০ কোটি টাকার ফুল নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে শুধু যশোর অঞ্চলে অন্তত ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে৷ সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ফুলখেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। শত শত শেড ধ্বংস হয়েছে। বেচাকেনা বন্ধ থাকায় চাষিরা বাগান থেকে ফুল কেটে তা পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করছেন। ছাগল-গরু দিয়ে খাওয়ানো হচ্ছে ফুল। চাষিরা ফুল বিক্রি করতে পারছেন না। আবার খেতে ফুল রাখতেও পারছেন না। উভয়সংকটে পড়েছেন তাঁরা। এ অঞ্চলের ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীরা চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছেন।
ফুলচাষিদের সম্পর্কে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিলেন আবদুর রহিম। তিনি জানান, দেশের প্রায় ৩০ লাখ মানুষের জীবিকা এই ফুলকে কেন্দ্র করে। প্রায় ২০ হাজার চাষি ফুল চাষ করেন। এর মধ্যে কেবল যশোরেই প্রায় ১০ হাজার ফুলচাষি। ফুলচাষিদের প্রায় ৭০ ভাগ বর্গাচাষি। করোনাভাইরাস ও আম্পানে এই খাতে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে ৫০০ কোটি টাকার কৃষি প্রণোদনার ঋণ প্রয়োজন। ক্ষতিগ্রস্ত ফুলচাষি ও ফুল ব্যবসায়ীদের ফুল চাষের খরচ বিবেচনায় সহজ শর্তে কৃষি প্রণোদনার ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে হবে। আর সেটা দিতে না পারলে এই খাত বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে।